বাংলায় লেখা: দুই

১৬। লেখালেখি/লেখালিখি
এ জাতীয় ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাসবদ্ধ শব্দ বাংলায় অনেক আছে। তার মধ্যে যেগুলোর আদিতে কোনো ধাতু আছে এবং সেই সিদ্ধ একমাত্রিক ব্যঞ্জনান্ত ধাতুর মধ্যে ই-কার আছে, বর্তমান আলোচনার প্রয়োজনে কেবল সেগুলি লক্ষ করলেই চলবে। একবারে একটা বিশেষ শ্রেণির সব ধাতু মনে পড়ে না, তাই অগতির গতি রাজশেখর বসুর 'চলন্তিকা' অভিধানের শরণ নিয়ে আপাতত এই ধাতুগুলির উল্লেখ করছি:
কিন্, খিঁচ্, গিল্, ঘির্, চিন্, চির্, ছিঁড়্, জিত্, জিন্, টিক্, টিপ্, তিত্ (কেবল সাধু, পদ্যে), নিব্, পিজ্, পিট্, পিয়্ (কেবল সাধু, পদ্যে), পিষ্, ফির্, বিধ্, ভিজ্, ভিড়্, মিট্, মিল্, মিশ্, লিখ্, শিখ্, সিঝ্/সিজ্
এই ধাতুগুলো থেকে ব্যতিহার বহুব্রীহি সাধারণ কথ্য/লেখ্য প্রমিত বাংলায় যা প্রচলিত আছে তা এ-ই:
ঘির্ > ঘেরা > ঘেরাঘেরি, ছিঁড়্ > ছেঁড়া > ছেঁড়াছেঁড়ি, টিপ্ > টেপা > টেপাটেপি, পিট্ > পেটা > পেটাপেটি, পিষ্ > পেষা > পেষাপেষি, ফির্ > ফেরা > ফেরাফেরি, মিশ্ > মেশা > মেশামেশি
এর বাইরেও থাকতে পারে বা তৈরি করা যেতে পারে।
লক্ষণীয় যে, এই সবকটি শব্দেই স্বরধ্বনির ক্রম হল [এ-আ-এ-ই]। সেদিক থেকে দেখলে লিখ্ > লেখালেখি হওয়া স্বাভাবিক, 'লেখালিখি' হবে কি? যদি কেউ বলেন অন্তিম ই-কারের প্রভাবে স্বরসঙ্গতিতে লে > লি হয়েছে, যেমনটা প্রণম্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ODBL গ্রন্থে বলেছেন, তাহলে বাকি শব্দগুলোতে তা হলো না কেন? হলো না যখন, তাহলে কি সমতার খাতিরে এই স্বরসঙ্গত রূপ 'লেখালিখি' বর্জনীয়?
ব্যাপারটা বিশেষ করে ভাবিয়ে তোলে, কারণ ধাতুর একটি অন্য শ্রেণি উ-কারসম্পন্ন ধাতু থেকে ব্যতিহার বহুব্রীহিতে প্রায় সর্বত্র স্বরসঙ্গত রূপ দেখি: উড়্ > ওড়া > ওড়াউড়ি, খুল্ > খোলা > খোলাখুলি, ঘুর্ > ঘোরা > ঘোরাঘুরি, ইত্যাদি। যেসব শব্দ ধাতু থেকে আসে নি, যেমন কোল > কোলাকুলি, সেখানেও তা-ই।
লেখালেখি/লেখালিখি বিষয়ে প্রশ্নটা থেকেই যায়। তবে আমরা 'লেখালেখি'-ই প্রমিত হিসেবে নিই (বাকিগুলোর মতো করে)।




১৭। সচরাচর
