ভাবনাদেয়ালের পলেস্তারা: ১৩৯

ভাবনা: নয়-শো সাতষট্টি
………………………………………………………

এক। যারা ছবি শেয়ার করে না, তারা বা তাদের পরিবারের কেউ বিপদে এবং অসুখে পড়ে না, তা কিন্তু নয়। কষ্ট-লুকানো মানুষের কষ্টই সবচাইতে বেশি। না জেনেই আলতুফালতু মন্তব্য করে বসবেন না কাউকে নিয়ে। আপনার অনুমান হজম করার জন্য অসীম ধৈর্য নিয়ে কেউ বসে নেই। কিছু মানুষ পারলে আন্ডার‌ওয়্যারের কালারটাও ফেইসবুকে শেয়ার করে দিত! সবাই তো আর ওরকম নয়। যার জীবন, তার মতন। এ পৃথিবীতে ফেইসবুকের বাইরেই বেশি ঘটনা ঘটে। দুঃখ পাবলিসিটি করে না যারা, তাদেরকে পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষ ভেবে নিজের দুঃখ নিয়ে ঘ্যানর-ঘ্যানর করার জন্য ছুটে যাবেন না। কষ্ট সবার‌ই আছে। মানুষ নিজের দুঃখেই বাঁচে না, আপনার দুঃখের পাঁচালি শোনার সময় বা দরকার কোথায়? নিজের পথটা নিজেই পাড়ি দিন। আপনি তো আর আমার পথটা পাড়ি দিয়ে দিচ্ছেন না, তাই না?

খুবই বিরক্ত লাগে।

দুই। মানুষ মরে গেলে বেঁচে যায়, বেঁচে থাকলে পস্তায়।

তিন। মানুষ তিনটি ক্ষেত্রে মূর্খদের মনের মতন করে কথা বলে:

সে নিজেও মূর্খ হলে,
মূর্খদের কাজে লাগানোর জন্য,
মূর্খদের খেপিয়ে না তোলার জন্য।

চার। যা জন্মসূত্রে পাওয়া যায়, তা যোগ্যতা বা অর্জন নয়। তাই তার দোহাই দিয়ে কিছু প্রত্যাশা করাটা চরম নির্বুদ্ধিতা। যে ওভাবে প্রত্যাশা করে, সে অপদার্থ; আর যে ওরকম প্রত্যাশাকে প্রশ্রয় দেয়, সে অপদার্থদের সর্দার।

এই দেশে অবশ্য জন্মসূত্রে গায়ের জোর, গলার জোর, মনের জোর সব‌ই পাওয়া যায়।

পাঁচ। অশান্তির চেয়ে বিচ্ছেদ উত্তম।

ছয়। যেখানে বসে লেখায় ডুবতে পারি, সেখানেই আমার ঘর।

সাত। তাহলে শোনো, একটা কথা বলি। আমি এই পৃথিবীর কাউকেই আর আমার অভিভাবক মনে করি না, কাউকেই আর বিন্দুমাত্র ভয় পাই না; পৃথিবীর কোনো কিছু হারিয়ে গেলেও আমার ভেতর সেই ব্যক্তি বা বস্তুর জন্য কষ্ট হবে না। আমি হতে দেবো না, নিজেকে যে-কোনো পরিস্থিতিতে নিজেই সামলে নেব। কেই-বা আমার কথা ভাবছে, যার কথা আমি ভাবব? 

একটা জিনিস আমার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, ঈশ্বর ছাড়া আর কাউকেই ভরসা করব না। এই বিশ্বাসটুকু আছে, এই মুহূর্তে যদি এই বাসার দরজা আমার জন্য কোনো কারণে বন্ধ হয়ে যায়, ঈশ্বর আমার জন্য আরও দশটা দরজা খুলে দেবেন। আমার মাথার উপর ঈশ্বরের কৃপার ছায়া আছে, সুতরাং জীবনে যতই খারাপ পরিস্থিতি আসুক না কেন, কখনোই ঈশ্বর আমাকে একা ছেড়ে দেবেন না। কোনো একটা রাস্তা আমার জন্য খুলবেনই তিনি। আজ আমার ঘর ঘরের বাইরে।

এ কথাগুলো শুনে হাস্যকর লাগতেও পারে, কিন্তু আমি জানি, ঈশ্বরই আমার ভার নেবেন। ঈশ্বর আমার একমাত্র অভিভাবক। বাবা-মা কিংবা ভাই-বোন, তাদের সাথে যা-কিছু হবার হয়ে গেছে, তাদেরকে জোর করে আমি ভালোবাসতে পারব না, শ্রদ্ধাও করতে পারব না, আর সেটা অতটা গুরুত্বপূর্ণও না। রক্তের সম্পর্ক এক, মনের সম্পর্ক আরেক। পরিবারের অন্যান্য সব সদস্যের সাথে সর্বোচ্চ ভালো ব্যবহার করব, কিন্তু কখনোই তাদের প্রতি আগের সেই আবেগটা আর আসবে না। আর এতটুকুতেই আমি খুশি। ফালতু জায়গায় আবেগ খরচ করে অনেক দুঃখ পেয়েছি জীবনে; যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়!

মানুষ সামাজিক জীব। এই অজুহাতে সমাজ তাকে সমাজের নিয়মে চলতে বাধ্য করে। সমাজ নিজে একটি ব্যক্তিত্বহীন সত্তা এবং গায়ের জোরে তার সদস্যদের‌ও ওরকম করেই রাখে। সমাজের দুইটি জিনিসের বড়ো অভাব: কাজ আর লজ্জা। কী আর করা যাবে! অগত্যা সামাজিক অভিনয়ের মধ্য দিয়েই মানুষকে বাঁচতে হয়।

আট। কেউ মদ খায়;
কাউকে মদ খায়।

একান্তই হতে চাইলে, প্রথম দলের মানুষ হবার চেষ্টা করো। হতে না পারলে অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলবে জীবন থেকে। যে মানুষকে মদ-গাঁজা খাইয়ে কিনে নেওয়া যায়, তার জীবন সুন্দর হবার কথা নয়।

মদ জিনিসটা খেলে কেবল দুই ভাবে খাওয়াই ভালো: কিনে খাওয়া, কিংবা কিনে খাওয়ানোর সময় খাওয়া। বিনা পয়সায় মদ খাওয়ায় যে, সে সাধারণত বিনা স্বার্থে তা খাওয়ায় না। হয় পয়সা ফেলো, নয় সম্মান মেলো। মদ খেতে চাইলে কিছু-একটা খোয়াতেই হবে: হয় পয়সা, নয় সম্মান।

নয়। মানুষ আলোচনায় আসে দুই উপায়ে:

বিখ্যাত হবার কাজ করে,
বিখ্যাত লোকের পেছনে লেগে।

এখন পুরোটাই আপনার উপর নির্ভর করে যে, আপনি কোন উপায়ে ভাইরাল হবেন: ভাইরাস দূর করে, না কি নিজেই ভাইরাস হয়ে!

দশ। আমাদের গল্পটা অন্য রকম হলেও হতে পারত! আমার জীবনে সঠিক মানুষটি তুমিই যদি হতে, জীবনটা আরও সুন্দর মনে হতো, হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে হতো।

মাঝে মাঝে মনে হয়, তোমার কাছে যেতে পারাটা আমার সৌভাগ্য; আবার পরক্ষণেই মনে হয়, চাইলেই তোমার সাথে কেউ কেউ দেখা করতে পারে।

তোমার সাথে নিজের ইচ্ছেতে দেখা না করে থাকাই যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

আমার খুব ইচ্ছে, তুমি দুর্লভ হও। চাইলেই একটা মানুষ তোমাকে টেক্সট দিয়ে তোমার রিপ্লাই না পাক। তুমি তো বলতে, তুমি শুধু ভালোবাসা চাও; আমি প্রায়ই অনুভব করি, তুমি শুধু ভুল মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে যাও।

মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয়, তোমার সাথে একান্ত নিভৃতে সময় কাটাই, কিন্তু মনে জোর পাই না। আর কখনো সুযোগ হবে কি না জানি না তোমার সাথে দেখা করার।

আমি একা, কিন্তু অনেক ভালো আছি। আবারও বলছি, দুর্লভ হও। তোমার ভালোবাসার দরকার; অনেক ভালোবাসা যেন পাও, এই কামনা করি। ভালো থেকো।

এগারো। প্রতিদিন উঠতে-বসতে ভাতের খোঁটা শোনার চেয়ে কি অল্প আয়ের একজন মানুষকে বিয়ে করা ভালো, যে আমাকে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে ভালো রাখার চেষ্টা করবে?

যে তার সামর্থ্যের সবটা আমার পেছনে ঢেলে দিতে প্রস্তুত, এমন একজন মানুষের আয় যদি অন্যদের তুলনায় একটু কম‌ও হয়, তাহলে কি সেই মানুষটা জীবনসঙ্গী হিসেবে সঠিক?

যে-মানুষটা আমার অতীতের কিছুটা জানে; বর্তমানের সবটা দেখে এবং উপলব্ধি করেই কোনো চাহিদা ছাড়া আমাকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত, তার আয় একটু কম হলেও কি তাকে বিয়ে করা উচিত?

কিন্তু বিয়ের আগের মানুষ আর পরের মানুষটা কি একই মানুষ থাকে?

বিয়ের আগে সম্পর্কের প্রতি যে আন্তরিকতা থাকে, সেটা কি বিয়ের পরেও থাকে?

আমি প্রতিবার অনেক ধরনের চাপের ভেতর দিয়ে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও বিভিন্ন ভয়ের কারণে আবার পিছিয়ে যাই, ভেতর থেকে সেই শক্তি কিংবা ভরসা কোনোটাই পাই না, কিন্তু দিনদিন বাসার মানুষের আমার প্রতি আচরণগুলো এতটাই বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে যে, আমি কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না।

চাকরি পেতেও তো আমার সময় লাগবে; তাছাড়া বাসার বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে আমি পড়াশোনাটা ঠিকমতো করতেই পারি না, তার উপরে সারাক্ষণই আত্মীয়স্বজনদের এক-একজনের ফরমায়েশ পূরণ করতে করতে, এর-ওর প্রতি দায়িত্বপালন করতে করতে আমি ক্লান্ত; যদিও জানি, যাদের জন্য এত কিছু করছি, তাদের কেউই দিনশেষে আমার খোঁজও নেবে না এবং কৃতজ্ঞতাপ্রকাশ করা তো দূরের কথা, এমনকি স্বীকারও করবে না এসব।

এত বুঝেও আমি বিয়ে করতেই কেন জানি না ভীষণ ভয় পাই। এত বেশি কিছু সহ্য করেছি জীবনে যে, মনে হয়, এখন পর্যন্ত যা-কিছু সহ্য করেছি কিংবা রোজ করে যেতে হচ্ছে, সেটার যেন এই বাসা থেকে বের হবার পরে আর কখনও পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
আমি যে পরিস্থিতিতে আছি, এমন পরিস্থিতিতে যে-কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কঠিন। আমার মনে হচ্ছে, আমি চারপাশ থেকে আটকে আছি। এখান থেকে বের হবার কোনো রাস্তা আমি পাচ্ছি না। যদিও এখান থেকে বের হওয়াটা অনেক আগেই জরুরি হয়ে গেছে, তবুও দাঁত কামড়ে পড়ে আছি এই ভেবে যে, একটা কিছুতে ঢুকতে পারলেই চলে যাব; কিন্তু সেই একটা কিছুই হচ্ছে না।

এদিকে প্রতিবার এর-ওর বাসায় থেকে পরীক্ষা দিতে যাই; তাদেরও খুশি করতে এটা-ওটা করে চলতে হয়। আমি আসলে কী করব? কোনদিকে যাব? কোনটা করলে আমার পথটা এবার একটু ইজি হবে?


