বাহ্য হতে ব্রহ্মে

বাহির ও ভেতর নিয়েই এ জগৎ। একটি সদর, অন্যটি অন্দর; একটি স্থূল, অন্যটি সূক্ষ্ম; একটি আবরণ, অন্যটি আবৃত; একটি ভূষণ, অপরটি ভূষিত—এটাই জগতের নিয়ম, এটাই জগতের শোভা। জগৎ আবরণকে বড়ো ভালোবাসে, কেননা আবরণেই তার উৎপত্তি, আবরণের বিনাশেই তার বিনাশ। বলা যায়, আবরণই জগতের সব কিছু। আবরণের অলঙ্কার না থাকলে জগতের মলিন মূর্তি বেরিয়ে পড়ত, উপরের চাকচিক্য নষ্ট হয়ে ভেতরের ভগ্নস্তূপ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ত।




জলের মরীচিকা দেখে তৃষ্ণার্ত হরিণ ছুটে যায়, টসটসে মাকাল ফলে বালকের মন মোহিত হয়—কেউই ওসবের ভেতরের দিকে তাকায় না। ততখানি শ্রম ও সময় খরচ করতে কেউ প্রস্তুত নয়।‌ এ জগতের প্রতি আমাদেরও এমন ভাব।




আমরা জিনিস ছেড়ে আবরণ নিয়ে উন্মত্ত। ফলের ভেতরস্থিত আসল ভাগটুকু ছেড়ে আমরা তার উপরের আবরণটুকু চিবোতে চাই—এ বড়ো বিভ্রাটের কথা। "আমি তোমাকে ভালোবাসি।"—এ খুব ফাঁপা একটা কথা। তোমার কোনো একটি গুণের মাধুরী, কোনো একটি ভাবের লহরী, কোনো একটি সৌন্দর্যের আলোকমালা—সকলে মিলে তোমার উপর এমনই এক কুহকময় আবরণ রচনা করেছে, এমনই এক সাজে সাজিয়েছে যে—আমি সত্যিকারের তোমাকে ভুলে সেই আবরণকেই ভালোবেসে ফেলেছি!




তোমাকে ভালোবাসিনি, তোমার আবছায়াকে ভালোবেসেছি। আমার মনের চোখ তার সামনে প্রথমে তোমার বিচিত্র আবরণটিকেই দেখতে পেয়েছে। সেই আবরণের ভেতরে তুমি-রূপ যে আবার একটা অতিরিক্ত সত্তা আছ, তার সঙ্গে আমার মনের কোনো জানাশোনা নেই, আলাপ-পরিচয় নেই। কাজেই অজানা অচেনা যে তুমি, সেই তোমাকে মন কেমন করে ভালোবাসবে? তোমাকে জানতে হলে তোমার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতে হলে বড্ড যন্ত্রণায় পুড়তে হয়। এক খাঁটি সোনা বাদে আর কেই-বা পায় তোমাকে!




প্রকৃত তোমাকে জানতে হলে প্রথমে তোমার এই মোহনীয় শারীরিক ছবিটিকে ভুলতে হবে, তোমার মধুর কোমলকান্তি হাসিমাখা মুখটিকে ভুলতে হবে। তোমার অমিয় ভাবপূর্ণ—মমতা ও ভালোবাসার খনি—অন্তঃকরণটিকেও বিদায় দিতে হবে। শুধু তা-ই নয়, তার বিপরীত ভাবনাও ভাবতে হবে। এই যে তোমার শরীরটা, এটা একটা রক্ত, মাংস, মেদ, মজ্জার পিণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। এই যে তোমার মনটা, এটা তোমার মায়াবী বাঁধনের রশি, পৃথিবীর দিকে টেনে-রাখা এক দারুণ পিছুটান। এই যে 'তুমি' ভিন্ন যা-ই কিছু স্থূলদৃষ্টিতে দেখা যায়, তার সবই জড়ত্বের পরিণাম মাত্র, বিকারের বিস্ফুরণ মাত্র।




এ সব কিছুরই অণু-পরমাণুতে অনিত্যতা মাখা। এসব ছাড়িয়েই তোমার অবস্থান। এতগুলি স্তর ছাড়িয়ে এতখানি পরিশ্রম করে তবেই ভেতরের তোমাকে জানতে হবে। সুন্দরকে অসুন্দর ভেবে, অমৃতকে গরল ভেবে প্রাণে-কল্পিত প্রিয়কে দূরে ঠেলে 'তোমার' কাছে পৌঁছতে হবে। বড়ো কঠিন এ কাজ! এ বড়ো অসাধ্য সাধন!




