ব্রাহ্মধর্মের উপদেশ: ২





৩৬. স্বেচ্ছাচারিতার অনেক বিঘ্ন, অনেক দুঃখ। ভগবানের অধীনতা ও নিয়মপাশে বদ্ধ হও। (নিজের চৈতন্যকে জাগাতে চাইলে স্বেচ্ছাচারী হলে চলবে না। একমাত্র চৈতন্যের পথ‌ই আনন্দের পথ, ভগবানের পথ।)
৩৭. ব্রহ্মমন্দিরের দ্বার অতি সূক্ষ্ম, এখানে উন্নত মস্তকে প্রবেশ নিষেধ। (বড়ো সুন্দর কথাটি! অহংকার ছেড়েছুড়ে নিজেকে একেবারে ধুলোর সাথে মিশিয়ে ফেলতে না পারলে কিছুতেই ব্রহ্মের উপলব্ধি হ‌য় না। সেই শান্ত ঘরে ঢুকতে চাইলে শান্ত হতে হয়, নতমস্তকেই জ্ঞানের পথে হাঁটতে হয়।)
৩৮. নিঃস্বার্থ প্রীতিসাধন করো। (হিসেব কষে মেকি আচরণের মাধ্যমে লোকের মনে প্রীতির উৎপাদন করা যায় না।)
৩৯. একমাত্র ভগবানকে ডাকো, তিনি স্বয়ং প্রকাশিত হবেন। কাউকেও মধ্যবর্তী মেনো না, কিন্তু সাধু মহাত্মাগণের সহায়তা গ্রহণ কর। (বেদান্ত ও উপনিষদ বলছেন, ব্রহ্মকে জানা যায় না যদিও, তবু আগমশাস্ত্রের সহায়তা নিয়ে ব্রহ্মের স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এবং ব্রহ্মজ্ঞানলাভের পথে যাত্রা শুরু করা যায়। বিভিন্ন মহাপুরুষের উপদেশ ও জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভগবানকে পাবার পথে হাঁটলে এগোনো সহজ হয়; তবে ভগবানের সাথে নীরব-নিভৃত আলাপচারিতায় তৃতীয় কাউকে রাখলে কোনো ফল হবে না। প্রার্থনা বলে বা দেখিয়ে বেড়ানোর জিনিস নয়।)
৪০. যাঁর পায়ের তলায় কোটি কোটি ব্রহ্মাণ্ড ও চন্দ্র-সূর্য রক্ষা পায়, তিনি অধম চণ্ডালকেও কোলে করে থাকেন; ব্রাহ্মধর্ম এর সাক্ষ্যপ্রদান করে। (উপনিষদ ও গীতায় বিধৃত ব্রহ্ম বা ভগবানের সমদর্শিতার কথা বলা হচ্ছে। সূর্য যেমনি শ্রেষ্ঠ কি নিকৃষ্ট, উচ্চ কি নীচ, বড়ো কি ছোটো সব কিছুকেই সমানভাবে আলোকিত করেন, ঠিক তেমনি ব্রহ্ম‌ও বস্তু ও জীব নির্বিশেষে সকলের ভেতরে-বাইরে সমভাবে প্রকাশিত হন। এখানে সূর্য ও ব্রহ্মের ক্রিয়াত্ব বোঝার সুবিধার্থে আরোপিত।)
৪১. ব্রাহ্মধর্ম অতলস্পর্শী সাগরের মতো গভীর, অভ্রভেদী গিরিশৃঙ্গ হতেও উচ্চ, নিশীথকাল অপেক্ষাও গম্ভীর। (এর কারণ, ব্রহ্মত্বলাভ তথা ব্রহ্মজ্ঞানলাভ তথা জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন‌ই ব্রহ্মের স্বরূপে অধিষ্ঠিত হ‌ওয়া। এটিই পরমদ্রষ্টাত্বে পৌঁছে যাওয়া, এর পরে আর কিছু নেই, এখানেই শেষ। তাই এর গভীরতা, উচ্চতা, গাম্ভীর্য সব‌ই অনন্য ও অতুলনীয়।)