ভাবনা: নয়-শো আটষট্টি
………………………………………………………

এক। খেয়াল করে দেখলাম, স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা নিজের মতন করে দু-চারটা দিন‌ও বেঁচে থাকতেই ভুলে যাই।

ভালো রেজাল্ট করতে হবে, নামি ভার্সিটিতে পড়তে হবে, হাই-স্যালারির চাকরি ধরতে হবে। বাড়ি করতে হবে, গাড়ি কিনতে হবে। অমুক জায়গায় জমি, তমুক জায়গায় প্লট। সব হারানোর আয়োজন, অথচ তা শুরুতে চেনা দায়!

সবাই দৌড়োচ্ছি তো দৌড়োচ্ছিই।

আচ্ছা, একটা মানুষ যদি ২৪ ঘণ্টায় ১০ ঘণ্টাই চাকরির পেছনে খরচ করে দেয়, ৬ ঘণ্টা ঘুমে কাটিয়ে দেয়, মানুষ তবে নিজের জন্য বাঁচে ক-টা দিন? ওই দিনগুলিতেও কি ঠিকভাবে বাঁচতে পারে মানুষ?

এক দিনে ১০ ঘণ্টা অন্যের জন্য বিলিয়ে দিলে মাসে কত ঘণ্টা? বছরে? ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে দেখতেই মানুষের আয়ু ফুরিয়ে যায়।

একটা মানুষ ৬০ বছর বাঁচলে তার নিজের জন্য সে বাঁচে ক-টা দিন? ২৫ বছর‌ই সে বাঁচে অন্যের জন্য; বাকি ৩৫ বছরে ঘুম আছে, কতশত অহেতুক কাজেও তো সময় নষ্ট হয়। আজেবাজে লোকের পেছনে ফালতু খরচ-হ‌ওয়া সময়ের জন্য আফসোস করতেও তো কত সময় চলে যায়!

সবচেয়ে বড়ো কথা, সবাই কি আর ৬০ বছর বাঁচে আদৌ?

দুই। আমি মরে গেলে তুমি আমায় আকাশে খুঁজো না, মরার পর আমি কখনোই তারা হব না।
আমি মরে গেলে তুমি তোমার আঙুলগুলিকে বারবার ছুঁয়ে দেখো, নাহয় তোমার কিবোর্ডের কিগুলির দিকে তাকিয়ে থেকো। মন চায় তো তোমার হাতে যত বিষাদি কবিতা-গল্প-গান জন্মাবে, ওদের লাইনে লাইনে আমায় খুঁজো।

মরে গেলে আমি কখনোই তারা হব না, এটা নিশ্চিতভাবে জেনে রেখো। আমি তোমার চোখের এক ফোঁটা অশ্রু হব; নয়তো দেখবে, তোমার বামগালে নতুন একটা তিল গজাবে, ওটাই আমি হব। কিংবা ধরো, তোমার একটা কন্যাসন্তান হবে, সে হয়তো সে নয়‌, বরং আমি।

তবে বারবার বলছি, আমি মরে যাবার পর কখনোই তারা হব না। আমি আকাশের তারা হতে ভয় পাই, যেমনটা ভয় পাই আমায় ছেড়ে যাবার সময় মৃদুহেসে তোমার সেই বলে যাওয়া..."ভালো থাকিস, তুই আমার চেয়ে ভালো কাউকে ডিজার্ভ করিস।"
মরার পর আমি সত্যিই তারা হব না, আমি মরার পর কখনোই আকাশ দেখে তারা খুঁজো না।

আমি মরার পর কখনোই, কোনোভাবেই তারা হব না! মানুষ তারায় তারায় মিথ্যে জমা রাখে।

তিন। (হাইট অব এক্সপেক্টেশন)

: শোন বাবা, বিয়ে করলে এমন মেয়েকে করবি, যে কখনোই আমার আর তোর বাপের কথার অবাধ্য হবে না। আমরা যা বলব, তা-ই ঠিক।
: ঠিক আছে, মা।
: আর শোন, তোর দিদির কথার বাইরেও সে যাবে না, ওরকম মেয়ে দেখেই বিয়ে করবি।
: অ্যাঁ...? আচ্ছা, ঠিক আছে!
: গাধা, আঁতকে উঠলি কেন? এই যেমন ধর, সে পুডিং বানাবে। পুডিং বানাতে জানলেও সে তোর দিদিকে ফোন করে রেসিপি জিজ্ঞেস করবে। ওই রেসিপি সে জানলেও মন দিয়ে শুনবে, আবারও জানার চেষ্টা করবে। এটা করলে তোর দিদি খুশি হবে। বুঝিস নাই ব্যাপারটা?

(ছেলে আর কথা বাড়াল না। বিয়েটা সে করবে, না কি তার মা করবে, ব্যাপারটা নিয়ে সে কনফিউজড হয়ে গেল।)

চার। জানিস, তোকে-না আমার আমি আমি লাগে ... তুই এমন ক্যান রে!

পাঁচ। প্রিয় মানুষের সব ভালো, খালি একটাই সমস্যা: প্রিয় মানুষ হুট ক‌ইরা মইরা যায়।

তারপর হাজার-কোটি বৎসর পার হইয়া যায়, পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ে, জনসংখ্যা দ্বিগুণ থেইকা তিনগুণ হয়; সমাজ বদলাইয়া যায়, কৃষ্টি পালটাইয়া যায়, বিজ্ঞান আইসা তাজ্জব সব আবিষ্কার কইরা দুনিয়াটারে বদলাইয়া এক্কেবারে উলটাইয়া-পালটাইয়া দেয়।

অঘাট ঘাট হয়, মঙ্গলে ঘরবাড়ি হয়, চাঁদে মানুষ বসত শুরু করে, প্রজন্ম থেইকা প্রজন্মে ম্যালা বদল হয়। তবু, যে মানুষটা এক বার মইরা যায়, সে আর কখনও, কোনোভাবেই, কিছুতেই ফিইরা আসে না, আসার সুযোগ‌ই পায় না।

আচ্ছা, ঠিক এমনি কইরাই বুঝি আমাদের বাপ-মা'ও একদিন চইলা গিয়া আর কোনোদিনই ফিইরা আসবে না, তাই না? কোনো মানে হয় এসবের?

ছয়। কিছু সম্পর্কের কোনো নাম হয় না।

মানুষটার জন্য অকারণে কেন খুব মায়া হয়, তার সামান্য ব্যথাতেও কেন বুক কেঁপে ওঠে, তার জ্বরে-পোড়া কাবু শরীরটা দেখলে কেন চোখে জল জমে, তার সঠিক কারণ আপনি খুঁজে পাবেন না।

তবুও...তবুও এমন অ-সম্পর্কের কাঁটাতার মাড়িয়ে মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে, শার্টের কলারে লেগে থাকা ধুলো ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে সে আনমনেই বলে উঠুক..."একদম ভয় পেয়ো না তো, আমি তো আছি!"

আচ্ছা, কেন কিছু সম্পর্কের কোনো নাম দেওয়া যায় না? কেন কিছু মানুষ আমাদের সব হয়েও 'কেউ না' হয়ে থেকে যায়?

অথচ, 'কেউই না' হওয়া এই মানুষটা কী যে ভীষণভাবে অনেক কিছুই হয়ে বুকের ঠিক মাঝ বরাবর বটগাছের মতন শক্ত করে শেকড় গজিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অনেক অনেকগুলো বছর...তা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়!

মানুষের সব মায়াই বুঝি গন্তব্যহীন।

সাত। যার বিচারে তোমার কিছু এসে যায়, এক তার বাদে বাকিদের বিচারের কোনো উত্তর কখনোই দিয়ো না। ওরা তোমার শব্দ নয়, নীরবতা ডিজার্ভ করে। এতে করে ওরা যা ইচ্ছে ভেবে নিক। অদৃষ্ট যাকে তেমন কিছু দেননি, মার্ক জুকারবার্গ তাকেও নিজের একটা ফেইসবুক ওয়াল দিয়েছেন। তাই বলতে দাও; বললেই তো আর হয়ে যায় না। হয়তো তোমার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারাই হবে ওদের জীবনের সবচাইতে বড়ো অর্জন, কে বলতে পারে! কেউ করে দেখায়, কেউবা বলে দেখায়।

আট। আমি যা পেয়েছি, তা পেতে চাইলে...আমি যা ছেড়েছি, সবার আগে তা ছাড়ো।

নয়। তুই হবি আমার কষ্ট?

দশ। মানুষ নিজেই নিজের শব বহন করে।

এগারো। চৌধুরী সাহেব, দোহাই লাগে, প্রেমিকার জন্মতারিখ, আপন ব‌উয়ের বিবাহবার্ষিকী, পরের ব‌উয়ের পুশির (বেড়ালের) জন্মদিন...এসব মনে রাখতে বলবেন না, প্লিজ!

...ওসব বিসিএস প্রিলিতে আসে না! একটু বোঝার চেষ্টা করুন...

বারো। ধরো, তুমি চাও, তোমার ভালোবাসার মানুষ তোমার জন্মদিন মনে রাখুক। কিন্তু এমনও হতে পারে, সময় ও তারিখ মনে রাখার নাম তার কাছে ভালোবাসা নয়। জন্মতারিখ মনে রাখার দায়িত্ব ফেইসবুকের উপর ছেড়ে দিলে তোমার প্রিয় মানুষটির উপর চাপ একটু কমত আর কি!

