জীব ও ঈশ্বর

আমি সংসারের অভাব-অভিযোগে উদ্‌বিগ্ন, দুঃখ-দারিদ্র্যে উৎপীড়িত, রোগ-শোকে অবসন্ন, ঘাত-প্রতিঘাতে ক্ষত-বিক্ষত—আমি শান্তি চাই; শান্তির একমাত্র নিলয় তুমিই; শান্তি চাওয়া যে তোমাকেই চাওয়া, তাই, প্রভু, আমি তোমাকে চাই।




বাগানে এলাম, শুধু পাতা গুনে গুনেই দিশেহারা হলাম, আমার আম খাওয়া আর হলো না। সবদিকে কেবল হিসাব-নিকাশ! হীরে ফেলে তুচ্ছ কাচখণ্ডের দিকেই আমার যত ঝোঁক। জানি, এসব হিসেবে কিছুই লাভ হবে না, তবু হিসেবের দিকেই কেবল নজর। আমি কেবল গুনেই খুশি হতে শিখেছি!




কখনো কখনো কত প্রশ্ন জাগে—আমি কোথায় ছিলেম, কেমন করে এখানে এলেম; যাব কোথায়, তুমি কে, তুমি আমাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে এসেছ কি, তোমার সঙ্গে আমার কী সম্বন্ধ…প্রশ্নের যেন শেষ নেই। এ-সব প্রশ্নের উত্তরে নানা লোকে নানা কথা বলে, বিভিন্ন শাস্ত্রেও বিভিন্ন প্রকারের কথা! বিশ্বাস করি তার কিছু—কিছু আবার করি না। সংশয় যেন কিছুতেই মেটে না। কার কাছে জানব এ-সব—কোথায় গেলে মিলবে সদুত্তর? কেন তুমি এই সুন্দর জীবজগৎ, চন্দ্রসূর্য, গ্রহনক্ষত্র সৃষ্টি করেছ—কে উত্তর দেবে? যদি কেউ এর উত্তর দিতে পারে তো সে যে এক তুমিই!




তোমার অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব নিয়ে তর্ক করার ইচ্ছে জাগে না। আমার বিশ্বাস: তুমি আছ—যেমন আমার মধ্যে, তেমনি সকলেরই মধ্যে। তুমি যে অন্তর্যামী! যারা ভাবে, তুমি নেই এবং তা ভেবেই ভালো থাকে—আমি ভাবি, তুমি ওদের ওভাবে ভাবতে দিয়েই ভালো রেখেছ। এ যে তোমারই লীলা, তাই ওদের ভাবনা নিয়ে আমি কখনোই কিছু মতামত দিই না। থাকুক না ভালো সেভাবেই—যাকে তুমি যেভাবে ভালো রেখেছ!




তুমি নির্লিপ্ত, নির্বিকার, চিরন্তন। পাপী-পুণ্যাত্মা, শিষ্ট-দুষ্ট, সাধু-অসাধু, ধনী-দরিদ্র—সকলেরই উপর তোমার সমান অহেতুক কৃপা। সবদেশে সবকালে সবঅবস্থাতে সকলেই তোমার কৃপার অধিকারী। জগতে এত এত প্রতিযোগিতা, নিষ্ঠুরতা, উৎপাত, অনাচার, অবিচার—এর জন্যে তো তুমি দায়ী নও। এই বৈষম্য ও বিভিন্নতার কারণ তো আমরাই—আমাদের কর্মফল। তোমার আলো, তোমার বাতাস সকলেরই জন্যে অবারিত।




হে কৃপাময়, তোমার কৃপাবাতাস বয়েই চলেছে—পাল তুলে দেবে যে, সে-ই বুঝতে পারবে। আমি পাল তুলতে পারিনে, সংসার-সমুদ্রে তরঙ্গাঘাতে আহত হই তাই বারবার। তোমার কৃপার কী শক্তি…বুঝতেই পারিনে!




তুমি রসস্বরূপ, পরম আনন্দস্বরূপ, অনির্বচনীয় প্রেমস্বরূপ। আমি রসপিপাসু, রসের আস্বাদ করলে ধন্য হব। আমি চিনি হতে চাইনে, চিনি খেতে ভালোবাসি। তোমাকে আস্বাদ করতে চাই—রূপে রসে ছন্দে বর্ণে গন্ধে গানে। ক্ষুদ্রকায় পিঁপড়ের মতো আমার অবস্থা—এক দানা চিনিতেই আমি ভরে যাই, চিনির পাহাড়ে আমার কী কাজ?




