প্রেমের মড়া জলে ভাসে না

সুন্দরীদের কোনও দেশ কিংবা কাল ভেদ নেই। সুন্দরী যেকোনও স্থানেই থাকতে পারে। অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্যি, এমনকি বর্তমানে ইঞ্জিনিয়ারিংও সুন্দরীদের জন্য নিষিদ্ধ কোনও বিদ্যা নয়!!

পাঁচ বছরের কিছু বেশি সময় আগের কথা। চাকরি হয়েছে বেশিদিন হয়নি। চুয়েটের এক দাদা আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলেন এখন বিয়ের কথা ভাবছি কি না। জানালাম, খুব সিরিয়াসলি ভাবছি না, তবে ভাবলে সমস্যা হবে না, আমার মোটামুটি প্রস্তুতি আছে। বললেন, চুয়েটের এক মেয়ে আছে, ** ব্যাচ, সেকেন্ড ইয়ারে উঠল মাত্র, *** ডিপার্টমেন্টে পড়ে, লম্বা, দেখতে খুব ভাল। দেখতে পারিস। “দাদা, চুয়েটে পড়ে, আবার দেখতেও ভাল! ক্যাম্নে কী? হাহাহাহা……” “ফাজলামো করিস না ভাই। মেয়েটার মামা আমার পরিচিত। মনে হল, তোর সাথে মানাবে, আমি নিজ থেকেই উনাকে বলেছি তোর কথা। প্রথমে রাজি না হলেও তোর কথা বলাতে বিয়ের কথা ভাবতে রাজি হয়েছে। মামা তোকে চেনেন, প্রথম আলো’তে দেখেছেন। তুই রাজি কি না বল।” “দাদা, হাইট কেমন হবে?” “৫-৫’এর মতো।” “ভেরি গুড! ওকে দাদা, ওর ফেসবুক লিংকটা দাও, আমি খবর নিচ্ছি।” “খবর নিতে হবে না, খুব ভাল মেয়ে, তুই শুধু পছন্দ হয় কিনা দেখ। আমি তোকে লিংক দিচ্ছি।”

লিংকে গেলাম; **** দত্ত। দেখলাম, ভাল লাগল। সাদামাটা মিষ্টি ধরনের মেয়ে। খুব সাজে না, ওকে অতো সাজতেও হয় না। খাড়া নাক, টানাটানা সুন্দর চোখ। চাহনি আর চুলও আকর্ষণ করে। সে মেয়ে শাড়িও পরে। দেহপল্লব যেন হাওয়ায় দোলে। প্রকৃতির কাছে তোলা কিছু ছবি দেখে মনে হতে লাগল, প্রকৃতিরই কন্যা। বেশ ভাল লেগে গেল। ঠিক করলাম, পারিবারিকভাবেই মেয়েটাকে দেখব। দাদাকে ফোন করলাম। “দাদা, দেখলাম, পছন্দ হয়েছে। আমাকে পছন্দ করবে কি না কে জানে!” “তোকে পছন্দ না করার কী আছে?” “অনেককিছু আছে। আচ্ছা দাদা, মেয়ের অ্যাফেয়ার নেই তো?” “নেই বলেই তো জানি।” “তবুও মেয়েকে একটু জিজ্ঞেস করে নিতে বল।” “মামাকে তো জিজ্ঞেস করতে বললাম।” “নেই বলেছে?” “মামা তো বললেন, পুকুরের কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে করে পুকুরে মাছ ধরতে হবে নাকি? আমাদের মেয়ে খুব শান্ত মেয়ে, ও ওসবের মধ্যে নেই।” “না দাদা, তবুও জিজ্ঞেস করে নেয়া দরকার। পরে অনেকসময়ই ঝামেলা হয়।” “সুশান্ত, মেয়েকে দেখে কিন্তু মনে হয় না, অ্যাফেয়ার থাকতে পারে।” “দাদা, এসব ব্যাপারে ‘দেখে মনে হয় না’ বলে কিছু নেই। তুমি একটু ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে নিতে বল।” “আচ্ছা ঠিক আছে।”

পাক্কা খবর এল, মেয়ে নিজেই জানিয়েছে, ওর কোনও অ্যাফেয়ার নেই। জেনে বড় ভাল লাগল। এ জগতসংসারে তাহলে এখনও কিছু মহৎ হৃদয়ের সুন্দরী মেয়ে আছে, যারা আমাদের মতো জন্মসিঙ্গেলদের কথা ভেবে বয়ফ্রেন্ড জোটায়নি কিংবা ব্রেকআপ করে বসে আছে, যাদেরকে কোনওরকমের অস্বস্তি ছাড়াই ‘ভালোবাসি’ বলা যায়! আহা, আহা! “দাদা, আমি কি মাকে বলব ওদেরকে ফোন করতে?” (বাবা এসব ব্যাপারে বড় লাজুক ধরনের মানুষ, যা করার মাকেই করতে হবে।) “না, তুই আমাকে আন্টির নাম্বারটা দে, মেয়ের মামা ফোন করবে।” খুশিতে লাফাতে-লাফাতে দিয়ে দিলাম মায়ের নাম্বার। ফোন এল। “………….দিদি, আপনি কষ্ট করে আমার দাদাবাবুকে একটু ফোন করবেন? আমি নাম্বারটা দিচ্ছি। কোনও অসুবিধে নেই, আমি উনাকে বলেছি আপনাদের কথা।” “আচ্ছা দাদা, আমি কালকে উনাকে ফোন করবো।”