তেরো। অবসরের পুরোটা প্রিয় মানুষকে দিয়ে না ফেলে কিছুটা সময় ব‌ইয়ের জন্যও রাখুন, এতে পড়ার অভ্যেসটা টিকে অন্তত থাকবে। ন‌ইলে ব্রেক‌আপের পর কার সাথে সময় কাটাবেন? ধরে নিলাম, মানুষটা চলে যাবে না, থেকে যাবে। ঝগড়াঝাঁটি তো হবেই, যোগাযোগ‌ও সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে। তখন?

চৌদ্দ। শান্তিই ধর্ম।

পনেরো। যে বিচার করে, সে বোঝে না, না বুঝেও হ‌ইচ‌ই করে।
যে বোঝে, সে বিচার করে না, বুঝেই চুপচাপ থাকে।

ষোলো। মানুষ নিজের অপূর্ণতাকেই ভালোবাসে। আর ভালোবাসে বলেই সে এমন কিছুকেই আঁকড়ে ধরে রাখে, যা তাকে পূর্ণ হতে দেয় না।

সতেরো। একেকটা মানুষ দুনিয়াতে একেকটা কাজে লাগে। যে যে-কাজে লাগে, সে-কাজের গুরুত্ব যার কাছে নেই, তার কাছে সে গুরুত্বহীন; যদিও সে অনেকের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যা পারেন, তা যে গোনে না, তার কাছে আপনার দাম একপয়সাও নয়। নিজের ওজন বুঝে দাঁড়িপাল্লায় উঠুন।

ভাবনা: নয়-শো উনসত্তর
………………………………………………………

এক। যে তার নিজের ঘরেই পরগাছা হয়ে যায়, তার জন্য একটা পুরো পৃথিবীও কম পড়ে যায়।

এমন অনেক ক্ষত আছে, যা সময় কখনও মুছে দিতে পারে না, বরং সময়ের সাথে সাথে সেই ক্ষতচিহ্নগুলো আরও গাঢ় হতে থাকে।

পৃথিবীতে অজস্র অকৃতজ্ঞ সন্তান যেমন আছে, তেমনি অনেক অকৃতজ্ঞ বাবা-মা'ও আছে; কোনো কিছু দিয়েই যাদের মন ভরানো তো যায়‌ই না, বরং দিনশেষে কিছু কিছু বাবা-মা'য়ের কাছে, দেখা যায়, সেই সন্তানই সূর্যসন্তান, যে কিনা উঠতে-বসতে বাবা-মা'কে পায়ে ঠেলে দেয়!

কিছু কিছু সন্তানের মতো কিছু কিছু বাবা-মা'কেও খুশি করা যায় না, এবং অকৃতজ্ঞ মানুষের মতো তারাও সব কিছুতেই একটা-না-একটা ছিদ্র খুঁজে বের করে ফেলেই ফেলে! ছিদ্র খোঁজাই যাদের স্বভাব, তারা স্বর্গে গেলেও ছিদ্রই খোঁজে।

দুই। মানুষ অন্যের সামনে যতটা সাবধানে বায়ুত্যাগ করে, ততটা সাবধানে কথা বললে সে আর বিপদে পড়ত না। অথচ অসাবধানী বায়ুত্যাগ বিপদ ঘটায় না, আর বেফাঁস কথা প্রায়‌ই বিপদ ঘটায়।

তিন। আমরা মুক্তি পেতে চাই, আবার শেকল ভাঙতে ভয় পাই। কেন, জানেন? মুক্ত হতে দুইটি ডানাই যথেষ্ট, কিন্তু অনেক শেকল ভাঙলেই পরে শেকল ভাঙা হয়! এসব মাথায় এলে মন বলে, "ওড়্ না!", আর শরীর বলে, "থাক্ না!"

চার। সবাই ভালোবাসতে জানে না। কেউ কেউ ভালোবাসতে গিয়ে ইনসিকিউরড বোধ করে। তখন সে তার ভালোবাসার মানুষটির চলাফেরার উপর কঠোর নজরদারি করতে শুরু করে দেয়। এতে করে দু-জন‌ই ক্রমশ অসুস্থ ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভালোবাসা এমনি করে একসময় ভয় আর ভারে পরিণত হয়। সম্পর্কে জড়ানোর চাইতে বরং না খেয়ে থাকাও ভালো।

পাঁচ। কিছু সম্পর্ক বরং দূরত্ব থাকলেই সুন্দর থাকে।

ছয়। অন্যের সাথে থেকে মানুষ তার একাকিত্ব ঘোচাতে চাইলেও মানুষের একাকিত্ব আসলে কখনোই পূরণ হবার নয়। প্রকৃতপক্ষে, মানুষ পরিবর্তনকে ভয় পায়।

মানুষ যখন একা থাকে, তখন সঙ্গী ভয় পায়, অন্য কারও প্রতি অভ্যস্ততা এবং পরনির্ভরশীলতার ভয় পায়; সে ভয় পায় এটা ভেবে যে, কেউ হয়তো তার সাথে প্রতারণা করবে!

আবার যখন সে কোনো সঙ্গীর সঙ্গে থাকে, তখন সেই একই মানুষ সঙ্গীবিহীন একা হয়ে যাবার ভয় পায়, তার অভ্যাসের এই আকস্মিক পরিবর্তনকে ভয় পায়, অনিশ্চিত আগামীকে ভয় পায়! সে ভাবে, আমি আবার একা হয়ে গেলে বাঁচব কী নিয়ে!!

সাত। একটা সময় পরে মানুষ একাকিত্ব ভয় পায়। একাকিত্বের ভয়ে ভুল মানুষ জেনেও কেবল সঙ্গীর শূন্যস্থান পূরণের জন্য কাউকে সে আকঁড়ে ধরে।

ধীরে ধীরে রাত গাঢ় হয়, একাকিত্বের বেদনা তাকে চারপাশ থেকে এমনভাবে জাপটে ধরতে থাকে যে, সেই মুহূর্তে নিজেকেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো বোঝা মনে হতে থাকে।

নিজের সামান্য নিয়ন্ত্রণটুকুও নিজের আয়ত্তে রাখতে নিজের সমস্ত শক্তি এক করে ফেলে মানুষ। 

এই মুহূর্তগুলো এতটাই কঠিন যে, অনেকসময় অনেক দিক থেকে সফল মানুষটাও নিজের কাছে এসে কেমন জানি অসহায় হয়ে পড়ে। অজস্র মানুষকে রোজ আশার আলো দেখিয়ে বাঁচিয়ে রাখা মানুষটাও নিজের দিকে তাকিয়ে ভাবে, "নিজেকে এতটা জঞ্জাল মনে হচ্ছে কেন আমার?"

মানুষ অন্যের ভার‌ সহ্য করতে পারলেও নিজের ভার সহজে সহ্য করতে পারে না। এজন্যই অনেকসময় ভুল মানুষের সাথে গড়া সম্পর্কগুলোও একভাবে টিকে যায়।
মানুষ জানে ও বোঝে, যে মানুষটার সঙ্গে সে আছে, সে আদৌ তার জন্য সঠিক মানুষ নয়, সে কখনোই তার যথাযথ মূল্যায়ন করবে না, দিনশেষে এই মানসিক দূরত্ব বাড়তেই থাকবে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে সেই মানুষটিকেই আকঁড়ে ধরে পড়ে থাকে এ কারণে নয় যে, সে তাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না; সে আসলে তার একাকিত্বের ভয়ে, নিজের সাথে লড়াইয়ে হেরে যাবার ভয়েই আঁকড়ে ধরে থাকে।

অসময়ের ফেরে জীবন শেখায়, কেবল মায়া কিংবা অভ্যস্ততায় নয়, মানুষ কখনো কখনো বাধ্য হয়েও নিজের অবাধ্য হয়!

আট। প্রিয় সায়ান,

কেন বাড়লে বয়স ছোট্টবেলার বন্ধু হারিয়ে যায়... গানটা শুনে শুনে অনেক কেঁদেছি একসময়।

ইদানীং এই গানটা শুনে কাঁদি। আমার মাঝে মাঝে কিছু কান্না লাগে।
আপনার এই সৃষ্টি অনেক সম্পর্ককে ভেঙে যাবার হাত থেকে বাঁচিয়ে দেবে যুগ যুগ ধরে। সেই মানুষগুলো আপনাকে মনে রাখবে, ভালোবাসবে, যা আপনি জানতেই পারবেন না কোনোদিনই।

ভালো থাকবেন সবসময়ই।

নয়। Let silence take the decision.

দশ। ছেলেরা ভাবে, দুইটি জিনিস পেয়ে গেলে জীবনটা অনেক সুখের হতো: চাকরি আর ব‌উ।

দুটোই পেয়ে যাবার পর ছেলেরা ভাবে, দুইটি জিনিস ছেড়ে দিলে জীবনটা অনেক সুখের হতো: চাকরি আর ব‌উ।

এগারো। যাকে ভালোবাসি ও যাকে ঘৃণা করি, দু-জনের কাছ থেকেই আমরা আঘাত পাই। প্রথম ধরনের আঘাতটি ভালোবাসি বলেই পাই, দ্বিতীয়টি পাই বলেই ঘৃণা করি।

বারো। কার রাগ কে করে!
কার পূজা কে দেয়!

তেরো। মানুষ ভালোবাসার নামে মূলত নিজের চাহিদা পূরণ করে --- মানসিক বা শারীরিক বা দুটোই।

চৌদ্দ। মানুষ মানুষের কাছে খুব সহজেই এই দুইটি জিনিস চেয়ে বসে: সময় আর টাকা; অথচ দুটিই খুব দামি। দামি জিনিস কি কারণ ছাড়া চাওয়া যায়... তা-ও আবার যে কারুর কাছে? টাকা দেওয়া কঠিন, সময় দেওয়া কঠিনতর; অপরিচিত কাউকে বিনা কারণে যে-কোনোটিই দেওয়া কঠিনতম।

মজার ব্যাপার, মানুষ এই দুইটি জিনিস চায় সাধারণত এমন কারও কাছে, যার দ্বারা তার কোনো উপকার হয়েছে। চেয়ে না পেলে তখন সে ভুল বোঝে, কখনো রেগেও যায়। মানুষ বড়ো প্রত্যাশাপ্রিয় প্রাণী। মানুষ বুঝতেই চায় না যে, জ্বালা যার, ঠ্যাকা তার।

যার মাধ্যমে মানুষ কখনও উপকৃত হয় না, তার কাছে সে কখনও যায় না। তাকে কেউ ভুল‌ও বোঝে না, তার উপর কেউ রাগ‌ও করে না। তার কথা কার‌ও মাথায়ই আসে না। সে সব দিক থেকেই নিরাপদ।

সময় কেন টাকার চেয়ে দামি জানেন? কারণ, যে কারুর‌ই টাকা আপনার কাজে লাগলেও যে কারুর‌ই সময় আপনার কাজে লাগবে না। সব টাকাই এক হলেও সব সময়ই এক নয়। সময়ের দাম মানুষভেদে কমে বাড়ে।

পনেরো। মেয়েটির নতুন বিয়ে হয়েছে। সে থাকে শ্বশুরবাড়িতে; বরটি থাকে দূরের একটি জেলায়, জীবিকার তাগিদে। বর মাঝে মাঝে আসে, দুই-এক দিন থেকে চলে যায়। মেয়েটি শুধু অপেক্ষা করে।

একদিন অপেক্ষা করতে করতে আনমনে সে বরের একটি ছবি আঁকল। ভারি সুন্দর সে ছবি... কিন্তু বেচারি বরের পা-দুটি আঁকল না...এই ভয়ে যে, পা আঁকলে বর যদি ছবি ছেড়েই পালায়!

