ভক্তিতেই শক্তি

ইহুদিদের যারা প্রতিশ্রুত দেশে যেতে নিরুৎসাহিত করেছিল, তারা এই কথা রটিয়ে দিয়েছিল যে, সে-দেশ তার বাসিন্দাদের গ্রাস করে ফেলে; অর্থাৎ, সেখানকার আবহাওয়া এতই অস্বাস্থ্যকর যে সেখানে বেশিদিন বেঁচেবর্তে থাকা অসম্ভব; আর সেখানকার অধিবাসীরা এমনই রাক্ষস যে তারা পঙ্গপালের মতো অন্য মানুষদের খেয়ে ফেলে। এ সব‌ই ছিল পুরোপুরি মিথ্যে রটনা।




আমাদের পৃথিবীটাও ঠিক এই রকম। পবিত্র ভক্তিকে এখানকার মানুষেরা যথাসাধ্য দূর-ছাই করে; সাত্ত্বিকদের এরা প্রচার করে খিটখিটে, বিষণ্ন, আর ক্রুদ্ধ স্বভাবের মানুষ হিসাবে। পার্থিব জগৎ বলে বেড়ায়, ভক্তিযোগ এমন একটি সাধনা, যা মানুষের মেজাজকে খারাপ আর তিরিক্ষি করে তোলে। পার্থিব জগৎ দেখে যে ভক্তিমান মানুষেরা উপবাস করে, প্রার্থনা করে, এবং সমস্ত রকম অপমান-লাঞ্ছনাকে ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করে, রোগীদের সেবা করে, দরিদ্রদের দান করে, রাত জাগে, নিজেদের ক্রোধকে সংযত করে, নিজেদের আবেগ-উচ্ছ্বাসকে দমন করে, লালসা ত্যাগ করে, এবং এমন সব কাজ করে, কাজ হিসাবে যেগুলি বেশ কঠিন আর শ্রমসাধ্য; কিন্তু তাদের অন্তরে যে হৃদ্যতাপূর্ণ ভক্তি রয়েছে, যার ফলে এইসব কাজ মনোরম, মধুর আর সহজ হয়ে দাঁড়ায়, তাকে পৃথিবীর মানুষেরা দেখেও দেখে না।




নিমগাছের ওপরে বসে-থাকা মৌমাছিগুলির দিকে তাকিয়ে দেখো; সেখানে যে রস তারা পায়, তা খুবই তেতো; কিন্তু তাকেই শুষে নিয়ে তারা তাকে পরিণত করে মধুতে; কারণ তেতোকে মিষ্টি করাই তাদের স্বভাব। এ কথা সত্যি যে রিপুদমন করার অভ্যাসে ভক্তিবান মানুষকে অনেক তিক্ততার স্বাদ গ্রহণ করতে হয়; কিন্তু সেই কাজে তাদের সে পরিণত করে মধুর আর পরম আনন্দরসে।




ভক্তিমান বলেই শহিদের কাছে আগুন, শিখা, চাকা আর তলোয়ার ফুল আর সুগন্ধিদ্রব্য বলে মনে হয়। ভক্তি যদি সবচেয়ে নিষ্ঠুর যন্ত্রণা, এমনকি মৃত্যুকেও পর্যন্ত মধুর করে তুলতে পারে, তাহলে সৎকাজ করার জন্যে তা আরও কত কী-ইনা করবে!




কাঁচা ফলে চিনি মেশালে তা মিষ্টি হয়, আর যেসব ফল পুরোপুরি পেকে গিয়েছে, তাদের টকো আর ক্ষতিকর ভাবটাকে কাটিয়ে তুলতে সাহায্য করে চিনি। এখন ভক্তিই হচ্ছে মনের সত্যিকার চিনি, যা রিপুদমনের সমস্ত তিক্ততা এবং রিপুর আনন্দের মোহে আমাদের যে ক্ষতি হতে পারে, তাকে নষ্ট করে, দূর করে দরিদ্রদের অশান্তি আর ধনীদের উৎকণ্ঠা, নষ্ট করে নিগৃহীতদের দুঃখ আর অনুগৃহীতদের ঔদ্ধত্যকে; নিঃসঙ্গকে মুক্ত করে বিষণ্ণতা থেকে, বন্ধুবান্ধবদের আড্ডায় যারা ঘুরে বেড়ায়, তাদের বাঁচায় বয়ে যাবার হাত থেকে। শীতকালে তা আগুনের কাজ করে, আর গরমে শিশিরের। কী করে প্রাচুর্য আর অনটন দুটিকেই সমানভাবে গ্রহণ করতে হয়, তা সে জানে। সম্মান আর অসম্মানকে তা একই রকমের লাভজনক করে তোলে, সুখ আর দুঃখকে প্রায় সবসময় একইভাবে গ্রহণ করে; ফলে আমাদের অন্তর ভরে ওঠে পরমানন্দে।




