প্রাক্তনের প্রেমিকের প্রতি



আমি জানি, খুব সম্প্রতি তুমি আমার প্রাক্তনের প্রেমে পড়েছ।


তার খেয়াল রেখো, এই কাজটা আমি ঠিকভাবে করতে পারিনি। কী কী নিয়ে জানি আমি সবসময় খুবই বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকতাম। যদি তার একটু খেয়াল রাখো, তবে দেখবে, এর হাজার গুণ যত্ন তুমি তার কাছ থেকে পাবে। সে ভীষণ যত্নে রাখতে জানে, দেখো!


তার কথাগুলি মন দিয়ে শোনো। আমি শুনতাম না, না শুনে আমি ভুল করেছি। সে কথা বলার সময় আমার মন থাকত অন্য দিকে। আমি তার কথাগুলি কখনও খেয়াল করে শুনিনি। তাই তখন সে খুব কষ্ট পেত। ওর সঙ্গে তুমিও এমন কোরো না। আমাকে দেখো, আজ খুব করে চাইলেও তার কণ্ঠে একটু 'হ্যালো'টুকুও শুনতে পারি না!


তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়ো। সে সত্যিই খুব চমৎকার একজন মানুষ। তোমার খুব ভালো লাগবে তার সঙ্গে গল্প করতে। আমি তাকে সময় দিতে পারিনি কিংবা দিইনি। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, সে আমার হয়ে গেছে। যে মানুষটাকে আমি পেয়েই গেছি, তাকে এত সময় দেবার কী আছে! এইসব ভাবতাম! কী যে নির্বোধ ছিলাম তখন!


মাঝে মাঝে তাকে কাচের চুড়ি কিংবা বেলি ফুলের মালা কিনে দিয়ো। তার চাহিদা খুব সামান্য। খুব অল্প পেলেও সে শিশুর মতন খুশি হয়ে ওঠে। আমি কখনও এই ব্যাপারটা নিয়ে ওভাবে ভাবিনি। তুমি মনে করে ভেবো কিন্তু! সুখী হবার, ছোটো ছোটো সুখ পাবার, তোমার কাছ থেকে ওইটুকু উপহার নেবার অধিকারটা নিশ্চয়ই তার আছে।


তার জন্মদিনটা মনে রেখো, রেস্টুরেন্টে বসে সে কী কী অর্ডার করে মনে রেখো। আমার মনে থাকত না, ভুলে যেতাম। সে খুব করে চাইত, আমার যেন মনে থাকে। তবু আমি বরাবরই ভুলে যেতাম। আমি বোধ হয় মনে রাখার চেষ্টাই কখনও করিনি। চেষ্টাটা তুমি কোরো। খুব সহজ কাজ, শুধু একটু করতে চাইতে হয়।


তার প্রিয় রংটা মনে রেখো। যদি সে দেখে, তুমি মনে রেখেছ, তবে সে খুব খুশি হবে। এই সহজ খুশিটাও আমার কাছ থেকে সে কোনোদিন পায়নি। আমাকে জিজ্ঞেস করলেই আমি ভুল উত্তর দিতাম। তার প্রিয় রং কী, তা আমি জানতাম না। আমি জানি, মুখে হাসি ছড়িয়ে রাখলেও মনে মনে সে ঠিকই কষ্ট পেত।


তার খুব ছোটো ছোটো কিছু ইচ্ছে আছে। সেগুলি পূরণ করতে ভুলে যেয়ো না। এই যেমন ধরো, সে চাইবে, গোধূলিবেলায় ছাদে উঠে তোমার হাত ধরে সূর্যডোবা দেখবে, কিংবা পাখিদের ঘরে-ফেরা। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দু-জন মিলে ফুচকা খাওয়া, ঝালটা একটু বেশি যেন হয়। এসব মনে রেখো, কেমন? আরও আছে, সময় করে জেনে নিয়ো। বেচারিকে ভালো রাখতে আমি পারিনি, অবশ্য চেষ্টাই তো করিনি কখনও!


যদি সে তোমার মোবাইলের কিংবা ফেইসবুকের পাসওয়ার্ড জানতে চায়, জানতে দিয়ো। আমি কখনও দিইনি, যদিও তার সব পাসওয়ার্ড সে আমার কাছে অনেকটা জোর করেই দিয়ে রেখেছিল। তুমি একটু দিয়ো? হয়তো সে কখনও ঢুকবেই না তোমার অ্যাকাউন্টে, কিন্তু পাসওয়ার্ডটা চাইবে; না দিলে মুখে কিছুই বলবে না, তবে মনে খুব দুঃখ পাবে। তোমার প্রেমিকা সত্যিই অনেক ছেলেমানুষ। তাকে কখনও বোকো না, আদর করে বুঝিয়ে বোলো। বুঝিয়ে বললে সে সবই মেনে নেয়। বকাঝকা করলে খুব কাঁদে। আমি প্রায়‌ই কাঁদাতাম। তুমি কাঁদিয়ো না, প্লিজ?