৪২. ব্রহ্মজ্ঞান উপার্জনের জন্য অবস্থা ও সময়ের উপর নির্ভর করা উচিত নয়। (যে কেউই যে-কোনো স্থান ও অবস্থান থেকে এই জ্ঞান অর্জন করতে পারে। এর জন্য কোনো অনুকূল-প্রতিকূল পরিবেশ নেই, সময়-অসময় সংক্রান্ত কোনো হিসেব নেই। শুরুটা করতে হবে। সকল অবস্থাই উপযোগী, সকল সময়‌ই উপযুক্ত।)
৪৩. ঈশ্বর আরাধনার জন্য ব্রহ্মজ্ঞান ও ব্রহ্মানুরাগ উভয়ই চাই, কারণ ব্রহ্মজ্ঞান না থাকলে ব্রহ্মানুরাগের লোপ হয় এবং ব্রহ্মানুরাগ না থাকলে ব্রহ্মজ্ঞানের লোপ হয়। (ব্রহ্মকে জানার রাস্তা না চিনলে ব্রহ্মকে জানার গভীরতর ও গভীরতম রাস্তা চেনার তৃষা জাগে না; আবার অমন তৃষা না জাগলে ব্রহ্মকে জানার রাস্তা জীব স্বাভাবিকভাবেই একসময় বিস্মৃত হয়।)
৪৪. জ্ঞান ও প্রেম—ধর্মের জনক ও জননীস্বরূপ। (জ্ঞানের সাথে প্রেম তথা ঐকান্তিক অনুরাগ বা ভক্তির সমন্বয়েই ধর্মের তথা কর্তব্যকর্মের প্রতি আন্তরিকতার জন্ম হয়। জ্ঞান ও ভক্তি তাই ধর্মবোধের মূল কারণ।)
৪৫. ঈশ্বরকে অবগত হলেই ধর্মের প্রকৃত মর্ম অবগত হওয়া যায়। (ঈশ্বরের পথে চলতে গিয়েই ধর্মের পথে চলা হয়। ঈশ্বর তথা চৈতন্যের ঘরে পৌঁছনোর রাস্তায় ধর্মের মর্মোপলব্ধিই একমাত্র বাহন।)
৪৬. বিশ্বকার্যের আলোচনাতেই ব্রহ্মজ্ঞান উজ্জ্বল হয়। (পৃথিবীর সৃষ্টি, স্থিতি, বিকাশ এবং এই তিন প্রক্রিয়া কীভাবে সংঘটিত হয়—তা নিয়ে অপরাবিদ্যা অর্জন করতে করতে একসময় পরাবিদ্যার অনন্ত সাগরে সাঁতার কেটে বেড়ানোর মতো সামর্থ্য আর মন তৈরি হয়ে যাবে।)
৪৭. অন্যান্য বিদ্যা শিক্ষা করার মতো ব্রহ্মবিদ্যাও শিক্ষা করা কর্তব্য। (জীবনের পরমার্থিক লক্ষ্য হচ্ছে ব্রহ্মলাভ, তাই ব্রহ্মত্বের শিক্ষা যে গ্রহণ করল না, তার অন্য সমস্ত‌ ঐশ্বর্য‌ই বৃথা গেল। অবশ্য, একইসাথে সাফল্য ও সার্থকতার চরম শিখরে পৌঁছতে পারে যারা, তাদের যাত্রা বস্তুতপক্ষে সেই ‘আমি’-র অভিমুখেই; তাই প্রকারান্তরে, তারাও ব্রহ্মত্বের‌ই অনুসারী বা পথিক।)
৪৮. যে-ব্যক্তি ঈশ্বরের স্বরূপ অবগত হয়েছেন, তিনি কিছুতেই বিচলিত হন না। (ঈশ্বরের স্বরূপ মানেই ব্রহ্মের স্বরূপ। মানুষ কখন বিচলিত হয়? যখন তার কোথাও পৌঁছনোর তাড়া থাকে, যখন হাতে অনেক কাজ জমে থাকে। ব্রহ্মের স্বরূপ অবগত হবার পর মানুষের তো আর কিছুই জানার থাকে না, সব‌ই জানা হয়ে যায়; আর কোথাও পৌঁছনোর তাড়া থাকে না, পরম গন্তব্যে পৌঁছানো হয়ে যায়; করার মতো আর কোনো কাজ‌ই অবশিষ্ট থাকে না, সব কাজের চরম লক্ষ্য‌ই অর্জিত হয়ে যায়। তাহলে তখন‌ও বিচলিত হবার আর কীই-বা থাকে?)