আহা, প্রিয় মাত্রেই বুঝি পলায়নপর!


ভাবনা: নয়-শো সত্তর
………………………………………………………

এক। মশা ও খল (খারাপ লোক) এক‌ই জাতের। কাজেকর্মে মশা ঠিক খলের অনুকরণ করে। খল স্বার্থসাধনের জন্য প্রথমে লোকের পায়ে গিয়ে পড়ে; মশাও এসে পায়ের উপর বসে। খল লোকের পিঠের মাংস খায়, অর্থাৎ খল লোকের পেছনে গিয়ে নিন্দা করে ও ক্ষতি করার চেষ্টা করে। লোকের অসাক্ষাতে নিন্দামন্দ করে বলে খলের একটি নাম 'পৃষ্ঠমাংসাদক'। মশাও পিঠে হুল ফুটিয়ে রক্ত খায়। খল তার দুরভিসন্ধিসিদ্ধির জন্য লোকের কানে নানা প্রকারের কপট তবে মিষ্টি কথা বলে থাকে। মশাও রক্ত খাওয়ার আগে কানের কাছে মধুর স্বরে গুনগুন করতে থাকে। ছিদ্র অর্থাৎ সুযোগ পেলেই খল ব্যক্তি লোকের ঘরের ও মনের ভেতর ঢুকে পড়ে এবং নির্ভয়ে তার ক্ষতিসাধন করে। মশাও ঠিক তেমনি মশারির কোনো জায়গায় একটু ছিদ্র পেলেই ভেতরে ঢুকে আরাম করে রক্ত খায়।

দুই। নিজের ভুলগুলিকে কীভাবে স্বীকার করতে হয়?

আমাদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্যে সামগ্রিক অর্থেই পাপস্বীকার করার জন্যে বিনতভাবে সাহস করে এগিয়ে যেতে হবে; তখন কোনো আশঙ্কায় নিজেকে বিরত করা যাবে না। সাপ যখন আমাদের গায়ে বিষ ঢুকিয়ে দেয়, তখন তা বিষাক্ত; কিন্তু সেই একই সাপের বিষ থেকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরি হয়, যা শরীরে ঢুকিয়ে দিয়ে জীবন বাঁচানো যায়। পাপ যখন আমরা করি, তখন তা ঘৃণ্য; কিন্তু যখন সেই পাপকে স্বীকার করে অনুতাপ করি, তখন তা হয়ে দাঁড়ায় উপকারী আর শক্তিদায়ী। অনুশোচনা আর পাপস্বীকার এত সুন্দর আর সুগন্ধযুক্ত যে ওরা পাপের কদর্যতাকে মুছে দেয় আর তার দুর্গন্ধকে দূর করে।

আমরা যদি সত্যিই বিনম্র হই, তাহলে আমাদের পাপগুলিতে আমরা ভীষণভাবে বিরক্ত হব; কারণ ঈশ্বর তাতে ক্ষুণ্ণ হন; কিন্তু পাপস্বীকার করলে তা হবে আমদের কাছে মিষ্টি আর উপাদেয়; কারণ তাতে ঈশ্বর খুশি হবেন। যে রোগ আমাদের কষ্ট দিচ্ছে, তার কথা ডাক্তারের কাছে খুলে বললে আমাদের কিছুটা স্বস্তি হয়। যখন আমরা গুরুর কাছে যাব, তখন মনে করতে হবে, ঈশ্বরের তথা নিজের আত্মার পায়ের কাছে ধুলোয় আমরা বসে রয়েছি। আমাদের সমস্ত কালিমা ধুয়ে দেবার জন্যে সারাঅঙ্গ থেকে গুরুর মূল্যবান রক্ত ঘাম হয়ে ঝরে পড়ছে। গুরুর শ্রম আর ঘামেই আমাদের পাপ ধুয়ে যাবে, আর আমরা পাপমুক্ত হব। পাপস্বীকারের মধ্য দিয়ে যাতে পাপগুলি বেরিয়ে যায়, সেইজন্যে আমাদের হৃদয়দুয়ার খুলে দিতে হবে। কারণ মন থেকে পাপ যত বেরিয়ে যাবে, ততই পবিত্র যাতনাভোগের পরম পুণ্য তার আশীর্বাদ দিয়ে পূর্ণ করার জন্যে হৃদয়ে প্রবেশ করবে।

এর জন্য সহজভাবে সব কিছুই বলতে হবে---কিছু রেখেঢেকে নয়, যাতে বিবেক চিরকাল আনন্দে থাকে। আর সেই কাজ শেষ হলে পরে গুরু তথা ঈশ্বরের সেবকের উপদেশ আর নির্দেশ শুনতে হবে; মনে মনে বলতে হবে: "প্রভু, তুমি বলো; কারণ তোমার দীন সেবক কান পেতে আছে।" তখন ঈশ্বরের কথাই আমরা শুনতে পাই, কারণ তিনি তাঁর মুখপাত্র তথা যথার্থ গুরুকে বলেন: “যে তোমার কথা শোনে, সে আমার কথা শোনে।” এভাবেই ধীরে ধীরে আত্মজ্ঞানের জাগরণ ঘটে এবং আত্মা অন্ধকার থেকে মুক্তি পায়।

তিন। মৃত্যু নিয়ে কিছু ভাবনাকে মনে জায়গা দেওয়া যাক।

১। ঈশ্বরের সামনে নিজেকে দাঁড় করাও।
২। তাঁর অনুগ্রহ পাবার জন্যে তাঁর কাছে প্রার্থনা করো।
৩। মনে করো, মৃত্যুশয্যায় তুমি শুয়ে আছ; সেরে ওঠার কোনো আশা নেই তোমার।
কিছু বিষয় মাথায় রেখো সবসময়ই।

১। মনে রেখো, কোনদিন তোমার মৃত্যু এসে দুয়ারে হানা দেবে তুমি জানো না। একদিন এই দেহটাকে ছেড়ে তোমাকে যেতেই হবে। সেদিন কখন কোথায় কীভাবে আসবে? শীতে, না গ্রীষ্মে? শহরে, না গ্রামে? দিনে, না রাত্রিতে? সেই মৃত্যু কি না জানিয়ে আসবে, না জানিয়ে আসবে? অসুখে তুমি মারা যাবে, না দুর্ঘটনায়? সেদিন নিজের ভুলগুলিকে স্বীকার করার সময় কি তুমি পাবে, না পাবে না? মৃত্যুর সময় তোমার ভুলগুলিকে ধৈর্য করে শোনার মতো কোনো গুরুকে কি তুমি পাবে? হায়, এসব বিষয়ে কিছুই আমাদের জানা নেই! আমরা কেবল জানি, আমরা মারা যাব; আর যতদিন বাঁচব আশা করি, প্রায় সবসময়ই তার আগেই আমরা মরি।
২। মনে রেখো, তোমার কাছে পৃথিবী তখন লুপ্ত হয়ে যাবে, তোমার ভোগের জন্যে তার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তোমার চোখের সামনে এই পৃথিবী তখন মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে। হ্যাঁ, তখন যত আমোদ-প্রমোদ, দম্ভ-দেমাক, সুখ-আহ্লাদ, অপার প্রেম-ভালোবাসা, তার সবই মনে হবে মায়ামরীচিকার মতো। হায়, কী দুর্ভাগাই-না আমি! কীসব তুচ্ছ আর ফাঁকা লোভের মোহেই আমি এমন সব কাজ করেছি! এর ফলে ঈশ্বর আমার উপরে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তুমি দেখবে, অসারের লোভে ঈশ্বরকে তুমি ভুলে গিয়েছ বহু বহুবার। অন্য দিক থেকে মনে হবে, ভক্তিসাধনা আর পুণ্য কাজই তোমার কাছে এত কাম্য আর মধুর, আর তা সত্ত্বেও, ওই সুন্দর আর আনন্দের পথ তুমি অনুসরণ করোনি কেন? আগে যে-সব পাপ খুব ছোটো বলে মনে হয়েছিল, এখন সেগুলিকে মনে হবে পাহাড়ের মতো বড়ো, আর তোমার ভক্তিকে মনে হবে খুব ছোটো। তখন হায় বড়ো দেরি হয়ে যাবে!
৩। এই অসার জগতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেতে তোমার অনেক শক্তি লাগবে, খুব কষ্ট হবে। একবার ভেবে দেখো, সম্পদপ্রাচুর্য, দম্ভঅহংকার, আমোদপ্রমোদ, ইয়ারদোস্ত, খেলাধুলা, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, এককথায়, সকলের কাছ থেকেই বিদায় নিয়ে যাবে তুমি। আর সবশেষে বিদায় নিয়ে যাবে আপন দেহের কাছ থেকে; সেই দেহ পড়ে থাকবে বিবর্ণ, কঙ্কালসার হয়ে, আবর্জনার মতো হয়ে উঠবে উৎকট দুর্গন্ধময়।
৪। তার পরে, কত তাড়াতাড়ি তোমার দেহটাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে মাটির মধ্যে পুঁতে ফেলা হবে, সেকথা একবার ভেবে দেখো; আর ভেবে দেখো, দেহটাকে একবার পুঁতে ফেলা হলে তোমার কথা এ জগৎ আর ভাববে না; তুমি অন্যদের কথা চাইলেও মনে রাখতে পারবে না, আর এই জগৎ তোমাকে মনে রাখতে চাইবেই না। বেঁচে থাকতে কত মানুষ, মরে গেলে মানুষ কোথায়? সবাই বলবে, ঈশ্বর তোমার আত্মাকে শান্তি দিন; ব্যস্‌, ওটুক ছাড়া আর কিছু নয়। হে মৃত্যু, তুমি কারও তোয়াক্কা করো না; কতই-না নির্মম এক সত্য তুমি!
৫। ভেবে দেখো, দেহ থেকে বেরিয়ে যাবার পরে, আত্মা ডান অথবা বাম দিকের পথ ধরে এগিয়ে যায়! হায়, তোমার আত্মা কোথায় যাবে বা কোন পথ ধরে যাবে তখন? এই জন্মে যে পথ ধরে সে চলতে শুরু করেছিল, সেই পথ ধরেই। তোমার দায়িত্ব, বেঁচে থাকতেই আত্মাকে সুন্দর পথে চলতে দেওয়া।