রাত পৌনে ১২টা। ফেসবুক ইনবক্সে একটা টেক্সট এল। যে পাঠিয়েছে, সে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নেই। “দাদা, আমি কি আপনার নাম্বারটা একটু পেতে পারি? আমার কিছু কথা ছিল। কথাগুলো বলাটা খুব খুব জরুরি।” সেই মেয়েটিই! বুকের মধ্যে ধক্ করে উঠল। “নাম্বার কেন? কী বলবে ও?” নাম্বার দিলাম। সাথেসাথেই ফোন এল। “দাদা, নমস্কার। আমি ****। আমাদের বাসায় আপনার-আমার বিয়ের ব্যাপারে কথা চলছে। মামা বোধ হয় আপনার মাকে ফোন করেছিল। ঠিক না?” (নার্ভাস কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম…….) “হ্যাঁ, ঠিকই বলছেন।” “দাদা, আমি আপনার ছোটবোনের মতো।……..” “কী???” (আমি ক্ষণিকের অসীম অভিমানে আর বিস্ময়ে নিজেকে মুখ ফসকে অনেকটা চিৎকার করে ওটা বলতে স্পষ্টভাবে শুনলাম!) “হ্যাঁ দাদা, আমি আপনার বোন। এই বোনটিকে একটু সাহায্য করবেন?” (গম্ভীর স্বরে বললাম……) “বল, কী বলতে চাও।” “রাগ করবেন না, দাদা। নিতান্ত অপরাগ হয়েই আপনাকে ফোন করেছি। আপনাকে একটা কথা জানানো খুব প্রয়োজন। গত দেড় বছর ধরে থেকে একটা ছেলের সাথে আমার পরিচয়। আমরা দুইজন দুইজনকে অনেক-অনেক ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না, দাদা। এই বোনটিকে একটু হেল্প করুন। প্লিজ, দাদা!” “আমি তো তোমার ফ্যামিলিকে তোমার সাথে কথা বলতে বলেছি। ওরা তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি?” “করেছে দাদা। কিন্তু আমি ভয়ে কিছু বলতে পারিনি। বাবা ভীষণ রাগী। এরকম কিছু বললে আমাকে মেরেই ফেলবে। তাছাড়া ও এখনও স্টুডেন্ট, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি।” “তো, আমি কী করতে পারি?” “দাদা, আপনি বলবেন, আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি।” “আমি মিথ্যা বলতে পারব না। আর আমি তো এর মধ্যেই বলে দিয়েছি, তোমাকে আমার ভাল লেগেছে।” “দাদা, আমি আপনার বোনের মতন। প্লিজ। আমাকে বাঁচান।” “ঠিক আছে, আমি দেখছি।” “অনেক-অনেক ধন্যবাদ দাদা। ঈশ্বর আপনার ভাল করবেন। শুভরাত্রি।” আর কিছুই না বলেই ফোনটা কেটে দিলাম। নিজের উপরেই প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। ‘রোজা’ মুভির এমন সফল আংশিক মঞ্চায়ন আমার জীবনেই হবে, এ কথা কি কখনও ভাবতে পেরেছিলাম? কেন আমার ওই মেয়েকে পছন্দ হতে গেল? সে অন্যের প্রেমিকাকে বলে? নাকি, সে আমার হওয়ার নয় বলে? ঈশ্বরের সকল প্রহসনই কি শুধু আমার জন্যই লেখা? আমিই কেন চিরকালই ট্র্যাজেডির নায়ক হয়ে থাকবো? আমার জীবনেই কেন মিলনের আগেই বিরহের সুর বেজে ওঠে? প্রেমই তো করতে পারলাম না, অথচ কী বিশ্রীভাবে ছ্যাঁকাট্যাকা খেয়ে বসে আছি! কেন কেন কেন???

