পায়ে-ওড়া পাখি



এক। ক্ষমা মহৎ গুণ। তবে বেঁচে থাকতে চাইলে, নিজের মধ্যে যা যা গুণ থাকবে, তার প্রত্যেকটিকেই মহৎ হতেই হবে, এমন কোনও কথা নেই। মানুষ মহত্ত্ব ছাড়াও বাঁচতে পারে, কোনও ব্যাপার না। যে মহত্ত্বকে ধারণ করলে নিজেরই বাঁচতে কষ্ট হয়, সে মহত্ত্বকে ধারণ করার মানে বোকার মতন অন্যদের সৃষ্ট মহত্ত্বের পুঁথিগত কপচানি মেনে নিয়ে নিজেকে যন্ত্রণায় রাখা। দিনশেষে, নিজের কষ্ট নিজেরই, যারা ক্ষমাকে মহৎ গুণ বানিয়ে হয়তো নিজেরাই কোনও অপরাধের জন্য ক্ষমা পেতে চাইছে, তারা এসে আপনার কষ্ট কমিয়ে দিয়ে যাবে না। কিছু শয়তানের বাচ্চা আছে, যাদের ক্ষমা করে দিলে ওরা শয়তানির চরম সীমাটিও অতিক্রম করে ফেলে। ওরা ক্ষমাকে দুর্বলতাই মনে করে। ওদের শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ কেউ যদি কানের কাছে এসে মাছির মতো ভনভন করতেই থাকে, ক্ষমা মহৎ গুণ, ক্ষমা মহৎ গুণ, তবে কি তা মাথায় রাখার আদৌ কোনও দরকার আছে? শয়তানের শুভাকাঙ্ক্ষীরাই শয়তানকে বাঁচায়। ক্ষমা মহৎ গুণ তো অবশ্যই! কখন? দুই ক্ষেত্রে: যে ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য, তার বেলায়; এবং যখন ক্ষমা আপনাকে শান্তি দেয়, তখন। বেশিরভাগ বেয়াদব আজীবন বেয়াদবই থেকে যায়। বেয়াদবকে আবার কীসের ক্ষমা?


দুই। নারীদের নিয়ে অনেককেই অনেক ভালো কিছু বলতে শোনা যায়। ও সবই মুখে মুখে! খোঁজ নিয়ে দেখুন, ওদের বাসায় এখনও সেই নারীর কদর বেশি, যার হাতের রান্না ভালো। হ্যাঁ, এখনও আমাদের দেশে একজন নারীর ভালোমানুষ হওয়ার চাইতে ভালো রান্না করতে পারার গ্রহণযোগ্যতা হাজার গুণে বেশি। এমনও হতে পারে, যিনি রান্না করেন, তিনি হয়তো রান্নাটাই ভালো পারেন, অন্য কোনও দিকে তাঁর তেমন কোনও যোগ্যতাই নেই। আবার এমন নারীও দেখা যায়, খুব ভালো রান্না করতে পারেন, কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি খুব একটা ভালো নন। তবুও বাড়িতে তাঁর অবস্থানটা সেই নারীর চাইতে উপরে, যাঁর রান্না ভালো নয় কিন্তু যিনি মানুষ হিসেবে ভালো ও যোগ্যতর। অথচ ভালো রান্না করতে পারেন, এরকম কাজের বুয়া খুঁজলে পাওয়াটা খুব কঠিন নয়। ভালো রান্না-করতে-পারা কাজের বুয়াকে মানুষ ভালো বেতন দেয়, আর যাকে বেতন দেয় না, তাকে ভালো সমাদর দেয়।


আমি এমন মেয়েকেও চিনি, যে ভালো রান্না পারে বলেই সবাই ওকে দাম দেয়। অথচ সে মানুষ হিসেবে এতটাই বাজে যে, নিজে রান্না করতে না পারলে কেউ তাকে রান্না করে খাওয়াত কি না সন্দেহ! দিনশেষে, ওরকম মেয়েদেরকেই মানুষ বেশি মূল্যায়ন করে। নারীবাদী হোক আর পুরুষবাদীই হোক, এই এক জায়গাতে ওদের অনেকেই এক, মানে পেটবাদিতায়! একজন নারী যতই যোগ্য কিংবা ভালো হোক না কেন, রাঁধতে না জানলে তাঁর শিক্ষা, ইলম, দর্শন, জীবনবোধ, মানবিকতা, নম্রতা এসবের কিছুই তেমন চোখে লাগে না। রান্না যতটা ভালো, ব্যবহার ততোধিক খারাপ, এমন মেয়ের বেলাতে মানুষ যেরকম চুপ থাকে, রান্না ভালো নয়, কিন্তু ব্যবহার ভালো, তেমন মেয়ের বেলায় মানুষ ইচ্ছে করেই সেরকম খুঁত খুঁজতে শুরু করে। যার অন্তর খারাপ, রান্না ভালো, সে আমাদের অন্তরে যত সহজে ঢুকে পড়ে, যার অন্তর ভালো, রান্না খারাপ, সে আমাদের অন্তরে তত সহজে ঢুকতে পারে না।


