কৃপাস্রোতে ভেসে যাবার কালে

বেশি আলোর মধ্যে, বহু বিচিত্রতার মধ্যে তোমাকে হারিয়ে ফেলি, তাই তোমাকে খুঁজে ধরবার জন্যে অন্ধকারে যাই, নির্জনে যাই। সেখানে তোমাকে অন্ধকারের জ্ঞাতারূপে ধরি। সেখানে তোমার সঙ্গে একত্ব অনুভব করি। সেই একত্বের মধ্যেও ভেদ দেখিয়ে দাও।




আমাকে তো সবই ভুলিয়ে দাও, কিন্তু তুমি কিছুই ভোলো না। অল্প অল্প করে সবই স্মরণ করাতে থাকো। তোমার সঙ্গে আমার ভেদ এখানে স্পষ্ট দেখি। ভোলাতেই তো দেখি আমার বিশেষত্ব। না ভোলাতে, স্মরণ করিয়ে দেওয়াতে তোমার বিশেষত্ব।




যখন সব ভুলে যাই, তখন আমার বিশেষত্ব আর কী থাকে? আমি তো তখন কিছুই জানি না। তোমার থেকে ভিন্ন আমি তখন কোথায়? আমার কাছে তার কিছুই থাকে না। কিন্তু তোমার কাছে সবই থাকে। থাকে বলেই জানি, থাকে বলেই তুমি জানাও। এই নিদ্রা-জাগরণ, স্মৃতি-বিস্মৃতি, জ্ঞান-অজ্ঞান ক্রমাগত চলছে। আমার সঙ্গে তোমার এই নিত্যলীলা। এই লীলা তোমার স্বভাব। এই লীলা তোমার প্রেম। এই লীলাতেই তুমি মা, আমি ছেলে।




এই অদ্ভুত লীলা আর কোথাও দেখি না। মানুষে মানুষে দেখি না। কোনো মানুষ আমার অত ভেতরে আসে না, আমাকে এমন করে কবলিত, আত্মসাৎ করে না। আমার সর্বস্ব এমন করে হরণ করে না, এমন করে ফিরিয়েও দেয় না। তাই মানুষের ভালোবাসায় আর তৃপ্তি পাই না।




মানুষের প্রেম থেকে তোমার সঙ্গে প্রেমসাধনের বিশেষ কিছু সহায়তাও পাই না। এই দুইয়ের সাদৃশ্য আমার কাছে বড়োই কমে গেছে৷ অথচ তুমি এই যে আমার সঙ্গে প্রেমলীলার ছবি দেখাচ্ছ, গভীর নিগূঢ় প্রেমের দাবি বসাচ্ছ, আমি সেই ছবি ধরে রাখতে পারছি না, সেই দাবিও প্রাণভরে স্বীকার করতে পারছি না।




তুমি আমাকে সময়ে সময়ে যে ক্ষণিক অনুভূতি দিচ্ছ, এই কাল গভীর নিশীথে যা দিলে, তাতে দেখাচ্ছ যে, তোমার সঙ্গে আমার এমন নিগূঢ় মধুর সম্বন্ধ হওয়া সম্ভব, যা মানুষে মানুষে কখনও হয়নি, হতেও পারে না। কী সে দর্শন! কী সে স্পর্শন! কী সে হৃদয়ের মিশ্রণ! আমি তো কোনো কবিতায়, কোনো উপন্যাসে তা পড়িনি। সে তো আমার কল্পনা নয়। তুমি সাক্ষাৎভাবে প্রকাশিত ও অনুভূত হয়ে তা দেখাও। কাজেই আমি তার সম্বন্ধটা ছাড়তে পারছি না।




আমার জীবনে এই মিলনলাভের বাধা যেন ক্রমশই বাড়ছে। তাতে নিরাশাও বাড়ছে। কিন্তু তোমার দাবি তো কমছে না, দাবি তো বেড়েই চলছে। তোমার দাবি বাড়াতে মনে হচ্ছে মিলন, স্থায়ী মিলন নিকটে আছে। বাধা কে দেয় বুঝতে পারছি না। আমি তোমায় চাই, তুমি আমায় চাও, বাধা দেয় কে?




এখন বাধা কোথায়? এ-ই তো তোমার আমার মিলন, অচ্ছেদ্য মিলন। অমিলন তো কেবলই কল্পনা। এই কল্পনা আমি মনে স্থান দেবো না। তুমি কৃপা করে এই কল্পনা থেকে আমাকে রক্ষে কর। আমার প্রাণকে কেড়ে নাও, মনকে স্থির করো, তোমার কৃপাস্রোত আমার জীবনে অবিশ্রান্ত প্রবাহিত হোক।