রিকশায় উঠলে আমি সাধারণত চুপচাপ থাকি। তবে মুড ভালো থাকলে কখনও কখনও দু-একটা কথা বলি রিকশাওয়ালার সঙ্গে। ফেইসবুকে ভুল করেও ঢুকি না, যদি কেউ ছোঁ মারে! দু-দিন আগে বৃষ্টি থামার ঠিক পরে একটা কাজে বেরিয়েছিলাম। ওয়েদারটা ভালো ছিল, চারিদিকে কীরকম একটা ঠান্ডা-স্নিগ্ধ আলো-হাওয়া, অনুভব করতে বেশ ভালো লাগছিল! রিকশা চলছে, খুব ধীরে। প্যাডেল মারার ধরনে মনে হলো, রিকশাওয়ালা অনভ্যস্ত। বয়সে তরুণ, মুখে মাস্ক, বড়ো রুমালের মতো কিছু-একটা দিয়ে ওর মুখ অনেকটা ঢাকা। ওঠার সময় ভাড়াও বলেনি; বলেছে, যা ভাড়া হয়, তা-ই দিয়েন। - নতুন রিকশা চালাচ্ছেন নাকি? - জি স্যার। - বাসা কোথায়? - আগ্রাবাদ। - ওখানে কোথায়? (ও কিছু বলল না।) - আমাকে নামতে হবে? খাড়া রাস্তাটা শেষ হোক? - না স্যার, আমি পারব। - আপনার বাসায় কে কে আছেন? (ছেলেটা চুপচাপ।) - এখন কি প্যাসেঞ্জার কম নাকি একটু? বাস-টেম্পো তো চলে না, বেশি হবার কথা! (এখনও চুপ।) - রিকশা টানতে কষ্ট হচ্ছে? শরীর সুস্থ তো? - জি না স্যার, কষ্ট হচ্ছে না। (বেশ হাঁপাতে হাঁপাতে উত্তর দিল সে।) - তাহলে কথা বলেন না কেন? (এবারও চুপ।) ওর সঙ্গে আর একটাও কথা বললাম না বাকি রাস্তায়। তবে ওকে নিয়ে যে ভাবিনি, তা নয়। মানুষ যার সঙ্গে কথা বলা হঠাৎ থামিয়ে দেয়, তাকে নিয়ে ভাবে। ছেলেটার কথা বলার ধরন খুবই মার্জিত, গলার স্বর বেশ নরম, মুখের ভাষাও খুব সুন্দর। এই ছেলে সত্যিই রিকশা চালায় সবসময়? মিলছে না তো! রিকশা আমার বাসার সামনে এসে থামল। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে চলে যাবার সময় ছেলেটা মৃদুকণ্ঠে আমাকে পেছন থেকে ডাকল। - সুশান্ত স্যার, একটু শুনবেন? - আপনি আমাকে চেনেন কীভাবে? - আপনাকে কে না চেনে! (এবার সে মুখ থেকে রুমাল সরাল, মাস্ক খুলল। ওকে দেখলাম ভালো করে। নাহ্, চিনি না তো!) - আপনি কে? - রিকশাওয়ালা! - বুঝলাম, কিন্তু… - রিকশাওয়ালাদের ফেইসবুক, ইউটিউব সবই থাকে, স্যার! (ওর কণ্ঠস্বর ধীর, বলার ধরন নম্র ও দৃপ্ত।) - না না, ঠিক আছে। আপত্তি না থাকলে আপনার পরিচয়টা বলতে পারেন। - আমি সোহেল। - কী করেন? - এখন রিকশা চালাই। - আগে কী করতেন? - টিউশনি করতাম, পাশাপাশি পড়াশোনা করতাম। - কোথায় পড়তেন? - পড়তাম না, এখনও পড়ি; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, এতদিনে থার্ড ইয়ারে থাকার কথা ছিল। - কী বলছেন! চিটাগাং ভার্সিটিতে? - জি স্যার। - টিউশনি নেই এখন? - না স্যার, তাই রিকশা চালাচ্ছি। - বাসায় কে কে আছেন? - বাবা, মা, ছোটো বোন আর ভাইয়া। বাবা প্যারালাইজড, ভাইয়া অটিস্টিক, মা-ও অসুস্থ। ছোটো বোনের স্কুল বন্ধ, সে টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করে। - আমি বুঝতে পারিনি, সত্যিই সরি! আসলে কী বলব বুঝতে পারছি না! - আপনি কেন সরি বলছেন? স্যার, আপনাকে পেছন থেকে ডেকেছি কিছু কথা জিজ্ঞেস