তুমি আমার ভেতরে থেকে অন্তরের দ্বার বন্ধ করে দিলে কেন? আমার অভিমান—আমার অহংকারের জন্যে? তোমার দেওয়া রং-বেরঙের খেলনা নিয়ে ভুলে রইলাম বলে? আমি তোমাকে চাইছি না বলে আমার মায়ামোহের বেড়া ভেঙে দেবে না তুমি? আমার আকুতি ঐকান্তিকতা নেই বলে কি তোমার দেখা পাবো না?




আমার অহংকার? সে তো তোমারই! তুমি সেই অহংকারকে নিঃশেষে নাশ করে দিয়ে আমাকে সম্পূর্ণভাবে তোমার করে নাও। আমার মনের সব মলিনতা মুছিয়ে দিয়ে আমার শরীরকে তোমার মন্দির করে দাও।




তুমি নিরাকার নিরাধার—আবার সাকার সর্বাধার। আমি কিন্তু তোমাকে সাকাররূপেই চাই। তোমার প্রেমময় দৃষ্টিনন্দন মোহনরূপ দেখার বড়ো সাধ আমার। দাও দিব্যচক্ষু, সর্বত্র তোমার ঐশ্বরিক রূপ প্রত্যক্ষ করি—সর্বজীবের মধ্যে তোমাকে দেখে আনন্দতীর্থে স্নান করি।




তুমি তো পিঁপড়ের পায়ের নূপুরধ্বনিও শুনতে পাও, আর আমার অন্তরের বেদনগুঞ্জন তোমার কানে কি পৌঁছায় না?




তুমি আমাকে যে ধরে রয়েছ, এ তো বুঝতে পারিনে; তুমি যে আমাকে নিরন্তর রক্ষা করে চলেছ—এ বোধ হয়‌ই-বা কই? তাই আমি তোমাকে ধরতে চাই, কিন্তু তোমার দেখা পাইনে—তোমাকে ধরতে না পেরে পড়ে যাই, আছাড় খাই। বিপদে-আপদে দুঃখের দিনে পথ হারিয়ে ফেলি। সম্পদের দিনে ধন-বিদ্যা-মান যখন আসে, তখন মনে হয়, আমার শক্তিতেই পেলাম এ-সব, বিপদের সময় তোমাকে দোষ দিই। তোমার অলক্ষ-হাতের ক্রীড়নক যে আমি, তা মনে থাকে কই? সম্পদে-বিপদে প্রতিপদক্ষেপে তুমি আমায় ধরে থাকো; তুমি ধরে থাকলে আমার আর পড়ে যাবার ভয় থাকবে না।




যখন আহার করি, মনে করি, তোমাকেই অর্পণ করছি, তুমি যে আমার ভেতরে রয়েছ; কিন্তু শুধু মনে করাই সার—তুমি যে গ্রহণ করছ, তা তো বুঝি না। সন্ধ্যারতির সময় তোমার মধুর স্তবগান করি, মুখে উচ্চারিত হয় তোমার পূজার মন্ত্র—তবু ওসব অন্তর স্পর্শ করে না একটুও। দিনরাত কত কথা শুনি—তার সবই কি তোমার বাণী? বিশ্বব্যাপী তুমি, আমার ভ্রমণ কি তবে তোমাকে প্রদক্ষিণ করা হবে না? কেন যে এত সংশয়ে ডুবে থাকি!




মন্দিরে মন্দিরে ছুটোছুটি করি তোমাকে পাবো ভেবে, গঙ্গাস্নানে পূজা-পাঠে ধ্যান-জপে কাজকর্মে সময় কাটাই তোমার স্পর্শ অনুভব করব বলে—কিন্তু সকল আশাই দুরাশায় পর্যবসিত হয়, তোমার দীপ্তিতে আমার অন্তরলোক আলোময় হয় না।




শাস্ত্র পড়া হয়েছে, যুক্তিতর্কও কত হলো—তবু অনুভূতি কই? তবে কি সবই নিষ্ফল? ধর্মজীবনের পূর্ণতা যে অনুভূতিতে! এই অনুভব তোমার কৃপাসাপেক্ষ। আমার সমস্ত অহংকার দূর করে আমায় তোমার যোগ্য করে নাও।