৪৯. যে-ব্যক্তি ঈশ্বরকে হৃদয়ে প্রত্যক্ষ দৃষ্টি করেন, তিনিই ব্রহ্মবিৎ। (“ব্রহ্মবিৎ ব্রহ্মৈব ভবতি” (মুণ্ডকোপনিষদ, ৩/২/৯) অর্থাৎ যিনি ব্রহ্মকে জানেন, তিনি ব্রহ্মই হয়ে থাকেন। তুলনীয়: আগুনের তেজ আর আগুন তো অভিন্ন সত্তাই, রাহুর মস্তক বস্তুত রাহুই, সূর্যের আলো সূর্যের সত্তারই প্রকাশক।)
৫০. ঈশ্বরের সমীপে গমন করাই জীবাত্মার একমাত্র উদ্দেশ্য। (ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলে ব্রহ্মত্বের উপলব্ধি পাওয়া যায়। ব্রহ্ম পরম দ্রষ্টা বিধায়, ব্রহ্মকে লাভ করার মানেই মোক্ষলাভ করা। ঈশ্বর তথা পরমাত্মার নিকটবর্তী হ‌ওয়াই জীবাত্মার একমাত্র উদ্দেশ্য।)
৫১. কোনো ধর্মগ্রন্থে না থাকলেও অথবা কোনো ব্রহ্মবাদী কর্তৃক উপদিষ্ট না হলেও নির্মুক্তভাবে জ্ঞান দ্বারা যা গৃহীত হয়, ইচ্ছা দ্বারা যা অনুষ্ঠিত হয় এবং যা দ্বারা ঈশ্বরের প্রীতি হয়, তা-ই ধর্ম। (ব্রহ্মজ্ঞানের পথে যা যা বৈধ ও সুখকর, সেগুলিকে জ্ঞানের সাহায্যে বিচার করে ইচ্ছে অনুযায়ী পালন করার নামই ধর্ম। কোনো ধর্মগ্রন্থে না থাকলেও, কোনো ব্রহ্মবাদী এসব নিয়ে কোনো উপদেশ না দিলেও, ঈশ্বরের প্রীতির জন্য‌ই এ জগতে এত কিছুর আয়োজন।)
৫২. যখন সংসারের সমস্ত জীবকে সমভাবে দেখবে, কারও প্রতি অশ্রদ্ধা থাকবে না, তখনই প্রীতির প্রশস্ততা হবে। (অর্থাৎ (পরমাত্মা বা পুরুষরূপ) ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত দর্শন বা উপদেশ ‘সমদর্শিতা’র চর্চার মাধ্যমে প্রীতি চারিদিকে ছড়িয়ে যাক।)
৫৩. কেবলই ঈশ্বর আছেন বললে চলবে না, তোমার রসনার (জিহ্বার বা আস্বাদনের) অস্তিত্ব যেভাবে সহজে অনুভব করতে পারো, তেমনি সহজে হৃদয়ে-বাইরে তাঁকে অনুভব করতে হবে। (ঈশ্বর তথা পরমাত্মাকে কে কোথায় খোঁজেন, তা দিয়েই নির্ধারিত হয় কার ঈশ্বর কোথায় আছেন। তিনি পরমব্রহ্ম বলেই সবখানেই তাঁর অস্তিত্ব। এর জন্য তৃষায় তীব্রতার প্রয়োজন, ওটা ছাড়া হৃদয়ের অনুভব ঠিকভাবে আসে না।)
৫৪. জগতে যা-কিছু সত্য, তা-ই ব্রাহ্মধর্মের অন্তর্গত। (এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সকল সত্যকে ব্রাহ্মধর্মের অভ্যন্তরে আপন করে নেওয়া হলো। যার মধ্যে সত্য নেই, সে কিছুতেই ব্রাহ্ম নয়। যা সত্য, তা যা-ই হোক না কেন, যেখানকার‌ই হোক না কেন, যেমন‌ই হোক না কেন, যখনকার‌ই হোক না কেন—তা ব্রাহ্মধর্মে স্থান পাবে, আদর পাবে। নব্য বাহাই ধর্মেও ঠিক এমন দর্শন আছে। ওঁরা বলেন, একজন মানুষ ভালো হলেই তিনি বাহাই। বাহাই কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়—যাঁর মধ্যে ভালোত্ব আছে, তিনিই বাহাই। এর জন্য ধর্মান্তরিত হবার দরকার নেই। বাহাই দর্শন বলে, মানুষের ভালোত্ব‌ই তার একমাত্র ধর্ম। আহা, দর্শনের কী চমৎকার শিক্ষা!)
