ঈশ্বরভক্তি

কোনো কাজের শুরুতে ছোটোখাটো যে-সব দোষত্রুটি দেখা যায়, যত দিন যায়, ততই সেগুলি বড়ো হতে হতে বিরাট আকার ধারণ করে; এবং শেষপর্যন্ত তাদের আর শোধরানো যায় না। সেজন্যে, কোনটি আসল আর কোনটি নকল তা জানতে না পারলে মানুষ প্রায়‌ই ঠকে যায়। আর তারই ফলে, যা ভুল, আর কুসংস্কারে ভরা, এমন একটি পথের অনুসরণে মানুষ মশগুল হয়ে থাকে।




এমন একজন চিত্রকরের কথা আমি জানি, যিনি তাঁর প্রেমিকাদের হাবভাব আর সাদৃশ্য তাঁর আঁকা হরেক রকমের ছবির মধ্যে ফুটিয়ে তুলতেন। সেইরকম নিজের নিজের আবেগ আর খেয়ালখুশিমতো প্রত্যেকেই তার পথের এক-একরকম ছবি আঁকে। যে উপবাসে অভ্যস্ত, তার মন বিদ্বেষে ভরে থাকলেও, কেবলমাত্র উপবাস করলেই নিজেকে সে খুবই ধার্মিক বলে মনে করে; এবং পাছে পাপ হয়, এই ভয়ে সেদিন মুখে একফোঁটা জল‌ দেবার সাহসও তার হয় না; অথচ, নিন্দা আর কুৎসা রটিয়ে প্রতিবেশীর রক্তে নিজের জিভকে ডুবিয়ে দিতে তার বিবেকে বিন্দুমাত্রও বাধে না। আর-একটি কাজের মধ্যে দিয়ে নিজেকে সে ধার্মিক বলে প্রমাণ করতে চায়; সেই কাজটি হচ্ছে, প্রতিদিন গোছাগোছা মন্ত্র আওড়ানো---যদিও তার পরে, তার ঘরের আর পাড়ার লোকজনদের অস্বস্তিকর, ক্ষতিকর আর উদ্ধত কথা বলার জন্যে জিভের লাগামকে সে একেবারে আলগা করে দেয়।




আবার এমন কেউ কেউ আছে, যে দরিদ্রকে দান করার জন্যে তাড়াতাড়ি গোঁজের মুখটা খুলে পয়সা বার করে; কিন্তু শত্রুকে ক্ষমা করার জন্যে নিজের হৃদয় থেকে সে কোনো করুণার ধারা বার করতে পারে না! আবার এমন মানুষও আছে, যারা শত্রুদের ক্ষমা করে; কিন্তু, আইনত বাধ্য না হলে পাওনাদারদের টাকা মিটিয়ে দেয় না।




এদের সকলকেই ভক্তসাধক বা ধার্মিক মানুষ বলে আমরা ধরে নিই; কিন্তু, তারা তা নয়, মোটেই নয়; পাওনাদারেরা একজন ধার্মিক লোককে খুঁজতে এসেছিল তাঁর বাড়িতে; কিন্তু, তাঁর মেয়ে বাবার কথামতো একটি পুতুলকে চাদর ঢেকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তাদের বলেছিল, বাবা অসুস্থ হয়ে ঘুমোচ্ছেন। সেকথা তারা বিশ্বাস করেছিল। সেই রকম এমন অনেক মানুষ আছে, সাত্ত্বিক পোশাকের আড়ালে নিজেদের যারা ঢেকে রাখে; আর চারপাশের লোকেরা মনে করে, তারা সত্যিই ধার্মিক প্রকৃতির মানুষ, অধ্যাত্মচিন্তায় বিভোর। অথচ আসলে তারা সাত্ত্বিক মানুষের ছায়া আর প্রতিমূর্তি ছাড়া আর কিছু নয়।




সত্যিকার ভক্তি তারই আছে, ঈশ্বরকে যে ভালোবাসে। সত্যি কথা বলতে কী, অন্য কিছুকেই প্রকৃত ভক্তি বলা যায় না। তবু ভগবৎপ্রেম হলেই তাকে ভক্তি বলা যাবে না; কারণ, যে স্বর্গীয় প্রেম আমাদের অন্তরকে সুন্দর করে তোলে, ভগবানের কাছে আমাদের প্রিয় করে তোলে, তাকে বলা হয় ঐশী অনুগ্রহ। যা আমাদের ভালো করার শক্তি দেয়, তাকে বলা হয় প্রেম। কিন্তু যে প্রেম এমন তুঙ্গে ওঠে, যা আমাদের কেবল ভালো করার শক্তিই দেয় না, সেই কাজ আমরা যাতে ভালোভাবে, প্রায়‌ই এবং বিনা দ্বিধায় করতে পারি, সে-শক্তিও দেয়, সেই প্রেমকে বলা হয় ভক্তি।