এসো, কিছু কাজের পরিকল্পনা এবং সেগুলি বাস্তবায়ন করা যাক।
১। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো, ঝাঁপিয়ে পড়ো তাঁর বুকের মধ্যে। হায় প্রভু, সেই ভয়ংকর দিনটিতে তুমি আমাকে আশ্রয় দিয়ো। সেই মুহূর্তটি আমার কাছে যেন আনন্দের হয়; যেন সবই অনুকূলে হয় আমার; সেইজন্যে আমার জীবনের অন্য দিনগুলি দুঃখ-কষ্টের হলেও আফসোসের কিছু নেই।
২। এই জগৎকে অবজ্ঞা করো। হে জগৎ, ঠিক কোন সময় তোমাকে আমি ছেড়ে যাব, তা আমি জানি না বলেই তোমার উপর আদৌ কোনো মোহ জন্মাতে আমি দেবো না। হে আমার বন্ধু আর সঙ্গীরা, যে পবিত্র বন্ধুত্ব চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকে, কেবল তা দিয়েই আমি যেন তোমাদের ভালোবাসতে পারি। কারণ যে মিলনের বাঁধনকে ক্ষয় করা আর ছিঁড়ে ফেলা দরকার, তেমন বাঁধনে নিজেকে আমি তোমাদের সঙ্গে বেঁধে রাখব কেন? আত্মার সাথে বাঁধনই সুন্দরতম বাঁধন।
৩। সেই মুহূর্তটির জন্যে নিজেকে আমি তৈরি করে রাখব; এবং এই জগৎ থেকে আনন্দের সঙ্গে বিদায় নেবার জন্যে যা-কিছু প্রয়োজন, সেইসব বিষয়ে আমি সচেতন থাকব। নিজের বিবেককে সমুন্নত রাখতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব আর আমার এই ত্রুটিবিচ্যুতিগুলিকে আমি সংশোধন করব। যে নিজেকে শুধরে নেয় না, তার বেঁচে থাকার কোনো মানেই নেই।

মৃত্যু নিয়ে ভাবনা এলে যা করতে হয়, তা সংক্ষেপে লিখছি।
যে সংকল্পগুলি ঈশ্বর তোমাকে দান করেছেন, সেগুলির জন্যে তাঁকে ধন্যবাদ জানাও। সেগুলিকে পরমেশ্বরের কাছে উৎসর্গ করো; তোমার চিন্তা, শ্রম ও কর্মের গুণে তিনি যাতে তোমার মৃত্যুকে আনন্দময় করে তোলেন, সেজন্যে আবার তাঁর কাছে প্রার্থনা করো। প্রার্থনাই মুক্তি, প্রার্থনায় নিহিত পরম কল্যাণ। অনুতপ্ত হও . . . আত্মিক মৃত্যু ও পুনর্জন্মের জন্য—শারীরিক মৃত্যুর আগেই।


ভাবনা: নয়-শো একাত্তর
………………………………………………………

এক। পাপের বিষয়ে নিজেকে সচেতন ও সতর্ক করার জন্য কিছু অনুশীলন করা যেতে পারে।

১। ঈশ্বরের সামনে নিজেকে দাঁড় করাও।
২। তোমাকে প্রেরণা জোগানোর জন্যে প্রার্থনা করো তাঁর কাছে।

এসো, এবার কিছু বিষয় নিয়ে ভাবা যাক।
১। কতদিন আগে থেকে তুমি পাপের পথে নেমেছিলে, সেকথা ভেবে দেখো; যেদিন তুমি প্রথম পাপ করেছিলে, তারপর থেকে তোমার মধ্যে সেই পাপ কতটা বেড়ে উঠেছে, সেকথা ভাবতেও ভুলে যেয়ো না। ঈশ্বরের বিরুদ্ধে, নিজের বিরুদ্ধে, তোমার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে কাজে ও কথায় লোভ আর ভাবনাচিন্তার ভেতর দিয়ে প্রতিদিন পাপের কত যে বংশবৃদ্ধি করেছ, সে-সব কথা বিবেচনা করে দেখো।
২। পাপকাজ করার দিকে তোমার ঝোঁক আর সেই বোঁকগুলিকে তুমি কতটা অনুসরণ করেছ, সেকথা মনে করে দেখো। আর এ দুটি বিষয়ের কথা ভাবলে তুমি দেখতে পাবে, তোমার পাপগুলি সংখ্যায় তোমার মাথার চুলগুলির চেয়েও যেন অনেক বেশি গজিয়ে উঠেছে! তোমার পাপের ও ভুলের সংখ্যা যেন মরুভূমির বালির চেয়েও বেশি!
৩। ঈশ্বরের প্রতি তুমি যে অকৃতজ্ঞতা দেখিয়েছ, আলাদাভাবে সেই পাপের কথাই ভেবে দেখো। তা এমন একটি পাপ, যা অন্য পাপগুলির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সেগুলিকে অতি জঘন্য করে তোলে। তারপরে দেখো, ঈশ্বর তোমাকে কত উপহারই-না দিয়েছিলেন, আর সেই দাতার বিরুদ্ধেই সেগুলির কী অপব্যবহারই-না তুমি করেছ, বিশেষ করে, তাঁর দেওয়া কত প্রেরণাকে তুমি অগ্রাহ্য করেছ, কত সৎ প্রচেষ্টাকে তুমি নিজেই হাতে ধরে বানচাল করে দিয়েছ। সবার উপরে, কতবার তুমি পুণ্য সংস্কারগুলি গ্রহণ করেছ, কিন্তু তার ফল কী হয়েছে? তোমার প্রিয় বন্ধু, প্রিয় গুরু, প্রিয় স্রষ্টা যে-সব দামি মণি দিয়ে তোমাকে সাজিয়েছিল, তাদের আজ কী দশাই-না হয়েছে! তোমার পাপের তলায় সেগুলি চাপা পড়েছে। সেগুলি গ্রহণ করার জন্যে কী প্রস্ততি তুমি নিয়েছ? তোমাকে বাঁচানোর জন্যে ঈশ্বর যখন অবিরাম তোমার পেছনে ছুটছেন, সেই সময় মরার জন্যে তুমি নিজে সবসময় তাঁর কাছ থেকে ছুটে পালাচ্ছ। তোমার এই অকৃতজ্ঞতার কথা বেশ ভালো করে ভেবে দেখো।
এখন যা করতে পারো, তা নিয়ে কিছু কথা বলছি।

১। তোমার সমস্ত ভুলের জন্যে লজ্জিত হও। বলো, হে আমার ঈশ্বর, তোমার সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস আমার কোথায়? হায়, এই বিশ্বের আবর্জনা আমি, অকৃতজ্ঞতা আর পাপের এক নর্দমা আমি! এটা কি সম্ভব যে, আমি তোমার প্রতি এতই অবিশ্বাসী হয়ে পড়েছি, যার ফলে আমার এমন একটা ইন্দ্রিয়ও নেই, অথবা মনের এমন একটা শক্তিও নেই, যাকে আমি বিনষ্ট, অপবিত্র আর নোংরা না করেছি? আর আমার জীবনে এমন একটা দিনও যায়নি, যেদিন আমি এইসব অপরাধ না করেছি। আমার স্রষ্টা আমাকে যেসব উপহার দিয়েছেন, সেগুলির কি এই প্রতিদান দেওয়া আমার উচিত?
২। সংকল্প করো ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্যে। হে প্রভু, আর কোনোদিনই, তোমার অনুগ্রহের মাধ্যমে, আর কোনোদিনই পাপের স্রোতে নিজেকে আমি ভাসিয়ে দেবো না। হায়, এই পাপকে আমি খুবই ভালোবাসতাম; একে এখন আমি ঘৃণা করি। হে করুণাময় পিতা, তোমাকে আমি আলিঙ্গন করি। আমি চাই তোমার মধ্যে আর তোমার সঙ্গে বেঁচে থাকতে।
৩। আমার অতীতের পাপগুলি যাতে মুছে যায়, সেইজন্যে সাহসের সঙ্গে সেগুলি আমি স্বীকার করব; এমন একটা পাপও থাকবে না, যাকে আমি মন থেকে বের করে দেবো না।
৪। আমার মন থেকে সমস্ত পাপের শেকড়গুলিকে তুলে ফেলতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব, বিশেষ করে সেইসব পাপের, যেগুলি আমাকে সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় ফেলে।
৫। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য আমি সারাজীবন ধরেই চেষ্টা করে যাব, এবং কখনোই এটা মাথায় আনব না যে, এখন নিজেকে সংশোধন করার আর দরকার নেই, তাই এখন আমার ছুটি।

অল্প কথায় বলি।
১। ধন্যবাদজ্ঞাপন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাও; এখন পর্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে তোমার জন্যে তিনি অপেক্ষা করেছেন, এবং তোমার মনে এইসব ভালো অনুরাগ ও প্রবৃত্তি দান করেছেন।
২। আহুতিদান। তোমার বোধগুলিকে কাজে পরিণত করার শক্তি তিনি যাতে তোমাকে দেন, সেজন্যে তোমার হৃদয়কে আহুতি দাও তাঁর কাছে।
৩। আবেদন। তোমার সমর্পণকে গ্রহণ করার জন্য এবং তোমাকে আলোর দিকে নিয়ে যাবার জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করো।

দুই। আত্মিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য ঈশ্বরের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করতে হয়। এটিই আত্মিক উন্নতির প্রথম ধাপ। নিজের হৃদয়কে তাঁর কাছে সঁপে দেবার জন্য নিচের কাজগুলি করা যায়:

১। ঈশ্বরের সামনে নিজেকে দাঁড় করাও।
২। তোমাকে অনুপ্রেরণা দেবার জন্যে প্রার্থনা করো।

