ইতিহাস বলে, ইহুদিদের সকলেই অবশ্য মিশর ছেড়ে চলে গিয়েছিল, কিন্তু তাদের সবাই মোহমুক্ত হয়ে সেখান থেকে যায়নি; আর সেইজন্যে মরুভূমির বুকে বসে বসে তাদের মধ্যে অনেকে মিশরের পেঁয়াজ আর মাংসের চপের জন্যে আফসোস করেছিল। ঠিক সেইরকম এমন অনেক অনুতপ্ত মানুষ রয়েছে, যারা সত্যি সত্যিই পাপকে পরিত্যাগ করেছে বটে, কিন্তু পাপের প্রতি তাদের মোহটাকে পরিত্যাগ করতে পারেনি। অর্থাৎ আর পাপ না করার জন্যে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বটে, কিন্তু পাপের শোচনীয় আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত ও রিক্ত করতে তাদের কেমন যেন একটা অনিচ্ছা থেকে যায়; মন তাদের পাপকে বর্জন করে তার কাছ থেকে দূরে সরে যায়, তবু পাপের দিকে প্রায় সময়ই পেছন ফিরে তাকাতে মন ছাড়ে না। যে-সব মানুষ পাপ থেকে বিরত থাকে, তারাও পাপের আনন্দগুলি ভোগ করতে না পারার জন্যে দুঃখ পায়, ওগুলি নিয়ে আলোচনা করে, আর তা যে মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর, সেকথা মানতে চায় না। যেমন করেই হোক, তারা চায় সেগুলির গন্ধ শুঁকতে, আর যারা সেগুলি আস্বাদন করতে পেরেছে ও পারছে, তাদের তারা হিংসে করে। দুর্বল চিত্তের আর ভীরু প্রকৃতির অনুতপ্ত মানুষেরা কিছুক্ষণের জন্যে পাপ থেকে বিরত হয় বটে, কিন্তু তার জন্যে আক্ষেপও তারা কম করে না। তারা চায়, অভিশপ্ত না হয়েই তারা পাপ করবে আর পাপের সুখে গা ভাসাবে। কিছুটা খোশমেজাজ আর আমেজ নিয়ে তারা পাপের কথা বলে, আর যারা পাপ করে, তাদের তারা বেশ সুখী মানুষ বলে মনে করে। নিজের ক্ষতির জন্যে প্রতিশোধ নিতে যে বদ্ধপরিকর, পাপস্বীকারের সময় সে তার মন পরিবর্তন করবে; কিন্তু তার পরে অনতিবিলম্বে তুমি তাকে তার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে দেখতে পাবে; আরও দেখবে, নিজের বিবাদের কথা সেখানে সে বেশ তারিয়ে তারিয়ে আলোচনা করে বলছে — ঈশ্বরের ভয় না থাকলে সে এটা বা ওটা করত; আর এই ক্ষমা করার ব্যাপারে ঐশী বিধান পালন করা বেশ কষ্টকর। হায়, অত্যাচারের বদলা নিলে যদি তা বিধিসঙ্গত হতো! যদিও হতভাগ্য মানুষটি বর্তমানে পাপমুক্ত, তবু সে যে একেবারে পাপে মোহগ্রস্ত, এ দেখতে কে ভুল করবে? এ যেন ঠিক সেই মেয়েটির মতো, যে তার কলঙ্কিত প্রেমকে বর্জন করেও অন্য ছেলেরা তাকে তোষামোদ আর তার প্রণয় প্রার্থনা করলে খুশিই হয়। হায়! এই রকম মানুষেরই বিপদ বেশি! তোমাকে কেবল পাপের পথ ছাড়লেই চলবে না, পাপের সঙ্গে যে-সব মোহ জড়িয়ে রয়েছে, সেগুলি থেকেও মনকে মুক্ত ও পরিষ্কার করে তুলতে হবে। কারণ, তার ফলে আবার পাপে জড়িয়ে পড়ার বিপদ তো আছেই, তাছাড়া এই শোচনীয় মোহগুলি তোমার আধ্যাত্মিক শক্তিকে চিরকাল ধরে দুর্বল করে রাখবে এবং তাকে সে এত ভারাক্লান্ত করে তুলবে যে, সহজভাবে ও নিষ্ঠার সঙ্গে কোনো ভালো কাজ করা ওই শক্তির পক্ষে আর সম্ভব হবে না। অথচ ভক্তিশীল জীবনে এটাই হলো আসল কথা। পাপের পথ থেকে সরে এসে যারা তার মোহ আর দুর্বলতাকে পরিত্যাগ করতে পারে না, আমার মতে, তারা হচ্ছে সেইসব মানুষের মতো, যারা অসুস্থ নয়, অথচ যাদের কাজগুলিকে সুস্থ মানুষের কাজ বলে মনে হয় না। তারা খায় বটে, কিন্তু খেয়ে তৃপ্তি পায় না; ঘুমোয়, কিন্তু বিশ্রাম পায় না; হাসে, কিন্তু আনন্দ পায় না। তারা হাঁটে না, রাস্তা দিয়ে নিজেদের টেনে টেনে নিয়ে যায় কোনোমতে; ঠিক সেরকম, এইসব মানুষ ভালো কাজ করেও এতই মানসিক ক্লান্তিতে ভোগে যে, তার ফলে তাদের ভালো কাজের সব ভালোটুকু নষ্ট হয়ে যায়; তাছাড়া মনের শক্তির অভাবে সেইসব ভালো কাজের সংখ্যাও কম, ফলও ওসবের অতি সামান্য।