ঘুম থেকে উঠে মাকে বললাম, “আপাতত মেয়ের বাবাকে ফোন কোরো না। আমি পরে বললে ফোন কোরো।” সকালে অফিসে পৌঁছেই মেয়ের মামাকে ফোন করলাম। “মামা, নমস্কার। আমি সুশান্ত বলছি। আমি কিছু কথা বলতে আপনাকে ফোন করেছি। এখন আপনার সময় হবে?” “বাবা, তুমি! কী খবর? বল, বল!” “মামা, মা আজকে আঙ্কেলকে ফোন করবেন না। কিছু সমস্যা হয়ে গেছে।” “কীরকম?” “মামা, আসলে আমার একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে। সম্পর্কটা অনেকদিনের। আমি এই রিলেশনটা নিয়ে একটু কনফিউজড ছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ওই মেয়েকেই আমি বিয়ে করবো।” “মানে? তুমি আগে কোথায় ছিলে? আগে আমাকে ফোন করনি কেন?” “মামা, আমি আপনাকে লজ্জায় কিছু বলতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করবেন।” “ফাজলামো পেয়েছ নাকি? আমি আমার দিদির ফ্যামিলিকে তোমার সম্পর্কে কত ভাল-ভাল কথা বলে ওদেরকে রাজি করালাম, আর তুমি কী বলছ এসব? ওরা তো রাজিই ছিল না এত তাড়াতাড়ি ওকে বিয়ে দিতে। কই? ***ও তো কিছু বলল না আমাকে!” “মামা, *** দাদার কোনও দোষ নেই, সব দোষ আমার। আমি দাদাকে কিছুই জানাইনি।” “ও আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। শোনো বাবা, আমার সহজসরল ভাগ্নিটা বড় বাঁচা বেঁচে গেছে। তোমাদের মতো ছেলেরা মেয়ের বাবা-মা’কে ফেলনা মনে করে। ভাবে, মেয়ের বাবা-মা তো খেলার পুতুল, যেভাবে নাচাবে সেভাবেই নাচবে! বড়-বড় পড়াশোনা করেছ, বড় চাকরিও পেয়েছ, কিন্তু এখনও মানুষ হতে পারোনি। তোমার শুধু সার্টিফিকেটটাই আছে, ভেতরে কোনও জ্ঞান নেই। ছিঃ! লজ্জাও করলো না তোমার! তোমাদের মতন বাজে ফ্যামিলির সাথে আমরা সম্পর্ক করতে যাচ্ছিলাম! দিদি আর দাদাবাবুর কাছে আমার মানসম্মান সব নষ্ট করে দিলে!” “মামা, আমি অনুতপ্ত। আমাকে ক্ষমা করবেন।” “ক্ষমা মানে? তুমি তো আর ছেলেমানুষ না, বাবা! শোনো, মানুষকে মানুষ বলে সম্মান করতে শেখো আর নিজের চরিত্রকে ঠিক কর। শুধু প্রতিষ্ঠিত হলেই হয় না।” “মামা, আমি……..” আর কিছুই বলতে পারলাম না, ফোন কেটে গেল।

সেই সম্পর্কের ওখানেই ইতি। কেউ কখনওই কিছুই জানতে পারল না। আমার বাসায় জানে, সেই রাতের পর থেকে কোনও এক ‘রহস্যময়’ কারণে হঠাৎই মেয়ের চেহারা আমার অপছন্দ হতে শুরু হয়েছে। আমার ছোটভাই তো মুখের উপর বলেই দিয়েছিল, “দাদা, এত বাছাবাছি করিস কেন? মেয়েটা খারাপ কোথায়? বরং তুই নিজেই ওর যোগ্য না। এত সুন্দর মেয়েকেও তোর ভাল লাগে না! তোর কপালে আর বিয়ে নেই! সারাজীবন এভাবেই থাকবি তুই!” কেউই কিছু জানল না; জানলাম শুধু আমি, ও আর নিষ্ঠুর বিধাতা। আর কেউ না, আর কেউ না!!

আচ্ছা, আমি ওটাকে সম্পর্কই বা বলছি কেন? যে সম্পর্ক শুরুই হলো না, শুরুর আগেই শেষ, সে সম্পর্কটাও কেন কাঁদায়, কেউ বলতে পারো? হ্যাঁ, আজও ওর কথা ভেবে মেজাজখারাপ হয়, আফসোস হয় নিজের নির্বোধ উদারতার জন্য। . . . . . . . হতো না, যদি না ও চুয়েট থেকে পাস করে বেরিয়ে বাবা-মায়ের পছন্দে অন্য একটা ছেলেকে বিয়ে করতো।

প্রেম কী? প্রেম হচ্ছে সেই অনর্থক সম্পর্ক যা অন্য একটি অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে দেয় না।

ওপরের কথাটায় কেউ ক্ষেপেটেপে গেলেন নাকি আবার? আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে! আমার কথা আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি। নাহ্! প্রেম বড় ভাইটামিনসমৃদ্ধ বস্তু, না খাইলে বিপদ, আর খাইলে তো মহাবিপদ!!