প্রথম ও শেষ ভালোবাসা

প্রিয় পিকু পিকু,




অবাক হবার ক্ষমতা এবং মুগ্ধ হবার ক্ষমতা, দুটোই আমার খুব কম; শূন্যের কোঠায় ধরা যায়। সবকিছু মিলিয়ে জীবনে একজনকেই পছন্দ করেছিলাম, কিন্তু ওই মানুষটাও আমার ভেতরের পাগলটাকে কখনও আবিষ্কার করতে পারেনি; পারেনি আমার পাগল পাগল অনুভূতিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে। তাই কখনোই আর কাউকে খুঁজতে যাইনি। কাউকে সেভাবে ভাবিনি বা ভাবনায় আসেনি...




তোমার লেখা পড়তাম ভালো লাগত বলে, তখনও তোমার সাথে পরিচয় হয়নি। লেখা পড়তে পড়তে একজন ভালো লেখক হিসেবে, ভালো মানসিকতার একজন মানুষ হিসেবে ভালো লাগত, যেমন লাগে সমরেশ মজুমদারকে। এ ছাড়া আর কিছুই ছিল না।




যেদিন প্রথম কথা হলো চ্যাটে, সেদিন খুশি হয়েছিলাম, কিন্তু অস্বাভাবিক কোনও উত্তেজনা কাজ করেনি। তারপর প্রায় এক মাস আর কোনও কথাই হয়নি। এক মাস পরে আবার কথা হলো, তখন আমার মনে হলো, আমি একটু বেশিই খুশি হয়েছি।




যেদিন প্রথম কথা হলো ফোনে, সেদিন খুব রাগ হচ্ছিল; আমার বয়ফ্রেন্ডের কথা জিজ্ঞেস করাতে, তোমার এক্সের গল্প করাতে, হঠাৎ আমাকে রোম্যান্টিক কথাবার্তা বলাতে... কারণ আমি সেভাবে প্রস্তুত তো দূরে থাক, অভ্যস্তই ছিলাম না। কেমন একটা লজ্জা, ভয়, রাগ, কিছু ভালোলাগা সব একবারে পেয়ে বসেছিল। নিজেকে প্রচণ্ড কেমন যেন একটা মনে হচ্ছিল!




একটা সময় তোমার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম কথা বলায়, কিন্তু অনুভূতিগুলোকে মোটেও বেড়ে উঠতে দিতাম না, শক্ত হয়ে থাকতাম। নিজের অনুভূতিকে এভাবে শাস্তি দেবার অসম্ভব বাজে রোগ আছে আমার।




যেদিন তোমার সাথে প্রথম দেখা হলো, বিশ্বাস করো, আমার একটুও উত্তেজনা হচ্ছিল না। অপরিচিত কারও সাথে দেখা হচ্ছে, এটা ভেবেও কিছুটা উত্তেজনা হওয়া উচিত ছিল। মনেই হচ্ছিল না, একটা অপরিচিত কারও সাথে দেখা হচ্ছে কিংবা অনেকের কাছেই কাঙ্ক্ষিত একজন মানুষের সাথে দেখা হচ্ছে... হা‌ হা হা...




যখন সিএনজি'তে তোমার পাশে বসলাম, তখন কেমন যেন একটা ভালো লাগল, তুমি মাথায় হাত দিলে তখনও ভালো লাগল, যেন আমি চাইছিলামই তুমি আমাকে একটুখানি ছুঁয়ে দাও! যখন আমার চোখের সামনে বসেছিলে, তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলিনি, কারণ আমি মানুষের সাথে আইকন্টাক্ট করি খুবই কম; ওই জায়গাটা মানুষকে দুর্বল করে দেয়, তাই।




তুমি হাত ধরে তোমার কোলে বসিয়ে যখন চুমু খাচ্ছিলে, তখনও আমি ছিলাম প্রচণ্ড আড়ষ্ট। জড়িয়ে ধরে আমার উপর শুয়ে যখন চুমু খাচ্ছিলে, তখন আমার প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছিল! বিশ্বাস হয়?




মানুষের ঘুম কখন পায় জানো? যখন সে খুব রিল্যাক্সড ফিল করে। ঘুমটা টায়ার্ডনেসের কারণেও আসে, সেটা ভিন্ন কথা। আমি কেন রিল্যাক্সড ফিল করছিলাম, আমি জানি না। প্রথম বারের ব্যাপারটা বুঝে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় বার সেই ঝড়ো সময়ে আবার চলে এলাম দু-জনে।




তারপর থেকেই তোমার প্রতি আমার অনুভূতিগুলোকে সাহস করে, বেশি না, অল্প একটু একটু প্রশ্রয় দেওয়া শুরু করলাম। গুটি গুটি হাঁটতে শিখে গেল আমার মাথায় জন্ম নেওয়া সেই প্রশ্রয়-পোকাটা, যে পোকাটার কথা তোমাকে প্রায়ই বলতাম। এরপর থেকে শুধু তোমার উপর অভিমান হতো। সম্পর্কের মধ্যে অভিমানের জন্ম হবার মানেই ভালোবাসার জন্ম হ‌ওয়া। যেখানে ভালোবাসা আছে, সেখানে অভিমান থাকবেই। যে অভিমান মানতে পারে না, সে আসলে ভালোবাসতেই জানে না।




ইচ্ছে করেই ফোন দিতাম না; দেখতাম, তুমি ফোন করো কি না, আমার মতো তুমিও আমাকে ভাবো কি না আদৌ। তুমি ফোন দিতে না, কষ্ট হতো, তবু যোগাযোগ করতাম না। কেবলই মনে হতো, নিজের অনুভূতিকে ছোটো করতে পারব না, ওটা যে আরও বেশি কষ্টের। এর চেয়ে এই-ই ভালো।