এ আমার মনের সামর্থ্যের বাইরে। তাই আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারলাম না, কেবল তোমার আবরণ নিয়েই মুগ্ধ হলাম। তোমার আবরণ ক্ষণভঙ্গুর, আমার ভালোবাসাও তাই ক্ষণভঙ্গুর—কিন্তু আত্মজ্ঞ যোগীর ভালোবাসা নিত্য, কেননা তিনি আববণ ভেদ করে মূল বস্তুকে ভালোবাসতে শিখেছেন। তিনি একটি পতঙ্গকে যে-চোখে দেখেন, তার চাইতে অনেক উন্নত জীব মানুষকেও, একই চোখে দেখেন। তিনি জানেন, পতঙ্গত্ব আর মনুষ্যত্ব ভিন্ন হলেও পতঙ্গাত্মা আর মানবাত্মা ভিন্ন কিছু নয়।




আবরণ ভিন্ন হলেও জিনিস কিন্তু অভিন্ন, উপাধি ভিন্ন হলেও উপহিত তবু অভিন্ন। আমাদের চোখে পতঙ্গ নিতান্তই তুচ্ছ একটি জীব মাত্র। অন্তর্দর্শী যোগীর চোখে তা-ই আবার শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-স্বভাব চিতিশক্তির জীবন্ত মূর্তি। আমাদের চোখে রমণীর অপূর্ব দেহপল্লব কতই-না কমনীয়, কিন্তু যোগীর চোখে তা মেদ, মাংস, অস্থি ও রক্তের এক সমন্বিত রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। একজন স্থূলদর্শী মূর্খের চোখে একখানি তালপাতার জীর্ণ, পুরোনো পুঁথি হেয় বিবেচনায় পোড়ানোর যোগ্য হতে পারে, কিন্তু পণ্ডিতের চোখে তা শিরোধার্য অমূল্য নিধি। মূর্খের হাতে না পড়লে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য অমূল্য পুঁথি নিশ্চয়ই পুড়ে ছাই হয়ে যেত না।




তীব্রবিশ্বাসী প্রেমিকের প্রাণে 'হবি' কথাটা কত মধু ঢেলে দেয়; 'হবি' শব্দটি শুনে তিনি কী এক অপূর্ব ভাবে বিভোর হয়ে যান! স্থূলতার মূর্তিমান কীট আমরা তা বুঝতেই পারি না। আমরা কেবল 'হ' আর 'বি', এই অক্ষর দুটিই দেখি। আজ আমাদের ধর্মপ্রকৃতি ও ধর্মভাব এমন মলিন আবরণে ডুবে গেছে, পূর্ণিমার চাঁদ এমন কলঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, আর এসবের ফলে স্বচ্ছ দর্পণে এমনই কলুষ ধূলি জমেছে যে, প্রকৃত শাস্ত্রীয় সত্যের প্রতিবিম্ব সেখানে আর পড়ে না।




আজ শাস্ত্র পড়লে—কোথায় শুদ্ধ শুভবুদ্ধির উদয় হয়ে ব্ৰহ্মমননে নিযুক্তির ভাব আসবে—তা আর হয় না, বরং অদৃষ্টের ফেরে এক ঘোরতর নাস্তিক হয়ে বসি—নিজেকেই আর চিনতে পারি না তখন। নিজেকে চেনে না যে, সে-ই নাস্তিক।




