ব্রাহ্মধর্মের উপদেশ: ১

ব্রাহ্মধর্মের দর্শন অতিচমৎকার। রাজা রামমোহন রায়ের হাত ধরে এই ধর্মদর্শনের যাত্রা শুরু। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার দত্ত, কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, রাজনারায়ণ বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন প্রমুখ অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী ছিলেন। ব্রহ্মের স্বরূপবীক্ষণে সহায়ক উপনিষদের উপদেশসমূহের উপর ব্রাহ্মধর্মের দর্শন দাঁড়িয়ে আছে। এ কারণেই যাঁরা মনুষ্যত্বের জয়ে বিশ্বাস করেন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে তাঁদের সকলের কাছেই ব্রাহ্মধর্মের উপদেশগুলো সবসময়ই আদর পেয়েছে।
উপদেশগুলো এমন:




১. যত দিন অহংকারের গন্ধ পাবে, তত দিন দেবভাবের (অধ্যাত্মভাব—বেদে তথা উপনিষদে যে-ভাবকে বাক্য ও মনের অতীত বলা হয়েছে) উদয় হবে না।
২. যদি প্রেমরাজ্য চাও, অহংকারকে বিদায় দাও। (মন অহংকারে পূর্ণ থাকলে ওতে কখনও ভালোবাসার জায়গা হয় না।)
৩. ধর্মজীবনে গাম্ভীর্য (মনের বিকারহীন ভাব বা গীতার ৬/৩৫ শ্লোকে বর্ণিত বৈরাগ্য) চাই।
৪. যোগই প্রাণ, বিয়োগই মৃত্যু। (কর্মে প্রবৃত্তিই প্রাণ, নিবৃত্তিই মৃত্যু।)
৫. কোনো অবস্থাতেই দেহকে পাপশূন্য মনে কোরো না। (ওতে অহেতুক অহংকার বা আত্মতৃপ্তি আসে। ফলে নিজেকে আরও উঁচুতে ওঠানোর ইচ্ছে মরে যায়। আত্মতৃপ্তি মৃত্যুর সমান।)
৬. গুণ থাকলেই দেবত্ব লাভ হয় না, সম্পূর্ণরূপে অহংকার ত্যাগ করতে পারলেই দেবত্ব লাভ করা যায়। (মনে অহংকার এলে ইন্দ্রিয়ের যাত্রা আপনাআপনিই স্তিমিত হয়ে যায়। এতে ক্রমেই দেবত্বের তিরোধানে জড়ত্বের আবির্ভাব ঘটে।)
৭. বিবেকের কথা গুরুমন্ত্র, যত্নের সাথে তা রক্ষা করো। অনুমানপ্রিয় হয়ে ‘বোধ হয়’, ‘যদি’ ইত্যাদি সন্দেহের শব্দ ব্যবহার কোরো না। (বিবেক হলো: দৃশ্যমান জগত থেকে অদৃশ্য ব্রহ্মকে আলাদা করার ক্ষমতা) (গুরুমন্ত্র—গু মানে অন্ধকার, রু মানে অপসারণকারী, মন্ মানে চিন্তা করা, ত্র মানে মুক্ত করা। তাই গুরু হলেন: যিনি অন্ধকার দূর করেন এবং মন্ত্র হলো: মুক্তির উপায়।)
৮. স্বর্গলাভ ও দেবত্বলাভ একই কথা। (অর্থাৎ মানুষ যখন নিজের চেষ্টায় এবং নির্গুণ (ব্রহ্মের) ঈশ্বরের কৃপায় দেবত্বলাভ করে, তখন সে এ পৃথিবীতেই স্বর্গের সুখ আস্বাদন করতে পারে।)
৯. হয় উন্নতি, নয় অবনতি। জীবন কখনও এক ভাবে চলে না। (‘ভালো’ হলে কেউ কখনও ‘মোটামুটি’ বলে না। ‘মোটামুটি’ মানে তাই ‘খারাপ’-ই।)
১০. স্বর্গের লক্ষণ কী? এক প্রাণ, এক আত্মা। (অর্থাৎ ব্রহ্মত্বে উন্নীত হ‌ওয়া)
১১. কি উপাসনা, কি সাধুতা, কি বিনয়—এর একটিরও সাধন শেষ করতে পারা যায় না। (সব পেয়েও তৃষ্ণা তবু কিছুতেই মেটে না। তৃষ্ণা মিটল যার, সে হয়তো তৃষ্ণাই চিনল না!)