৫৫. ঈশ্বরের প্রীতি ও তাঁর প্রিয় কাজ করাই তাঁর উপাসনা। (ঈশ্বর খুশি হন কীসে? তাঁর পছন্দের কাজগুলো করলে। সেইসব কাজ কী কী? নিজের ও জগতের কল্যাণে লাগে, এমন সকল বিশ্বাস, কাজ ও আচরণ‌ই ঈশ্বরের প্রিয়। ভালো ও জরুরি কাজ তথা কর্তব্যকর্ম‌ সাধন করাই ঈশ্বরের উপাসনা।)
৫৬. ঈশ্বরজ্ঞান সমস্ত কুপ্রবৃত্তি ও প্রলোভনকে চূর্ণ করে। (ব্রহ্ম সম্পর্কিত জ্ঞান মানুষকে ব্রহ্মত্বের উপলব্ধি করার জন্য তৃষ্ণার্ত করে দেয়। তখন অপ্রয়োজনীয় সকল কাজ থেকে মানুষ তার মনকে সরিয়ে ফেলে। অন্যের ক্ষতি করার চিন্তা, অন্যের বিষয় নিয়ে পড়ে থাকা, জাগতিক নানা প্রলোভন এবং ভ্রান্ত আত্মতৃপ্তির বোধ থেকে মানুষ নিজেকে দূরে রাখতে পারে, যখন সেই জ্ঞানের উদয় হয়।)
৫৭. কাঠে কাঠে ঘষলে যেমন আগুনের উৎপত্তি হয়, তেমনি জ্ঞান‌ও সংঘর্ষণ বা (মননের) প্রবল স্পর্শ পাওয়ামাত্রই সত্যকে উৎপন্ন তথা প্রকাশ করে। (সত্য কখনও সৃষ্টি করা যায় না, প্রকাশ বা আবিষ্কার করা যায়। এর জন্য ব্রহ্মজ্ঞান অর্জন ও অন্তঃকরণ বা মননের সাহায্যে নিরন্তর সাধনায় সেই জ্ঞানকে সত্য উন্মোচনে কাজে লাগাতে হয়।)
৫৮. সাংসারিক সমস্ত কাজের মধ্যে সকল সময়ে সেসবের অতিরিক্ত (নিয়ন্তা) এক (জ্যোতির্ময় বিরাট) পুরুষের সত্তা অনুভব করতে হবে। (এটিই উপনিষদের সারকথা। আমরা যা-ই করি, যেখানেই থাকি, যেভাবেই করি এবং থাকি, আমাদের ভেতরে ও বাইরের সব কিছুই ব্রহ্মময়। এই উপলব্ধিই আমাদের জন্ম, বৃদ্ধি, ক্ষয়, পরিবর্তন তথা জীবনযাপনের সারবস্তু। তাই আমরা যেন আমাদের কোনো কাজ বা অস্তিত্বেই তথা প্রকৃতিতে সেই বিরাট অনন্ত ব্রহ্ম তথা পুরুষকে বিস্মৃত না হ‌ই—বাতাসের সমুদ্রে বাস করেও বাতাসকে ভুলে থাকি যেমনি করে।)
৫৯. আত্মার সৃষ্টির সঙ্গেই ব্রহ্মজ্ঞান ও ব্রহ্মানুরাগের বীজ তাতে নিহিত হয়েছে। (আত্মজ্ঞান তথা ব্রহ্মজ্ঞানের সূত্র ধরে সক্রেটিসের সেই মহান ঘোষণা: Know Thyself-এর সূচনা এবং তার পরবর্তী বিকাশ আমাদেরকে সুপ্রাচীন কাল থেকেই আত্মার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত করে রেখেছে। আত্মার ধারণা কিংবা মনন, ব্রহ্মের জ্ঞান ও সেই জ্ঞানার্জনের স্পৃহা ছাড়া সম্ভব নয়।)
৬০. জ্ঞান দ্বারা যেমনি সত্য গৃহীত হয়, তেমনি অনুরাগ (কোনো ব্যক্তি, বিষয় বা বস্তুর প্রতি ভালোবাসা, প্রীতি, বন্ধুত্ব, পছন্দ, প্রণয়, আকর্ষণ, আসক্তি বা টান) যোগে মঙ্গলভাবের উদয় হয়। (মঙ্গলভাব হলো এমন একটা গুণ, যার মধ্যে কোনো মন্দতা নেই—আর‌ও সহজে, এটি হচ্ছে: ভালো কাজ করা এবং মন্দ কাজ প্রত্যাখ্যান করা। একজন ভালো ব্যক্তি সবসময় অন্যদের সাহায্য করার সুযোগ খোঁজেন এবং তাদের প্রতি সুবিবেচক থাকেন। কোনো কোনো ব্যক্তি তাঁদের পরিবার ও বন্ধুদের জন্য