গুরুর খোঁজে

বাইবেলে দেখি, রেগেসেতে যাবার নির্দেশ পেয়ে যুবক তোবিয়াস [তোবিত ৫:২, ৪] বলেছিলেন: "পথঘাট আমার একদম জানা নেই।" এই শুনে তাঁর বাবা বলেছিলেন: "বেরিয়ে তো যাও; রাস্তায় কাউকে জিজ্ঞেস করে নিয়ো।"




এটাই মূল কাজ: পথে বেরিয়ে পড়তে পারা। বাকিটা ঠিক‌ই হয়ে যায়, পথ‌ই পথ দেখিয়ে দেয়। সত্যি সত্যি ভক্তিসাধনার পথে এগোতে চাইলে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে কোনো যথার্থ গুরুকে খুঁজে বের করতে হয়। গুরু বলতে বোঝাচ্ছি এমন কোনো সত্তাকে, যা পথ দেখায়---মানুষ, ব‌ই, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, দুঃখ, বিশ্বাস, মুভি, মিউজিক, ভ্রমণ যা-ই হোক না কেন। এটিই হচ্ছে সকল সাধনার মূল। যে বিনম্র আনুগত্যকে প্রাচীনকালে ভক্ত-সাধকেরা অতটা জোর সুপারিশ আর অনুশীলন করে গেছেন, তাছাড়া আত্মাস্থিত ঈশ্বরের ইচ্ছাকে তেমন নিশ্চিতভাবে কেউই বুঝতে পারে না—তা সে যত চেষ্টাই করুক।




কার্দোনাবাসিনী ক্যাথারিন নামে একজন ভদ্রমহিলা কঠোর তপস্যা করেছেন, এ দেখে গুরুর নির্দেশ অমান্য করে তেরেসা নামে এক সাধ্বীও কঠোর যপতপ করতে মনস্থ করলেন। এসব কাজ করতে তাঁর গুরুর নিষেধ ছিল; অথচ তাঁর কেমন যেন প্রবল ইচ্ছে হলো যে, এ বিষয়ে গুরুর নির্দেশ তিনি মানবেন না।




ঈশ্বর তাঁকে বললেন: "বৎস, যে-পথ তুমি গ্রহণ করেছ, তা ভালো আর নিরাপদ; ক্যাথারিন যে কঠোর সাধনা করছে, তা কি তুমি দেখেছ? তবু, তোমার আবেগটাকেই আমি বেশি দাম দিই।" সেই থেকে এই গুণটিকে তিনি এত শ্রদ্ধার চোখে দেখতে লাগলেন যে, বড়োদের প্রতি তাঁর যে আনুগত্য ছিল, তা পালন তো তিনি করতেনই; তাছাড়াও, পরম একজন ভক্তের কাছে তিনি একটি বিশেষ ব্রত নিলেন; শপথ নিলেন যে তাঁর নির্দেশ তিনি মানবেন, আর তিনি যে-পথে চলতে বলবেন, সেই পথেই তিনি চলবেন। ফলে, তিনি বিস্ময়করভাবে শান্তির দেখা পেলেন। এক গুরু থেকে সঠিক সময়ে অন্য গুরুতে মন নিবদ্ধ করলেও পথের খোঁজ মেলে।




ঠিক এভাবেই, তাঁর আগের আর পরের যুগের অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ ঈশ্বরের কাছে নিজেদের আরও ভালোভাবে সমর্পণ করার জন্যে তাঁর সফল ও সার্থক সেবকদের কাছে আনুগত্য স্বীকার করেছেন। সিনা-র সাধ্বী ক্যাথারিন তাঁর 'কথোপকথন' (Dialogues) নামক গ্রন্থে এই অভ্যেসটির খুব প্রশংসা করেছেন। ভক্তিমতী রানী এলিজাবেথ পণ্ডিত কনরাডের কাছে সর্বতোভাবে আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন। ইতিহাস ঘাঁটলে এমন নজির অসংখ্য পাওয়া যাবে। মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাইলে শুরুতে মাথাটা নত করে একদম ধুলোর সাথে মিশিয়ে ফেলতে হয়। ইগো ধরে রাখলে জীবনে ভালো কিছু পাওয়া যায় না।




