ঈশ্বরসুধা (ভাগ: ১)

ধর্মের উপাদান দুইটি; এক, ঈশ্বরপ্রীতি; দুই, লোকপ্রীতি। প্রথমটি ভক্তি, দ্বিতীয়টি সাধুতা। এই দুই শব্দে পার্থক্য থাকলেও এদের বিকাশের পথ মোটামুটি একই। লোকের আচারআচরণে ভক্তি ও সাধুতা প্রায় একইসাথে বিকশিত ও প্রকাশিত হয়ে থাকে। ভক্তির শেষ যেখানে, সেখানেই সাধুতার শুরু; আবার সাধুতার শেষ যেখানে, সেখানেই ভক্তির শুরু। এই দুইয়ের সীমাভেদ করা বড়ো শক্ত। তবে এদের মূলের দিকে তাকালে কিছু পার্থক্য চোখে পড়ে; বাহ্যিকতার বিচারে যদিও তা খুব নগণ্য।




আমাদের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলির বাইরে মনের উচ্চতর স্তরে যা আছে, তার নাম আত্মা। মানুষের সব ধরনের অতীন্দ্রিয় বৃত্তি আত্মার একেকটি উপাদান। এই বৃত্তিগুলিকে চার ভাগে ভাগ করা যায়: এক, বুদ্ধিবৃত্তি; যার সাহায্যে মানুষ সত্যাসত্য নির্ধারণ করে এবং সৌন্দর্যের চেতনা জাগানোর শক্তি পায়। দুই, বিবেক; যার মাধ্যমে মানুষ ন্যায় ও মঙ্গলের বোধ সম্পর্কিত জ্ঞানলাভ করে। তিন, হৃদয়; যা আছে বলেই মানুষ আনন্দ ও সুখের অনুভূতি বুঝতে পারে। চার, আত্মা; যার দ্বারা মানুষ ঈশ্বরজ্ঞান তথা পরমাত্মাজ্ঞান তথা ব্রহ্মজ্ঞান অর্জন করে এবং নিজের চৈতন্যকে জাগ্রত করে ঈশ্বরের সাথে নিজের সংযোগ উপলব্ধি করতে পারে।




মানুষের বৈশিষ্ট্য পরিপূর্ণভাবে লাভ করা, অর্থাৎ শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ও ইন্দ্রিয় এবং আত্মার সকল বৃত্তি ও শক্তিকে যথাযথভাবে পরিচালিত করে তাদের বিকশিত করা এবং শিক্ষালাভ ও আনন্দ উপভোগ করার জন্য তাদের তৈরি করা; একইসাথে, ব্যক্তিগত বিষয়গুলিকে সর্বজনীনতার মাত্রাপ্রদান এবং সাময়িক অনুষঙ্গের মধ্যে চিরন্তন সত্যের স্থাপন—পৃথিবীতে মানুষের প্রধান কর্তব্য এটাই। এখন কথা হচ্ছে, মানুষ হয়ে ওঠার সময়টাতে ভগবদ্‌ভক্তি বা ঈশ্বরভক্তিকে আমরা কোথায় রাখব? প্রকৃত বিচারে মানুষ হতে চাইলে ভক্তি সেখানে কী ভূমিকা রাখতে পারে?




ঈশ্বরে বিশ্বাস তথা নিজের আত্মার উদ্‌বোধনে বিশ্বাস, অর্থাৎ ভগবদ্‌ভক্তি মানুষের সব ধরনের উৎকর্ষের ভিত্তিভূমি। এই উৎকর্ষের মধ্য দিয়েই মানুষ তার নিজস্ব প্রবৃত্তি অনুযায়ী আত্মার বিশ্বজনীনতা ও অনন্তের দিকে ঝোঁক প্রকাশ করে। স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষের মনের যেমন গতিপ্রকৃতি, মূলত তা-ই নির্ধারণ করে দেয়, মানুষ কী করে বা কী করতে চায়। এর কারণ হচ্ছে, মানুষ সবসময়ই অসীমকে সসীমের মধ্যে, অখণ্ডকে খণ্ডের মধ্যে এবং পরমকে আপেক্ষিকের মধ্যে এনে বা কল্পনা করে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। কোনো একটা কাজ কেন হচ্ছে এবং কীভাবে হচ্ছে, তা জানতে না পারলে কাজটা ঠিকভাবে করা সম্ভব নয়। খুব গভীরে যেতে না পারলেও অগভীর জ্ঞান দিয়েই কাজ শুরু করতে হয়। মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাইলে এটুকু বোঝা জরুরি।