স্বেচ্ছায় ভালো কাজগুলো করেন, কিন্তু এটাই কি যথেষ্ট? আমরা কেউই সবসময় নিখুঁতভাবে মঙ্গলভাব দেখাতে পারি না। বাইবেল বলছেন, “এমন ধার্মিক লোক পৃথিবীতে নেই, যে সৎকর্ম করে, পাপ করে না।” (উপদেশক, ৭:২০) প্রেরিত পৌল বা সাধু পৌল সততার সঙ্গে এটা স্বীকার করেছিলেন: “আমি জানি, আমার মধ্যে অর্থাৎ আমার অসিদ্ধ দেহে ভালো কিছু বাস করে না; কারণ যা-কিছু উত্তম, তা করার ইচ্ছা আমার রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা পালন করার সামর্থ্য আমার নেই।” (রোমীয়দের প্রতি চিঠি, ৭:১৮) তাই এটা স্পষ্ট যে, আমরা যদি এই গুণটা গড়ে তুলতে চাই, তা হলে আমাদের ব্রহ্মের তথা ব্রহ্মজ্ঞানের কাছ থেকে শিখতে হবে, কেননা ব্রহ্ম‌ই হচ্ছেন সকল মঙ্গলভাবের উৎস।)
৬১. সকল ধর্মশাস্ত্রের প্রতিই শ্রদ্ধাবান হওয়া কর্তব্য। (জ্ঞান আহরণের এটিই সর্বোত্তম পন্থা। প্রতিটি ধর্মশাস্ত্রই রত্নের সমুদ্র। সমুদ্রে রত্নের পাশাপাশি ধুলোবালিছাই থাকে, থাকাটাই স্বাভাবিক। যে রত্ন কুড়োতে শিখেছে, সে খুব অনায়াসেই বাকি সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে রত্ন কুড়িয়ে নিতে জানে। আর যে তা শেখেনি, সে কেবলই ধুলোবালিছাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে—মূর্খের চোখে কেবল ধূলিই পড়ে। এমন সমুদ্র আছে কোথায়, যেখানে কেবলই রত্ন থাকে?—এই সহজ বোধটির অভাব মানুষকে অন্ধ করে দেয়। ব্রাহ্মধর্মের অবস্থান ছিল সকল অন্ধত্ব ও গোঁড়ামির বিপরীতে। এ কারণেই তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজ ছিল মহাত্মা ও সুপণ্ডিতদের মিলনস্থল।)
৬২. যত্ন ব্যতীত ঈশ্বরকে দেখা যায় না। (যত্ন না করলে সাধারণ রত্ন‌ই তো মেলে না, আর ঈশ্বরলাভ তো সমস্ত রত্নের অফুরন্ত ভাণ্ডার!)
৬৩. যে-ব্যক্তি নিজেকে ব্রাহ্ম বলে প্রকাশ করে, সে কখনোই প্রকৃত ব্রহ্মজ্ঞানী নয়। (প্রকৃত জ্ঞানী কখনোই বলেন না যে, তিনি জ্ঞানী। তাঁর কাছে জ্ঞান কখনোই পূর্ণরূপে ধরা দেয় না, তাই তিনি যত‌ই জ্ঞান আহরণ করেন, তত‌ই তাঁর তৃষ্ণা বেড়ে যায়। যে যত জ্ঞানী, সে ততোধিক তৃষ্ণার্ত। যে বলে, তৃষ্ণা মিটে গেছে, তৃষ্ণার খোঁজটাই সে এখনও পায়নি। হাতের কাছে ভরা কলস—এটা জানতে পারাই মূলকথা, তখন তৃষ্ণা আর মেটে না।)
৬৪. স্বাধীনতা হতেই ধর্মের উৎপন্ন হয়। (আহা, এ বড়ো শক্তিশালী কথা! অনেক জোর লাগে এমন কথা বলতে। যেখানে প্রচলিত অনেক ধর্ম‌ই তার অনুসারীদের বিশ্বাসের শেকলে বেঁধে রাখায় ব্যস্ত, বিশ্বাসের অন্ধকার থেকে যুক্তির আলোতে চলতে দেখলেই রীতিমতো হত্যা করতে তেড়ে আসে, সেখানে ব্রাহ্মধর্ম উপনিষদের উদার দর্শনে আলোকিত হয়ে চিন্তার স্বাধীনতার জয়গান প্রচার করছে। নিঃসন্দেহে, এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন মহাত্মা আমৃত্যু ব্রাহ্মধর্মের ছায়াতলে ছিলেন। প্রতিভা কখনোই শেকলে হয় না।)