মৃত্যুর ঠিক আগে, মহান সাধু লুই তাঁর ছেলেকে যে-সব উপদেশ দিয়েছিলেন, সেগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে: "বারবার নিজের পাপ স্বীকার করো। যাঁর কাছে নিজের পাপগুলিকে তুমি স্বীকার করতে পারবে, আর যিনি তোমাকে তোমার করণীয় বিষয়ে প্রকৃত শিক্ষা দিতে পারবেন, এমন একজন বিজ্ঞ মানুষকে তুমি বেছে নিয়ো।" অত্যন্ত দামি একটি পরামর্শ। যথার্থ গুরুর কাছে পাপ বা ভুল স্বীকার করতে পারা, নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দেওয়া, গুরুর নির্দেশিত পথে চলা — এ তিনেই মানুষের আত্মার মুক্তি আসে। এমন মুক্তিই বাঁচার আনন্দ।




একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হচ্ছে মানুষের একটি শক্ত ঘাঁটি, আর যে এরকম একজন বন্ধু লাভ করেছে, সে গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে। প্রকৃত বন্ধু জীবনদায়ী ওষুধের মতো, তা অমৃতলোকের সন্ধান দেয়; আর যারা ঈশ্বরকে সম্ভ্রম করে, তারা তাঁকে খুঁজে পায়। সংকটের সময় একজন ভালো বন্ধুর সাহচর্য জাদুর মতো কাজ করে। গুরুও পরম বন্ধু হতে পারেন, বন্ধুও যথার্থ গুরু হতে পারে। বন্ধুর জায়গায় যে থাকে, তাকে এবং তার কথাগুলিকে গ্রহণ করা সহজ। তাই বন্ধুত্বের বন্ধন বেশ বিস্তৃত।




পরামর্শ আর উপদেশ দিয়ে বন্ধু বা গুরুই আমাদের পথ দেখাবেন আর বিপন্ন হ‌ওয়া থেকে রক্ষা করবেন। দুঃখকষ্ট আর পতনে-স্খলনে তিনি আমাদের প্রকৃত জ্ঞানের আলো দেখাবেন; আধ্যাত্মিক সংকটের সময় আমাদের মনকে আরাম আর সান্ত্বনা দিতে তিনিই কাজ করবেন ওষুধের মতো। আমাদের দূরে সরিয়ে রাখবেন অমঙ্গল থেকে; আমাদের মধ্যে যা ভালো, তাকে আরও ভালো করে তুলবেন, আর যদি কখনো কোনো দুর্বলতা আমাদের মধ্যে দেখা দেয়, তাহলে তা যাতে মারাত্মক হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে তিনি লক্ষ রাখবেন; কারণ তা থেকে আমাদের কৌশলে উদ্ধার করবেন তিনিই।




এখন কথা হচ্ছে, এই পরম বন্ধুটিকে কে খুঁজে পাবে? নিজের হৃদয়ের প্রভুত্বকে যারা সম্ভ্রম করে, তারাই তাঁকে খুঁজে পাবে; অর্থাৎ যারা নম্র, যারা মনে-প্রাণে নিজেদের আধ্যাত্মিক উন্নতি চায়, তারাই। এই পবিত্র ভক্তিমার্গে একজন সঠিক গুরুর সঙ্গে যাওয়াটা একান্ত প্রয়োজনীয় বলেই সাহায্য করার জন্যে ঈশ্বর যাতে তাঁর মনমতো একজনকে পাঠিয়ে দেন, সেজন্যে তাঁর কাছে একান্তভাবে প্রার্থনা করতে হয়; আর এই কাজটি করার সময় মনের মধ্যে কোনো সন্দেহকে স্থান দেওয়া যায় না।




