বন্ধু



কারও সাথে পরিচয় হলে তাকে বন্ধু ভাবা যায় কি যায় না, তা নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে ভাববার দরকার আছে। তার আচরণ, তার সাথে মেলামেশা, তার প্রতি আপনার অনুভূতি, আপনার প্রতি তার অনুভূতি, এসব নিয়ে নিবিড়ভাবে ভাবতে হয়। যার সাথে থাকলে বা কথা বললে ভালো অনুভূতির তৈরি হয় না, কিংবা মনে মনে লো ফিল হয়, সে কোনোভাবেই আপনার বন্ধু নয়। বিপদের সময় যাকে পাশে পাওয়া যায় না, সে যতই ভালোমানুষ হোক না, আপনার বন্ধু কিছুতেই নয়। যে লোকটা মানুষ হিসেবে অনেকের কাছেই খারাপ, সে লোকটাও আপনার বন্ধু হতে পারে যদি সে আপনার জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়। বন্ধুরা ভালোও হয় না, খারাপও হয় না, বন্ধুরা কেবল বন্ধুই হয়। বন্ধু যদি খারাপ হয়, তবে তাকে ভালো করার চেষ্টা করুন, নতুবা দেখবেন, আপনি নিজেই একদিন তার মতন খারাপ হয়ে বসে আছেন! একজন বন্ধুর যা যা থাকা দরকার, তার সবকিছু যদি কারও মধ্যে পান, তবে তাকে যে-কোনও মূল্যে পাশে রাখবার চেষ্টা করবেন।


আপনার বিপদের সময় যে পাশে থাকবার সময় ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পাশে থাকে না, তাকে সিরিয়াসলি নেওয়ার একদমই কোনও দরকার নেই। আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন সে কি বিশেষ কোনও কারণে আপনার পাশে ছিল না, না কি অকারণেই আপনার পাশে ছিল না। বন্ধুরা অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল ক্ষমা করতে জানে। যে ক্ষমা করতে জানে না, সে কখনওই বন্ধু নয়। আপনার বন্ধু পুরো পৃথিবীর জন্য খারাপ হতে পারে, তবে সে যদি আপনার জন্য ভালো হয়, তবে সে নিশ্চয়ই ভালো। সহজ করে যদি বলি, যে লোক পুরো পৃথিবীর সবচাইতে ভালোমানুষ, সে যদি আপনার জন্য ভালো না হয়, তবে সে আপনার বন্ধু নয়। বন্ধুকে জরুরি কিছু বললে সে তা মনে রাখে। যা-কিছু আপনার জন্য স্পেশাল, তা-কিছু তার জন্যও স্পেশাল। বন্ধুরা বন্ধুর গুণ মনে রাখে, দোষ ভুলে যায়। কেউ যদি অনেক বড়ো একটা অন্যায়ও করে ফেলে, তা-ও তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যে মানুষটা, সে-ই বন্ধু।


বন্ধু বন্ধুর জন্য ভালো কিছু করার চেষ্টা করে। যে আপনাকে ভুল কাজের জন্য শাসায়, তবে ভালো কাজের জন্য বাহবা দেয় না, সে আপনার বন্ধু নয়। বন্ধুর সাফল্যে বন্ধু ঈর্ষান্বিত নয়, বরং খুশি হয়। ঈর্ষা করে যে, সে কখনওই বন্ধু হতে পারে না। আপনার জন্য যা আনন্দের, আপনার বন্ধুর জন্যও তা আনন্দের। আপনার জন্য যা দুঃখের, আপনার বন্ধুর জন্যও তা দুঃখের। বন্ধুরা বন্ধুর দুর্বল দিকগুলি জানে, এবং সেগুলি নিয়ে খোঁচায় না, বরং সেগুলিকে পুরো পৃথিবীর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে। ডুবন্ত মানুষ খড়কুটোকে আঁকড়ে বাঁচবার চেষ্টা করে, তবে যার বন্ধু আছে, আঁকড়ে ধরবার জন্য সে বন্ধুকেই পাশে পেয়ে যায়। পুরো পৃথিবী, এমনকী পরিবারও যখন পাশ থেকে সরে যায়, তখনও বন্ধু সবকিছুর বিনিময়ে হলেও পাশে থেকে যায়। বিপদের সময় বন্ধু বন্ধুকে জাজ করে না, বরং পরিস্থিতিকে জাজ করে। আপনি ভুল করলে আপনার বন্ধু আপনাকে প্রয়োজনে চড় মারবে, বকাঝকা করবে, তবু কিছুতেই ছেড়ে যাবে না। বন্ধু সে-ই, যে আপনাকে প্রয়োজনে নিজেই গলা টিপে মেরে ফেলবে, তবু আপনার গলায় ফাঁসির দড়ি লাগতে দেবে না।