সিঁড়ির যে দুটো ধারের মাঝখান দিয়ে মানুষ ওঠে, আর যেগুলির সঙ্গে ধাপগুলো আঁটা থাকে, সেগুলি আমাদের প্রার্থনার, যা পুণ্য সংস্কারের প্রতীক। এই প্রার্থনা ঐশী প্রেম লাভ করে, আর এই পুণ্য সংস্কারগুলি সেই ভালোবাসা মানুষদের দান করে। আর সিঁড়ির ওই ধাপগুলি বিভিন্ন মাপের প্রেম-ভালোবাসার চিহ্ন হিসাবে কাজ করে; এরই ভেতর দিয়ে মানুষে এক পুণ্য থেকে আর-এক পুণ্যের দিকে ওঠা-নামা করে, প্রতিবেশীদের সাহায্য অথবা উদ্ধার করার জন্যে হয় সে নেমে আসে, অথবা ঈশ্বরের সঙ্গে প্রেমের বন্ধনে নিজেকে বাঁধার জন্যে ধ্যানের মধ্য দিয়ে সে ওপরে ওঠে।




যারা সিড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, তারা মানুষ হলেও অন্তর তাদের দেবদূতের মতো; মানবশরীরে তারা দেবদূত। তাদের হয়তো যৌবন অতিবাহিত হয়েছে, যদিও তারা প্রাণশক্তি আর আধ্যাত্মিক ক্ষিপ্রতায় ভরপুর বলে যুবক বলেই তাদের মনে হয়। ওড়ার জন্যে তাদের ডানা আছে, পবিত্র ধ্যানপ্রার্থনার মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরের দিকে তারা উড়ে যায়; কিন্তু পবিত্র আর অমায়িক মেলামেশার মাধ্যমে মানুষের পাশাপাশি হাঁটার জন্যে তাদের পা-ও আছে। তাদের মুখ সুন্দর আর প্রফুল্ল; কারণ মাধুর্য আর আনন্দের সঙ্গেই সবকিছু তারা গ্রহণ করে।




তাদের হাত-পা আর মাথা খোলা থাকে; কারণ ভগবানকে সন্তুষ্ট করা ছাড়া তাদের চিন্তা-ভাবনা, কাজকর্ম বা উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্য কোনো মতলব বা ইচ্ছা থাকে না। তাদের দেহের বাকি অংশটুকু থাকে ঢাকা; কিন্তু বেশ সুন্দর আর হালকা পোশাক দিয়ে। এর কারণ, তারা এই পৃথিবী, আর পার্থিব বস্তুগুলিকে ব্যবহার করে সত্যি কথা, কিন্তু এমনভাবে ব্যবহার করে, যা একেবারে পবিত্র এবং আন্তরিক। নিজেদের জীবনধারণের জন্যে যতটুকু প্রয়োজন, কেবল সেইটুকুই তারা গ্রহণ করে। ভক্তিশীল মানুষেরা এই প্রকৃতির।




ভক্তি সব চেয়ে মধুর, সকল গুণের রানি; কারণ প্রেমের চরম প্রকাশ এইখানেই। ভালোবাসা যদি দুধ হয়, ভক্তি তার সর; ভালোবাসা যদি গাছ হয়, ভক্তি তার ফুল; ভালোবাসা যদি কোনো মূল্যবান পাথর হয়, ভক্তি তার দ্যুতি; ভালোবাসা যদি মূল্যবান কোনো পারফিউম হয়, ভক্তি তার সুগন্ধ; হ্যাঁ, সেইরকম সুগন্ধ, মানুষকে যা সান্ত্বনা দেয়, দেবদূতেদের মনে জোগায় উল্লাস।