নাচ আমার ময়না

কিশোর কুমারের কণ্ঠে ১৯৭৪ সালের সিনেমা ‘রোটি’র বিখ্যাত গান ‘নাচ মেরি বুলবুল কে প্যয়সা মিলেগা’ সিনেমাটির বাংলাদেশি রিমেক ‘একমুঠো ভাত (১৯৭৬)’-এ খুরশিদ আলমের কণ্ঠে হয়ে গেল ‘নাচ আমার ময়না তুই পয়সা পাবি রে’, যা আমাদের অনেকেরই ঠোঁটে মনের অজান্তেই আজও বেজে ওঠে। এভাবেই অনেক গানই রিমেক হওয়ার পরও কালোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। গানটা ৪৫ বছরেও হারিয়ে যায়নি, যেখানে অনেক গানের আয়ু ৪৫ দিনও নয়!


এই গানের ভিডিয়োতে আমরা দেখি, আমাদের স্বপ্নের নায়িকা ববিতা গানের তালে তালে ‘ময়না’ হয়েই নাচছেন অভিনয়ের প্রয়োজনে। হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই 'গানের কথানুযায়ী' নেচে তিনি পয়সা ও নায়িকাখ্যাতি দুই-ই পেয়েছিলেন। অর্থাৎ দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য তিনি নেচেছিলেন পয়সা ও খ্যাতি পেয়েছিলেন বলেই। না পেলে আমাদের গণক্রাশ হার্টথ্রব ববিতা অমন করে নাচতেন কি? এ প্রশ্ন থেকেই যায়। কমনসেন্স বলে, না, নাচতেন না! পয়সা বা কোনও প্রণোদনা ছাড়া এ জগতে কেউই কারও কথামতো নাচে না।


কারও কথায় তখনই নাচা যায়, যখন নাচলে পয়সা পাওয়া যায়, খ্যাতি পাওয়া যায়, এই দুইয়ের ফলে সচ্ছলতা ও আনন্দ পাওয়া যায়, কিংবা পরিস্থিতির কারণে বা প্রয়োজনে নাচতে কেউ বাধ্য হয়। অন্যথায়, কেউ যদি বিনা কারণেই আশা করে, তার মর্জিমাফিক আপনি নাচবেন, তবে সেই লোকটাকে আপনার কী মনে হবে? বেআক্কেল? বেকুব? গর্দভ? নির্বোধ? ছাগল? পাগল? কিউট বলদ? না কি আরও বাজে কিছু?


মনে হওয়ারই কথা! যে আপনাকে আপনার কাজের জন্য পয়সা বা আনন্দ বা পুণ্য বা কোনও কিছুই দেয় না, সে-ও যদি আপনাকে বলে, ‘ভাই, আপনার কাছ থেকে এটা আশা করিনি।’ ‘আপনার কাছ থেকে আমি অমুক অমুক জিনিস প্রত্যাশা করি।’ ‘আপনার এখানে কেন এলাম যদি অমুক জিনিসটা না পাই?’ ‘এই কাজটা এখুনিই ছেড়ে ওই কাজটা করুন তো!’ ‘আপনি এমন করে চলুন, তেমন করে চলুন…হ্যান করুন, ত্যান করুন!’ ‘আপনার এই কাজে খুশি হতে পারলাম না।’ ‘আপনি নিজেকে অমুক উপায়ে উপস্থাপন করুন।’ ‘আপনি আমার জন্য এটা করলেন না কেন?…সেটা করলেন না কেন?’ ‘আজ থেকে আপনি এভাবে চলবেন, কেমন? কাল থেকে আপনি ওভাবে চলবেন, ঠিক আছে?’ ইত্যাদি ইত্যাদি…তখন আপনার কেমন লাগবে?


আপনি কি তার কথামতো চলতে বাধ্য? না কি তার মনমতো চলার জন্য আপনি পয়সা পান? না কি তাকে খুশি করতেই আপনি এই পৃথিবীতে এসেছেন? না কি দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে এনেছেন বলে আপনি এখন তাকে জামাইআদর করতে বাধ্য? না কি তাকে সময় দিলে আপনার জ্ঞানার্জন হবে? না কি সে আপনার কাজে খুশি হলে আপনি একটা প্রমোশন পাবেন? না কি সে আপনাকে জোর করে পুণ্য অর্জন করানোর যে মিশনে নেমেছে, তা সাকসেসফুল করাটা আপনার দায়িত্ব?


এসব সহজ জিনিস বুঝতে রকেট-সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। যে আপনার ময়নাপাখি নয়, আপনি কেন আশা করেন, সে আপনার মনের মতো করে নাচবে, গাইবে, কথা বলবে? যে আপনার খুশি অনুযায়ী চললে টাকা পায় না, তার কাছে আপনার অত প্রত্যাশা আসে কোত্থেকে? আপনার মনের মতো চললে কি সে বাড়তি কোনও সুখ বা আনন্দ পাবে? সে আপনার কাছের বা দূরের সম্পর্কের কেউ হয়? যদি এই প্রশ্নগুলির উত্তর হয় ‘না’, তবে আপনি কেন তার সামনে এসে ওরকম আশা-প্রত্যাশা-ভরসা’র ঝুলি খুলে বসে থাকেন? সে কি আপনার কাছের কেউ? আত্মীয়? ফ্রেন্ড? 'জাস্ট ফ্রেন্ড'? 'ফ্রেন্ড উইথ বেনিফিট'? বউ? গার্লফ্রেন্ড? জামাই? বয়ফ্রেন্ড? ডার্লিং? না কি তার সাথে আপনার পরকীয়ার সম্পর্ক?