উটপাখি কোনোদিন ওড়ে না, মুরগি ওড়ে, তবে তা নামমাত্র, আর অনেক উপরেও সে উড়তে পারে না। কিন্তু বাজপাখি, কপোত, আর দোয়েল প্রায়‌ই ওড়ে আর তা বেশ দ্রুতগতিতে, এবং অনেক উপর দিয়ে। ঠিক সেইভাবে, পাপীদের গতি ঈশ্বরের দিকে নয়; পার্থিব জগৎ আর পার্থিব বস্তুর চারপাশেই তারা ছোটাছুটি করে। এখনও যারা ভক্তিমার্গে উঠতে পারেনি, সেইসব সৎ মানুষ তাদের সৎ কাজের জন্যে ঈশ্বরের দিকে এগিয়ে যায়, তবে খুবই কম, ওই গয়ংগচ্ছভাবে, খুব ধীরে ধীরে।




যারা সত্যিকার ভক্তি অর্জন করেছে, তারা ঈশ্বরের দিকে বারবার এগিয়ে যায় খুব সহজে আর খুব উঁচু দিয়ে। অল্প কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, ভক্তি ব্যাপারটা আধ্যাত্মিক তৎপরতা আর প্রাণময়তা ছাড়া অন্য কিছু নয়। এরই মাধ্যমে আমাদের ভেতরে ভালোবাসা কাজ করে; অথবা ভালোবাসার ভেতর দিয়ে আমরা কাজ করি---নির্দ্বিধায়, সর্বান্তঃকরণে; আর সাধারণভাবে এবং সব জায়গায় ঈশ্বরের নির্দেশগুলিকে মেনে চলতে এ যেমন আমাদের তাড়া দেয়, সেইরকম ভক্তির কাজ হচ্ছে সেগুলিকে তখনই-তখনই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা।




এই থেকেই প্রতিপন্ন হয় যে ঈশ্বরের অনুজ্ঞাগুলি যে পালন করে না, তাকে সৎ বা ভক্তিশীল বলা যায় না; কারণ সৎ হতে গেলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে, আর ভক্তিশীল হতে গেলে প্রেম-ভালোবাসা ছাড়াও চাই প্রেম-ভালোবাসা যে সব কাজ করার জন্যে আমাদের উৎসাহ দেয়, সেগুলি সম্পন্ন করার জন্যে তৎপরতা আর আগ্রহ।




ভক্তি বলতে আমরা একটি উচ্চস্তরের ভালোবাসাকে বোঝাই বলে, ঈশ্বরের সমস্ত অনুজ্ঞা পালন করার জন্যেই যে কেবল এ আমাদের তৎপর, কর্মশীল আর নিষ্ঠাবান করে তা-ই নয়; যত রকম ভালো কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব, তৎপরতা আর আন্তরিকতার সঙ্গে ততগুলি কাজ করার জন্যে এ আমাদের উদ্‌বুদ্ধ করে; এমনকি সেগুলি সম্পন্ন করার জন্যে আমাদের যদি কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকে, থাকে কেবল উপদেশ অথবা উৎসাহ, তাহলেও। ঠিক যেমন সদ্য সুস্থ হয়ে উঠেছে, এই রকম একজন মানুষ যতটুকু প্রয়োজনীয়, কেবল ততটুকুই হাঁটে, তবে সেক্ষেত্রেও ধীরে ধীরে আর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, সেই রকম কোনো পাপী, পাপের পথ থেকে যে সবে সরে এসেছে, ঈশ্বর তাকে যতটুকু নির্দেশ দেন, কেবল ততটুকুই হাঁটে; তবে ভক্তিমার্গে হাজির না হওয়া পর্যন্ত সে বেশ ধীরে ধীরে আর কষ্ট করেই হাঁটে। হাজির হলে তখন স্বাস্থ্যবান মানুষের মতোই কেবল সে হাঁটে না, ঐশী অনুজ্ঞার প্রশস্ত পথে সে দৌড়ায় আর লাফায়।




তাছাড়া, সামনের দিকে এগিয়ে যায়, এবং স্বর্গীয় উপদেশ আর অনুপ্রেরণার সংকীর্ণ পথে ছুটতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত, আগুন আর শিখার মধ্যে যেটুকু পার্থক্য, তার চেয়ে বেশি পার্থক্য প্রেম আর ভক্তিযোগের মধ্যে থাকে না। কারণ, ভালোবাসা আধ্যাত্মিক অগ্নিশিখা হবার ফলে যখন তা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, তখনই তাকে ভক্তিযোগ বলা হয়। এ থেকেই বোঝা যায় যে, অগ্নিশিখা ছাড়া ভক্তি প্রেমাগ্নিতে কিছু যোগান দেয় না; এই শিখা কেবল ঈশ্বরের অনুজ্ঞা পালন করার জন্যই প্রেমকে তৎপর, কর্মঠ আর নিষ্ঠাবানই করে না, করে স্বর্গীয় উপদেশ আর অনুপ্রেরণাগুলিকে অনুশীলন করার কাজেও।