বাকের ভাইয়ের চিঠি



অ্যাই মুনা, ভালা আছ? সেইদিন যে চিঠিটা পাঠাইলা, ওইটা পাইসি। পইড়া ভেরি গুড ফিল করসি। তোমারে মেনি মেনি থ্যাংকস।


মুনা, এইখানে আমি ভালাই আছি। বিড়ি-সিগারেট ফুঁকার অভ্যাসটা আর নাই, একদমই ছাইড়া দিসি। ভদ্রলোক হইয়া গেসি, পুরাপুরি জেন্টলম্যান। আমারে দেখলে তুমি এখন আর কঠিন ব্যবহার করতা না।


তোমারে মনে পড়লে মনটা খুব পোড়ায়, মুনা; কীরকম জানি ব্যাড ফিল হয়। মনে হয়, বেহেস্ত-দোজখ সব একলগে আগুনে পুইড়া ছারখার হইয়া যাইতাছে। ভালা লাগে না কিছু। মনের মানুষরে দেখতে মন চাইলে তখন যদি কিছুই করার না থাকে, তাইলে খুব বেশি কষ্ট লাগে।


মুনা, জানো, এইখানে রোজ মধ্যরাইতে আমার বুকের ভিতরে একরকম পাথরবৃষ্টি হয়। স্টোন-রেইন। তখন বুঝতে পারি, তুমি বুঝি আমারে মনে কইরা মরণকান্দা কানতেসো। প্রতিরাইতে এমন কইরা ক্যান কান্দো, মুনা? অতিরিক্ত কান্না ইজ ব্যাড ফর আই অ্যান্ড হার্ট। তোমার চোক্‌খের জলে ডুইবা আমি তলাইয়া যাই, মুনা। আমার কষ্ট হয়; খুউব কষ্ট হয়, মুনা! বাঁইচা থাকতে কষ্ট জানতাম; এখন দেখতাসি, মইরা থাকতে আরও বেশি কষ্ট।


মায়া হইল ভেরি ভেরি ব্যাড থিং, মুনা! একবার কাউরে ধরলে আর সহজে ছাড়তে চায় না, এক্কেবারে ছারখার কইরা দেয়। মায়ার চাইতে সিগারেট বেটার জিনিস, মুনা; অতটা ছারখার সে করে না। পারলে ওইসব মায়া-টায়া পাত্তা কম দিয়ো। ফিলিংস জিনিসটা পাত্তা পাইলে হুড়মুড় কইরা বাইড়া যায়। আর...এক্‌খান বিবাহ কইরো। তোমারে বিবাহের শাড়িতে দেখতে অতীব সুন্দর লাগবে। আচ্ছা, এতগুলা বছরেও কি আমারে ভুইলা যাইতে পারো নাই? ক্যান পারো নাই, মুনা?


রোজ রাত্তিরে বারান্দায় দাঁড়াইয়া আকাশের দিকে তাকাইয়া তাকাইয়া আমারে অমন হন্যে হইয়া ক্যান খুঁজো, মুনা? আমি তো তোমার অন্তরের ভিতরে, মগজের নিউরনে নিউরনে লুকাইয়া আছি। এত খোঁজার কী দরকার, মুনা? মরা মানুষরে অত বেশি খুঁজতে হয় না। মরা মানুষরে খুঁজলে খালি কষ্ট পাইতে হয়। পারলে কোনও জ্যান্ত মানুষরে খুঁইজো, মুনা!


এই যে দ্যাখো, মইরা গিয়াও তো তোমার কলিজায় দিব্যি জ্যান্ত থাইকা গেসি! পুরাই তাজ্জব ব্যাপার! আমি মইরা না গেলে কি মনে রাখতা এমন কইরা? যারা এখনও মরে নাই, ওদের কি কেউ মনে রাখে, মুনা?


যারা কয়, বাকের মইরা গেসে, হেরা কেউ আসলে তোমারে জানে না, মুনা। যদ্দিন তুমি বাঁইচা থাকবা, তদ্দিনই তো তোমার হার্টের আর কলিজার ভিতরে বাকেরও জিন্দা থাকব! তুমি অন্য কারও ঘরে চইলা গেলেও আমারে সঙ্গে নিয়া যাইবা; না নিয়া যাইতে পারবা না। মানুষ বড়ো অদ্ভুত জিনিস---জ্যান্ত মানুষরে সঙ্গে রাখে না, কিন্তু মরা মানুষরে সঙ্গে সঙ্গে নিয়া ঘুরতে ভালোবাসে। তোমারে দেইখা বুঝি, আমিও একদিন মনে রাখার মতন মানুষ ছিলাম। না থাকলে তো আর তুমি মনে রাখতা না। ঠিক কইসি না, মুনা, কও?