সত্যিই যাঁকে সবসময় দেবদূত হিসেবেই দেখা যায়, তেমন একজনের দেখা পেলে তাঁকে কখনোই নিছক মানুষ হিসাবে দেখো না, সাধারণত মানুষকে আমরা যেভাবে বিশ্বাস করি, তাঁকে তুমি সেভাবে বিশ্বাস কোরো না, অথবা বিশ্বাস কোরো না তাঁর মানবিকজ্ঞানে, বরং বিশ্বাস রেখো নিজের অন্তরস্থিত ঈশ্বর মানুষটিকে নিয়ে কী বলেন, তার উপর। এই মানুষটির ভেতর দিয়ে তিনিই তোমাকে অনুগ্রহ দেখাবেন, তোমার সঙ্গে কথা বলবেন; তোমার আনন্দের ও শান্তির জন্যে যা দরকার, প্রয়োজনে ওটুকুকে তিনি তাঁর মনে ঢুকিয়ে দিয়ে মুখে দিয়ে বলাবেন। সেজন্য তাঁকে দেবদূত বলে মনে করে তাঁর কথা মন দিয়ে শুনবে; কারণ তোমাকে স্বর্গের পথ দেখাবার জন্যে তিনি স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন।




অকৃত্রিমভাবে, কোনো কিছু না লুকিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বোলো; ছলনামুক্ত খোলামনে, প্রতারণার আশ্রয় না নিয়ে তোমার ভালো আর মন্দ সব কিছু তাঁকে খুলে বোলো। এভাবে তোমার মধ্যে যা ভালো আছে, তা তাঁর সংস্পর্শে এসে আরও মজবুত হবে; আর যা-কিছু খারাপ আছে, তা সংশোধিত হয়ে তুমি শুদ্ধ হবে। এর ফলে দুঃখ-যাতনায় তুমি আরাম আর শক্তি পাবে; আর আনন্দের সময়ে পারবে নিজেকে সংযত আর নিয়ন্ত্রিত রাখতে। তাঁর উপরে চরম বিশ্বাস রেখো; সেই সঙ্গে রেখো পবিত্র শ্রদ্ধা; তবে দেখো, তার ফলে তোমার শ্রদ্ধা যেন তোমার আস্থাকে কমাতে না পারে, তোমার আস্থা যেন তোমার শ্রদ্ধার পথ আটকে দাঁড়িয়ে না থাকে।




বাবার প্রতি কন্যাসুলভ শ্রদ্ধা নিয়ে তাঁর কাছে তুমি তোমার সব কিছু খুলে বলো, মায়ের প্রতি পুত্রসুলভ আস্থা নিয়ে তুমি তাঁকে শ্রদ্ধা করো। ঠিক এমনি করেই সম্পর্কের মাত্রা ও প্রকৃতি বিচার করে বন্ধু বা গুরুকে নিজের জীবনে ধারণ কোরো। এককথায়, এই বন্ধুত্বকে হতে হবে শক্তিশালী আর মধুর; একেবারে পুণ্যপবিত্র, স্বর্গীয় আর আধ্যাত্মিক।




তাই বন্ধু বা গুরু নির্বাচনের সময় হাজারের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নাও। সময় লাগলে লাগুক, যার-তার সাথে বন্ধুত্ব রাখাটা নিজের আত্মার ক্ষয় ছাড়া আর কিছু নয়। এর কারণ, তোমার আত্মার সাথে সংযোগসাধনের কাজটির জন্য যাঁরা উপযুক্ত, তাঁদের সংখ্যা খুবই কম, একেবারে নগণ্য। অমন একজন মানুষের হৃদয়কে প্রেম, প্রজ্ঞা আর বিচক্ষণতায় ভরে থাকতে হবে। এই তিনটির একটি গুণের অভাব থাকলেই বিপদের আশঙ্কা থেকে যাবে।




তোমাকে আবার বলছি, ঠিক এরকম একজনকে ভাগ্যে মিলিয়ে দেবার জন্যে হৃদয়কে জাগিয়ে ঈশ্বরের কাছে তুমি প্রার্থনা কোরো; এবং সেরকম একজন গুরু পেলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ো; তখন অবিচল থেকো এবং অন্য কারও সন্ধান কোরো না। যত বেশি খুঁজবে, তত বেশি হারাবে। সহজ মনে বিনম্র চিত্তে বিশ্বাসের সঙ্গে নিজের পথে এগিয়ে যাও; তোমার যাত্রা তবেই আনন্দের হবে।