বালথাজার (১৯৬৬)

রবার্ট ব্রেঁসোর ‘বালথাজার (১৯৬৬)’ নিয়ে গদার বলেছিলেন, “এ সিনেমা যে দেখবে, সে অবাক হয়ে যাবে। কারণ, এ সিনেমায় দেড় ঘণ্টায় পুরো পৃথিবীকেই তুলে ধরা হয়েছে।”

‘বালথাজার’ মূলত পাপ ও প্রায়শ্চিত্তের গল্প। বালথাজার একটা গাধার নাম, সে বারবার মালিকবদল হয়—মেরির হাতে, মাস্তান প্রকৃতির যুবকের হাতে, রাগী মাতালের হাতে, লোভী ব্যক্তির হাতে………মেরি বাদে সবাই তাকে কোনো কারণ ছাড়াই অত্যাচার করে। ১৮৬০ সালে কাউন্টেস অব সিগুর ‘গাধার স্মৃতিকথা’ নামে একটা বই লিখেন। সে বইয়ে প্রতিবাদ করতে পারে না বলে একটা গাধা পদেপদে কত অপমানের শিকার হয়, তার কথা লেখা আছে। ব্রেঁসো হয়তো সে বই পড়ে ‘বালথাজার’ বানানোর অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। নিরীহ গাধার জীবনগাথায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন মানুষের আসল চেহারা। বালথাজার যেন তার কাঁধে পুরো পৃথিবীর পাপ বহন করে চলেছে, নীরবে মানুষের নির্যাতন সহ্য করে গেছে দিনের পর দিন, এবং কোনো অপরাধ ছাড়াই শেষ পর্যন্ত মানুষের নির্দয়তার বলি হয়েছে। সিনেমাটি মূলত মানুষের পশুত্ব ও পশুর মনুষ্যত্ব, এ দুইয়ের বাস্তব দৃশ্যচিত্রণ। সিনেমাটি দেখার সময় ক্রোধ এসে ভর করে, মুহূর্তে মুহূর্তে বিষণ্ণ হয়ে যেতে হয়, এক ধরনের নৈরাশ্য গ্রাস করে রাখে, এবং সবশেষে নিজেকে অসহায় ও অথর্ব মনে হয়। মজার বিষয়, ‘বালথাজার’ যদি সাইলেন্ট ফিল্ম হিসেবেও নির্মিত হত, তবুও তাতে থিমের কোনো হেরফের হত না। এ ছবিতে শব্দের তেমন কোনো ভূমিকাই নেই। ছবি দেখার সময় গল্পের প্লট ও চরিত্রগুলোর গতিবিধি তেমন একটা অনুমান করা যায় না। থিমটা বোঝা যায় গল্প শেষ হবার পর, তাও গল্পটা নিয়ে ভাবলে।

মানুষের দাম কতটুকু? দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ সমাজের কিছু নিয়ম আছে, এবং কেউ যতো দামি মানুষই হোন না কেন, সমাজের বিচারে যদি তিনি মূল্যহীন হন, তবে তাঁকে সেই গাধার জীবন বহন করেই বাঁচতে হয়। সমাজের বীভৎস পশুত্বের কাছে পশুদের সকল বৈশিষ্ট্য শিশুতোষ মাত্র, কোনো যুক্তির তোয়াক্কা না করেই সমাজের লোকজন কতটা নিষ্ঠুর, স্বার্থপর, অবিবেচক হতে পারে, তা সুস্থ মানুষের কল্পনারও বাইরে। মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই নিষ্ঠুরতায় আনন্দ পায়। যদি সেটির প্রদর্শন হয় সামাজিকভাবে কিংবা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে, তবে সেটিকে দায়িত্ব কিংবা প্রথা হিসেবেই লোকে পালন করে, এবং তখন সেটি হয়ে ওঠে একটি নৈতিক উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ! প্রসঙ্গত, ব্রেঁসোর ছবি নির্মাণের একটা স্টাইল আছে। তিনি যাঁদের দিয়ে অভিনয় করান, তাঁদের কেউই পেশাদার আর্টিস্ট নন। তিনি তাঁদের বলে দেন, ক্যামেরার সামনে কোনোভাবেই আবেগে উদ্বেল হওয়া যাবে না। এরপর তিনি বারবার শুটিং করতেই থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত চরিত্রগুলি গল্পের সাথে পুরোপুরি মিশছে। (এক দৃশ্যের শুটিং ৫০বার করার রেকর্ডও ব্রেঁসোর আছে!) ফলে তাঁর ছবির চরিত্র বরাবরই নিরাবেগ। তাঁর ছবিতে কেউ পোশাকি সংলাপ বলে না, একেবারেই সাদামাটা আলাপ বলতে যা বোঝায়, তা-ই করে। ‘বালথাজার’ দেখার সময় আমরা নিরাশ হই যখন দেখি অনৈতিকতা, দুরাচার, স্থলন, পাপ, অন্যায়, এইসব ব্যাপারগুলি সহজ ও স্বাভাবিকভাবেই ফিল্মের উপাদান হয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হতে থাকে, এবং ছবিটি সেসবকিছু থেকে উত্তরণের কোনো পথ দেখায় না।

