এলোভাবনা

ইনবক্সে মাঝেমধ্যে এমন টেক্সটও আসে যেগুলোর রিপ্লাই দিচ্ছি কি দিচ্ছি না, এ নিয়ে যিনি টেক্সটটা পাঠাচ্ছেন, তাঁর কোনওই মাথাব্যথা নেই। উনি যে টেক্সটা পাঠাচ্ছেন, এটাকে উনি ধরেই নিয়েছেন নিষ্কাম কর্ম হিসেবে। নিষ্কাম কর্ম কী? এমন কাজ, যেটাতে বিন্দুমাত্রও বৈষয়িক প্রাপ্তির আশা থাকে না। এই যেমন, মায়ের ভালোবাসা। আচ্ছা, এর মানে কী? প্রাপ্তি কি থাকেই না? একটুও? থাকে, থাকে! ধরুন, আপনি কোনও ধরনের প্রাপ্তির আশা কিংবা স্বার্থ ছাড়াই কাউকে হেল্প করলেন। এতে আপনি কী পেলেন? কিছুই না। আসলেই কি কিছুই না? একটু ভাবুন তো, কাউকে হেল্প করতে পারলে নিজের মনে একটা শান্তি-শান্তি ভাব আসে না? এই যে সুখের অনুভূতি, এর দামও কিন্তু লক্ষ টাকা। এটা আপনার আত্মবিশ্বাসও বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। আপনার প্রাত্যাহিক জীবনযাপন আর কাজকর্মে ক্লান্তি আসে কম। হাসিমুখে কম সময়ে কম ভুল করে কাজ করা যায়। এর দাম নিশ্চয়ই আপনি কোনও আর্থিক মূল্যের বিনিময়ে কাজটি করলে যে অর্থ পেতেন তার চাইতে অনেক-অনেক বেশি। যে সুখ পয়সা দিয়ে কেনা যায় না, সে সুখের দাম সবচাইতে বেশি।

আচ্ছা, লোকে ফকিরকে পয়সা দেয় কেন? হেল্প করতে? বেশিরভাগ সময়েই এর উত্তর: না। তবে কেন দেয়? প্রার্থনা পেতে। সব ফকিরই কি প্রার্থনা করে মন থেকে? নাতো! অনেকে তো পয়সা কম দিলে বদপ্রার্থনাও দেয়। তবে? কাউকে সাহায্য করলে নিজের মধ্যে এই অনুভূতি সৃষ্টি হয়, কাউকে হেল্প করার সামর্থ্য ও সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এই সৌভাগ্যের জন্য শুকরিয়া! যত বেশি শুকরিয়া আদায় করবেন, তত বেশি ভাল থাকবেন। মনে অহংকার কাজ করবে কম। আরও বেশিদূর যাওয়ার ইচ্ছে জন্মাবে। ওয়েটারকে একদিন ১০ টাকার জায়গায় ১৫ টাকা বকশিস দিয়ে দেখুন তো কেমন লাগে? রিক্সাওয়ালাকে একদিন খুশিমনে ৫ টাকা বাড়িয়েই দিলেন না হয়! কী এমন কমে যাবে আপনার? কিছুই না! Giving is an art. এরপর বাসায় ফিরে দেখুন তো কেমন চমত্‍কার একটা ভাললাগা কাজ করে! যে কাজটিই করবেন, সেটিই মন দিয়ে করতে পারবেন। ৬ ঘণ্টার পড়াশোনা হবে ২.৫ ঘণ্টায়। হিসাব করে দেখুন, লাভ কিন্তু আপনারই বেশি। আপনার মনের শান্তির দাম আপনার ব্যয়িত অর্থের কয়েক গুণ বেশি! মানুষ দানে ধনী হয়।