মৌলিক অর্থ, চরাচর-সহ। চরাচর, অর্থাৎ চর: যা চলে এবং অচর: যা চলে না, তা নিয়েই এই যে মহাবিশ্ব। সংস্কৃতে 'সচরাচর' ছিল বিশেষ্য, কদাচ বিশেষণ, সাহিত্য/শাস্ত্র থেকে তার দৃষ্টান্ত বড়ো কোনো অভিধান দেখলেই পাওয়া যাবে। কিন্তু বাংলা প্রয়োগে 'সচরাচর' হয়ে উঠল বিশেষণ/ক্রিয়াবিশেষণ, প্রধানত ক্রিয়াবিশেষণ। অর্থ হলো 'সাধারণত'। 'চরাচর-সহ', অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, এই ভাব থেকেই বাংলায় এই 'সাধারণত' অর্থে প্রয়োগ। তা নিয়ে বেশ আছি। কিন্তু যখন চিন্তা করি, 'সচরাচর'-এর মধ্যে মহাবিশ্বের অন্তর্ভুক্তি ছিলই, তখন মনে না হয়ে পারে না যে 'সাধারণত'-র মধ্যে অর্থটা হয়তো সংকুচিত হয়েছে। এতটা সংকোচন না হলে 'সচরাচর' হয়তো ইংরেজি universal (বিশেষণ) বা universally (ক্রিয়াবিশেষণ) শব্দদ্বয়ের বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারত।
এ দুটি শব্দই জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা প্রসঙ্গে কাজে লাগে, অথচ আমাদের হাতে universal-এর জন্য 'বিশ্বজনীন' (বা বড়ো জোর 'সার্বত্রিক') ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই, এবং universally-র জন্য কী করব মোটেও ভেবে পাই না। আবার, 'বিশ্বজনীন' আসছে 'বিশ্বজন' থেকে, যার মধ্যে 'জন' অর্থাৎ লোকের প্রসঙ্গ চলে আসে, স্থাবর-জঙ্গম নিয়ে যে বিশ্ব, সেই সংজ্ঞার নৈর্ব্যক্তিকতা থাকে না।
আরও সুবিধে ছিল, 'সচরাচর' বাংলায় সেই জাতীয় ক্রিয়াবিশেষণ, 'দ্রুত', 'পাশাপাশি', 'মাঝামাঝি', 'হঠাৎ' ইত্যাদির মতো, যা কোনো বিভক্তি ছাড়াই প্রয়োগ করা যায়, 'জোরে' 'ধীরে' 'কমপক্ষে'-র মতো এ-বিভক্তি লাগে না। তাই universal equation-কে হয়তো বলা যেতে পারত 'সচরাচর সমীকরণ', universally valid-কে বলা যেত 'সচরাচর সিদ্ধ'। সে সুযোগ এখন আর নেই।




১৮। আচ্ছা, নিয়মাবলী বানানে লী হবে, না লি? রবীন্দ্র রচনাবলী, না রচনাবলি? আবলি/আবলী পরস্পরের বিকল্প হলেও বাংলা একাডেমি বলছে, আবলি ব্যবহার করতে হবে।




১৯। যাইনে/যাচ্ছিনে/যাসনে ইত্যাদি
লক্ষণীয়, এই নাস্তিবাচক 'নে' পদটি নিত্য বর্তমানকালের উত্তমপুরুষে 'যাই না', ঘটমান বর্তমানে উত্তমপুরুষে 'যাচ্ছি না', এবং অনুজ্ঞায় তুই-পক্ষে 'যাস না' --- এগুলি বিকল্পে পশ্চিমবঙ্গীয় বাগ্-ধারায় 'যাইনে', 'যাচ্ছিনে', 'যাসনে'। এভাবে 'করিনে/করিসনে', 'বলিনে/বলিসনে' ইত্যাদি। এগুলির প্রচলন এখন কমে এসেছে 'উম্'-বিভক্তিতে 'করলুম', 'করতুম'-এর মতোই, কিন্তু চলিতভাষার আদিযুগে যখন এই বাগ্-ধারায় লেখা হতো, তখন সাহিত্যেও 'খাইনে', 'খাসনে' ইত্যাদি দেখা যেত। রবীন্দ্রনাথ এইরকম প্রয়োগ ভূরি ভূরি করেছেন।