এ ছবিতে গাধাটি যীশুর প্রতিভূ, সারাজীবনই মানুষের ভার বহন করে, অহেতুক নির্যাতন সহ্য করে, মৃত্যুবরণ করে খুব কষ্ট পেয়ে, তাও সে মরণ-প্রায়শ্চিত্ত এমন পাপের, যে পাপ গাধাটি করেইনি। আমরা দেখি, গাধাটির প্রতি একটু দয়া দেখিয়েছে যে লোকটি, তাকেও এমন দুর্ভাগ্য মেনে নিতে হয়েছে, যা তার প্রাপ্য ছিল না। সিনেমার দুইটি দৃশ্য মনে গেঁথে গেছে। এক। বালথাজারকে যখন সার্কাসে ব্যবহার করা হচ্ছে, সে তার খুরের সাহায্যে গাণিতিক হিসেব কষে দিচ্ছে, তখন বেচারা গাধাটিকে দেখে মনে হয়, যাক, এইবার সে একটু ভাল থাকতে পারবে, তখন অনেকটা ডিজনিমুভির সুখদৃশ্যের অনুভূতি আসে। এরপর যে-ই সে তার মালিককে দেখতে পায়, তখনই তালগোল পাকিয়ে বসে, এবং তার সারল্যের দাম দেয় পুরনো কষ্টের জীবনে পুনঃপ্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে। দুই। সবাই গানের তালেতালে বারে নাচছে, মদ্যপান করছে। সেসময় নায়িকার গুণ্ডা প্রকৃতির প্রেমিক হঠাৎ মাতাল অবস্থায় এদিকওদিক বোতল ছুঁড়তে শুরু করে, প্রচণ্ড শব্দে দেয়ালে বোতল ভাঙে, টেবিল আর শেলফ থেকে কাঁচের বোতল নিচে ছুঁড়ে ফেলতে থাকে। দেখা যায়, ওদিকে কারো কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, সবাই নিজেদের মতো করে আনন্দফুর্তিতে মেতে আছে। মানুষ যখন অতিসুখে থাকে, তখন মানুষ সাময়িক সময়ের জন্য বোধবুদ্ধিশূন্য হয়ে পড়ে। আশেপাশে কে কষ্টে আছে, কোথায় কোন অনর্থ ঘটে চলছে, এসবের দিকে তার কোনো খেয়ালই থাকে না।

