আত্মসমর্পণ করা

নিজেকে শুদ্ধ করার প্রথম ধাপ হচ্ছে পাপের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া; আর তার একটাই উপায়: নিজের সমস্ত দোষত্রুটি স্বীকার করে পূর্ণমাত্রায় আত্মসমর্পণ করা। যাঁরা পাপের স্বীকারোক্তি শুনে থাকেন এবং সে অনুযায়ী পথ দেখান, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য একজন গুরু বা আচার্যকে অনুসরণ করতে হবে। কাজটি ভালোভাবে করতে না পারলে আত্মজ্ঞান অর্জন করা যায় না। নিজের ভুলগুলো চোখের সামনে রাখতে পারলে বিবেক উন্নত হয়। এই প্রক্রিয়াটি সর্বতোভাবে গুরুমুখী।

যেদিন থেকে তুমি বিচারবুদ্ধি খাটাতে শিখেছ, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত কোন কোন বিষয়ে তুমি অন্যায়-অপরাধ করেছ, সেগুলিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখো। নিজের স্মৃতিশক্তির উপরে যদি তোমার আস্থা না থাকে, তাহলে যা দেখেছ লিখে রাখো। তোমার মনের অসৎ বাসনাগুলিকে ঝাড়াই-বাছাই করে এক জায়গায় জড়ো করার পর ঘৃণা আর যতটা সম্ভব অনুতাপ আর অসন্তোষের সঙ্গে সেগুলি দূরে বিসর্জন দাও। সেই সময় চারটি কথা মনে রেখো: এই পাপের জন্যে তুমি অন্তরস্থিত ঈশ্বরের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছ, স্বর্গে তোমার নির্দিষ্ট জায়গাটিকে হারিয়েছ, নরকের অনন্ত যন্ত্রণাকে সম্বল করেছ এবং নিজেকে বঞ্চিত করেছ ঈশ্বরের দর্শন ও তাঁর অনন্ত প্রেম থেকে। নিজের হৃদয়ের গভীরে তাকিয়ে দেখলে এসব সত্য উপলব্ধি করতে পারবে।

নিজের পাপগুলি চোখের সামনে সবসময় যে রাখতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই; তবে আমার অভিজ্ঞতাপ্রসূত ধারণা, শুরতে এটা করতে পারলে তোমার জন্য খুবই ভালো হবে। তাই এটা করার জন্যে আমি এত জোর দিয়ে বলছি। হরহামেশাই দেখা যায়, সাধারণ মানুষেরা যে-সব পাপস্বীকার করে এবং তা যে উপায়ে করে, তার মধ্যে অনেক বড়ো বড়ো গলদ থেকে যায়। কারণ, এদিক থেকে প্রায়ই তাদের কোনো প্রস্তুতি থাকে না, থাকলেও তা ক্বচিৎ-কদাচিৎ; আর তাছাড়া, প্রয়োজনীয় অনুতাপবোধ‌ও তাদের মধ্যে নেই। মানুষ কষ্টভোগ করে বিবেকের সামনে দাঁড়িয়েও নিজের সাথে মিথ্যা বলার অপরাধে।

এমন ঘটনাও মাঝে মাঝে ঘটে যে, আবারও একটা পাপ করার মৌন অভিপ্রায় নিয়ে তারা পাপস্বীকার করতে যায় গুরুর কাছে। একথা আমি এই কারণে বলছি যে, পাপ করার উপলক্ষ্যকে এড়িয়ে থাকার ইচ্ছে তাদের নেই; অথবা নিজেদের জীবনযাত্রাকে সংশোধন করার জন্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেও তারা চায় না; এবং এইসব ক্ষেত্রে মনটাকে নিরাপদে রাখার জন্যে একটি সামগ্রিক ও আন্তরিক পাপস্বীকার অপরিহার্য। কিন্তু এ ছাড়াও, এই রকম পাপস্বীকার নিজেদের আরও ভালোভাবে জানতে আমাদের সাহায্য করে, অতীত জীবন সম্বন্ধে আমরা লজ্জিত হই আর তাতে আমাদের ভালোই হয়। নতুন জন্মের পথে অগ্রসর হতে চাইলে পুরোনো জীবনের মৃত্যু আবশ্যক।

ভগবান যে কত কৃপাশীল, তা ভেবে আমরা অবাক হয়ে যাই, কেননা এই ভগবানই আমাদের পাপগুলিকে এত ধৈর্যের সঙ্গে সহ্য করেছেন। এই পাপস্বীকার আমাদের হৃদয়কে শান্ত করে, মন জুড়িয়ে দেয়; সৎ সংকল্প গ্রহণ করার অনুপ্রেরণা দেয়; আমাদের বিভিন্ন অবস্থা অনুসারে আমাদের পরামর্শ দেবার জন্যে আমাদের আধ্যাত্মিক পিতা বা গুরুকে সুযোগ দেয়, এবং পরবর্তীকালে মন খুলে পাপস্বীকার করার জন্যে আমাদের মনে আস্থার জোগান দেয়। একজন প্রকৃত গুরু পিতৃতুল্য, কেননা তিনি আমাদের বোধের পুনর্জন্ম দান করেন। মূলত বোধের এই পুনর্জন্ম‌ই মানুষের পুনর্জন্ম।
সেইজন্য একটি ভক্তিশীল জীবন গ্রহণ করে আমাদের মনকে একেবারে নতুন করে গড়ে তোলা আর তাকে ঈশ্বরের দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য শতভাগ সৎ পাপস্বীকারের গুরুত্ব অসীম। মিথ্যা লালন এবং আড়াল করে সত্যের পথে বাঁচা অসম্ভব।