ক্রিয়ার যে যে কালে ও পুরুষে/পক্ষে 'না' হয়ে ওঠে, 'নে' তার প্রত্যেকটিতেই। দেখা যায় যে ক্রিয়ার বিভক্তিশৃঙ্খলের শেষে পুরুষবাচক বিভক্তিটির মধ্যে উচ্চস্বর ‘ই’ আছে। যেমন, করি = কর্ + ই, খাস < খাইস = খা + ইস্ ইত্যাদি। তাহলে 'করি না > করিনে', 'করিস না > করিসনে', অর্থাৎ '-ই-না > -ই-নে', '-ইস্-না > -ইস্-নে'; এটা কি পূর্বস্বর ‘ই’-এর প্রভাবে স্বরসঙ্গতির (স্বরোচ্চতাসাম্য) ঘটনা? যদি তা হয় তো বলতেই হবে যে বাক্যে পূর্বপদ পরপদের ধ্বনিপরিবর্তন ঘটাচ্ছে, এটা অতি অনন্য ঘটনা।
সব ক্রিয়ার শেষ syllable-এ যদি ‘ই’ থাকে, তাহলে পরের না-এর আ ‘এ’ হয়ে যায় স্বরসংগতি বা স্বরোচ্চতাসাম্যের নিয়মে। তাই উপভাষা বিশেষে যাবিনে, খাবিনে, যাইনে, খাইনে ইত্যাদি হয়। যাসনে আসলে যাইস্‌ + না, শুসনে শুইস + না। এটা আরও বড়ো নিয়ম--- ফিতা > ফিতে, ভিক্ষা > ভিক্ষে, বিদ্যা > বিদ্যে ইত্যাদি পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত। ক্রিয়াতে বলিনে, শুনিনে রূপও পাবে।




২০। ঝগড়াটে, ঝগড়ুটে
বাংলা শব্দপ্রত্যয় 'টিয়া'-যোগে 'ঝগড়া-টিয়া > ঝগড়াটিয়া > (অভিশ্রুতি) ঝগড়াটে'।
কিন্তু 'ঝগড়ুটে' এই উচ্চারণভেদটা (আ > উ) কী করে এল? আ > উ হবার মতো কোনো প্রতিবেশ তো দেখছি না। তবে সুকুমার সেনের 'ব্যুৎপত্তি-সিদ্ধার্থ'-তে দেখছি, 'ঝকড়/ঝগড়' বলে একটা শব্দ ছিল। যদি সেটা উচ্চারণে অ-কারান্ত (বা 'টিয়া' যোগে অ-কারান্ত) হয়ে থাকে, তাহলে তার থেকে 'ঝগড়ুটে' এসে থাকতে পারে।




২১। 'পণ্ডিতম্মন্য'; কিন্তু 'হীনম্মন্য', না 'হীনমন্য'?
'হীনম্মন্য'/'হীনমন্য' শব্দ হরিচরণ ও জ্ঞানেন্দ্রমোহনে নেই। মনিয়র উইলিয়ামসের সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধানে নেই। চলন্তিকা (ত্রয়োদশ সংস্করণ ১৩৮৯) ও সংসদে (সুভাষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত) আছে 'হীনমন্য'। বাংলা আকাদেমি বানান অভিধানে আছে 'হীনম্মন্য', ম্ম-র প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে বন্ধনীতে। তাহলে 'হীনমন্য' বনাম 'হীনম্মন্য' --- পক্ষে বিপক্ষে কী কী যুক্তি?