যে-সমস্ত মেয়েকে সে অপছন্দ করে, ভুল করেও কক্ষনো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখো না। রাখো যদি, তবে সে অনেক দুঃখ পাবে। আমি ভুল করে এবং ইচ্ছে করে রাখতাম কখনও কখনও। বেচারি খুব কষ্ট পেত।


যখন তার মন খারাপ থাকবে, তখন তাকে মনে করে সময় দিয়ো। তার কথাগুলি চুপ করে শুনো। তার ভুল ধরতে যেয়ো না যেন! তাকে তখন জাজ করতেও যেয়ো না। এমনকী তার সমস্যাগুলির সমাধানও তোমাকে দিতে হবে না। সে শুধু চায়, তার প্রিয় মানুষটা তার দুঃখগুলি ধৈর্য ধরে শুনুক। তাকে আশ্বস্ত করুক, সে একা নয়। এইটুকু অন্তত কোরো তোমার প্রেমিকার জন্য। আমি পারিনি করতে। সময় দিইনি, বকেছি, ভুল ধরিয়ে দিয়েছি, তার মনটা আরও খারাপ করে দিয়েছি। তখন আরও একটু ধৈর্য রাখলে আজ তাকে হারাতাম না। তুমি এই ভুলটা কোরো না, তাকে ভালো রেখো।


সে যেন তোমার সঙ্গে থাকার সময়টাতে তোমার অখণ্ড মনোযোগটা পায়। তুমি তাকে কায়দা করে বিশ্বাস করিয়ে দিয়ো, চেষ্টা করলে সে বিশ্বজয় করতে পারবে। তার পাশে থেকো, তাকে সাহস দিয়ো। তোমার সঙ্গে থাকার পুরো সময়টাতে যেন সে ভালো অনুভব করে। তোমার কাছ থেকে যেন তাকে কোনও কিছুই লুকিয়ে রাখতে না হয়। সে যেন তোমার সামনে তার নিজের মতো করে থাকতে পারে। এইসব মনে রেখো। আমার মনে থাকত না, কিংবা আমি মনে রাখতাম না। একটু খেয়াল রাখলেই এমন রত্ন আজ হারিয়ে ফেলতাম না। আমার সবচাইতে বড়ো ভুলটা ছিল: আমি কখনও তার বন্ধু হয়ে উঠতে পারিনি।


ইগো ধরে রেখো না। তার কাছে নিজেকে সমর্পণ কোরো। সে যেন অনুভব করে, তুমি তার পাশে আছ এবং সবসময়ই থাকবে। আমি তার প্রতি দুর্বল ছিলাম, তাকে ভালোবাসতাম; তবে এসবের কিছুই তাকে কখনও দেখাতাম না, নিজেকে সবসময় লুকিয়ে রাখতাম, বোধ হয় ইগো ধরে রাখতাম। তাকে আমি সহজে সরি-ও বলতাম না। সে-ই বলত সবসময়। সে খুব করে চাইত, আমিও বলি; কিন্তু তার সামনে আমার মুখে কিছুতেই 'সরি' আসত না। কেন আসত না, আমি জানি না। সে আমাকে বোঝেনি, কিংবা আমিই তাকে বোঝাইনি। নিজেকে বুঝতে না দিয়ে আমি ভুল করেছি। তুমি এই দিকে একটু খেয়াল রেখো।


তার কাছে হেরে যেয়ো। সবসময় জিততে হয় না। ভালোবাসার মানুষের কাছে হেরে যেতে জানতে হয়। যার কাছে তুমি কখনও হারতে চাও না, তাকে তুমি আসলে ভালোইবাসো না। যদি দেখো, সে হেরে যাচ্ছে, তখন, যে-কোনও উপায়ে হোক, তাকে জিতিয়ে দিয়ো। মনে রেখো, তর্কে তাকে হারিয়ে দিলে বাস্তবেও তাকে হারিয়ে ফেলবে। ক্রমাগত জিততে জিততে আজ আমি খুব বাজেভাবে হেরে বসে আছি!


