স্বপ্নভঙ্গ

আজ অমাবস্যার রাত—বড়ো অন্ধকার রাত—রাশি রাশি আঁধার চারিদিকে ছড়ানো। এই অনন্ত অন্ধকার যেন মনের খুশিতে পৃথিবীর কোলে অন্ধকার ঢালছে। ঢালো, ঢালো, আরও ঢালো অন্ধকার! সমস্ত ধরাতল আজ অনন্ত অন্ধকারে আচ্ছন্ন করো।




প্রদীপের ক্ষীণ আলোয় তোমরা কী করবে? আকাশের ক্ষীণ আলোতেই-বা তোমার কী কাজ? আর, ক্ষীণ নক্ষত্রালোকের কথা বলছ? সে তো তোমার প্রভাবে আজ উজ্জ্বল মূর্তি ধারণ করেছে—তোমার অনন্ত মহিমা আজ সে অনন্ত জ্বলন্ত অক্ষরে প্রকাশ করছে। তোমারই অনুকম্পায় আজ নক্ষত্রপুঞ্জ বিমল, বিশদ, স্বচ্ছ—পবিত্র হৃদয়ে সে তাই তোমারই অনন্তধ্যানে নিমগ্ন! আমার সাথে তোমাকে পরিচয় করাতেই আজ এত কিছু!




প্রিয়তম অন্ধকার! আমি তোমাকে বড়ো ভালোবাসি। তুমি বড্ড ভয়ানক বটে, তোমার ভীষণ ভীমমূর্তি, তোমার গভীর আঁধাররাশি সমস্ত ভুবন ভরে রয়েছে ঠিক‌ই, এসব সত্ত্বেও তোমার কী সুন্দর সুগম্ভীর মূর্তি! আহা, মরি মরি! তুমি কী মনোরম! তুমি কী হৃদয়স্পর্শী, কী মর্মস্পর্শী। তোমার মতন প্রাণস্পর্শী আর তো কাউকেই দেখি না। তোমার মতন মুহূর্তের মধ্যে অনন্তে ডোবাতে আর কেউই পারে না।




তাই আকুল হয়ে বলি, অন্ধকার! তুমি আমার প্রিয়তম! আমার হৃদয় আজ তোমার অনন্তে মিশে অনন্তের দিকে ধাবিত হতে চাইছে। তুমি তো অনন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড গ্রাস করেছ, প্রত্যেক প্রাণে প্রাণে পরমাণুতে পরমাণুতে মিশে রয়েছ; অনন্ত জগতে একাধিপত্য বিস্তার করেও আরও অন্ধকার ঢালছ। একবার আমার হৃদয় তোমার এই অনন্ত আঁধাররাশিতে মিশিয়ে নাও। আমি একবার এই অনন্তের মধ্যে ডুব দেবো আর দেখব, কোথায় কী আছে। অনন্তের অনন্ত সীমানাই-বা কোথায়? আমি তোমার অনন্ত জগতে একবার আধিপত্য বিস্তার করতে চাই।




না, না, অন্ধকার! তোমার ওই অনন্তের মধ্যে ডুবব না, তাহলে আমি আর আমাতে থাকব না, আমার সমস্ত অস্তিত্ব একেবারে লোপ পাবে। জগতের উপর আধিপত্য করব কীভাবে? তোমার অনন্ত আঁধার-স্রোতে ডুব দিলে তো ওতে মিশে একেবারে তলিয়ে যাব। তা হবে না; তোমার ওই আঁধার-স্রোতে ডুব দেবো না, ভাসব। তাহলেই আমার সকল আশা পূর্ণ হবে।




তবে এসো, হে অন্ধকার! এসো, প্রিয়তম! হৃদয়ের ধন! প্রাণের প্রাণ! অনন্ত প্রাণ! একবার তোমার মধ্যে ভাসি; একবার তোমার অনন্ত বিকাশ মুহূর্তের মধ্যে দেখে নিই। তুমি দেখাও আমাকে অনন্ত প্রকৃতির অতুল শোভা। প্রাণ ভরে একবার দেখব। দেখাও, হে প্রিয়তম! তুমি একবার আমাকে দেখাও।




আহা, মরি মরি! প্রকৃতিদেবী! আজ তুমি কী অনির্বচনীয় রূপ ধারণ করেছ! তোমার গম্ভীর মুখশ্রী, তোমার পবিত্র-উদার হৃদয়, তোমার এমন অনন্তমগ্ন প্রাণ-আত্মা কখনও দেখিনি। মরি মরি! দেবী! শ্যামাঙ্গিনী! আজ তুমি অনন্ত ধ্যানে বিভোরা। তোমার স্তব্ধ প্রশান্ত মূর্তি বড়োই মধুর, বড়োই প্রাণস্পর্শী।