মন খারাপ হলে প্রথমেই যে মানুষটিকে ফোন করার কথা আপনার মাথায় আসে, সে-ই আপনার বন্ধু। পৃথিবীর সবার চোখে তো আর সবসময় ভালো হয়ে বাঁচা যায় না! যখন পুরো পৃথিবী মিলেও আপনাকে খারাপ বলে, তখনও বন্ধু আপনার ভালো দিকগুলি নিয়েই আপনার সামনে বলতে থাকে। বন্ধুর উপর রেগে গেলেও কখনও সে রাগটা লুকিয়ে ফেলতে হয় না। প্রকৃত বন্ধু বন্ধুর রাগ হজম করতে পারে। বন্ধুর সামনে অনুভূতিকে কোনও মুখোশ পরাতে হয় না। বন্ধু হচ্ছে সে ব্যক্তি, জীবন যখন কুৎসিত মনে হয়, তখন যার সাথে মিশলে জীবনকে সুন্দর লাগে, বাঁচতে ইচ্ছে করে, নিজের সম্পর্কে ভালো অনুভূতির তৈরি হয়। বেঁচে থাকবার জন্য বন্ধুত্ব ব্যাপারটাকে জরুরি মনে না-ও হতে পারে, তবে বন্ধুত্বের কারণেই বেঁচে থাকাটাকে জরুরি মনে হয়। পুরো পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে যখন আপনার মনে হবে, ‘বেঁচে থেকে আর কী লাভ?’, তখন আপনার বন্ধুর দিকে তাকালে সেই আপনারই মনে হবে, ‘মরে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না!’


আপনি নিজেকে যতটা বিশ্বাস করতে পারেন, যদি কাউকে ঠিক ততটাই বিশ্বাস করতে না পারেন, তবে সে আপনার বন্ধু নয়। যাকে আমরা জাজ করি, তাকে আমরা বন্ধু মনে করি না। বন্ধুকে কখনও জাজ করা যায় না, তবে বন্ধুর কাজের সমালোচনা করা যায়---অন্যের কাছে নয়, বন্ধুর কাছেই। কেউ যদি একবার বিশ্বাস ভাঙে, তবে তাকে দ্বিতীয় বার বন্ধুত্বের সুযোগ দেওয়া আত্মঘাতী ব্যাপার। প্রাণ যায় তো যাক, তবুও বন্ধু কখনও বিশ্বাস ভাঙে না। যে লোক তার নিজের কথা ভেবে কিংবা কোনও স্বার্থ উদ্ধার করতে কিংবা কোনও বিশেষ কারণে আপনার সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়, তাকে বড়োজোর পরিচিতদের তালিকায় রাখতে পারেন, বন্ধুদের তালিকায় নয়। বন্ধু কখনওই সংখ্যায় বেশি হয় না। যে লোকের অনেক বন্ধু, মিলিয়ে দেখবেন, তার বন্ধুর চাইতে পরিচিতই বেশি। বন্ধুত্বের সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের চাইতেও বেশি নিবিড়। তাই যাকে-তাকে বন্ধু বানানো খুবই বিশ্রী এটা বদভ্যাস। এর জন্য পরে পস্তাতে হয়।


বন্ধুরা আপনার কাজের সমালোচনা করতে পারে, কিন্তু আপনার নিন্দা কখনওই করবে না। যে নিন্দা করে সে নিন্দুক, যে সমালোচনা করে সে সমালোচক। ব্যক্তিকে অহেতুক টেনে না এনে যে ব্যক্তির কাজের ব্যাপারে তার নেতিবাচক অনুভূতি জানাতে পারে না, সে আসলে ব্যক্তির কাজ নয়, বরং ব্যক্তির উপরেই ক্ষিপ্ত। ব্যক্তিটি ভালো বা খারাপ, যা-ই করুক না কেন, সে খারাপ বলবেই! এরকম লোককে হেটার বলে, ফ্রেন্ড বলে না। যাদের আমরা বন্ধু ভাবি, তাদের অনেকেই হেটার বা সুবিধাবাদী। বৃষ্টি যেদিক থেকে পড়ে, ওরা ছাতাটা ধরে সেদিকেই, এতে যদি আপনি ভিজেও যান, ওতে ওদের কিছুই এসে যায় না। কত মানুষকে দেখেছি, বেশি বন্ধু নেই বলে কাঁদে! যেদিন থেকে মানুষ বেশি বন্ধু তৈরি হয়ে যাচ্ছে দেখে ভয় পেয়ে যেতে শেখে, সেদিন থেকেই মানুষের মধ্যে পরিপক্বতা আসতে থাকে। কখনও কখনও, বন্ধুদের ভয় পেতে শিখতে হয়, অবিশ্বাস করতে শিখতে হয়, আমলে না নিতে শিখতে হয়, তবেই বন্ধুদের মধ্য থেকে পরিচিতদের খুঁজে নিতে সহজ হয়।