ধরা যাক, এক লোক গাছ কাটছে। আমরা তা চোখে দেখতে পাচ্ছি। কুঠারের ক্রমাগত আঘাতের ফলে একসময় গাছটা কেটে মাটিতে পড়ে গেল। আমরা কেবল এইটুকু বলতে পারব যে, কুঠারের আঘাতের ফলে গাছটি কেটে গেছে, কিন্তু আঘাতের সংখ্যা ও প্রকৃতি নিয়ে কিছু বলা আমাদের সাধ্যের বাইরে। সৌন্দর্য কী? আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী যা সুন্দর, তা কি অন্য দেশের বা কালের সাথে মিলে যায়? সৌন্দর্যের বিশ্বজনীন জ্ঞান না থাকলে কি সৌন্দর্য নিয়ে আদৌ কোনো মতামত দেওয়া সমীচীন? চোখের সামনে একটা পোশাক দেখতে পেলাম। পোশাকের রং, কাপড়ের মান, সুতার বুনন সব‌ই দেখলাম। কিন্তু পোশাকটা আদর্শ মানের কি না, তা নিয়ে কথা বলা বা মতামত দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য বিশেষজ্ঞ দরকার।




সত্য, ন্যায় এবং পবিত্রতার সর্বজনীন আদর্শ নিয়ে যদি আমরা না জানি, তবে সত্য কথা ও মিথ্যা কথা, ন্যায় ও অন্যায়, বিশ্বস্ততা ও বিশ্বাসঘাতকতা, সততা ও শঠতা, এসবের ভেদাভেদ উপলব্ধি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষের যা যা বৈশিষ্ট্য, সেগুলি বুঝতে হবে সবার আগে। যেখানে মানুষ আছে, সেখানেই এই সকল বৈশিষ্ট্য বা গুণ স্বীকৃতি পায়। সব দেশে, সব কালে, সব মানুষে যা-কিছু আদরণীয়, তা-ই মূলত যে-কোনো ব্যক্তি, সময় বা অঞ্চল দ্বারা প্রকাশিত ও প্রচারিত জ্ঞানের ভিত্তিমূল। তাই সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, অন্তত ঈশ্বরকে নিজের চৈতন্যে অধিষ্ঠিত করাই মানুষের প্রধান লক্ষ্য, কেননা এই কাজটি করতে পারলে মানুষ হিসেবে অর্জনযোগ্য সকল উৎকর্ষ‌ই অর্জন করা হয়ে যায়।




মানুষের বুদ্ধি, বিবেক, হৃদয় ও আত্মা—এই চারটি বৃত্তি নিয়ে আলোচনা করলে উপরের কথাগুলির সত্যতা বোঝা যাবে।