আমাকে যাঁরা বলেন, আমি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই, তাঁরা লাইফের আসল ম্যাজিকটাই ধরতে পারেন না। শুধু আর্থিক লাভটাই দেখলে আজীবন দারিদ্র্যের মধ্যে কাটাতে হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকদিক দিয়েই অনেককিছু পেয়েছি। এই যেমন, বাংলাদেশের যেখানেই ঘুরতে যাই না কেন, আমার সাথে ঘোরার জন্য কাউকে না কাউকে পেয়ে যাই। এটা কি প্রাপ্তি নয়? মানুষের ভালোবাসা আমাকে আরও ভালভাবে বাঁচতে সাহায্য করে। এখানেই শেষ নয়। আমি বিশ্বাস করি, মানুষের প্রার্থনা কাজে লাগে। আর যদি সেই মানুষটি হয় কারওর পিতা, মাতা, কিংবা বড় ভাইবোন, তবে সেই প্রার্থনা অবশ্যই অনেক বড় প্রার্থনা। যাঁরা আমার কথায় কিংবা লেখায় তাঁদের কোনও ব্যথা কিংবা কষ্ট ভুলে জীবনে সুন্দর ও সুস্থভাবে বাঁচার অর্থ খুঁজে পান, তাঁদের কাছের মানুষেরা, বিশেষ করে বাবা-মায়েরা আমার জন্য প্রার্থনা করেন। অনেকেই আমাকে ফোন করে বাসায় দাওয়াত দেন, মনপ্রাণভরে প্রার্থনা করেন। আমাদের বাবা-মায়েরা সাধারণত ধার্মিক ও ভালমানুষ। এ ধরনের মানুষের প্রার্থনা অবশ্যই কবুল হয়; হয়তো আমরা তা জানতেও পারি না কোনওদিন। আমি আমার জীবনের অনেক বড়-বড় বিপদআপদ থেকে বেঁচে গেছি স্রেফ মানুষের প্রার্থনায়। আপনি যদি কারও ক্ষতি করেন, কারও মনে কষ্ট দেন, তবে তার কঠোর শাস্তি আপনি জীবিত অবস্থাতেই পাবেন। জীবনের সকল পুণ্য, সকল পাপ—বহুগুণে ফেরত আসে—আসেই আসে! এই যে বিসিএস পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছি, সেটা আমার বাবা-মা’র পুণ্যের ফল। একটা মজার ফ্যাক্ট শেয়ার করি। বিসিএস কী, এটা নিয়ে আমার মায়ের কোন ধারণাই ছিল না। মা শুধু জানতেন, আমি একটা চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি। এ পরীক্ষা কতটা কঠিন আর প্রতিযোগিতাপূর্ণ, সেটা মা একটুও জানতেন না। মা না বুঝেই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, ঠাকুর, তুমি আমার ছেলেকে বিসিএস পরীক্ষায় ফার্স্ট করে দাও। বিসিএস পরীক্ষা সম্পর্কে বিন্দুমাত্রও ধারণা থাকলে মা এই প্রার্থনা করার সাহসও হয়তো করতেন না। কী আশ্চর্য দেখুন! সেই প্রার্থনাই কবুল হয়ে গেছে। একটা লাইফ সিক্রেট শেয়ার করি। যখনই আল্লাহর কাছে কোনওকিছু চাইবেন, ছোটোকিছু চাইবেন না। আমাদের প্রতিদিনের প্রার্থনা কিংবা ইচ্ছের ১০% কবুল হয়ে যায়। ধরুন, আপনি মনে-মনে আইসক্রিম খেতে চাইলেন। কোনও এক উছিলায় আইসক্রিমই পেয়ে যাবেন। আপনার তকদিরে হয়তো ব্যুফেমিল ছিল, সেটা আর পাবেন না। অবচেতনভাবেও ভাববেন না, আপনাকে দিয়ে কোনওকিছু হবে না। আপনার ভাবনা কবুল হয়ে যেতে পারে! কোনওদিনও জানতেও পারবেন না, মুহূর্তের ভুলে জীবনে কী হারিয়েছেন!

তো যে প্রসঙ্গে ছিলাম! আমি প্রতিদিন যে পরিমাণ খুব চমত্‍কারভাবে গোছানো টেক্সট পাই, সেগুলোকে সাজিয়ে-সাজিয়ে অনায়াসেই কয়েকটি ‘সবিনয় নিবেদন’ কিংবা ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ লিখে ফেলা যায়। মজার ব্যাপার হল, এসব চমত্‍কার মেসেজে রাগ থাকে, অভিমান থাকে, অনুরাগ থাকে, ভালোবাসা থাকে, ভয় থাকে, শ্রদ্ধা থাকে। একেকটা মেসেজ হয়তো বা আগের অনেক আনআনসারড্ মেসেজের কন্টিনিউয়েশন। আগে ভাবতাম, মানুষ মেসেজের রিপ্লাই না পেয়েও কেন মেসেজ পাঠিয়েই যায়? এখন বুঝি। আসলে মানুষ কখনও-কখনও নিজের মনেই কথা বলে মজা পায়। কথোপকথনের সুবিধার জন্য আরেকজনকে দরকার, তাই না? টম হ্যান্কসের ‘কাস্ট অ্যাওয়ে’ মুভিটা দেখেছেন তো? মুভিতে একলা দ্বীপে নায়ক নানান এনটিটিকে সামনে এনে কিংবা কল্পনাতে এনে দিব্যি কথা চালিয়ে যায়। সে মিথস্ক্রিয়ায় রাগ, অভিমান, ভালোবাসা, অনুরাগ, বিরক্তি, সুখদুঃখ সবই থাকে। মানুষের যে সবসময়ই সঙ্গী দরকার তা কিন্তু নয়। বরং মাঝেমাঝে সঙ্গীহীনতাই বেশি সুখের। পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কথোপকথন’ পড়ে-পড়ে কিংবা লাভ স্টোরি, বিফোর সানরাইজ, বিফোর সানসেট এসব দেখার সময় আমি প্রায়ই কোনও এক মুজতবার শবনম কিংবা শঙ্খসুনীলের মার্গারিটার সাথে মনে-মনে কথা বলতাম। এখনও বলি। এই ব্যাপারটা আমাকে একধরনের সুখ দেয়। আমার কথা শুনে আমি যেরকম করে ভাবি, সেরকম করে কেউ যদি কথা না বলত, তবে কি ভাল লাগত অতটা যতটা লাগে একাএকা মনের মত রিপ্লাই ভেবেভেবে কথা বলে যেতে? মনের কথাগুলো যে অনেক দামি! যদি কেউ ওসব কথা শুনে মন-খারাপ-করে-দেয়া রিপ্লাই দিত কিংবা অবহেলা করত, তবে মন কতটা যে খারাপ হয়ে যেত, ভাবতে পারেন? এর চাইতে কি রিপ্লাই না পাওয়াও ভাল নয়? এই ‘বলছেও ও, শুনছেও ও’ ধরনে কথা চালিয়ে গেলে কিছু অহেতুক মনখারাপের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া যায়। এ করেই যদি ভাল থাকা যায়, তবে ক্ষতি কী?