তোষামোদি আর বন্ধুত্ব এক নয়। যে আপনার কোনও কাজেই বাধা দেয় না, সে বন্ধু নয়, মোসাহেব। বন্ধুরা আপনার ভুল দেখলে সেটা আপনাকেই বলবে, শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করবে। তারা এমনভাবে আপনার ভুল ধরিয়ে দেবে, যাতে আপনার কষ্ট না লাগে, বরং নিজেকে শোধরানোর ইচ্ছে জাগে। বন্ধুর জন্য নির্বাসনেও চলে যাওয়া যায়, অনেক বড়ো স্বার্থও ছেড়ে দেওয়া যায়, এমনকী নিজের জীবনটাও বিপন্ন করে ফেলা যায়। অনেককে দেখি, বন্ধুত্ব করার জন্য ভালোমানুষ নয়, ভালো স্টুডেন্ট খোঁজে। ওদের দেখে অবাক হই। যতদিন পর্যন্ত ভালো স্টুডেন্টকে ভালোমানুষের উপরে জায়গা দেবেন, ততদিন পর্যন্ত জীবন থেকে দুঃখ যাবে না। দামি দামি সার্টিফিকেট‌ওয়ালার সাথে বন্ধুত্ব করলেই নিজের দাম বেড়ে যায় না। বেশিরভাগ ভালো স্টুডেন্টই বেশ স্বার্থপর প্রকৃতির এবং বন্ধু হিসেবে তেমন ভালো নয়। ওরা সাধারণত নিজের কথা ছাড়া আর কারও কথা ভাবতে শেখেনি। কেউ কেমন স্টুডেন্ট কিংবা কতটা প্রতিষ্ঠিত বা মেধাবী এসবে আপনার কী এসে যায়? সে লিভারপুল ভার্সিটিতে পড়লেই আপনার কী, আর হাতিরপুল ভার্সিটিতে পড়লেই আপনার কী? এডুকেশন কিংবা পজিশন নিয়ে কখনওই মানুষ চেনা যায় না।


কে কোন পরিবার থেকে এসেছে, কার বাবা-মা কী করে, কার পেশা কী, কার আয় কত এসব নিয়ে বন্ধুদের মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। এমন নয় যে এসব জানা যাবেই না, তবে এসব কোনোভাবেই বন্ধুত্বের পথে সহায়ক বা অন্তরায় হবে না। বন্ধুদের সামনে কখনও হিসেব করে কথা বলতে হয় না, চিন্তাভাবনা করে কথা বলতে হয় না। মনে যা আছে, তা-ই হবহু বলে দেওয়া যায় না যাকে, সে বোধ হয় এখনও পুরোপুরি বন্ধু হতে পারেনি। বন্ধুর সাথে ঝগড়া বা মনোমালিন্য হতেই পারে, তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। যার সামনে নিজের সমস্ত ইগো ঝেড়ে ফেলা যায় না, তার সঙ্গে আপনার কিছু হলেও মনের দূরত্ব আছে বলে ধরে নেওয়া যায়। সে মানুষটা আর যা-ই হোক, বন্ধু নয়। মতের সাথে মতের মিল বন্ধুত্ব ছাড়াও হতে পারে, কিন্তু বন্ধুত্ব না থাকলে আত্মার সাথে আত্মার মিল কিছুতেই হয় না। যার সাথে কথা বলার সময় ততটাই নির্ভয়ে কথা বলা যায়, যতটা নির্ভয়ে কথা বলে মানুষ নিজের সঙ্গে, সে-ই হচ্ছে বন্ধু। ভালোবাসার শক্তিতে মানুষ নিয়তিও বদলে ফেলতে পারে, আর বন্ধুত্বের শক্তিতে মানুষ নিয়তই বদলে ফেলতে পারে।