৬৫. জ্ঞান দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করতে হবে, তাতে অন্য কিছুরই সাহায্য আবশ্যক হয় না। (বেদান্ত তথা উপনিষদের উপদেশমালাই ব্রাহ্মধর্মের মূলভিত্তি। সিগমুন্ড ফ্রয়েডের অন্যতম প্রিয় ব‌ই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সাধনা’; তিনি তাঁর পড়ার টেবিলের কাছেই রাখতেন ব‌ইটি। অনন্তের সাধনায় আমৃত্যু মগ্ন রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন অনেকটাই বিধৃত হয়েছে এই সিরিজ-লেকচারে। উপনিষদের জ্ঞানের সাথে তাঁর ঋষি-আত্মার মেলবন্ধন‌ই যে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বর তথা চৈতন্য-সাধনার শেকড়, তা সহজেই বোঝা যায় রবীন্দ্র-সৃষ্টির প্রতি দৃক্‌পাত করলে।)
৬৬. বিশ্বাসের পরিচালনা না করলে তা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। (বিশ্বাস ধারণ করার বস্তু যতটা, ততোধিক পালন করার বস্তু। বিশ্বাস করাটাই যথেষ্ট নয়, সে অনুযায়ী কাজ করাই আসল কথা। উন্নতির প্রধান প্রতিবন্ধক বিশ্বাসের অভাব নয়, বরং বিশ্বাস অনুযায়ী উদ্যোগের অভাব। মৃত্যুর পরবর্তী কল্পিত স্বর্গের চিন্তায় চিন্তায় মৃত্যুর আগের জীবনটাকে নরক বানিয়ে রাখলে তো—মৃত্যুর আগেও নরকবাস, পরেও সেই নরকবাস‌ই!)
৬৭. জ্ঞান ও প্রেম ব্যতীত ধর্ম পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় না এবং এই দুই বাদে মুক্তির অন্য উপায় নেই। (ধর্মপথে চলতে গেলে কোন পথে চলছি, তা ভালোভাবে জানতে হবে এবং পথচলার জন্য প্রয়োজনীয় নিষ্ঠা ও ভালোবাসা লাগবে। এই দুইয়ের সমন্বয়হীনতা কেবলই অন্ধত্বের জন্ম দেয়। যার মনের ঘরে আলো নেই, ঈশ্বর তথা ব্রহ্ম তথা পরমদ্রষ্টা তথা চৈতন্যের ঘরে পৌঁছাবার সব রাস্তাই তার বন্ধ।)
৬৮. যে-উপায় দ্বারা ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা যায়, তারই নাম ব্রহ্মজ্ঞান। (ব্রহ্ম‌ই ঈশ্বর, চৈতন্য‌ই ঈশ্বর। তিনিই পরমদ্রষ্টা, তার পরে আর কিছু নেই। নিজেকে জানাই তাই ঈশ্বরকে জানা। প্রকৃতি থেকে পুরুষ তথা চৈতন্যে পৌঁছে গেলে যাবার আর কোনো জায়গা নেই। আর‌ও যেতে চাইলে তো ‘আমি’ থেকেই বেরিয়ে যেতে হয়, তখন আর কিছুই থাকে না—অনবস্থা দোষ ঘটে—’আমি’ থেকেই ‘আমি’ বেরোয় কী করে?)
৬৯. জ্ঞান দ্বারা স্বর্গের দ্বার মুক্ত হয় ও প্রেম তার মধ্যে প্রবেশ করার ক্ষমতা প্রদান করে। (শুরুতে জ্ঞান, তার পরে ভক্তি। শুধুই জ্ঞান বা শুধুই ভক্তি জীবকে প্রায়ই ভ্রান্ত পথে নিয়ে যায়। ভক্তিহীন জ্ঞান মানুষকে অনেকসময় অহংকারী করে তোলে এবং জ্ঞানহীন ভক্তি মানুষকে প্রায়ই নির্বোধ করে দেয়।)