হরিচরণ, জ্ঞানেন্দ্রমোহন, চলন্তিকা ও সংসদে পণ্ডিতম্মন‍্য আছে। প্রথম দুটিতে হীনম্মন‍্য বা হীনমন‍্য কোনোটাই নেই। চলন্তিকায় হীনমন‍্য আছে, হীনম্মন‍্য নেই। সংসদে কিন্তু হীনম্মন‍্য-ই আছে, হীনমন‍্য নেই। বাংলা একাডেমির বিবর্তনমূলক অভিধানেও হীনম্মন‍্য ও হীনম্মন‍্যতা শব্দদুটি আছে। হীনমন‍্য নেই।
এখন একটু নিয়মে যাই। এখানে খশ্ প্রত‍্যয় আছে। খশ্ যে-সব জায়গায় হতে পারে, তার একটি হল √মন্ ধাতু, যদি তার আগে আত্মমনন অর্থে একটি কর্মবাচক পদ থাকে। সেক্ষেত্রে উপপদের পর ম্-এর আগম হবে। পণ্ডিতম্মন‍্য, কৃতার্থম্মন‍্য, ধন‍্যম্মন‍্য যদি হতে পারে তবে হীনম্মন‍্য না হওয়ার কোনও কারণ নেই। হীনম্মন‍্য শব্দটিতে নেগেটিভিটি থাকলেও সেটা আত্মমনন তো বটেই।
দ্বিতীয়ত, মন্য কথাটার আগে সাধারণভাবে দ্বিতীয়ার একবচন হয়, এইটা আমার মনে হয় সাধারণ নিয়ম। তাই পণ্ডিতম্মন্য (এটা সংসদেও আছে), তাই হীনম্মন্য, উচ্চম্মন্য। আমি হীনম্মন্য, হীনম্মন্যতাই লিখি।




২২। বয়ঃকনিষ্ঠ, মনঃকষ্টই হবে, বয়ঃসন্ধি-ও। বয়ঃকনিষ্ঠ > বয়োকনিষ্ঠ [সং. বয়স্ + কনিষ্ঠ] । শব্দমধ্যস্থ বিসর্গ বর্জিত রূপে বয়োকনিষ্ঠ, নিঃশ্বাস > নিশ্বাস, মন:কষ্ট > মনোকষ্ট। কোনগুলো শুদ্ধ হবে?
"বয়ঃক্রম" নিয়ে সমস্যা নেই, কারণ এটি বিসর্গসন্ধির নিয়মের সঙ্গে মেলে। সমস্যা "বয়োকনিষ্ঠ" শব্দের ওই ও-কার নিয়ে, এবং এটি কোনো নিয়ম দিয়ে মেলাতে পারি না। "বয়োগুণ" ও "বয়োধর্ম" ঠিক আছে।
পূর্বপদের শেষে ‘অ’-এর পর যদি স্-জাত বিসর্গ থাকে এবং পরপদের প্রথমে যদি বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম বর্ণ অথবা য র ল ব হ থাকে, তবে সূত্রানুযায়ী ও-কার হবারই কথা। সুতরাং ‘বয়োবৃদ্ধ’, ‘বয়োগুণ’, ‘বয়োধর্ম’ ইত্যাদির ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। এই নিয়মে 'বয়োকনিষ্ঠ' হয় না। বর্গের প্রথম দুটি বর্ণ নিয়েও সমস্যা নেই, যদি তারা চ/ছ, ট/ঠ, ত/থ হয়। যত সমস্যা ক/খ বা প/ফ পরে থাকলেই। শেষোক্ত ক্ষেত্রে সাধারণত বিসর্গ লুপ্ত হয় না। যেমন বয়ঃক্রম, বয়ঃপ্রাপ্ত, স্রোতঃপথ, মনঃকষ্ট, শিরঃপীড়া, স্বতঃপ্রবৃত্ত।