আজ বেদ পড়ে বৈদিক প্ৰকৃতি লাভ করে কোথায় জীবনকে ধন্য মনে করব, তা না হয়ে উলটো দর্শনখনি বেদ আমার চোখে চাষার অর্থহীন গান হয়ে দাঁড়ায়! সে-কালের লোকে কী জানি বেদ পড়ে কী বুঝত! আমি কিন্তু তেমন কিছু বুঝতে পারি না। সামনে থাকা মেঘের কালো যেমন সূর্যকে দৃষ্টিসীমার বাইরে নিয়ে যায়, ঠিক তেমনি আমার মনের চোখের সামনে কী-একটা আবরণের বিকট মূর্তি বৈদিক প্রতিভার সব দরোজা বন্ধ করে দিয়েছে। যিনি শাস্ত্রের আবরণ ভেদ করে শাস্ত্রের প্রকৃত মর্ম, প্রকৃত প্রতিপাদ্য বুঝেছেন, তিনিই ধন্য, তিনিই সুখী। যিনি সেটুকু পারেননি, তিনি শাস্ত্রজ্ঞ হয়েও মূর্খ; আর যিনি সেটুকু পেরেছেন, তিনি অশাস্ত্রজ্ঞ হলেও পণ্ডিত। সবই বোধের ব্যাপার।




একটা দৃষ্টান্ত দিই। চৈতন্যদেব যখন নীলগিরিতে ছিলেন, সেই সময়ের একটা ঘটনা বলছি।




একদিন চৈতন্যদেব পথে যাচ্ছিলেন, তাঁর পথের পাশে কোনো ঘর হতে ভগবদ্‌গীতা পাঠের অশুদ্ধ উচ্চারণধ্বনি তাঁর কানে বাজল। তিনি সেই শব্দের খোঁজ করতে করতে দেখতে পেলেন যে, একটি ঘরে এক ব্রাহ্মণ-সন্তান বড়োই আন্তরিকতার সাথে গীতাপাঠে নিযুক্ত। তাঁর প্রেমোদ্‌বেলিত অশ্রুধারা গাল বেয়ে নিচে পড়ছে। ভাবের উচ্ছ্বাসে তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে। তাঁর গা হতে যেন স্বর্গীয় প্রভা ফুটে বের হচ্ছে। ফুটন্ত জোৎস্নার মতো তাঁর মুখখানি সারাঘর আলো করে রয়েছে। চৈতন্যদেব স্তম্ভিত হলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, "বাবা, তুমি গীতার যে-অংশ আবৃত্তি করছ, তার সমস্ত অর্থ কি বুঝেছ? যদি বুঝে থাকো, তবে উচ্চারণ অশুদ্ধ হচ্ছে কেন? তুমি গীতা কার কাছে অধ্যয়ন করেছ? সেই গুরুর নাম কী?"




ব্রাহ্মণতনয় উত্তর দিলেন, "আমি গীতা কারও কাছে পড়িনি। গীতার অর্থ আমি বুঝি না। গুরু-আজ্ঞায় কেবল আবৃত্তি করে যাচ্ছি মাত্র।" চৈতন্যদেব আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি গীতার অর্থ কিছুই বোঝো না, অথচ কীসের ভাবে উন্মত্ত হয়ে এভাবে অশ্রু বিসর্জন করছ?" তিনি উত্তর করলেন, "আমি যখন গীতা খুলে গীতার একটা শ্লোক আবৃত্তি করতে যাই, তখনই আমার সামনে সেই পীতাম্বরধারী শ্যামল-জলদবপু লীলা-রসময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রথে সারথি হয়ে অর্জুনের সাথে বসে যেন হাসতে থাকেন। আমি আমার সেই প্রাণের ঠাকুরকে দেখে বিমোহিত হয়ে যাই। তাই কেঁদে কেলি।"




চৈতন্যদেব অবাক হয়ে তাঁর গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, "বাবা, তোমারই গীতাপাঠ সার্থক। তুমিই গীতার ভেতরে প্রবেশ করেছ, সাগরে ডুবেছ, আর সব পণ্ডিত কেবল গীতার বাঙ্‌ময় স্তূপের বোঝা বয়েই মরে। কেবল গীতা মুখস্থ পড়ে যায় আর নটের কাজ করে। তুমি দেবতা, তোমার পায়ের ধুলা নিতে হয়!"