কারও ব্যক্তিগত তথ্য যদি আপনার জানা থাকে, তবে সেই তথ্য তার অনুমতি না নিয়ে কারও সাথে শেয়ার করা যায় না। এমনকী যদি সেই তথ্যটি আপনার দৃষ্টিতে লুকিয়ে রাখার মতো কিছু না-ও হয়, তবু শেয়ার করা যাবে না। সবাই তো আর নিজের ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করতে চায় না, তাই না? অনেকেই বিভিন্ন কারণে তা শেয়ার করতে না-ও চাইতে পারে, যে কারণগুলি আপনার হয়তো জানা নেই। যেমন, কারও বিয়ের তারিখে আপনি জনসমক্ষে তার ওয়ালে লিখলেন, ‘শুভ বিবাহবার্ষিকী’। যদি সে নিজে এই তথ্যটি কারও সাথে শেয়ার করতে না চায়, তবে আপনার এই আচরণে সে নিশ্চয়ই বিরক্ত হবে। আপনি ভাবতেই পারেন, শুভকামনা জানালাম, এতে বিরক্ত হওয়ার কী আছে? আমাদের সবসময়ই মাথায় রাখতে হবে, কে কীসে বিরক্ত হয়, কে কীসে খুশি হয়, এসব ঠিক করে দেওয়ার আপনি আমি কেউই নই। এসব ব্যক্তিভেদে একেক রকমের। শুভকামনা জানাতে চাইলে তাকে ব্যক্তিগতভাবে জানান, লোকজনকে দেখিয়ে জানানোর কী আছে? যদি সে নিজেই তথ্যটি সবার সাথে শেয়ার করত, তাহলে একটা ব্যাপার ছিল। আপনি তার বন্ধু হতে পারেন, শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারেন, তবে যেহেতু আপনি একজন বেআক্কেল, সেহেতু আপনার মতন একটা বেআক্কেল বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়েছে বলে সেই বেচারা যারপরনাই বিরক্ত ও বিব্রত হওয়ার কথা।


বড়ো অবস্থানের কারও সাথে বন্ধুত্ব অনেক কাজে আসে। তবে যদি সে বন্ধুত্ব হয় অনেকটা তার প্রভুত্ব সহ্য করার মতো একটা ব্যাপার, তাহলে সেখানে বন্ধুত্ব যতটা, হিসেব তার চেয়ে বেশি। বড়ো অবস্থানের কেউ ভুল কথা বললেও আপনি যদি তা মেনে নেন বন্ধুত্বের ধারে নয়, তার অবস্থানের ভারে, তবে সেখানে আর যা-ই থাকুক, স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধুত্ব অন্তত নেই। ওরকম অবস্থানের বন্ধুকে আপনার প্রয়োজনের সময় সাহায্যের জন্য বার বার অনুরোধ করতে হবে না, যদি সে আপনার বন্ধু হয়, তবে সে নিজেই আপনার প্রয়োজনটাকে নিজের প্রয়োজনই ভাববে। আমরা যখন কোনও সমস্যায় পড়ি, তখন যার সংস্পর্শে এলে সমস্যাটির সমাধান একটু হলেও সহজ মনে হয়, সে-ই আমাদের বন্ধু। এমনও হতে পারে, যে সমস্যার মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তার সত্যিই কোনও সমাধান নেই। তখন যার সাথে কথা বললে সমস্যাটি সহনীয় মনে হবে, কিংবা সমস্যাটির সাথে স্বস্তিপূর্ণ সহাবস্থান শেখা যায়, কিংবা সমস্যার গভীরে ঢুকে সেটি উপেক্ষা করে বাঁচার কোনও একটি উপায় বের করা যায়, সে-ই আসলে বন্ধু। বন্ধুর সঙ্গে বসে ডাল-আলুভর্তা দিয়ে ঘি-ভাতের সাথে কাঁচামরিচ মেখে খেলেও অমৃতের মতন লাগে।