বুদ্ধি কী? বুদ্ধি হচ্ছে তা, যা ঈশ্বরকে সত্যরূপে দেখায়। মানুষের চৈতন্যের জাগরণ হয় কেবল সত্যতেই। ঈশ্বরকে তুষ্ট করার অর্থ তাই বুদ্ধিতে নিজের চৈতন্যকে জাগিয়ে নিজেকেই তুষ্ট করা, অর্থাৎ সত্যকে নিয়ে পথ চলা। যে-সত্য আমার অপ্রিয়, তা-ও মেনে নেওয়া; যে-সত্য আমার কাল বা স্থান বা অভিজ্ঞতার বিপরীতে, তা-ও মেনে নেওয়া; যা সত্য, তা সত্য বলেই, ইচ্ছে থাক না থাক, তবু মেনে নেওয়া—এটাই বুদ্ধির একমাত্র পরিচায়ক। অসীমকে সসীমে বিশ্বাস করে অসীম সত্যের সন্ধান পাওয়া, এতেই বুদ্ধির প্রকৃত সুখ নিহিত। বলা বাহুল্য, এই অসীম অনন্ত সত্য‌ই মানুষের বুদ্ধির চিরন্তন গতি এবং পরম লক্ষ্য।




সত্যের সমাদর করতে জানে না যে, তার মানসিক উৎকর্ষ সাধিত হয়নি বুঝতে হবে। যে-সত্য সকল কাল, সকল দেশ, সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য, তার উপলব্ধি খুব জরুরি। এটা না থাকলে বিশেষ কোনো সত্যের প্রতি উদারতা ও সহিষ্ণুতা দেখানো সম্ভব নয়। যারা এটি দেখাতে পারে না, তাদের বুদ্ধির বিকাশে সমস্যা আছে, তারা নিতান্তই নির্বোধ।




সত্যকে ভালোবাসা ও গ্রহণ করতে জানা, এটাই ভক্তির প্রথম ধাপ। সকল ধরনের সত্যের প্রতি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকেই গাঢ় ভক্তির জন্ম হয়। তাই, ভক্তিই সকল ধরনের বুদ্ধিগত উৎকর্ষের ভিত্তিভূমি। শিল্পে, বিজ্ঞানে, সাহিত্যে এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, যেখানে সত্যের অপরিহার্যতা প্রতিষ্ঠিত, সেখানেই ভক্তির প্রাধান্য স্পষ্ট। তবে ভক্তিকে জীবন থেকে দূরে রেখেও নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বেছে বেছে কাজের সত্যের দ্বারস্থ হ‌ওয়া যায় যদিও, তবু সত্যকে আংশিকভাবে গ্রহণ করা এবং সত্যকে সামগ্রিকভাবে মেনে নেওয়া—এই দুইয়ের ফলাফলের মধ্যে অনেক দূরত্ব।




এমন মানুষ হরহামেশাই দেখা যায়, যারা সত্যের সুবিধাটুকুকে গ্রহণ করতে রাজি, কিন্তু সত্যের কঠোর দিকগুলিকে কৌশলে এড়িয়ে চলে। ওরা সত্যকে সবসময়ই নিজের পক্ষে পেতে চায়, কিন্তু নিজেরা ভুল করেও সত্যের পক্ষে যেতে চায় না। যে-সত্য তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষা করে না, সেই সত্য তাদের কাছে মূল্যহীন। এমন মানুষ বন্ধুর বাৎসল্য ও আন্তরিকতা গ্রহণ করে বটে, কিন্তু বন্ধু বিপন্ন হলে বন্ধুকে ছেড়ে চলে যায় এবং কৌশলে নিজেকে সুরক্ষিত রেখে দেয়। সুদিনে জ্ঞানী ও সৎ হ‌ওয়া সহজ, দুর্দিনে সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারাই প্রকৃত মানুষের কাজ।