যার সাথে আপনার প্রেম নাই, তার কাছেও আপনি প্রেমময় কথাবার্তা আশা করেন কোন যুক্তিতে? আপনাকে খুশি রাখলে সে কি টাকা পায়, না সুখ পায়, না পুণ্য পায়? না কি আপনি তার বস? কোনটা, ভাই? তাকে দেখলেই রাগ ওঠে? কেন? সে আপনার মনের মতো করে সাম্বাড্যান্স দেয় না বলে? যত খুশি রাগুন, যত খুশি কাঁদুন! চেঁচান, প্রয়োজনে ভেড়ার সাথে কম্পিটিশন করে চেঁচান। নো প্রবলেম! মাথা ঠান্ডা হলে দেখবেন, ইন দ্য মিনটাইম, সে আরও এগিয়ে গেছে, যা আপনি তার কাছ থেকে আশা করেন নাই! আপনার আশার ডিমে বসে বসে তা দেওয়ার জন্য পৃথিবীতে সে মুরগিমানব হয়ে জন্ম নেয় নাই। অক্ষমের ঈর্ষা সক্ষমের ক্রোধ বাড়িয়ে দেয়। এতে অক্ষম আরও অক্ষম হয়ে পড়ে এবং সক্ষম আরও সক্ষম হয়ে ওঠে।


কাউকে যদি বলতে মন চায়, ‘নাচ আমার ময়না’, তবে তার পরের কথাটা যেন মাথায় রেডি থাকে…তুই___পাবি রে! শূন্যস্থানে কী বসালে---সে আপনাকে খুশি করতে নাচবে, আপনার প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করবে, আপনার ধান্দা ভালোভাবেই হাসিল হবে, আপনি যা চান তা-ই পাবেন তার কাছ থেকে, সে আপনাকে পরামর্শ বা সময় দেবে, সে আপনার দুঃখের কথা শুনে তা দূর করতে চেষ্টা করবে, এবং এরকম আরও যা-কিছুই আপনি চান না কেন, তা-কিছুই পেয়ে যাবেন,---সেটা আগেই স্টাডি করে নেবেন। এইটুকু স্মার্টনেস না থাকলে তার চোখে আপনি হয়ে যাবেন একটা ছাগল, গাধা, বলদ! সে আপনাকে মুখে বলবে…ভাই ভাই!, আর মনে মনে বলবে…বাই বাই!


কিনতে জানলে সবই কেনা যায়---সময়, শ্রম, দক্ষতা, বুদ্ধি, পরামর্শ---টাকা দিয়ে হোক, ব্যবহার দিয়ে হোক, কোনও কাজ করে দিয়ে হোক, পছন্দের কিছু উপহার দিয়ে হোক, সুখ-আনন্দ-স্বস্তি দিয়ে হোক, কিংবা অন্য কিছু দিয়ে হোক! কাজের কারণটা দেখান, কাজ হয়ে যাবে! সবাই-ই ক্ষুধার্ত, শুধু জানতে হয়, কার ক্ষুধাটা কোথায়! তার ক্ষুধা মেটান, দেখবেন, আপনার নিজের ক্ষুধাও মিটে গেছে!


এ জগতে পুরোপুরি ‘ফ্রি লাঞ্চ’ বলে কিছু নাই। প্রতিটি ‘ফ্রি লাঞ্চ’-ই পরিবেশন করা হয় কোনও-না-কোনও কারণে। মনে রাখবেন, যে সময় দিলেই আপনার কাজটা হয়ে যাবে, তার সময়ের অনেক দাম আছে। অন্য দিকে, যে সময় দিলেও আপনার কাজটা হবে না, তার সময়ের তেমন কোনও দামই নাই। যা আপনার প্রাপ্য নয়, তা আপনি কিছুতেই দাবি করতে পারেন না, বড়োজোর তার জন্য হাত পাততে পারেন। তা আপনি পাবেন কি পাবেন না, সেটা নির্ভর করছে যার কাছে হাতটা পেতেছেন, তার মর্জির উপর।


সুন্দরীদের একসময়ের 'ক্রাশ' ডিপজলের একটা ডায়লগ আবছা আবছা মনে পড়ছে...এখানে নাইনটি-ফাইভ পার্সেন্ট কাজই টাকা দিয়ে হয়, বাকি ফাইভ পার্সেন্ট কাজ...বেশি টাকা দিয়ে হয়!
আমিও বলি, আপনার যা যা দরকার, তার নাইনটি-ফাইভ পার্সেন্টই আপনি কোনও কিছুর বিনিময়ে পেয়ে যাবেন, বাকি ফাইভ পার্সেন্ট...বেশি কিছুর বিনিময়ে পেয়ে যাবেন!


মিছরির দামে কখনও সন্দেশ পাওয়া যায় না। সন্দেশ পেতে হয় সন্দেশের দামেই কিংবা মন্দিরের প্রসাদ হিসেবে। এখন আপনি সন্দেশের দাম মেটাবেন, না কি মন্দিরের ভক্ত হবেন, সেটা আপনার ব্যাপার। দাম মেটাতে পারলে ও ঠিক দোকানটা চিনলে নিজের ইচ্ছে ও সময়মতো সন্দেশ পাবেন; আর দাম মেটাতে না পারলে মন্দিরের ইচ্ছে ও সময়মতো সন্দেশ পাবেন, এমনকী না-ও পেতে পারেন কিংবা পেলেও সন্দেশের বদলে মিছরিও পেতে পারেন। প্রসাদ পছন্দ না হলে বড়োজোর মনঃক্ষুণ্ণ হওয়া যায়, তবে তা প্রকাশ করা যায় না, কেননা দেবতার ইচ্ছেই যে প্রসাদ, আর প্রসাদ মাত্রই শিরোধার্য!