কেন করবে তাঁর অনুধ্যান?
১। ঈশ্বর তোমাকে দেহের জন্যে যা-কিছু দিয়েছেন, সেগুলির কথা স্মরণ করো; তোমার দেহের কথা, সেটিকে প্রতিপালন করার জন্যে অত সুযোগসুবিধে দানের কথা, দেহের জন্যে নানান হিতকর আমোদপ্রমোদের কথা, এত ভালো বন্ধু আর সাহায্যের কথা মনে করো। ভাবো, তুমি খুব সহজেই ঈশ্বরের আশ্রয়ে নিজেকে সুস্থসবল রাখতে পারো। যাদের অবস্থান তোমার মতোই হতে পারত, তবু যারা এইসব উপহার লাভ করেনি, তাদের সঙ্গে নিজের তুলনা করো; যেমন ধরো, দেহ আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দিক থেকে যারা বিকলাঙ্গ; স্বাস্থ্য যাদের খারাপ; যারা পরের ভর্ৎসনা-গঞ্জনা, ঘৃণা আর অসম্মানের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘোরে; যারা গরিব-দুঃখী। ঈশ্বর চাননি, তুমি তাদের মতো দীনদুঃখী হও। ঈশ্বরের অস্তিত্বকে হৃদয়ে অনুভব করো।
২। তোমার মনের জন্যে যা-কিছু তুমি পেয়েছ, সেসব কথা স্মরণ করো। বিশ্বে এমন কত লোকই তো রয়েছে, যাদের বুদ্ধি মোটা, যারা প্রলাপ বকে, যারা পাগল; আর তুমি কেন তাদের দলে নেই? তুমি এমন কে যে তোমাকে অমন করে গড়তে হয়নি? ঈশ্বর আসলে তোমার উপরে প্রসন্ন। বর্বর আর আকাট মূর্খের মতো মানুষ হয়েছে, এমন কত মানুষই তো রয়েছে! অথচ ভালো শিক্ষা পেয়ে সম্ভ্রান্ত মানুষের মতো বেড়ে ওঠার সকল সুযোগ মঙ্গলময় ঈশ্বর তোমাকে দিয়েছেন।
৩। তোমার আধ্যাত্মিক দানগুলির কথা স্মরণ করো। যৌবন থেকেই তাঁকে জানার জন্যে ঈশ্বর তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন। কতবারই-না তিনি তোমাকে তাঁর পুণ্যসংস্কার দান করেছেন! কতবারই-না তিনি তোমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, অন্তরের মধ্যে জ্বালিয়ে দিয়েছেন দিব্যজ্যোতি, তিরস্কার করেছেন তোমাকে সংশোধন করার জন্যে! কতবারই-না তিনি তোমার দোষ ক্ষমা করেছেন! আধ্যাত্মিক ধ্বংসের মুখে পড়ার হাত থেকে কতবারই-না তিনি তোমাকে উদ্ধার করেছেন! এবং অতীতের দিনগুলিতে তোমার আত্মার মঙ্গলের পথে এগিয়ে যাবার অবসর আর সুযোগ কি তুমি পাওনি? ঈশ্বর যে তোমার প্রতি কত সদয় আর প্রসন্ন, সেকথা গভীরভাবে একটু ভেবে দেখো।

কীভাবে করবে এই কাজগুলি?
১। ঈশ্বর যে কত উদার, তা অবাক হয়ে ভাবো। ঈশ্বর আমার উপরে কতই-না সদয়। তাঁর মঙ্গলময়তার শেষ নেই। হে প্রভু, তোমার হৃদয় করুণার ঐশ্বর্যে ভরা। প্রেমে আর করুণায় তুমি কতই-না উদার! হে আমার হৃদয়, তিনি আমাকে যেসব অনুগ্রহ দান করেছেন, সেগুলি আমরা যেন চিরকাল বলতে পারি।
২। তুমি যে কত বড়ো অকৃতজ্ঞ, তা ভেবে অবাক হও। বলো, হে প্রভু, আমি এমন কী যে আমার কথা তুমি মনে রাখবে? আমি কতই-না অপদার্থ! হায়, তোমার দেওয়া উপহারগুলিকে আমি পায়ে মাড়িয়ে গিয়েছি। অপমান করেছি তোমার অনুগ্রহগুলিকে; তোমার পরম মঙ্গলময়তাকে অবজ্ঞা করে আমি সেগুলির অপব্যবহার করেছি। তোমার অতলান্ত করুণা আর অনুগ্রহের পথ আমি বন্ধ করে দিয়েছি আমার অতল অকৃতজ্ঞতার ভারী পাথর দিয়ে।
৩। কৃতজ্ঞতায় নিজেকে উত্তাল করো। বলো তবে, হে আমার হৃদয়, এই মহান হিতকারীর প্রতি আর অবিশ্বাসী, অকৃতজ্ঞ, বিদ্রোহী হয়ো না; এবং আমার হৃদয় কি এখন থেকে ঈশ্বরের দ্বারস্থ হবে না? যে ঈশ্বর আমার মধ্যে আছেন এবং আমার জন্যে এত বিস্ময়কর কাজ করছেন, এবং দান করছেন অপরূপ অনুগ্রহ, আমি তাঁকে খুশি রাখতে কী করছি?
৪। ঈশ্বর তোমার জন্যে অনেক কিছু করেছেন বলে তোমার দেহকে নানান ভোগবিলাস থেকে সরিয়ে এনে তাঁর সেবায় উৎসর্গ করো। এমন সব অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তাঁকে জানার এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হবার জন্যে তোমার হৃদয়ের সমস্ত ক্ষমতাকে নিযুক্ত করো, যেগুলি মহৎ উদ্দেশ্যসাধনে তোমাকে সাহায্য করবে। নিজের পরিত্রাণলাভের এবং ঈশ্বরকে ভালোবাসার জন্যে যে-সব উপায় নির্দেশিত হয়েছে, সেগুলিকে যত্ন সহকারে পালন করো। নিজেকে বোঝাও: হ্যাঁ, আমি নিয়মিতভাবে ধ্যান-প্রার্থনা আর পুণ্যসংস্কার গ্রহণ করব; ঈশ্বরের পুণ্যবাণী আমি শুনব; যে অনুপ্রেরণা আর উপদেশ আমি গ্রহণ করব, সেগুলিকে আমি অনুশীলন করব।

অল্প কথায় বলি।
ধন্যবাদজ্ঞাপন। তোমার কর্তব্য আর আজ পর্যন্ত যে সুযোগসুবিধাগুলি তুমি লাভ করেছ, সে সম্বন্ধে তোমাকে জ্ঞানদান করার জন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও।
২। আহুতিদান। তোমার সমস্ত সংকল্প নিয়ে তাঁর কাছে তোমার হৃদয়কে আহুতি দাও।
৩। আবেদন। তাঁর অনুগ্রহপ্রাপ্ত মানুষদের জীবন যেমন, ঠিক তেমন একটা জীবন গঠন করার জন্য তাঁর কাছে নত মস্তকে শক্তি চাও, আশ্রয় চাও।


ভাবনা: নয়-শো বাহাত্তর
………………………………………………………

এক। আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে নিজের আত্মার সাথে একটু আলাপচারিতায় মেতে ওঠা যাক।

১। ঈশ্বরের সামনে নিজেকে দাঁড় করাও।
২। তোমাকে অনুপ্রেরণা দেবার জন্যে তাঁর প্রার্থনা করো।

কেন করবে এমন?
১। তাঁর কোনো প্রয়োজন রয়েছে বলে ঈশ্বর যে তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তা নয়; কারণ, তোমাকে তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই; তোমাকে তাঁর অনুগ্রহ আর গৌরব দান করে তিনি যে কত দয়াময়, তা-ই তোমার মধ্যে প্রকাশ করার জন্যে তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। আর সেজন্যে, তাঁকে বোঝার উদ্দেশ্যে তোমাকে দিয়েছেন বোধশক্তি, তাঁকে মনে রাখার জন্যে দিয়েছেন স্মৃতিশক্তি, তাঁকে ভালোবাসার জন্যে ইচ্ছাশক্তি, তাঁর দানগুলিকে চোখের সামনে তুলে ধরার জন্যে কল্পনাশক্তি, তাঁর বিস্ময়কর কীর্তিগুলি দেখার জন্যে দিয়েছেন দুটি চোখ, তাঁর স্ততি করার জন্যে জিহ্বা, এবং একইভাবে আরও অনেক কিছুই।
২। এই উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করে জগতে তিনি তোমাকে নিয়ে এসেছেন বলে তাঁর প্রতিকূলের সব কিছুকে, সব কাজকে বর্জন করতে আর এড়িয়ে যেতে হবে; আর যা-কিছু সেই উদ্দেশ্যসাধনে সাহায্য করবে না, তাকেই তুচ্ছ মনে করবে অসার আর অবান্তর বলে।
৩। যারা একথা চিন্তা না করে এমনভাবে বেঁচে থাকে যে, তাদের মনে হবে, কেবলমাত্র বাড়ি তৈরি করার, গাছপালা লাগানোর, অর্থ সঞ্চয় করার আর আজেবাজে আনন্দে মত্ত থাকার জন্যে তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে, সেইসব বিষয়ী মানুষের দুর্ভোগ্যের কথা মনে রেখো।
কীভাবে করবে?
১। লজ্জিত হ‌ও, নিজের হীনাবস্থার জন্যে তিরস্কার করো নিজেকেই। অতীতে তুমি অনেক অন্যায় কাজ করেছ; এইসব দিকে তুমি খুব কম নজর দিয়েছ বা আদৌ দাওনি। তুমি বলবে, হায় ভগবান! তোমার কথাই যদি ভেবে না থাকি, তাহলে এতদিন কার কথা ভেবেছি? তোমাকে ভুলে গিয়ে কার কথা আমি মনে রেখেছি এতদিন? তোমাকে ভালো না বেসে ভালোবেসেছি কাকে? হায়, যা পরম সত্য, তাকে গ্রহণ না করে মিথ্যা অসার জিনিসেই আমি মেতে রয়েছি; তাই যে-সংসার আমাকে সেবা করার কথা, তাকেই আমি সেবা করে চলেছি।
২। অতীতের ভুলে-ভরা জীবনকে ঘৃণা করো। হে আমার অসার-অকেজো চিন্তারাশি, তোমাদের আমি বর্জন করছি। হে আমার ঘৃণ্য আর শূন্যগর্ভ স্মৃতিমালা, শপথ নিয়ে তোমাদের আমি পরিত্যাগ করছি। হে আমার অবিশ্বাসী-অকৃতজ্ঞ বন্ধুর দল, অসার-শোচনীয় পার্থিব সুখসমাধি, স্বার্থপর-ক্লান্তিকর সম্ভোগ, তোমাদের আমি বর্জন করলাম।
৩। ঈশ্বরের চিন্তায় নিজেকে ডুবিয়ে দাও। মনে মনে বলো: হে আমার ঈশ্বর, আমার পরিত্রাতা, এখন থেকে তুমি আমার সমস্ত চিন্তার সার হবে। তোমার যা অপ্রীতিকর, তেমন কোনো চিন্তা জীবনে কখনও আমি করব না। তুমি যে আমার উপরে মধুর ভালোবাসা আর করুণা দেখিয়েছ, তারই স্মৃতিতে সারাজীবন আমি ভরিয়ে রাখব। তুমি হবে আমার হৃদয়ের আনন্দ, আমার সমস্ত অনুরাগের সুধাভাণ্ড। যে যে সব তুচ্ছ নির্বোধ মোহে এতদিন আমার মন আচ্ছন্ন হয়ে ছিল, আর যে যে সব বাজে কাজে অনেক সময় আমি নষ্ট করেছি, আজ থেকে সেগুলির কথা স্মরণ করে আমি আতঙ্কিত হব; আর সেগুলির হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে আমি এই এই কাজ করব। (কাজের নামগুলি প্রার্থনা করার সময় বললে খুব ভালো হয়।)