বিবেক কী? বিবেক তা-ই, যা ঈশ্বরকে ন্যায় ও মঙ্গল হিসেবে অনুধ্যান করে। যেখানে ন্যায় ও মঙ্গল নেই, সেখানে বিবেক নেই। ঈশ্বরকে বিবেক দিয়ে খুশি করার অর্থই হলো, ন্যায় ও মঙ্গলের মধ্যে ঈশ্বরের প্রকাশকে গ্রহণ করা। যে ন্যায্য বা মঙ্গলকর বিষয়টি আমার পক্ষে, কেবল সেটিকেই গ্রহণ করলাম, কেননা এতে আমার বেশি সুবিধা, এর নাম বিবেক নয়, বরং কোনো ধরনের পক্ষপাতিত্ব ছাড়া স্বার্থশূন্য হয়ে সকল প্রকারের ন্যায্য ও মঙ্গলকর বিষয়কে সকল সময়ে ও পরিস্থিতিতে, সেটি ন্যায্য ও মঙ্গলকর বলেই গ্রহণ করার গুণটি বিবেক। ন্যায় ও মঙ্গলভাব সবসময়ই বিবেকের কাছে খুব আদরের ও আনন্দের। পৃথিবীতে যা-কিছু পরিবর্তনশীল ও অনিত্য, সেগুলির মধ্যেও আমরা অপরিবর্তনীয় চিরসত্য ও মঙ্গলের আভাস দেখি। এই ধ্রুব নিত্য মঙ্গলই বিবেকের চিরন্তন গতি ও লক্ষ্য।




ন্যায় ও মঙ্গলকে গ্রহণ করা নৈতিক উৎকর্ষের প্রধান লক্ষণ। কিন্তু সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়, যে ন্যায় ও মঙ্গল সকলের জন্যই প্রযোজ্য, তার প্রতি আন্তরিক প্রীতি প্রাণে ধারণ না করলে বিশেষ কোনো ন্যায্য ও মঙ্গলকর কাজের প্রতি আন্তরিক প্রীতি কখনোই জন্মাতে পারে না। সত্যিকার অর্থে নৈতিক বিষয় বলতে যা বোঝায়, তা যদি বিশেষ কোনো পরিস্থিতিনির্ভর কিংবা ব্যক্তিগত‌ও হয়, তাতেও সবসময় সর্বজন- ও সর্বকালস্বীকৃত নৈতিকতার মানদণ্ড স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়।




ন্যায় ও মঙ্গলপ্রিয়তাতেই ভক্তির নৈতিক প্রকাশ দেখা যায়। ব্যক্তিগত নয়, বরং সকল প্রকারের ন্যায় ও মঙ্গলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সেগুলিকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়েই মানুষের বিবেকে ভক্তি প্রকাশিত হয়। এই ভক্তিই সব ধরনের নৈতিক উৎকর্ষের ভিত্তিভূমি। সত্যিকারের ভক্তিকে এড়িয়ে যাবার মাধ্যমে আমরা আমাদের কাজে লাগে বলেই বিশেষ স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিশেষ কোনো ন্যায় ও মঙ্গলকে অবলম্বন করতে পারি, এটা সত্য; কিন্তু ওরকম অবস্থায় আমরা প্রকৃতপক্ষে ন্যায় ও মঙ্গলকে হৃদয়ে ধারণ করি না, বরং আমাদের নিজের সুবিধার জন্যই সুবিধামতো ন্যায় ও মঙ্গলকে গ্রহণ করি।




সহজ করে বলা যাক। আপনার যে-বন্ধুটি ভবিষ্যতে আপনার ক্ষতি করবে, সেই বন্ধুটি বর্তমানে আপনার অনুগত হয়ে থাকবে এবং আপনার সকল ধরনের সুবিধার জন্য তার জীবনপ্রাণ যেন উৎসর্গ করে দেবে! তাকে দেখে আপনার মনে হবে, "এর চাইতে ভালো বন্ধু আমি এ জীবনে কখনও পাইনি। আমার এই বন্ধুটি আমার জীবনের জন্য সবচাইতে বড়ো আশীর্বাদ।" অথচ একদিন দেখবেন, এই বন্ধুটি আপনার অন্ধবিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে আপনার সবচাইতে বড়ো ক্ষতিটি করে বসেছে; এমনকি, অনেকসময় নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য কিংবা নিজে বাঁচার জন্য আপনার জীবনকে বিপন্ন‌ও করে দিতে পারে। সে নিজের সুবিধার জন্যই আপনার মঙ্গল করার মধ্য দিয়ে কৌশলে আপনার বিশ্বাস অর্জন করেছিল।