আঃ! বৃথাই আশা তোর, লক্ষ্মীপেঁচা! কালরাত্রি পেয়েছিস, অন্তরে বড়ো অহংকার হয়েছে, না? তাই বুঝি ধ্যানমগ্না প্রকৃতিদেবী শ্যামাঙ্গিনীর অনন্ত ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য এমন বিকট স্বরে চিৎকার করছিস? এ কেবলই বৃথা আশা! অনন্ত ধ্যানমগ্না ভাবসমাহিত‌ আঁখি উন্মীলন করাই কি তবে তোর ক্ষমতার প্রকাশ? ধিক্ তোরে! হিংসুটে-নীচ‌ অসুর তুই! তোদের প্রকৃতিই আলাদা!




আবার, এ কী! এ কী! কে তুমি আকাশতলে বসে শান্তি-জ্যোতি ছড়াচ্ছ? ক‌ই, তোমাকে তো এতক্ষণ দেখিনি। আহা! তোমার কী অমলধবল, বিমল, মধুর, উজ্জ্বল মূর্তি! হে আকাশদেবতা! তুমিও কি সেই অনন্তের অনন্ত ধ্যানে মগ্ন? তোমাকে দেখে আমার হৃদয়ও অনন্ত ধ্যানে মগ্ন হতে চাইছে। আমিও একবার তোমার মতন অনন্ত ধ্যানে মগ্ন হব।




প্রিয়তম অন্ধকার! তুমি একবার আমার সহায় হও। আমি এই চোখ বুজলাম। আমার হৃদয়ে একবার অনন্তভাব ঢেলে দাও—আমিও অনন্তভাবে বিভোর হব, অনন্ত পদে এই নশ্বর জীবন মেশাব, অনন্ত সেবায় প্রাণোৎসর্গ করব। আমার এই অনন্ত আশা তুমি না করলে আর কে পূরণ করবে? এসো, তুমি সহায় হও; এই আমি চোখ বন্ধ করেছি।




আহা আহা! কী মধুর দৃশ্য! এমন অপূর্ব দৃশ্য তো আগে কখনও দেখিনি। আমার হৃদয় যেন আলোকময়—হৃদয়াকাশে শুকতারার বিকাশ, আলোকময় হৃদয়ে মধুর উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা: “এই অন্ধকারের মধ্যে সত্যের আলোকময় পথ দেখে চলো, অনন্ত জীবন পাবে।”




হঠাৎ সেই স্বপ্ন ভাঙল। চারিদিকে চেয়ে দেখি, হায়! হায়! এ কী! এ কী! কোথায় তুমি, প্রিয়তম অন্ধকার! হে অনন্ত আঁধার-নিশি, আমাকে একলা ফেলে কোথায় পালালে? তোমার সেই অনন্ত কায়া কোন অনন্তে মেশালে?




হায়! কে জানত, তুমি মুহূর্তমাত্র! তোমায় অনন্ত ভ্রমে আমার হৃদয় দিলাম, আর তুমি আমায় ফেলে কোথায় পালালে? তোমায় অনন্ত ভেবে আমি যে জগতের উপর অনন্ত আধিপত্য বিস্তার করছিলাম, সেই আধিপত্যের সব‌ই আমার লোপ পেল! সামনে অনন্ত জগৎ আমাকে গ্রাস করতে আসছে, এখন কে আমাকে রক্ষা করবে? তবে কি তুমি কেবলই মায়া? মায়াময় অন্ধকার! হায় হায়! এ আমি কী করলাম? কোথায় অনন্ত! কোথায় তুমি অনন্ত প্রাণ! আমার এ জীবন আজ যায় যায় হয়েছে। তুমি আমায় অনন্ত জীবন দাও।




পুব দিকে একটু আলো এল, কে যেন আমার হৃদয়তন্ত্রী সজোরে বাজিয়ে বলল, “আলো দেখে চলো, অনন্ত জীবন পাবে।” অমনিই হৃদয় পুলকিত হলো। হঠাৎ উৎফুল্ল চোখে চারিদিক নিরীক্ষণ করলাম, নিমিষেই সেই আনন্দ লোপ পেল। জগৎ এখন আমার উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে, সুতরাং জগতের কাজেই আবার ডুবলাম।