১২. যেখানে দেখবে বিষাদের রেখা, সেখানে জানবে স্বর্গের পবিত্রতা আসেনি। (ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করার পর কেবলই আনন্দ আর আনন্দ। তখন জীবাত্মা সাক্ষিস্বরূপ, তিনি পরম দ্রষ্টা হয়ে মনকে তথা দৃশ্যকে আনন্দে ভাসান।)
১৩. যদি অভীষ্ট লাভ করতে ও নির্ভীক হতে চাও, অবিশ্রান্ত উপাসনা করো। (উপাসনায় মনের শক্তি বাড়ে; আর তখন লক্ষ্যে পৌঁছনো ও ভয়শূন্যতা লাভ করা দুই-ই সহজ।)
১৪. ঈশ্বর যদি বিনাশ‌ও করেন, তবু তাঁর উপর‌ই নির্ভর করো। ছেলের কল্যাণের জন্যই বাবা ছেলেকে প্রহার করেন। সংসারের যে-দিকে দুঃখ আর বিপদ, সেদিক ঈশ্বরের শাসনের স্থল। (ভগবান যা করেন, ভালোর জন্যই করেন।)
১৫ ‘অহং’ যখন জ্ঞানকে দেখে, তখন‌ই সে ধীরে ধীরে আত্মার জীবন একেবারে বিনষ্ট করে দেয়। (এখানে ‘আত্মা’ বলতে মন, বুদ্ধি ও স্মৃতির সমন্বয়কে বোঝানো হয়েছে।)
১৬. শরীরে যেমন চোখ, আত্মাতে তেমনি বিশ্বাস। চোখহীন দেহ আর বিশ্বাসহীন আত্মা সমান। (নিজের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের উপর ভর করেই মানুষ ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। অদ্বৈতবেদান্তের পুরোহিত স্বামী বিবেকানন্দ তাই বলছেন, যার নিজের উপর বিশ্বাস নেই, সে-ই নাস্তিক।)
১৭. ‘পারব’ বললে ঐশ্বরিক শক্তি হৃদয়ে প্রবেশ করে; ‘পারব না’ বলামাত্রই দুর্বলতা তার চারগুণ পিশাচী শক্তিতে হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। (আত্মবিশ্বাস‌ই দেবত্বে উন্নীত হবার প্রথম সোপান। আত্মবিশ্বাস‌ নষ্ট হয়ে গেলে তাই আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।)
১৮. শত্রুকে কী দেবো? ক্ষমা। (যে ক্ষমা করতে পারে না, তার পক্ষে শক্তিশালী হ‌ওয়া অসম্ভব, কেননা ক্ষমা করতে না পারলে অন্তর্দহন বাড়ে আর মনের শক্তি কমে। ক্ষমা শক্তির প্রকাশ।)
১৯. অবিশ্রান্ত প্রার্থনা করো, কোনো অভাবই থাকবে না। (এখানে প্রার্থনা বলতে নিজের কাজ সবটুকু আন্তরিকতা ও শ্রম খরচ করে করার কথা বলা হয়েছে।)
২০. রিপুদমন সবচাইতে কঠিন, কিন্তু সবচাইতে বেশি দরকার। (ছয়টি রিপু: কাম—ইন্দ্রিয়সুখ, কামেচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা; ক্রোধ—রাগ, যা কামনার হতাশা থেকে উদ্ভূত; লোভ—যা ‘কামুকতা, লালসা, বাসনা’ বা ‘সংবেদনশীল বস্তুর সাথে সংযুক্তি’...এর যে-কোনো রূপকে নির্দেশ করে; মোহ—বিভ্রান্তকারী শত্রু বা উপাদান; মদ—মানসিক অস্থিরতা, যা আত্মাকে কষ্ট দেয়; মাৎসর্য—হিংসা বা ঈর্ষা, অর্থাৎ নিজের সম্পত্তি এবং অন্যান্য বস্তুগত দ্রব্য উপভোগ করতে অক্ষম হ‌ওয়া সত্ত্বেও সেগুলিকে কার‌ও সাথে ভাগ না করে নিজেই আঁকড়ে রাখা।)
২১. এই জীবনে যদি স্বর্গের আভাস না পাও, তবে কোথাও যে স্বর্গ আছে, তার বিশ্বাস কী? আত্মার মধ্যে যদি স্বর্গ না থাকে, তবে আর তা কোথাও নেই। (এর চেয়ে চমৎকার দর্শন আর কী হতে পারে! দেবত্ব বা স্বর্গের প্রাপ্তি জীবদ্দশাতেই। মৃত্যুর আগেই স্বর্গ, মৃত্যুর আগেই নরক—পরে কী আছে কে জানে!)
২২. চোখ বুজলেই (ধ্যানস্থ হলেই) ব্রহ্মরূপ (নিজেকে) যেমন দেখা যায়, চোখ খুললেই তেমন দেখা যাবে। (তবে এর জন্য ক্রমাগত সাধনা করে মনকে বেঁধে ফেলে সেই ঊর্দ্ধস্তরে পৌঁছতে হবে। সেই স্তরে পৌঁছে গেলে চোখ খোলা রেখে, লোকের সাথে গল্প করতে করতেও ধ্যানস্থ হয়ে যাওয়া যায়।)
২৩. সবার আগে পশুজীবন, তার পরে মনুষ্যজীবন, এর‌ও অনেক পরে দেবজীবন। অতএব, দেবত্ব লাভ করতে চাইলে প্রথমেই পশুজীবন পরিত্যাগ করো। (পথচলার এখনও যে অনেক বাকি!)