কিছু জায়গায় ‘স্’ আসে ব্যতিক্রম হিসেবে। যেমন, (১) ‘নমঃ’, ‘পুরঃ’, ‘তিরঃ’ শব্দের পর √কৃ-নিষ্পন্ন পদ থাকলে; (২) পরে ‘কর’ (শ্রেয়স্কর), ‘কার’ (পুরস্কার), ‘কান্ত’ (অয়স্কান্ত), ‘কামনা’ (মনস্কামনা) ইত্যাদি শব্দ থাকলে। এর মধ্যে তো ‘বয়ঃ’ শব্দের উল্লেখ দেখছি না। থাকলেও ‘বয়ঃকনিষ্ঠ’-র বদলে আমরা ‘বয়স্কনিষ্ঠ’ পেতাম, 'বয়ঃক্রম'-ও হয়ে যেত 'বয়স্ক্রম'। ‘বয়োকনিষ্ঠ’ কোনও নিয়মের মধ্যে পড়ে না।
বয়োজ্যেষ্ঠ, বয়োবৃদ্ধ, বয়োধর্ম ইত্যাদি ঠিক। বয়োকনিষ্ঠ ভুল।
মূল কথা এ-ই:
১. অ-কার ও স্-জাত বিসর্গের পর বর্গের ৩য় ৪র্থ ও ৫ম বর্ণ অথবা য র ল ব হ থাকলে অ-কার ও বিসর্গ মিলে ও-কার হবে। এই নিয়মে 'বয়োকনিষ্ঠ' হবে না।
২. অ-কার ও বিসর্গের পর ক খ প ফ থাকলে, দু-একটি ব‍্যতিক্রম ছাড়া, বিসর্গ যেমন ছিল তেমন থাকবে। অর্থাৎ 'বয়ঃকনিষ্ঠ'-ই হওয়া উচিত।
৩. ব‍্যতিক্রম বলতে 'পুরঃ' 'তিরঃ' 'নমঃ' আগে থাকলে অথবা 'কর' 'কার' 'কামনা' এরকম কয়েকটি শব্দ পরে থাকলে বিসর্গের জায়গায় স্ আসবে। যেমন - পুরস্কার বা মনস্কামনা। 'বয়ঃ' শব্দ এইসব ব‍্যতিক্রমের মধ‍্যে পড়ে না। পড়লেও 'বয়োকনিষ্ঠ' হত না, 'বয়স্কনিষ্ঠ' হত।
৪. সুতরাং 'বয়ঃকনিষ্ঠ'-ই শুদ্ধ বানান।
যে 'স্‌' বিসর্গের রূপ নেয়, তার পরে অঘোষ বর্ণ থাকলে তা বিসর্গই থাকে। তাই বয়ঃক্রম, বয়ঃকনিষ্ঠ, বয়ঃপ্রাপ্ত, বয়ঃসন্ধি। কিন্তু পরে ঘোষবর্ণ থাকলে তা ও-কার হয়ে যায়। তাই বয়োজ্যেষ্ঠ, বয়োধর্ম, বয়োবৃদ্ধ।
ট-বর্গ থাকলে হতো ষ (যেমন, 'ধনুষ্টঙ্কার'), চ-বর্গ থাকলে শ। 'মনঃ' দিয়ে 'মনশ্চক্ষু', ঘোষবর্ণ থাকলে 'মনোবেদনা', 'মনোনিবেশ'।




২৩। হচ্ছেটা কী --- (ক্রিয়া + পদাশ্রিত নির্দেশক 'টা')
পদাশ্রিত নির্দেশক 'টা' সাধারণত বিশেষ্য বা সর্বনামের সঙ্গে যুক্ত হয়, কিন্তু বাংলা প্রয়োগের বৈশিষ্ট্য হলো, তা সমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গেও যুক্ত হতে পারে। কয়েকটি উদাহরণ নীচে লিপিবদ্ধ করছি।
সাধারণ বর্তমান ---এখানে আছেটা কে/কী? এখানে হয়টা কী?
ঘটমান বর্তমান --- হচ্ছেটা কী? বসে বসে করছটা / করছিটা কী? ওখানে যাচ্ছেটা কে?
পুরাঘটিত বর্তমান --- তাতে হয়েছেটা কী? এতক্ষণে করেছটা / করেছিটা কী? ওখানে গেছেটা কে?