আমি ঊষর মরুভূমির মতো হয়ে আছি—তোমার স্নিগ্ধ-শ্যামল স্পর্শে আমায় সরস-শ্যামল করবে না? তুমি অমৃত, আমি অমৃতের সন্তান। তবুও কেন আমার ভয় কাটে না? আমি জীবমায়ার অধীন, আর তুমি ঈশ্বর—মায়াধীশ। তুমি মায়ার সাক্ষী—প্রকাশক; তাই মায়া তোমার বশীভূত। অনির্বচনীয় মায়া তোমারই শক্তি। আমার দুইটি রূপ—ব্যক্ত, অব্যক্ত। আমার ব্যক্ত রূপটিই আমি জানি। জাগ্রৎকালে আমার যা-কিছু অনুভূতি, তার সবই এই ব্যক্ত রূপটি নিয়েই।




সুষুপ্তির অজ্ঞানে যখন জগতের সকল পদার্থই অব্যক্তভাবে অবস্থান করে, তখন সংস্কার-সমষ্টিরূপ সেই অজ্ঞানের দ্রষ্টা ও নিয়ন্তা তো তুমিই। তোমার থেকেই জগৎ ব্যক্ত হয়, তুমিই সর্বত্র সমভাবে অনুস্যূত থেকে সৃষ্টির বীজাবস্থা, সূক্ষ্ণাবস্থা ও স্থূলাবস্থা প্রকাশ করো। সকল জগৎকে এককালে জানছ বলে তুমি সর্বজ্ঞ। আমি জীব—খণ্ডে আমার অভিনিবেশ, তাই আমি অল্পজ্ঞ। খণ্ডদেহে অভিমানবশত আমি অপূর্ণ হয়ে 'হায় হায়' করছি।




এ জগৎ তোমার সৃষ্টি, সঙ্কল্প, লীলা। জগৎসৃষ্টির জন্যে বাইরের কোনো উপাদানের প্রয়োজন হয়নি তোমার—বাইরের কোনো বস্তুর অপেক্ষাও করোনি তুমি। তোমার বাহিরই-বা কোথায়? যদি সৃষ্টির জন্যে বাইরের কোনো বস্তুর উপর তোমাকে নির্ভর করতে হতো, বাইরের বস্তু সংগ্রহ করতে হতো, তাহলে তো তুমি সৃষ্টিকর্তা হতে না। তাই সৃষ্টি তোমার সহজ সঙ্কল্প।




সৃষ্টির পূর্বে মায়াশক্তি তোমাতেই লীন থাকে। অনাদি সংস্কার থেকেই তুমি এই জগৎ সৃষ্টি করেছ। মহাপ্রলয়ে কর্মবাসনা নিয়েও জীবগণ অজ্ঞানে লীন থাকে। জীবগণের সমস্ত কর্ম ফলদানে উন্মুখ হলে তোমার সৃষ্টি করার ইচ্ছে হয়, তখন তুমি নিজের মায়াশক্তিকে ঈক্ষণ করো। মণিপ্রভার মতো তোমার ঈক্ষণ স্বাভাবিক—ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি প্রভৃতি করণের উপর তোমার ঈক্ষণ নির্ভর করে না।




সুষুপ্তি-অবস্থা থেকে আমার যে ব্যষ্টি-বুদ্ধি জাগ্রত হয়, এরও মূলে রয়েছে তোমার অনুগ্রহ। তোমার অভেদ দৃষ্টি নিত্য‌ই অবাধিত। তোমার স্বরূপজ্ঞান অগ্নির উষ্ণতার মতো তোমার নিত্য সহচর, তোমার জ্ঞানবল ও জ্ঞানক্রিয়া সত্য-স্বাভাবিক।




নাট্যকার যেমন নিজের সঙ্কল্পে নাটক রচনা করেন এবং নাটকের প্রত্যেক ব্যক্তি, বস্তু ও ব্যাপারের মধ্যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থেকে ওদের ধরে থাকেন, তুমিও তেমনি তোমার সঙ্কল্প-রচিত জগৎ-নাট্যের প্রত্যেক ব্যক্তি ও ব্যাপারের মধ্যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থেকে সব কিছুকে ধরে আছ। নাট্যকার যেমন নাটকের সব কিছু জানেন, সেই সব কিছুর সঙ্গে নিজের অভিন্নতা সম্পর্কে অবগত থাকেন, তুমিও তেমনি জগতের সব কিছু জানো, তোমার সৃষ্টির সব কিছুর সঙ্গে নিজের অভিন্নতা সম্পর্কে অবগত আছ। নাটকের সৃষ্টি-স্থিতি ও লয়-বিলয়ে নাট্যকার স্বাধীন, তুমিও সেরূপ জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়-বিলয়ে স্বাধীন—তোমার ইচ্ছের উপরেই নির্ভর করে জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়।