আমরাও চৈতন্যদেবের সুরে তা-ই বলতে চাই। বাস্তবিক অর্থে, শাস্ত্র পড়ে যে-ব্যক্তি শাস্ত্রের প্রতিপাদ্যের দিকে তাকায় না, সে বড়ো হতভাগ্য। আবরণের কুহকে না মজে জিনিসের দিকে দৃষ্টিপাত করাই মানবজীবনের উদ্দেশ্য। বাইরের অবগুণ্ঠন হতে ভেতরের দিব্য প্রভার স্ফুরণ‌ই উন্নতির লক্ষ্য। স্থূলকে পৃথক করে স্বপ্নের বিভিন্ন অস্তিত্ব নিরূপণ করাই জীবনের প্রধান ব্রত। কিন্তু যাঁরা প্রথমে স্থূলকে বিনষ্ট করে, স্থূলকে পরিত্যাগ করে, স্থূলের সাহায্য না নিয়ে সূক্ষ্মের দিকে দৌড়াতে থাকেন, তাঁদের পতন পদে পদে। তাঁরা ভ্রান্ত জীব। সূক্ষ্মকে নিরূপণের যন্ত্র হিসেবে যাঁরা স্থূলকে অবলম্বন করে নেন, তাঁরাই প্রশংসনীয়।




আগে স্থূলের স্থূলত্ব বোধ না জন্মালে সূক্ষ্মের সূক্ষ্মত্ব বোধ হতে পারে না। প্রথমে, স্থূল শরীর ও লিঙ্গ শরীর, এই দুইয়ের আপেক্ষিক স্থূলত্ব ভালো করে না বুঝলে এদের সাহায্য ছাড়া আত্মস্বরূপের বোধ হতে পারে না। যিনি সাধক, তিনি ধীরে ধীরে একটার পর একটা করে আবরণ উন্মোচন করতে করতে একসময় আধ্যাত্মিক রাজ্যে প্রবেশ করেন। প্রথমে অন্নময় কোষ, তারপর প্রাণময় কোষ, তারপর মনোময় কোষ, তারপর বিজ্ঞানময় কোষ, তারপর আনন্দময় কোষ—এভাবে পরপর অতিসূক্ষ্ম আত্মার চেয়ে স্থূল আবরণগুলি ভেদ করতে করতে সাধক যখন সবীজ সংপ্রজ্ঞাত সমাধিতে মগ্ন হন, তখনই তাঁর কামনার শেষ হতে থাকে। তখনই তিনি প্রাণের মাঝে জ্যোতির্ময় মূর্তিকে দেখে আনন্দে পুলকিত হন।




তবে তখনও তিনি তাঁকে প্রাণভরে দেখতে পান না। তখনও তাঁর সমস্ত চিত্তবৃত্তির নিরোধ হয়নি। তাই পূর্ণভাবে তখনও তিনি আত্মাকে অধিকার করতে পারছেন না। বাঞ্ছিত বস্তুকে পূর্ণভাবে অধিকার করতে না পেরে তাঁর প্রাণ বড়ো ব্যাকুল হয়ে থাকে। তিনি মর্মবেদনায় ক্রমেই অধীর হয়ে ওঠেন। তখন তিনি ভাবছেন…




তারে ধরি ধরি মনে করি,
ধরতে গেলেও আর পেলেম না।




তারে আমার আমার মনে করি,
আমার হয়েও আর হ‌ইল না।




সে মানুষ চেয়ে চেয়ে,
ফিরিতেছি পাগল হয়ে;
মরমে জ্বলছে আগুন,
আর নিভে না।




(গগন হরকরা)




যখন তাঁর ব্যাকুলতার একশেষ হয়ে দাঁড়াল, তখন তিনি অসংপ্রজ্ঞাত নিরোধ-সমাধি অবস্থায় পৌঁছলেন। যা-কিছু সংপ্রজ্ঞাত সমাধি অবস্থায় অনিরুদ্ধ ছিল, নিরোধ-সমাধিতে সেসবের সম্পূর্ণ বিলয় হলো। তখনই তিনি নিরাবরণ নিষ্কল-অখণ্ড ব্রহ্ম হয়ে দাঁড়ালেন। এটাই সূক্ষ্মতার নিরপেক্ষ চরম সীমা।