সাধারণ অতীত --- তাতে হলোটা কী? এতদিনে করলেটা কী? সেদিন গেলটা কে?
ভবিষ্যৎ --- এটা করে হবেটা কী? ওখানে গিয়ে করবেটা / করবটা কী? এত রাতে যাবেটা কে?
আমি যতটুকু এই প্রয়োগের বৈশিষ্ট্য লক্ষ করতে পারছি, তা হলো --- ১/ এগুলি প্রশ্নবাক্য, ২/ প্রশ্নবাচক সর্বনাম ক্রিয়ার পরে অবস্থিত, ৩/ ক্রিয়াগুলি সমাপিকা, ৪/ কর্তা সাধারণত আমি/তুমি, ৫/ সাধারণ বর্তমান, ঘটমান বর্তমান, পুরাঘটিত বর্তমান, সাধারণ অতীত, ভবিষ্যৎ কালে এই প্রয়োগ পাওয়া যায়। ৬/ ঘটমান অতীত, পুরাঘটিত অতীত ও নিত্যবৃত্ত অতীতে সাধারণত এ প্রয়োগ পাওয়া যায় না। ৭/ সব ক্রিয়ার ক্ষেত্রে এ প্রয়োগ খাটে না।




২৪। দু-রকম 'আর কি/কী' আছে। যে কি প্রশ্নের উত্তর 'হ্যাঁ' বা 'না' হবে, সেটা 'কি'। যেমন 'আর কি ওখানে গিয়ে লাভ হবে?' ' আর কি কিছু বলার আছে?' 'আর কি সে-দিন আছে এখন?’
কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর 'হ্যাঁ' বা 'না' হবে না, অন্য কিছু হবে, তাতে 'কী' হবে। যেমন, 'আপনার আর কী চাই বলুন তো?' 'ওর আর কী করার ছিল তখন?' ইত্যাদি। সেই সঙ্গে 'এই আর কী', 'আবদার/ইয়ার্কি/জুলুম আর কী?'
বাক্যে অলংকার হিসেবে ‘আর কি’ ব্যবহৃত হয়। সেক্ষেত্রে ‘আর কি’ তুলে দিলেও বাক্যের অর্থ ঠিক থাকে। যেমন, ‘আরে, থাকো আর কিছুক্ষন, যাবে আর কি!’ ‘এমনিতে বললাম আর কি!’ ইত্যাদি।




২৫।  উপর ও ওপর-এর মধ্যে পার্থক্য
'উপর' ও ‘ওপর’ উভয় শব্দের সাধারণ অর্থ প্রায় অভিন্ন। এ দুটো শব্দের অর্থ নিয়ে কোন ঝামেলা না থাকলেও প্রয়োগ নিয়ে ব্যবহারকারীগণ অনেকসময় বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন।
আমরা প্রায়শই ইচ্ছেমতো বাক্যে ‘উপরে’ কিংবা ‘ওপরে’ শব্দদুটি ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু এই শব্দদুটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। যদিও সাধু রীতির ‘উপর’ বানানটি ধ্বনি পরিবর্তনের স্বরসঙ্গতির নিয়ম অনুসারে চলিত রীতিতে ‘ওপর’ হয়েছে। তবুও আমরা ইচ্ছেমতো 'উপর' ও 'ওপর' শব্দ দুটি ব্যবহার করতে পারি না।
বিষয়টিকে বোঝার জন্য আমরা ইংরেজি প্রিপোজিশনের সাহায্য নিতে পারি। ইংরেজিতে 'Up' ও 'On' যেভাবে প্রয়োগ হয়, বাংলার ক্ষেত্রে 'উপর' এবং' 'ওপর' শব্দদুটির প্রয়োগ অনেকটা তা-ই। কেউ যদি Up ও On এর পার্থক্য বুঝতে পারে, সে সহজেই 'উপর' ও 'ওপর'-এর প্রয়োগ ব্যবহার বুঝতে সক্ষম হবে। সহজ করে বলতে গেলে, 'উপর' হলো 'Up' এবং 'ওপর' হল ' 'On'.
উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বলার চেষ্টা করি:
উদাহরণ: ক
(১) আমার মাথার উপর ফ্যানটি ঘুরছে। (২) দুপুর ১২টায় সূর্য ঠিক মাথা উপর থাকে। (৩) আমার মাথার উপর দিয়ে একটি পাখি উড়ে গেল।
উদাহরণ: খ
(১) বইটি টেবিলের ওপর রাখো। (২) দেয়ালের ওপর ঘড়িটি টাঙানো আছে। (৩) আমার চোখের ওপর কিছু একটা পড়ল মনে হয়।
'উদাহরণ ক ' থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি 'উপর' শব্দটির অর্থ ঊর্ধ্বভাগ এবং ঊর্ধ্বদিক। আর 'উদাহরণ খ' থেকে 'ওপর' শব্দটির অর্থে কোনো আধারের ওপর স্থিত বা অবস্থান বোঝানো হয়েছে।
সাহিত্যিক উদাহরণ:
উপর: "বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই"
ওপর: "তোমার চোখের জল নিঃশব্দে ঝরে পড়ল আমার কপালে, আমার গালে, আমার বুকের ওপর।"
ওপর কাল্পনিক অবস্থানকেও বোঝানো হয়। যেমন: "তোমার ওপর আমার কোনো অভিযোগ নেই।" "আমাদের সবসময় পুঁথিগত বিদ্যার ওপর নির্ভর করা উচিত নয়।"
সুতরাং ‘উপর’ এবং ‘ওপর’-এর যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে না।




২৬। "Clause + comma + এবং + clause" প্রসঙ্গে
যৌগিক বাক্যের কথা বলেছি, সুতরাং এ clause তো principal clause. এত সরল ছক করলে মিলবে না। 'শিশুটি একইসঙ্গে হাসল এবং কাঁদল', এটাও যৌগিক বাক্য, কিন্তু মিলল কি? বাক্যের দৈর্ঘ্য ও জটিলতা একটা নির্ণায়ক হবে। 'দেবব্রত বিশ্বাস এলেন মোটরসাইকেল চালিয়ে, অত্যন্ত অশিল্পীসুলভ ভঙ্গিতে মঞ্চে উঠে বসলেন, এবং পরমুহূর্তেই অগণন শ্রোতার মধ্যে তাঁর কণ্ঠের সম্মোহন ছড়িয়ে পড়ল।'




২৭। সংস্কৃতে হ্রস্বস্বরের পরে ছ থাকলে আগে চ্-এর আগম হয়। প্রচ্ছদ, পরিচ্ছদ, বিচ্ছেদ, তরুচ্ছায়া। দীর্ঘস্বর থাকলে বিকল্পে চ্ আসে। লক্ষ্মীচ্ছায়া বা লক্ষ্মীছায়া। কিন্তু বিশেষ কিছু কিছু ক্ষেত্রে আ-এর পর নিত‍্য চ্ আসবে। আচ্ছাদন। সংস্কৃত সন্ধির অনুকরণে তৈরি হয়েছে হতচ্ছাড়া, বিচ্ছিরি, ব‍্যাটাচ্ছেলে। তবে ব‍্যাটাচ্ছেলে শব্দটি প্রযুক্ত হয় অবজ্ঞায়। ব‍্যাটাছেলে-তে সে-অবজ্ঞা নেই। ব‍্যাটাছেলে মানে পুরুষমানুষ। ব‍্যাটাছেলে মেয়েছেলে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। (মেয়েছেলে শব্দটা গোড়া থেকেই অশিষ্ট হয়তো ছিল না।)