অল্প কথায় বলছি।
১। ধন্যবাদজ্ঞাপন। ওই রকম একটি মহৎ উদ্দেশ্যে তোমাকে সৃষ্টি করার জন্যে ভগবানকে ধন্যবাদ দাও: আমি যাতে তোমার অনন্ত গৌরবের জন্যে অনন্তকাল ধরে উল্লাস করতে পারি, সেই উদ্দেশ্যে, হে প্রভু, তোমার জন্যেই আমাকে তুমি সৃষ্টি করেছ। এর যোগ্য আমি কবেই-বা হব? তোমার যোগ্য বন্দনা করার শক্তি কবেই-বা আমার হবে?
২। আহুতিদান। মনে-প্রাণে, সর্বান্তকরণে, হে আমার প্রিয় স্রষ্টা, আমার এই অনুরাগ আর সংকল্পগুলি তোমার সেবায় উৎসর্গ করছি।
৩। আবেদন। হে আমার ঈশ্বর, আমার এই কামনা-বাসনাগুলিকে তুমি গ্রহণ করো, আমাকে দাও তোমার আশীর্বাদ। আমি যেন আমার সমস্ত রক্তকে ঘামে পরিণত করে জীবনপথে চলতে পারি।

দুই। আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য প্রার্থনার ভূমিকা অসীম। নিচের কাজটি নিভৃতে করে দেখতে পারো, শান্তি পাবে।

১। ঈশ্বরের সামনে নিজেকে দাঁড় করাও।
২। তোমাকে অনুপ্রেরণা দেবার জন্যে তাঁর কাছে প্রার্থনা করো।

কেন করবে?
১। মনে রেখো, মাত্র কয়েক বছর আগে এই বিশ্বে তুমি আদৌ ছিলে না; কোনো অস্তিত্ব ছিল না তোমার। হায়, তখন তুমি কোথায় ছিলে! এই পৃথিবী তো অনেক দিন ধরেই রয়েছে; অথচ তোমার খবর সে রাখেনি।
২। তুমি যা, সেভাবে তোমাকে গড়ে তোলার জন্যে শূন্যতা থেকে ঈশ্বর কেবল আপন দয়ায় তোমাকে সৃষ্টি করেছেন; কারণ, তোমাকে তাঁর কোনো প্রয়োজন ছিল না। তুমি অপরিহার্য ন‌ও।
৩। ঈশ্বর তোমাকে যে সত্তা দিয়েছেন, তার কথা মনে রেখো; কারণ, এই বিশ্বে এই সত্তাটিই সর্বশ্রেষ্ঠ। অনন্তকাল ধরে বেঁচে থাকার, এবং সেই পরম রাজাধিরাজের সঙ্গে মিলিত হবার শক্তি এই সত্তার আছে।

কীভাবে করবে?
১। ঈশ্বরের কাছে একান্তভাবে বিনত হও। অন্তর থেকে বলো: "তোমার কাছে আমি কিছুই নই। তুমি আমার সম্বন্ধে এমন কী ভেবেছিলে, যার জন্যে আমাকে তুমি সৃষ্টি করেছ?" হায়, এতদিন তো তুমি ডুবেছিলে সেই আদি অতলান্ত শূন্যতার মহাসাগরে; সেখান থেকে ঈশ্বর তোমাকে উদ্ধার না করলে সেখানেই তুমি পড়ে থাকতে; আর সেই মহাশূন্যতায় তুমি কী করতে?
২। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাও। প্রার্থনা করে বলো: হে আমার মহান পরম মঙ্গলময় স্রষ্টা, তোমার কাছে আমি কতই-না ঋণী। কারণ, আমি যা, তোমার অসীম করুণায় আমাকে সেইভাবে গড়ে তোলার জন্য আমার সেই তুচ্ছতার মধ্যেই আমাকে গ্রহণ করতে তুমি সম্মত হয়েছে। উপযুক্তভাবে তোমার পুণ্য নামের স্তুতি গাইবার, আর অসীম মঙ্গলময়তার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ জানাবার মতো শক্তি কোনোদিন কি আমার হবে?
৩। তোমার মন লজ্জায় ভরে উঠুক। আনত চোখে স্বীকার করে নাও: হায়! হে আমার স্রষ্টা, প্রেম আর সেবার মধ্য দিয়ে তোমার সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে না দিয়ে, অপরিমিত মোহের জালে জড়িয়ে পড়ে নিজেকে আমি বিদ্রোহী করে তুলেছি; পাপাসক্ত হয়ে থাকার জন্যে তোমার কাছ থেকে নিজেকে আমি বিচ্ছিন্ন করে সরিয়ে নিয়েছি; তোমার কৃপার জন্যে তোমাকে আমি কোনো সম্ভ্রম জানাইনি; এমন আচরণ করেছি যেন তুমি আমাকে সৃষ্টি করোনি।
৪। ঈশ্বরের সামনে আছড়ে পড়ো। নিজের দিকে তাকিয়ে বলো: হে আমার আত্মা, প্রভুই যে তোমার ঈশ্বর, সেকথা জেনে রাখো; তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন; নিজেকে তুমি আপনাআপনি সৃষ্টি করোনি। তোমার মধ্যে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান হয়েছে বলেই তুমি আজ তুমি হতে পেরেছ।
৫। আমি নিজে কিছু নই। সেজন্যে নিজেকে নিয়ে আমি আত্মপ্রসাদে আর মেতে উঠতে চাই না। নিজেকে আজ আমি বলছি, ছাইপাঁশ তুমি! কীসের জন্য তুমি গর্ব বোধ করো? তুমি সত্যিকারের বিশেষ কিছু ন‌ও; তাহলে নিজেকে তুমি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলো কেন? তাহলে নিজেকে বিনম্র করার জন্যে আজ নিজের কাছেই সংকল্প করো: আমি এই এই কাজ অবশ্যই করব; ধৈর্যের সঙ্গে এই এই অপমান সহ্য করব। জীবনধারার পরিবর্তন করব আমি, এখন থেকে অনুসরণ করব আমার সৃষ্টিকর্তাকে। যে সত্তা তিনি আমাকে দিয়েছেন, তারই জন্যে আমি তাঁর প্রশংসা করব। যেভাবে আমি শিক্ষালাভ করব, ঠিক সেইভাবে এই সত্তাকে সম্পূর্ণভাবে খাটিয়ে তাঁর সেবা করব; আর এ বিষয়ে আমার গুরুর কাছ থেকে উপদেশ নেব।

অল্প কথায় বলছি।
১। ধন্যবাদজ্ঞাপন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাও। হে আমার আত্মা, তোমার পরমেশ্বরের স্তুতি গাও; আমার মধ্যে যা-কিছু আছে, সবই যেন তাঁর পবিত্র নামের গান করে; কারণ, অসীম শূন্যতা থেকে দয়া করে তিনিই আমাকে উদ্ধার করেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন পরম করুণায়।
২। আহুতিদান। হে ঈশ্বর, তুমি আমাকে যে সত্তা দিয়েছ, তাকেই সর্বান্তঃকরণে তোমার কাছে আমি আহুতি দিচ্ছি। তোমার কাছে নিজেকে আমি সমর্পণ আর উৎসর্গ করছি।
৩। আবেদন। হে ঈশ্বর, এই সকল অনুরাগ আর সংকল্পে আমাকে তুমি শক্তি দাও। যাদের জন্যে আমার প্রার্থনা করা উচিত, তাদের সকলের সঙ্গে আমার পুণ্যগুলিকে তোমার করুণা লাভের জন্যে গ্রহণ করো।


ভাবনা: নয়-শো তিয়াত্তর
………………………………………………………

এক। মানুষ পাপের মোহ ত্যাগ করবে কেন? এর মুখ্য কারণ, পাপ যে আমাদের বিরাট একটা ক্ষতি করে, এই বিষয়ে দারুণ এক আতঙ্ক, যা থেকে আমাদের মনে একধরনের গভীর ও তীব্র অনুতাপ জাগে। অনুতাপ দুর্বল হলেও তা যদি সত্যিই খাঁটি হয়, বিশেষ করে, তা যদি পুণ্যসংস্কার গ্রহণের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তাহলে তা আমাদের পাপের হাত থেকে দৃশ্যমানভাবে রেহাই দেয়; তেমনি আবার অনুতাপ তীব্র আর গভীর হলে তা পাপ করার সমস্ত মোহ থেকে আমাদের মুক্ত করে।

ক্ষীণ আর দুর্বল ঘৃণা অথবা বিদ্বেষের ফলে যাকে আমরা ঘৃণা করি, তাকে আমরা অপছন্দ করে থাকি এবং তাকে আমরা এড়িয়েও চলি। কিন্তু তা যদি মারাত্মক আর দুর্ধর্ষ হয়, তাহলে যাকে আমরা ঘৃণা করি, তাকে যে আমরা কেবল এড়িয়ে চলি বা অপছন্দ করি, তা-ই নয়, তাকে দেখলেই ঘৃণায় আমাদের সমস্ত শরীর কুঁচকে ওঠে, তার বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের সংস্পর্শও আমরা সহ্য করতে পারি না। চাই কী, তার ছবি এবং জিনিসপত্রও আমাদের মনে গভীর ঘৃণা আর বিরক্তির উদ্রেক করে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, অনুতপ্ত মানুষ যখন তার পাপকে দুর্বল চিত্তে ঘৃণা করে, তখন আর পাপ করব না বলে সত্যি সত্যিই সে মনস্থ করে, কিন্তু পাপের জন্যে যখন তার অনুশোচনা প্রবল এবং তীব্র হয়ে ওঠে, তখন সে কেবল পাপকাজকেই ঘৃণা করে না, পাপ করার মোহকেও ঘৃণা করে, আর ঘৃণা করে পাপ থেকে যা-কিছুর উৎপত্তি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি, তার সব‌ই; এবং মানুষকে পাপের পথে টেনে নিয়ে যায় যা, তার‌ও সব‌ই। সেজন্যেই বলছি, যত বেশি অনুতাপ-অনুশোচনা করতে পারা যায়, ততই ভালো; তাহলে পাপের সঙ্গে যা-কিছু জড়িত আছে, সে-সব কিছুকেই, তা যত সামান্যই হোক না কেন, ঘৃণা করা যায় সহজেই।

