জ্ঞেয় ও জ্ঞাতার মিলন

এই তুমিই আত্মা। তোমাকে আত্মারূপে জানছি। জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় দুই-ই তুমি। দুয়ে এক, একে দুই; অপূর্ব এ রহস্য, সমস্ত রহস্যের সমাধান। তোমাকে ভালো করে দেখি, তোমাকে ভালো করে ধরি। এই যে জ্ঞেয়-জ্ঞাতা, বিষয়-বিষয়ী, ভেদাভেদ-রূপী তুমি, তুমিই অনন্ত, তোমাকে ছেড়ে কিছু নেই। আমি সান্ত, সসীম, আমার কাছে তুমি ক্রমশ কত বিষয় প্রকাশ করছ, সমস্ত বিষয়কে বিষয়ী দিয়ে জড়িয়ে আনছ, জ্ঞেয়কে জ্ঞাতার ভেতর করে আছে। যা আমার সসীমত্বের বাইরে থেকে আসছে, তা অদ্ভুতভাবে আমার হয়ে যাচ্ছে।




বিশ্বাত্মা তুমি আমার উচ্চতর আত্মারূপে প্রকাশ পাচ্ছ। জীবাত্মা অদ্ভুতভাবে বিশ্বাত্মারূপে ছড়িয়ে পড়ছে। তোমার এই প্রকাশই মুক্তি। এতে আমার সমস্ত কেটে যাচ্ছে। আমার অবিদ্যার বন্ধন, সসীমত্বের সীমা, অশান্তির বন্ধন, বিষাদের বন্ধন, পাপের বন্ধন, অপ্রেমের বন্ধন, সব কেটে দিয়ে তোমার সঙ্গে আমাকে যোগযুক্ত করছে।




এই সর্বমঙ্গলময় যোগের অবস্থায়ই আমি থাকতে চাই। এই যোগের সমস্ত বাধা তুমি দূর করো। এই যোগের অবস্থায় আমি ক্ষণকাল মাত্র থাকি, অধিকাংশ সময়ই যোগভ্রষ্ট হয়ে থাকি। যোগভ্রষ্ট হলেই আমার মনে হয়, আমার আত্মারূপী যে তুমি, তুমি ছাড়া আরও অসংখ্য বস্তু আছে।




তুমি যে অনন্ত, সর্বাধার, সর্বময়, সর্বরূপী, তা তুমি আমাকে অসংখ্য বার দেখিয়েছ, কিন্তু যোগভ্রষ্ট হলে সে দর্শন আমার হাতছাড়া হয়ে যায়, বুদ্ধির একটা সিদ্ধান্ত মাত্র হয়ে থাকে। এই সিদ্ধান্ত আমাকে শান্তি দিতে পারে না। সংসারের নানা ক্লেশকর ঘটনা, আমার মনের নানা ক্লেশকর চিন্তা আমাকে বিষাদযুক্ত করে। তোমার কাছে এসে তোমার সঙ্গে আমার যোগযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সেই বিষাদ দূর হয় না।




তোমার উপর আমার গাঢ় ভালোবাসা থাকলে বুঝি-বা আমার যোগ কখনও ভঙ্গ হতো না। অথবা ভঙ্গ হলেও আমি প্রেমেই তৃপ্ত থাকতাম, সংসার আমাকে ক্লিষ্ট, বিষণ্ণ করতে পারত না, আমি শান্ত হৃদয়ে তোমার সাথে পুনর্মিলনের প্রতীক্ষায় থাকতাম।




কিন্তু মনের ক্লেশ আমাকে অস্থির করে, সশঙ্কিত করে, অপ্রেমের চিন্তা আনে, ক্ষুদ্র বাসনা-কামনা আনে, তোমার থেকে বহু দূরে নিয়ে যায়। তুমি অনন্তস্বরূপ, অদ্বৈত, বিশ্বরূপী; আমাকে তোমার সঙ্গে অভঙ্গ যোগে যুক্ত করো।




তোমাকে সর্বত্র দেখি, সর্বত্র শুনি, সর্বত্র স্পর্শ করি, সকল চিন্তায় চিন্তা করি, সকল ভালোবাসায় ভালোবাসি। বস্তুত তুমি ছাড়া তো দেখার কিছু নেই, শোনার কিছু নেই, ছোঁবার কিছু নেই, চিন্তা করার কিছু নেই, ভালোবাসার কিছু নেই।




তবে আর মোহে পড়ি কেন? তোমাকে ছেড়েছি মনে করি কেন? ভালোবাসতে শিখিনি বলেই বুঝি এই দশা হয়? ভালোবাসি না বলেও তো বোধ হয় না। ভালো না বাসলে আর তোমার বিচ্ছেদে কষ্ট হয় কেন? তোমার সঙ্গে মিলন চাই কেন? তোমার সঙ্গে মিলনে আনন্দ হয় কেন?




জীবন রহস্যময়। সব রহস্যের সমাধান যে তুমি, তা কেবল বুদ্ধিতে বুঝিয়েছ। এখন তা কাজে বুঝিয়ে, নিত্য অনুভবে অনুভব করিয়ে, যোগময় জীবনে বাস্তব করে, সব সংগ্রাম দূর করো, জীবন ধন্য করো।