পারফিউম: দ্য স্টোরি অব অ্যা মার্ডারার (২০০৬)

প্যাশন মানুষকে দেবতার আসনে বসাতে পারে। কেউ যদি তার প্যাশনের প্রতি সৎ থাকে, তবে ক্রমেই নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে যেতে একটা সময়ে সে নিজেকে তার চারপাশের জগতের মানুষের চাইতে উচ্চস্তরে নিয়ে যায়। তবে প্যাশনের প্রতি অন্ধ হয়ে গেলে তা কেবল কষ্টই বাড়ায়। কখনোবা নিখাদ প্যাশন মানুষের আত্মিক মৃত্যু পর্যন্ত ঘটায়।

প্যাশন শব্দটির ব্যুৎপত্তি ল্যাটিন ‘প্যাশিও’ থেকে, যার অর্থ ‘কষ্টভোগ’। দেখা যায়, কারো কারো ক্ষেত্রে ক্রমাগত চর্চায় দক্ষতা ও মেধার সমন্বয়ে প্যাশনের প্রতি বিশ্বস্ততা এমন একটা পর্যায়ে চলে যায়, যখন ব্যক্তি প্যাশনকে নয়, প্যাশনই ব্যক্তিকে পরিচালনা করে এবং এমন অনেক কিছুই করিয়ে নেয় যা অস্বাভাবিক, ক্ষতিকর ও স্বার্থচালিত। সেসময়, যিনি আর্টিস্ট, তিনি আর্টের দোহাই দিয়ে এমন কিছু নেই, যা করতে পারেন না। সে কাজ প্রায়ই আমাদের বোধের সকল সীমা অতিক্রম করে নিকৃষ্টতার চরমে গিয়ে পৌঁছে। ওতে অবশ্য আর্টিস্টের কিছু এসে যায় না। পুরো পৃথিবীর দামে হলেও আর্টের উৎকর্ষ তার চাইই চাই!

কিছু আর্ট প্যারাসাইটের মতো, কিংবা আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, কিছু আর্টিস্ট আর্টকে প্যারাসাইটের মতো করে বাড়তে দেন। সে বৃদ্ধি বেপরোয়া, উন্মত্ত, বোধবুদ্ধিহীন। তেমন আর্ট আর্টিস্টকে দেয় মহিমা, পৃথিবীকে দেয় গ্লানি। জীবন, ভালোবাসা, প্রেম, শান্তি, সুস্থতা সবকিছুকেই নষ্ট করে দেয় এমন আর্ট!

যে সৃষ্টি স্রষ্টাকেই ধ্বংস করে দেয়, তেমন সৃষ্টির আখ্যান ‘পারফিউম: দ্য স্টোরি অব অ্যা মার্ডারার’। স্বপ্নের শিখরে পৌঁছেও আর্টের দানবীয় ক্ষুধা আর্টিস্টকে অতৃপ্ত করে রাখে। মুভির প্রোটাগনিস্ট চেয়েছে যেন এ পৃথিবীর সবাই তাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, ঈশ্বর মানে………এমন-কী যারা তাকে ঘৃণা করে, তারাও! পেয়েছেও তা-ই। তা পেতে গিয়ে একজন মানুষের পক্ষে যতটা অমানুষ হওয়া সম্ভব, হয়েছে। তবু প্রকৃতপক্ষে সে পায়নি কিছুই।

যে স্রষ্টা নিজের চাইতে তার সৃষ্টিকে বেশি ভালোবাসে, তার পক্ষে সফল হওয়া হয়তো সম্ভব, কিন্তু সার্থক হওয়া? নৈব নৈব চ! মুভির পারফিউমারের ক্ষেত্রেও আমরা এমন হতে দেখি। সবচাইতে বড়ো কথা, যে আর্টের মহত্ত্ব আর্টিস্টের সৌল নয়, বরং আর্টিস্টের অবজেক্ট নির্ভর, সে আর্ট মানুষকে ক্ষণিকের জন্য মোহিত করলেও আর্টিস্টকে এমন এক আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ফেলে দেয়, যা মৃত্যুর মতো নির্দয়।

মুভির প্লট অনেক জায়গায়ই খাপছাড়া, ভ্রান্ত। ম্যাকগাইভারের কেরামতি দেখাতে যা প্রয়োজন, তার সবকিছুই তার হাতের কাছে, কী এক অবোধ্য ইশারায় পরিবেশও অনুকূল হয়েই তৈরি! এ মুভির সিরিয়াল কিলার গ্রানুইলির ক্ষেত্রেও আমরা অমন হতে দেখি। সংবেদনশীল দর্শকমাত্রই এ শৈথিল্য সহজে খেয়াল করতে পারেন। মুভিটা দেখতে যেমনই লাগুক, শেষ না করে ওঠা যায় না। পুরো মুভি দেখার পর মনে হবে, পরিচালক টম টাইকার এমন এক অভিশপ্ত অতিমানবের জীবনযাত্রা আমাদের সামনে তুলে আনলেন, যার ক্ষমতার অভিঘাতে বিলীন হয়ে গেছে সকল প্রেম-ভালোবাসা,আশা-আকাঙ্ক্ষা কিংবা মনুষ্যত্ব।