তাকে হাসিয়ো। সে যা পেলে এবং যা শুনলে খুশি হয়ে ওঠে, ওসবের দিকে চোখ রেখো। কখনও তাকে ছোটো করে কিছু বোলো না। কারও সামনে তাকে বড়ো কথা শুনিয়ো না। কিছু যদি বলতেই হয়, তবে তাকে একাকী কাছে ডেকে বোলো। আমি এসব নিয়ে আগে ভাবিনি, এখন ভাবছি। অবশ্য এখন ভেবে আর লাভ নেই। তবে তুমি ভাবলে তাকে ভালো রাখতে পারবে। সে ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকব। এখানে আমার নিজেরই স্বার্থ আছে, তাই এত বকবক করছি।


কারও সঙ্গে সম্পর্কে থাকার সময় আমরা যখন ধরেই নিই, 'আমি তাকে পেয়েই গেছি। চিরজীবনের জন্য সে আমার হয়ে গেছে!', তখন সত্যিই ব্যাপারটা খুব হাস্যকর হয়ে যায়। আরও হাস্যকর ব্যাপার কী জানো, আমরা হুট করে ধরে নিই, 'সে থেকে যাবে, কখনওই চলে যাবে না---আমি যা-কিছুই করি না কেন! তাকে ধরে রাখার জন্য অত চেষ্টা করারই তো কিছু নেই!'


এরপর একদিন সে ঠিকই চলে যায়। যেখানে থেকে যাবার কিছু নেই, সেখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো। তখন আমরা বুঝতে পারি, কী যে বড়ো একটা ভুল করে ফেললাম! হারিয়ে ফেলার আগে তার দামটা আমরা অনুমানও করতে পারি না। চলে গিয়েই তাকে বুঝিয়ে দিতে হয়, তাকে ধরে রাখাটা খুব দরকার ছিল। এই উপলব্ধিটা যখন আসে, তখন আর কিছুই করার থাকে না। আমরা সময় থাকতে হেসে বাঁচতে জানি না বলেই সময় ফুরিয়ে গেলে পরে আমাদের কেঁদে মরতে হয়।


একদিন যাকে আমরা দামই দিই না, দাম দেবার জন্য পরবর্তীতে সেই তাকেই আর খুঁজে পাই না। যার যা প্রাপ্য, তাকে তা না দিলে, সে জীবন থেকে হারিয়ে যায়, তখন কান্না গিলে গিলে বেঁচে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। সময় থাকতে যার কান্না অনুভব করি না, দেরি হয়ে যাবার পর তার জন্যই কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাই।


আমাদের শুধুই মনে হয় আর হতেই থাকে...কেন তার সঙ্গে আরও একটু ভালো আচরণ করলাম না? কেন তাকে ধরে রাখার শেষ চেষ্টাটা করলাম না? কেন তার সঙ্গে অমন অন্যায় করলাম? কেন তাকে দুটো ভালো কথা বললাম না? কেন ওই বাজে পরিস্থিতিটা নিজে দায়িত্ব নিয়ে সামলে নিলাম না? কেন তখন সবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে হলেও তার পাশে থাকলাম না? কেন সেদিন তার কান্নাগুলির দিকে ফিরেও তাকালাম না?


ভাই রে, বিশ্বাস করো, খুব অনুশোচনা হয়।
সব কিছুর জন্য এক আমিই দায়ী।
আমিই পারিনি তাকে ধরে রাখতে।
তার সত্যিই কোনও ভুল ছিল না।
আমার নিজেরই গাফিলতিতে সে আজ আমার হলো না!
মানুষ অমন চেষ্টা করেও ভালোমানুষের দেখা পায় না, আর আমি কিনা পেয়েও হারালাম!
সেদিন হাতটা অমন করে ছেড়ে দিয়েছিলাম বলেই আজও আমি সুখ হাতড়ে মরছি!


আমি যা যা করিনি কিংবা করতে পারিনি, তুমি তার প্রত্যেকটিই কোরো।
আমি যা যা ভুল পথে হেঁটেছি, সেগুলি সবসময়ই এড়িয়ে চোলো।
নিশ্চিত থাকতে পারো, তার চাইতে ভালো কোনও মানুষের সঙ্গে তোমার আগে কখনও দেখা হয়নি, আর কখনও দেখা হবেও না।
মানুষটাকে ভালো রেখো, ভাই; আমি তো আর রাখতে পারলাম না, তুমি রেখো?
তোমাদের সুখের জন্য আমি সবসময়ই প্রার্থনা করব।