তিন। কেউ কেউ ভাবেন, যে মগজে ভালো, সে বোধ হয় বিছানায়ও ভালো হবে। অথচ বিছানায় ভালো যারা, ওদের অনেকে জানেই না যে মগজ কী জিনিস! ব্যাটে-বলে না মিললে কি আর ছক্কা হয়? তবু কী আর করা যাবে! তবে দুটোতেই সমান তালে ভালো, এমন মানুষ অনেকেই আছে। দুঃখের বিষয়, ওরা যাদের পায়, তারা হয়তো দুই দিকেই সব্যসাচী নয়। তখন কাউকে কিছু বলাও যায় না, মেনে নেওয়াও কঠিন। এ ভীষণ ফালতু একটা পেইন! বিয়ে জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়, বাড়তি পোশাক কেনার চাইতে বিয়ে তো নিঃসন্দেহে অনেক অনেক জরুরি; অথচ এই জরুরি জিনিসেরই কোনও ট্রায়াল-রুম হয় না! সুখের বিষয়, মানুষ অভ্যাসের দাস যতটা, অভ্যাস মানুষের দাস ততোধিক। চিনি ছাড়া চায়ে অভ্যস্ত হয়ে গেলে চিনিহীন চা-ও ঘুম তাড়াতে পারে। ব্যাপার না! আর যে কখনও জানতেই পারে না, চায়ে চিনি দিলে কেমন লাগে, তার কাছে তো চায়ের সাথে চিনির কোনও সম্পর্কই নেই! কাচ্চি বিরিয়ানির অস্তিত্ব সম্পর্কে যে জানেই না, তার কাছে তো ভাতই কাচ্চি! অভ্যস্ততার কারণে ওতে কিন্তু মন ভরাতে তার তেমন কোনও অসুবিধে হয় না।


চার। আপনি দীর্ঘদিনের অসুস্থতা থেকে যখন সুস্থ হবেন, তখন খেয়াল করলে দেখবেন, প্রথম প্রথম কিছুদিন এই সুস্থ অবস্থাটার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতেই যেন আপনার বেশ কষ্ট হয়ে যাচ্ছে! মনে হবে, অসুস্থতাটাই তো বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের ছিল। মানুষ দীর্ঘসময় ধরে নরকে থাকলেও সেখানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, সেখানেই তার কমফোর্ট-জোন তৈরি হয়ে যায়, ফলে সেখান থেকে বেরোতে সে কেমন একটা চাপাঅস্বস্তি অনুভব করে। কে কোথায় ভালো থাকে, তা একমাত্র সে নিজেই জানে। ঠিক তেমনি, দেখবেন, কিছু কিছু মানুষ এতটাই নোংরা মানসিকতার যে ওরা ভালো কিছুর উপস্থিতি সহ্যই করতে পারে না। ওরকম হিংসুটে, মিথ্যুক, প্রতারক, চাপাবাজ, মূর্খ, ছোটোলোক হয়ে থাকতেই ওদের অনেক আনন্দ। ওদের মতন নয় যারা, তারাই ওদের টার্গেটে পরিণত হয়। ওদের ভাবনা, বিশ্বাস ও যাপনের কমফোর্ট-জোনের মধ্যে পড়ে না যে মানুষ, ওরা যে-কোনও মূল্যে সে মানুষের পেছনে লাগে, মানুষটাকে ঠকায়, কষ্ট দেয় আর সুযোগ পেলেই আঘাত করে। পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে: সময় কম, ঘিলু বেশি। সময় বেশি, ঘিলু কম। প্রায়ই, দ্বিতীয় ধরনের মানুষ প্রথম ধরনের মানুষের পেছনে লাগে।


মনের এমন গঠন অনেকটাই অভিজ্ঞতা-, জ্ঞান- ও বিশ্বাসনির্ভর। আপনি খুব আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলেও ওদের সে জায়গা থেকে সরিয়ে আনতে পারবেন না। ওদের জন্মই হয়েছে আমৃত্যু ওখানে থেকে যাওয়ার জন্য। তাই ভালো হয় যদি ওদের সঙ্গ পুরোপুরিই ত্যাগ করতে পারেন। এর জন্য যদি জীবন থেকে কিছু হারাতেও হয়, তবুও ভালো। ছোটোলোকের সাথে ছোটোলোকি করতে না পারাটাই একটা ব্যর্থতা। তাই ছোটোলোকের সঙ্গে চললে ছোটোলোকি না করে শেষমেশ আর পারা যায় না। ডানা না গজালে ওড়া যায় না। তো সেই ডানা গজাতে সময় দিতে হয়! ডানা গজানোর আগেই ওড়াউড়ি করার চেষ্টা করলে সবাই দেখে হাসে। ওরকম করে যারা, তারা সেই হাসিকে পাত্তা না দিয়েই লাফিয়ে লাফিয়ে ওড়ে। একসময় নিজেকে পাখির চাইতেও বড়ো পাখি ভেবে ফেলে এবং সবার সামনে তা ঘোষণা দিয়ে বেড়ায়। বুঝুন অবস্থা! ওদের সঙ্গে মিশলে ওদের মতোই পাখি হবেন---পায়ে-ওড়া পাখি!