নাটকের সকল চরিত্র যেমন নিজ নিজ ব্যষ্টিভাবে অভিনিবিষ্ট থেকে নাটকের সব জায়গায় অনুস্যূত নাট্যকারকে কিংবা নাটকের সর্বাংশ দেখতে পায় না, আবার পরস্পরের ভাব সম্পর্কেও ওরা অবগত নয়—ঠিক তেমনি জগৎনাট্যে স্থিত একটি জীব 'আমি' ব্যষ্টিভাবে অভিনিবিষ্ট ও মুগ্ধ বলে জগৎ-নাট্যের সব জায়গাতেই অনুস্যূত তোমাকে এবং তোমার সৃষ্ট জগতের সব অংশ দেখতে পায় না ও জীবের অন্তরের ভাব নিয়েও জানে না।




তুমি ছাড়া আমার বা কোনো জীবের পৃথক সত্তা নেই, অহংকারবশে পৃথক সত্তা কল্পনা করেই নানা দুঃখভোগ। তোমার কৃপায় অজ্ঞান-প্ৰসূত খণ্ডভাব চিরতরে দূর হয়ে যাক আমার।




কার্য-কারণ-ভাবের মূলে তোমার সঙ্কল্প, তোমার মায়া। তুমিই কার্য, তুমিই কারণ। এই ভাব তোমার শক্তির খেলা—তোমার মায়া—এ দেশ-কাল ব্যাপ্ত করে থাকে, তুমি দেশকালাতীত, তোমার সৃষ্টিতে কার্যকারণের অবকাশ কোথায়? বিকল্পের দ্বারা তোমার সঙ্কল্প প্রতিহত নয়, যেহেতু তুমি স্বাধীন। সঙ্কল্পকর্তা তুমি ছাড়া তোমার সঙ্কল্পেরও পৃথক সত্তা নেই। মায়াশক্তিকে বশে রেখে সৃষ্টি করো বলে সঙ্কল্পে বহু হয়েও তুমি অভিন্নই থাক, তোমার পূর্ণত্ব কখনও খণ্ডিত হয় না।




জলে যখন স্থিরভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, তখন নানা আকারের তরঙ্গ দেখেও ঠিকই বুঝি, ওই তরঙ্গগুলি জল ছাড়া আর কিছু নয়। তুমি যদি আমায় দিব্যদৃষ্টি দাও, তবেই তো বুঝতে পারব—তোমার সৃষ্টির যা-কিছু আমার নয়নগোচর হচ্ছে, সবই সচ্চিদানন্দ পরমেশ্বর তুমি ছাড়া আর কিছু নয়। প্রকাশময় সূর্যরশ্মিও প্যাঁচার কাছে যেমন অন্ধকাররূপে প্রতীত হয়, তোমার মায়াশক্তিও আমার কাছে অজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই আমি বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে—তোমার অস্তিত্বকে উপলব্ধি করতে পারছি না।




তুমি চির-অবিনাশী, নিয়ত-ক্রিয়াশীল, সদা-জাগরিত। জগৎ-সংসার যখন নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, তখনও তোমার দু-চোখ নিদ্রাহীন। তুমি প্রতিনিয়ত কর্ম করেই চলেছ অনলস ক্লান্তিহীনভাবে। জগতে যা-কিছু পরিবর্তন ও বিকাশ, তার সবই তোমার কাজ। জগতের বিলয় হলেও তুমি অবিনাশী শাশ্বত পরমপুরুষ।




তোমার শক্তি অনন্ত, অনন্ত তোমার ঐশ্বর্য ও প্রেম। সমস্ত ঐশ্বর্য-বীর্য-যশ-শ্রীজ্ঞান-বৈরাগ্যের অধিকারী তুমি প্রাণীদের উৎপত্তি, বিনাশ, পরলোকপ্রাপ্তি ও ইহলোকে আগমন-যাপন, বিদ্যা-অবিদ্যা সবই জানো; তাই তো তুমি ভগবান। আমি নুনের পুতুল আর তুমি সাগর, তোমার পরিমাপ আমি করব কী করে?




তুমি অনন্ত শুদ্ধ নিত্যযুক্ত সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ, আমি অল্পশক্তিতে অল্পজ্ঞ। তুমি তিনকালে—অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতে চিরবিদ্যমান। তুমি স্বপ্রকাশ—তোমারই আলোয় আমি প্রতিভাত, প্রকাশিত।