আমাদের সমাজে নানান সংস্কার ও বাধানিষেধের বেড়াজালের মধ্যে আটকে পড়ে অনেকেরই দম আটকে আসে, মুখে কিছু বলতে না পারলেও সবসময়ই সুযোগ খুঁজতে থাকে কীকরে এখান থেকে পালানো যায়। যদি কখনো এই সামাজিক কারাগার থেকে পালিয়ে বাঁচার বিন্দুমাত্রও সুযোগ আসে, তখনই সে ওটা লুফে নেয়। ওতে যদি এমন কারো জীবনে জড়াতেও হয়, যে মানুষ হিসেবে খারাপ প্রকৃতির, তাতেও সে পিছু সরে আসে না। এ গল্পের নায়িকা মেরির প্রেমিক মেরিকে এমন এক জীবনের স্বাদ দিয়েছে, যা ছিল তার কাছে অচেনা, কাঙ্ক্ষিত। ফলে প্রেমিক মেরিকে নিজের খেয়ালখুশিমত ব্যবহার করেছে, অথচ মেরি তার প্রতিই আকৃষ্ট হয়েছে বারবার। সে ছেলেটি মেরির প্রিয় বালথাজারকে প্রহার করেছে, নিরীহ প্রাণীটির সাথে নিষ্ঠুর খেলায় মেতেছে বারবারই। মেরি কোনো প্রতিবাদ করেনি, বরং সব জেনেও মেরি তাকেই মনে জায়গা দিয়েছে। ছেলেটি লেদারের জ্যাকেট পরে বাইকে ঘুরে বেড়ায়, তার মতোই কিছু বখাটে ছেলের সাথে তার ওঠাবসা, ওদের জীবনযাপন মেরির চোখে রঙিন মনে হয়। হয়তো মেরিকে কাছে পেতে চায় বলেই মেরির প্রিয় পশুটিকে সে সহ্য করতে পারত না, কিংবা এমন নির্দয়তা তার স্বভাবজাত, দুটোর যেকোনোটিই হতে পারে। যা-ই হোক, মেরির চেহারায় যে সারল্য আর নিষ্পাপ ভাব, তা কোনোভাবেই এ স্বেচ্ছাচারিতার সাথে যায় না। মুভির শেষের দিকে দেখি, সে ছেলে তার বন্ধুরাসহ মেরিকে ধর্ষণ করে পালিয়ে যায়। ওদিকে মেরিকে সত্যিই ভালোবাসে যে ছেলেটি, তাকে মেরি ভালোবাসে না। কেননা, ছেলেটি ভদ্র, দায়িত্বশীল ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। সে মেরির প্রতি আন্তরিক হলেও মেরির চোখে সে বিরক্তিকর ও গতানুগতিক, তাকে ভালোবাসার কিছু নেই। প্রেমে পড়ার ক্ষেত্রে মেয়েরা ভুল মানুষকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। একটা মেয়েকে প্রেমে ফেলার ক্ষেত্রে তেমন একজন ভুল মানুষ অতুলনীয়। সমাজে এমন মেরির সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।

ব্রেঁসো তাঁর সাদাকালো ফ্রেমে বালথাজারের বড়বড় চোখে করুণা ও অসহায়ত্ব-মাখা যে প্যাথোস ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা আমাদের গভীর আবেগে স্পর্শ করে। ফিল্মের শেষ দৃশ্যটি অমূল্য। গুলিবিদ্ধ বালথাজার পালিয়ে একটা ভেড়ার পালে মিশে যায়, মাঠে বসে পড়ে, তখন তার চোখেমুখে প্রশান্তির ছায়া, স্বস্তির আশা। তবু সে শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারে না। রক্তক্ষরণের এক পর্যায়ে মারা যায়। মানুষের নির্দয়তা থেকে চিরমুক্তি মেলে। কারো কারো জন্য বেঁচেথাকার অর্থই হল নীরবে মুখ বুজে সকল অবিচার সহ্য করা। ওদের কাছে তো মৃত্যুই মুক্তি! ব্রেঁসো একটা গাধার জীবন দিয়ে সমাজের ও মানুষের চেহারা তুলে এনেছেন, জীবন ও নিয়তির রহস্যভেদ করার চেষ্টা করেছেন। গাধা যেমনি জীবনের শেষদিনটি পর্যন্ত মানুষের খেয়াল ও মর্জিমাফিক বেঁচেছে, তেমনি এ পৃথিবীর অনেকেই বেঁচে থাকে উপরের স্তরের কিছু মানুষের খামখেয়ালের আদলেই। যাঁদের হাতে পৃথিবী চলে, তাঁদের কেউই এ অবস্থার পরিবর্তন চান না, কেননা তাঁরা শোষিতের দলে নন। ফলে অবস্থা বদলায়ও না।