এর বেশ কিছুদিন পর যখন জানলাম, আমার ভেতর আরেকটা আমি প্রতিদিন ছোটো ছোটো করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, তখন মনে হলো, আমার চেয়ে সুখী মানুষ আর কেউ নেই এই বসুন্ধরায়! তোমাকে জানানোর পর তুমি যখন আমাকে কনগ্রাচুলেশনস বললে, বিশ্বাস করো, আমার একটুও রাগ হচ্ছিল না, তোমাকে বকা দিতে ইচ্ছে করছিল না। খুব খুশি হয়েছিলাম, চোখে খুশির সেই অশ্রু ধরে রাখতে পারছিলাম না, তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়েছিল। তারপর ভেবেছিলাম, তোমার সাথে আর যোগাযোগ করব না।




৪ জুন ক্লিনিকে যাবার আগ পর্যন্ত প্রতিটি রাত, প্রতিটি মুহূর্ত আমি ওর সাথে কথা বলেছি, ওকে ছড়া শুনিয়েছি, গান শুনিয়েছি, আরাম করে ঘুম পাড়িয়েছি; যখন খেয়েছি, একটু বেশি বেশি খেয়েছি; জোর করে খেলে আমার বমি হয়, তখনও হয়েছিল, তবু খেয়েছি, বমি করে আবার খেয়েছি। খুব যত্ন করে শুয়েছি, যেন ওর কষ্ট না হয়; বিশ্বাস করো, আমি বাবুকে একটুও কষ্ট দিইনি। ওকে আমি অনুভব করি আমার ভেতরে প্রতিটি মুহূর্তে, এখনও...




ভেবে রেখেছিলাম, আর যোগাযোগ করব না, কিন্তু ২৬ মে যেদিন ওর কথা জানলাম, সেদিন থেকে আমি যে কখন এক অন্য মানুষ হয়ে উঠেছি, বুঝতেই পারিনি। জীবনে প্রথম বারের মতো নিজের সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটা আবিষ্কার করলাম। যে ভালোবাসা ইগোর সমুদ্রে থমকে গিয়েছিল, সেই ভালোবাসায় এর পরে যে এভাবে জোয়ার আসবে, আমি কখনোই ভাবিনি। ওই যে বললাম, আমি ভেবেই নিয়েছিলাম, আমার ভেতরকার অশান্ত অনুভূতিগুলো জাগানোর মতো আমি কাউকে খুঁজে পাবো না, তাই খুঁজিও না, কারও প্রতি মুগ্ধ হতে পারি না সহজে...




চট্টগ্রামে ফিরে যাবার পর থেকে তোমার সাথে যোগাযোগ নিয়মিত হতে লাগল। তার পুরো কৃতিত্বই তোমার। তুমি যোগাযোগ না করলে নিজের অনুভূতিকে শাস্তি দেবার রোগটা আমি হয়তো আবারও বেড়ে উঠতে দিতাম। আমি আজ প্রতিটি মুহূর্তে তোমাকে গভীরভাবে অনুভব করি। তুমি সেই মানুষ, যে কিনা আমার মতো কাঠখোট্টা একটা মেয়ের বুকের গভীরে জমে থাকা তারই অজানা পাগলপারা ভালোবাসাকে জাগাতে পেরেছ। এই ভালোবাসা বহুযত্নে বহুবছর ধরে আমি লালন করে আসছি, যা কাউকে দিইনি ওই একটাই কারণে।




যখন তুমি এসে সেই জায়গাটা চিনে নিলে, তখন জমে থাকা সমস্ত ভালোবাসা শুধু তোমাকেই চিনল, শুধু তোমাকেই জানল... শুধু একারণেই আমার সেইদিন ওয়াদাগুলো করতে একমুহূর্তও দ্বিধা হয়নি। তোমাকে যে স্থানটা দিয়েছি, এটা এমনিতেও আর কাউকে দিতে পারব না। সম্ভব না দেওয়া। নিজের অনুভূতিগুলোকে তো জানি... বাজে রকমের তীব্র ওসব...




প্রথমদেখায় আমার তেমন কোনও বিশেষ অনুভূতি ছিল না, আর আজ আমি অধীর হয়ে থাকি কবে, কোন মুহূর্তে তোমার সাথে দেখা হবে, সে ভাবনায়। অদ্ভুত!!! যে কয়দিন তুমি আসার তারিখ দিয়েছিলে, আমি প্রচণ্ড রকমের অস্থির হয়ে ছিলাম, কীরকম যেন একটা অনুভূতি কাজ করছিল সবসময়ই। প্রবাসে থাকা কাছের মানুষ যখন দেশে ফেরে, তাকে ঘিরে যে আনন্দ-উত্তেজনা থাকে, সেইরকম অনুভূতি। তুমি নিজে থেকে কাছে না এলে আজ এই মুহূর্তটাই হয়তো কখনও সৃষ্টি হতো না। 




আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি। হয়তো তুমিই শিখিয়েছ, এভাবেই তোমাকে ভালোবাসতে হবে। এভাবে কাউকে ভীষণভাবে ভালোবাসি বলব, তা-ও তো কখনও ভাবিনি; তুমিই শিখিয়েছ। তোমাকে ধন্যবাদ!




এই তো... আমার ছোটোখাটো প্রেমের বিশাল কাহিনি...




তুমিই আমার প্রেম।




ইতি
তোমার পচা