দেখা যায়, মনপরিবর্তনের সময়, মহাত্মাগণ, পাপের প্রতি তাঁদের মোহ আর তাতে যে-সব আনন্দ পেতেন, সেগুলিকে এমনভাবে ছেড়ে দেন যে, সেগুলির কথা আর তাঁদের মনে কখনও পড়ে না। জোরগলায় তাঁরা ঘোষণা করেন, তাঁরা কেবল পাপকেই ঘৃণা করেন না; ঘৃণা করেন যা-কিছু পাপের পথে আমাদের টেনে নিয়ে যায়, সে-সব কিছুকেও। এরই মধ্যে মন পায় নিত্যনতুন যৌবন, ঠিক বাজপাখির মতো।

দুই। ক্যান, ক্যান মাইনষের মাত্র ষাইট-সত্তর বৎসর আয়ু থাকব? টানা এক-শো বছর লাগব খালি সবুজ ঘাসে হাত-পা ছড়াইয়া দিয়া শুইয়া হাঁ কইরা আকাশ দেখতেই!

আম্মার কোলের উপর মাথা রাইখা চুপ কইরা শুইয়া থাকতেও তো মানুষের চার-শো ষাইট বৎসরও কম হইয়া যায়!

ক্যান, মানুষের এত কম আয়ু থাকব ক্যান?

পছন্দের মানুষটা হাসলে কেমন লাগে, তা দেখনের লাইগা একটানা তাকায়া থাকার জ‌ইন্যেও তো মানুষের কমসে-কম নব্বই বছর লাগেই!

মাঝরাইতে চান্দের আলোয় ভিইজা তিন হাজার বৎসরের পুরানা জীবনের কাহিনি মনে করতেও তো মানুষের আটাইশ কোটি বৎসর লাগে!

ক্যান খোদা, মাইনষেরে ক্যান এত কম আয়ু দিয়া দুনিয়ায় পাঠাইলা? আইজ জন্মাইলেই তো দেখি, কাইল দরজায় মৃত্যু আইসা হাত ধইরা টাইনা নিয়া কয়, "অনেক বাঁচছস, এবার ল চল, তোর ট্রেন চইলা আইছে।"

আইজ হঠাৎ ক‌ইরা আমার হাজার কোটি বৎসর বাঁচতে মন চাইতেসে ক্যান, খোদা? মানুষ তো শুনসি চ‌ইলা যাবার আগে এমন ক‌ইরা থাকতে চায়। আমিও কি তাইলে...

তিন। আমি সেসব মানুষকে কখনোই ক্ষমা করতে পারি না, যাদের কাছে অন্যের বিষণ্ণতা স্রেফ একটা ন্যাকামো। ওদের আমি খুনি বলি।

মাঝে মাঝে আমার ভীষণ ক্লান্ত লাগে। খুব অকারণে, খুব অপ্রয়োজনে। তখন মনে হয়, আমি সুখীও ন‌ই, দুঃখীও ন‌ই; আমি শুধুই ক্লান্ত।

আমি হন্যে হয়ে পালাতে চাই সব কিছু থেকে... যেখানে আছি, যার কাছে আছি, যে অবস্থানে আছি, তার সব কিছু থেকেই। পালাতে পারলে বেঁচে যেতাম। আর কার‌ও সাথে নয়, আমি আমার হাত ধরে পালাতে চাই।

আমি জানি না, আমি কোথায় যেতে চাই। আমি শুধু জানি, আমি এখানে থাকতে চাই না।

আমি হন্যে হয়ে নিজের কাছে মুক্তি খুঁজি। আকাশের দিকে দু-হাত মেলে ধরে চিৎকার করে বলি, বাঁচতে আমার বড্ড ক্লান্ত লাগছে!

চার। যেইদিন থেইকা জীবনটারে সিরিয়াসলি নেওয়া ছাইড়া দিসি, সেইদিন থেইকা আমার সুখ ফিইরা আসছে।

যেইদিন থেইকা ভাবতে শুরু করসি, দুনিয়ার কেউই আমার কিছুই হয় না, সেইদিন থেইকা আমার রাতে ভালো ঘুম হয়।

যেইদিন থেইকা ক্যারিয়ার নিয়া ভাবাভাবি বাদ দিসি, সেইদিন থেইকা আমার নিজেরে পাখির মতন হালকা লাগা শুরু হইসে।

এখন ভাবি, হায়রে! দম বন্ধ ক‌ইরা দম-বন্ধ-করা স্টাইলে দৌড়াইয়া কী এমন ঘোড়ার ডিমের লাভ হ‌ইসে আমার?

এখন আমি কারও কেউ হই না, দুনিয়ার কেউও আমার কেউ হয় না। যার যেমনে খুশি মরুক গা!

দিনকাল দেখি ভালোই কাটতেসে।

ম্যালা দিন বাঁচব ব‌ইলা দেখা সুখের স্বপন একদিন ফুরাইয়া আসে। সেইদিন‌ই কেবল সত্যি সত্যি বাঁচা যায়।

পাঁচ। খুব প্রিয় একজন মানুষকে আমি 'ব্যাঙাচি' নামে ডাকি।

জ্ঞানে, গুণে এবং মাধুর্যে মানুষটা ঠিক জাদুকরের মতন। আমি শেষ কবে এতটা মুগ্ধতা নিয়ে কাউকে অন্য নামে ডেকেছি মনে নেই।

ইনবক্সে রাশি রাশি মেসেজের ভিড়ে আমি কেবলই আমার ব্যাঙাচির মেসেজটা সবার আগে খুঁজি। সকাল, দুপুর বা রাত, সে যা-ই হোক না কেন, আমি চোখ মেলেই খুঁজি 'ব্যাঙাচি' নাম থেকে কোনো মেসেজ এসেছে কি না। চোখের সামনে সে এলে আমার ভালো লাগে।

এই যে হুটহাট, হঠাৎ করেই কারও প্রতি এমন আশ্চর্য মায়া জন্মে যায়, এই যে অকারণে খুব অপ্রয়োজনে কারও প্রতি একরাশ মুগ্ধতা জমে যায়, এর নাম কি প্রেমে পড়ে যাওয়া, না কি এ কেবলই মোহ? প্রেম ও মোহের মাঝখানে সরু একটা পর্দা আছে, যার নাম মায়া।

একটা মানুষ কেন এতটা স্নেহশীল, মমতাময় হবে? কেন কেউ-না-হওয়া একটা মানুষ হঠাৎ করে অনেক কিছু হয়ে যায়? কেন জীবনের মানুষটা যাপনের মানুষ হয় না?

ছয়। লোকে বলে, জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা।

বুঝি সবই, তবু মানতে ইচ্ছে করে না। কেন এই হতচ্ছাড়া অদৃষ্টে এমন সুন্দর জীবন দু-বার মিলবে না? এত অল্প সময়ে এত স্বপ্ন তবে কখন ছোঁব?

ছোট্ট একটা পিঁপড়ের মতন ছোট্ট একটা জীবন, কতটুকুই-বা ইচ্ছে পূরণ হয় আদৌ? বুঝতে আরম্ভ করলেই তো দেখি, সব শেষ!

আমার যে গোটা এক-শো বছর আকাশ দেখেই কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। আকাশ দেখার সাধটুকুও একজীবনে মেটে না! প্রিয় মানুষটির উচ্ছলতায় কিংবা বিষণ্নতায় ভরা চোখদুটোর দিকে দু-শো বছর তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আমাদের সব আছে, তবু প্রিয় মানুষটিকে হাসতে এবং কাঁদতে দেখার সময় নেই।

হাজার বছর ধরে মাকে বুকের ভেতরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করেই হারিয়ে যাই এমন কোথাও, যেখানে বিষাদেরা আমায় খুঁজে পাবে না, আর আমিও সেখান থেকে ঘরে ফেরার পথ খুঁজে পাবো না।

কেন জিন্দেগি দু-বার মিলবে না, খোদা? কেন? আমার যে কত কিছুই দেখা বাকি থেকে গেল...

সাত। অন্ধদের দেশে এক লোক আয়না বিক্রি করতে গিয়েছিল। তখন অন্ধরা সবাই মিলে ওই লোকের চোখ নষ্ট করে দিল। এর পেছনে ওদের অকাট্য যুক্তি ছিল: আমাদের দলে ঢুকে গেলেই তো বেচারাকে আর কষ্ট করে আয়না বেচতে হবে না।
 
অনেক পাখিকে দেখবেন, জলে ডুবে মরার হাত থেকে মাছেদের ওরা বাঁচিয়ে দেয়। সহমর্মিতা অনেক বড়ো একটা গুণ।
 
পাখিদের কিন্তু কোনও দোষ নেই। ওরা তো কখনও জলে থেকে দেখেনি, তাই ওরা ভাবে, এক বাতাসের সমুদ্র বাদে আর কিছুই বাঁচার উপযোগী নয়। ওরা চায়, মাছেরাও ওদের মতো করে বাঁচুক। বাতাসে নিয়ে এলেই ওরা ভালোভাবে বাঁচতে পারবে। মাছেরা খুব চেষ্টা করেও পাখিদের বোঝাতে পারছে না যে, বাতাসে যেমনি বাঁচা যায়, ঠিক তেমনি জলেও বাঁচা যায়। পাখিরা ভাবছে, বাতাস না পেলেও বাঁচা কীভাবে সম্ভব? ওদিকে মাছেদের রাজ্যটা এত বড়ো এত বড়ো যে, পাখিদের রাজ্য নিয়ে ভাবার সময়‌ই ওদের নেই, কেননা ওরা নিজের রাজ্য নিয়েই সুখে আছে। মাছেরা পাখিদের রাজ্যে থেকে না দেখলেও পাখিদের ধরে টেনে জলের রাজ্যে নিয়ে আসার চেষ্টাও করে না, কেননা ওদের বাঁচার জন্য পাখিদের লাগে না। মাছেরা অবশ্য মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে, একদিন পাখিরাও জলের মাছেদের বাতাসে টানাটানি না করেই বাঁচতে শিখে যাবে।