তয় মুনা, এখন আসি আসল কথায়। আরণ্যক বসু নামে একজন অতি উচ্চমানের কবি আছেহ্‌। তার লেখা একটা বিউটিফুল কবিতা শুনসি। নামটা মনে নাই। লাইনগুলাও মনে নাই, থাকলে তোমারে শুনাইতে পারতাম। আমি তো বুঝি কম, তবে ওই কবিতায় কিছু চরম রোম্যান্টিক জিনিস ছিল, ফিলিংসের আলাপ ছিল। বাকের পড়াশুনা না জানলেও ফিলিংস ঠিক‌ই বুঝে। কবিতাটা একজন শুনাইসিলো, ভালা লাগসিলো শুইনা। ওইখানে কিছু চমৎকার জিনিস পাইসি, মুনা।


পরের জনমে তোমার আমার দুই জনের বয়স হইব যখন ঠিক ষোলো বৎসর, তখন আমরা আবার প্রেমে পড়ব। ঠিক আছেহ্‌, মুনা? এই জনমে তো আর পারি নাই, তবে সেই জনমে মনে কইরা তোমারে আমার সব মোহাব্বতের কথা সাহস কইরা মুখ ফুইটা কইয়া ফালামু, মুনা। নো শেইম! শেইম ইজ ভেরি ভেরি ব্যাড ফর মাইন্ড। অত শেইম রাইখা কিছু হয় না, মুনা। মানুষ ম‌ইরা যায়, কিন্তু শেইমের আফসোসটা ঠিকই বাঁইচা থাকে। কী লাভ!


আরেকটা বিষয়। তুমি তো জানোই, মুনা; ওইসব ভালোবাসা-টাসা'র কথাবার্তা মুখে আনতে আমার কীরকম জানি শরম করে। কাউরে ভালোবাসলে মানুষ ক্যামনে যে দুম্‌ কইরা কইয়া ফালায়, তা আজও আমার বুঝে আসে না। মুখ ফুইটা কিছুই কখনও কইতে পারি না। বিগ প্রবলেম, বুঝলা, মুনা...ভেরি বিগ প্রবলেম!


সেইবার কিন্তু আমারে তুমি ফিরাইয়া দিয়ো না, মুনা! কও, দিবা না? আমার সঙ্গে ভালা কইরা দুই-চারটা আলাপ কইরো। বাকের একটু উড়াধুরা-মার্কা হইলেও তার মনের মধ্যে অনেক পিওর লাভ আছেহ্‌, মুনা। যারা মুখে কিছু কইতে পারে না, তারা অনেক ভালোবাসতে জানে, বুঝলা!


সেই জনমে পদ্মার পাড়ে ভাঙাচোরা হইলেও টিনের চালের ছোট্ট একটা ঘর হইব আমাদের। বৃষ্টি পড়লে টিনের চালে একধরনের অদ্ভুত আওয়াজ হয়, মুনা। বড়ো ভালো লাগে শুনতে! দুই-চারটা ছানাপোনা আর ঘরভর্তি মিল-মোহাব্বত ছড়ানো-ছিটানো থাকব। চারিদিকে খালি লাভ আর লাভ! তুমি হ্যাপি হইবা, মুনা। তোমারে হ্যাপি দেইখা খুশিতে আমি পাগল হ‌ইয়া যামু।


প্রতি পূর্ণিমা রাইতে জোসনায় ভিজতে ভিজতে তোমারে গান শুনামু…হাওয়া মে উড়তা যায়ে...গান শুনতে শুনতে আমার বুকের উপর মাথা রাইখা তুমি টুপ কইরা ঘুমাইয়া পড়বা। তোমার চুলে বিলি কাটতে কাটতে আমি আকাশের চান্দটারে গর্ব কইরা বলব, 'দ্যাখো চান্দ, দ্যাখো! আমার ভাঙাঘরেও তোমার মতন আরেক্‌খান চান্দ রোজ রোজ জোসনা ছড়ায়...! বাকের ইজ অ্যা ভেরি হ্যাপি ম্যান!'


কী কী-সব আগডুম-বাগডুম লিইখা ফালাইলাম! ডিপ ডিপ রোম্যান্টিক টকস! নিজেরই এখন শরম লাগতাসে। প্রেমে পড়লে মানুষের মাথা আসলেই ঠিক থাকে না, মুনা। অবশ্য মরা মানুষের শরমের কোনও দাম নাই! এক স্মৃতি বাদে মরা মানুষের আর কোনও কিছুরই কোনও দাম নাই!


আচ্ছা মুনা, কইতে পারো, এই দুই চোক্‌খে পরাণভইরা তোমারে আমি আবার কবে দেখব? দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করে। তোমার লাইগা এই মনে অনেক প্রেম, অনেক মায়া জমা আছেহ্‌। বাঁইচা থাকতে বুঝি নাই, মুনা! আমরা বড়ো আজব প্রাণী, সবই বুঝি, তবে হারাইয়া গ্যালে তার পরে বুঝি।


পরের জনমে তোমার আমার দেখাটা হইব তো, মুনা? সত্যি সত্যিই হইব তো? মুনারে না পাইলে বাকেরের জন্মাইয়া কী লাভ?