২৪. আমাদের অনেক কথাই বুদ্ধিগত, হৃদয়গত নয়। অতএব, হৃদয়গত কথাই ব্যবহার করবে। (মন বলে না যা, শুধুই বুদ্ধি বলে, তা দিয়ে জীবনে অনেক অনর্থের সৃষ্টি হয়। হায়, তখন এতটাই দেরি হয়ে যায় যে, বিভিন্ন কারণে আর কিছুই করার থাকে না!)
২৫. পাপী ও অজ্ঞানীর প্রতিও ভগবানের দয়া অল্প নয়। (অসহায়, অনুতপ্ত, পাপী মানুষের জন্য উপনিষদের এই বাণীর চেয়ে শক্তিদায়ী আশ্বাস আর হয় না। গীতাতেও আছে এমন কথা ৯/৩০-৩১ শ্লোকদুটোতে। অস্কার ওয়াইল্ড তাঁর A Woman Of No Importance নাটকে বড়ো অপূর্ব একটি কথা লিখেছেন: “The only difference between the saint and the sinner is that every saint has a past and every sinner has a future.”)
২৬. পরের জন্য জীবন দাও, নবজীবন পাবে। (মানুষের মঙ্গলের জন্য খাটলে জীবন সবসময়ই নতুনত্বের স্বাদ পায়।)
২৭. সকল জাতির পদতলে বসে যিনি সত্য-শিক্ষা করেন, তিনিই ব্রাহ্ম। (এখানে সমস্ত অহংকারকে দূরে সরিয়ে রাখার কথা বলা হয়েছে। অহম্ ছাড়তে না পারলে ব্রহ্মত্বে পৌঁছনোর সব রাস্তাই বন্ধ হয়ে যায়। যার সব রাস্তাই বন্ধ হয়ে গেল, সে আর পথিক তথা ব্রাহ্ম হবেই-বা কীভাবে?)
২৮. ঈশ্বরে রাজভক্তি (একনিষ্ঠ ভক্তি, যা মানুষ কোনো-না-কোনো কারণে রাজার প্রতি দেখায়) প্রদান করো, চারিদিকে তাঁর রাজদণ্ড নিরীক্ষণ করো। (এবং নিজের কাজগুলো সর্বোচ্চ সতর্ক হয়ে করো।)
৩০. একের দুঃখে দশের দুঃখ, একের সুখে দশের সুখ। ভ্রমজ্ঞানে একাকী-স্বতন্ত্র হতে চেয়ো না। (স্বার্থপর না হয়ে সবার সাথে মিলেমিশে চলো, অপরের প্রতি সহমর্মী, সহভাগী, সমব্যথী, সমদর্শী হ‌ও।)
৩১. ভক্ত কী চান? তিনি দর্শন ছাড়া আর কিছুই চান না। (ঈশ্বরের যে সবিকল্প রূপের কল্পনায় ভক্ত উপাসনা করেন, সেই রূপের কেবল দেখাটুকু পেলেও ভক্ত অবিশ্রান্ত সাধনার মধ্য দিয়ে নির্বিকল্পত্বে পৌঁছে যেতে পারেন। তখন তো সব‌ই পাওয়া হয়ে যায়।)
৩২. শরীরের মতো আত্মাও ব্যাধিমন্দির। শারীরিক রোগে লোকে অস্থির হয়, আত্মার ব্যাধিতে কেউই দৃক্‌পাত‌ করে না, কিন্তু শারীরিক ব্যাধির চেয়ে আত্মার ব্যাধি হাজারগুণ ভয়ংকর। (এ কারণেই অনেককেই বিষণ্নতা, হতাশা, মনের কষ্ট, বিচ্ছেদ ইত্যাদি কারণে অকালেই শরীর ছাড়তে হয়।)
৩৩. যদি ব্যাকুলতা থাকে, সশরীরে অর্থাৎ মৃত্যুর আগেই স্বর্গে যাওয়া খুবই সহজ। (আমরা আমাদের ভাবনা, আচরণ, কাজ, পারস্পরিক সুন্দর সম্পর্ক ইত্যাদির দিকে সচেতনভাবে খেয়াল রাখলেই ব্যাপারটি সহজে হয়ে যায়। দেবত্বে উন্নীত হবার একটাই যোগ্যতা: ব্যাকুলতা এবং তার প্রয়োগ।)
৩৪. ধার্মিকেরা পূর্ণ পুরস্কার পাবেন। পাপের দণ্ড অখণ্ডনীয়। পাপী কোথায় পালাবে? (কর্মফল ভোগ করতেই হবে। ভালো কাজের ভালো ফল, খারাপ কাজের খারাপ ফল; এবং শূন্য কাজের শূন্য ফল।)
৩৫. পরের যথার্থ মঙ্গল করার চেষ্টা করো, কিন্তু নিজের যথার্থ মঙ্গলসাধনেও বিস্মৃত হয়ো না। (যে নিজেকে ভালো রাখতে পারে না, তার পক্ষে পরকে ভালো রাখা সম্ভব নয়। মানুষ বড়ো অকৃতজ্ঞ প্রাণী। তাই আগে নিজের ঘরে আলো না জ্বেলে পরের ঘরে জ্বাললে, নিজের ঘর চিরকাল অন্ধকারেই থেকে যাবার আশংকা প্রবল।)