অর্ধতৎসমে 'শ্র'-এর শ বর্ণটিই 'ছ' হয়, 'র' স্থান পরিবর্তন করে না, বিপ্রকর্ষের ফলে মাঝে একটি স্বর আসে। শ্রী>ছিরি, শ্রাদ্ধ>ছেরাদ্দ, শ্রদ্ধা>ছেরেদ্দা(?)>ছেদ্দা।
সন্ধিতে পূর্বপদের শেষবর্ণ ও পরপদের আদিবর্ণের মিলন হবে, পরপদের দ্বিতীয় বর্ণ সেখানে গুরুত্বহীন। আপনি 'হত'-র সঙ্গে 'ছাড়া' বা 'ছিরা' বা 'ছেদ্দা' যা-ই লাগান, বাংলা সন্ধির ক্ষেত্রে র-এর আর কোনো ভূমিকা থাকল না, যেমন কিনা 'ব‍্যাটার+ছেলে'-তে আছে। একই কথা বি+ছিরি (শ্রী) সম্পর্কেও প্রযোজ‍্য। পরপদের প্রথম বর্ণ 'ছ' এবং পূর্বপদের শেষে স্বরবর্ণ থাকাটাই মূলকথা, সংস্কৃতে যেমন, বাংলাতেও তেমন।
প্রশ্ন হলো, মাত্রাছাড়া-য় কেন তবে সন্ধি হল না। সন্ধি হয় উচ্চারণের আরামের জন‍্য। অনুকৃতিমূলক সন্ধির ক্ষেত্রে সে-কথা আরও বেশি খাটে। হতছাড়া থেকে হতচ্ছাড়া উচ্চারণ সুবিধেজনক, কিন্তু মাত্রাছাড়া-র জায়গায় মাত্রাচ্ছাড়া উচ্চারণ জিহ্বার পক্ষে পীড়াদায়ক হবে না কি? এজন‍্যই হয়তো সংস্কৃতে অনেক ক্ষেত্রে বলেই দেওয়া আছে 'সন্ধি নিষেধ'।
পচ্ছন্দ ও জোচ্ছনা শব্দে দুটি পদের অন্ত‍্যবর্ণ ও আদিবর্ণের সন্ধি হচ্ছে না, শব্দমধ‍্যস্থ দুটি বর্ণের পরিবর্তন ঘটছে। পচ্ছন্দ অবশ‍্য খুব বেশি শোনা যায় না, অন্তত আমি শুনি না। তবে জোচ্ছনা বেশ শোনা যায়। পছন্দ-তে যেটা নেই, অথচ জ‍্যোৎস্নায় আছে, সেটা হল একটি ৎ। জ‍্যোৎস্না-র স-টি ছ-এ পালটে গিয়ে আর ৎ লোপ পেয়ে হয় জোছনা। তা সত্ত্বেও, আমাদের মনে ৎ-এর একটা প্রভাব হয়তো কাজ করে। আমরা যে কেবল উৎ+ছেদ=উচ্ছেদ শিখেছি, তা নয়, আমরা আরও শিখেছি উৎ+শল=উচ্ছল, উৎ+শ্বাস=উচ্ছ্বাস, মৃৎ+শকট=মৃচ্ছকট। হ‍্যাঁ, সংস্কৃতে শ-এর ক্ষেত্রে ছ-এর বিধান থাকলেও স-এর ক্ষেত্রে তা নেই। তবু বাংলায় শ ও স সমোচ্চার্য। তাই কথ‍্য ভাষায় উৎসন্ন হয়ে যায় উচ্ছন্ন, উৎসব হয়ে যায় উচ্ছব (মহোচ্ছব>মোচ্ছব), উৎসর্গ হয়ে যায় উচ্ছুগ‍্য। জোচ্ছনা-র চ্-টি ৎ-এর লোপে এসেছে কি না ভেবে দেখার। শক্তি চট্টোপাধ‍্যায় জোচ্ছনা না লিখে জোছ্ছনা লিখেছেন।




(চলবে . . . )