আমার জীবন থেকে একটা ছোটো ঘটনা শেয়ার করি। এক মেয়েকে খুব ভালো লাগত। ভীষণ রকমের লাজুক ও ভীতু ছিলাম বলে তার কাছে কখনওই আমার ভালোলাগাটুকু প্রকাশ করতে পারিনি। আমার খুব প্রিয় এক বন্ধু ওদের মেডিকেলেই পড়ত। মেয়েটি ফার্স্ট ইয়ারে, আমার বন্ধু ফিফথ ইয়ারে। বন্ধুকে বললাম আমার পছন্দের কথা। মেয়েটিকে সে চিনত না। আমার অনুরোধে সে মেয়েটির সম্পর্কে খোঁজখবর নিল এবং আমাকে জানাল, মেয়েটির বয়ফ্রেন্ড আছে। স্বাভাবিকভাবেই আমি মেনে নিয়েছিলাম, সে আমার ভাগ্যে নেই, যদিও এখন বুঝি, তার বয়ফ্রেন্ড থাকতেই পারে, হাজব্যান্ড তো আর ছিল না! বিয়ের আগে সে একজনের সঙ্গে প্রেম করছে বলে তো আর আরেকজনকে বিয়ে করার অধিকার হারিয়ে ফেলেনি, তাই না? আর এত সুন্দরী দেখতে যে মেয়ে, ওর বয়ফ্রেন্ড থাকবে না তো সেই মেয়েদের বয়ফ্রেন্ড থাকবে, যারা আজ অবধি কাউকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি শুধু কেউ কখনও ওদের প্রপোজ করেনি বলে? তখন বোকা ছিলাম, সরল ছিলাম, ভীতুর ডিম ছিলাম, একগামিতার ঔচিত্যে গোঁড়াবিশ্বাসী ছিলাম।


যা-ই হোক, মনে অনেক দুঃখ নিয়ে মেয়েটিকে ভুলতে চাইলাম অনেক দিন ধরে। ভুলে গিয়েছিলামও অনেকটা। একদিন খুব তীব্রভাবেই মনে পড়ে গেল, যেদিন আমার সেই ডাক্তার বন্ধুটি আমাকে তার বিয়েতে নিমন্ত্রণ করতে বাসায় আসে এবং আমি জানলাম, সেই মেয়েটির সাথেই তার বিয়ে। বড্ড বোকা ছিলাম তখন! ‘তুই বোস, আমি একটু বাথরুম থেকে আসছি!’ বলে ওকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখে ভেতরে গিয়ে বেসিনের কল ছেড়ে চোখে-মুখে বেশ জলের ঝাপটা দিয়েছিলাম যাতে কান্না বোঝা না যায়। নিজেকে খুব পরাজিত মনে হচ্ছিল তখন! আমি ওদের অভিশাপ দিইনি, ওদের জন্য প্রার্থনা করেছিলাম। বন্ধুকে অভিশাপ দেওয়া যায় না, ভালোলাগার মানুষকে অভিশাপ দেওয়া যায় না। আমাদের আরেক বন্ধুর কাছ থেকে পরে জানতে পেরেছি, মেয়েটিকে দেখার পর আমার বন্ধুরই ভালো লেগে যায়। আমার বন্ধু মেয়েটিকে অনেক চেষ্টায় প্রেমে ফেলে, ওদের সেই প্রেম চলে বছর তিনেক ধরে, এরপর বিয়ে। মেয়েটি সিঙ্গেল ছিল, আমার বন্ধুটি আমাকে মিথ্যে বলেছিল। নিপট ভদ্রলোক হওয়ার কারণে এ জীবনে অনেক কিছুই হারিয়েছি, সাহসের অভাবে হাত থেকে ফসকে গেছে অনেক অনেক সুযোগ! অতিচিন্তা দুঃখ আনে, সুখ ঠেলে। আই থট, দেয়ারফোর আই মিসড!


যা-ই হোক, মেয়েটি আমার ভালোলাগায় ছিল, তবে ভাগ্যে ছিল না। বন্ধুর কথায় অবিশ্বাস করতে শিখিনি বলে মেয়েটিকে পাইনি। আমার সেই বন্ধু মানুষ হিসেবে সত্যিই চমৎকার, তাই হয়তো মেয়েটির ভবিষ্যতের কথা ভেবে অমন চমৎকার একটা মেয়েকে আমার মতন বোকামানুষের হাতে তুলে দেয়নি। জীবনে আমি এমন বন্ধুও পেয়েছি, যখন আমি সামনে শুধুই অন্ধকার দেখতে পাচ্ছিলাম, হার মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেলেছিলাম, জীবনের সবকিছুকেই অর্থহীন লাগছিল, তখন সে কোত্থেকে যেন দেবদূতের মতো আমার পাশে এসে আমাকে সাহস দিয়েছিল, নতুন করে বাঁচার পথ দেখিয়েছিল, আমার সমস্ত একাকিত্ব দূর করে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। বন্ধু সে নয়, যে পুরো পৃথিবীকে বাঁচাতে গিয়ে আমাকে ভুলে যায়। বন্ধু সে-ই, যে পুরো পৃথিবীকে ভুলে গিয়ে হলেও আমাকে ঠিকই বাঁচায়!