করার জন্য। উত্তর পেলে ভালো লাগবে। অনেক দিন আপনাকে ইনবক্সে জিজ্ঞেস করেছি এসব, আপনি খেয়াল করেননি হয়তো। - হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন! - দু-একটা কথায় জিজ্ঞেস করি। বেশিক্ষণ সময় নেব না। আমি কিংবা আমার পরিবারের কেউই এ জীবনে কখনও কারও ক্ষতি করিনি। আমার বাবার টাকাপয়সা সবই তাঁর বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার মেরে দিয়েছে। প্রচণ্ড দুঃখ পেয়ে বাবা স্ট্রোক করেন। মা আগে থেকে অসুস্থ, ভাইয়ার কথা তো বললামই। আমাদের তেমন কোনও সঞ্চয় নেই। বাবা কিংবা মায়ের অবস্থার অবনতি হলে বিনা চিকিৎসাতেই মারা যাবেন হয়তো। মানুষের ক্ষতি না করেও এ জীবনে ক্ষতি ছাড়া আর কী পেলাম আমরা? বাবা-মা’য়ের চিকিৎসা, বোনের পড়াশোনা, বাসাভাড়াসহ পুরো পরিবারের সব খরচ আমাকে চালাতে হয়। ভার্সিটিতে পড়ি বলে কিছু টিউশনি জোগাড় করতে পেরেছিলাম। টাকা উপার্জনের পাশাপাশি যতটুকু পারি, পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। আমার জীবনটা এত বেশি ব্যস্ত যে কখনও বন্ধুদের সঙ্গে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দেবারও সময় পাই না। আমার মাথায় সারাক্ষণই বাবা-মা, ভাইয়া আর বোন। নিজের পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজের দিকে তাকানোরই সময় নেই আমার! আপনি তো বলেন, অন্যের পেছনে লেগে থাকলে সারাজীবনই অন্যের পেছনেই থাকবেন। তাহলে আমি কেন সবসময়ই আমার বন্ধুদের পেছনেই থেকে গেলাম? স্যার, আপনার কথাবার্তা পড়ে ও শুনে যতদূর বুঝেছি, আপনি ন্যাচারাল জাস্টিসে বিশ্বাস করেন। আপনি প্রায়ই বলেন, মানুষ তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করে। তাহলে আমি কীসের ফল ভোগ করছি এখন? দেখলাম, ওর দু-চোখে জল জমে গেছে। রুমালটা দিয়ে চোখ মুছে, মুখে আগের মতো মাস্ক পরল, রুমাল দিয়ে মুখ ঢাকল। - আসি, স্যার। কখনও মন চাইলে কোনও এক ক্যারিয়ার আড্ডায় বা লেখায় উত্তরগুলি দিয়ে দিয়েন। নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন। আসসালামু আলাইকুম। আমি মাথা নিচু করে শুনছিলাম ওর কথাগুলি। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে পেয়ে ওকে পেছন থেকে ডেকে খুব নরমস্বরে বললাম, ভাই, শোনো! তোমাকে কিছু টাকা দিই, যদি মনে কিছু না করো? সে হেসে বলল, টাকা লাগবে না, স্যার। পারলে উত্তরগুলি দিয়েন, কৃতজ্ঞ থাকব। ভাই সোহেল, যদি তুমি আমার এই পোস্টটা দেখে থাকো, তবে তোমাকেই এই কথাগুলি লিখছি: আমরা জীবনে কী পেলাম, তা জানতে পারি। কী পেলাম না, তা কখনওই জানতে পারি না। কীরকম? এ জীবনে যা ক্ষতি পেলাম, তার চাইতে বড়ো ক্ষতিও তো পেতে পারতাম, তাই না? তোমার বা তোমাদের ক্ষতি যে বা যারা করেছে, তার বা তাদের জীবনে কী ঘটেছে বা ঘটছে বা ঘটবে, তা কি তোমরা কেউ জানতে পেরেছ? কারও ক্ষতি না করার পুরস্কার পাওনি ভাবছ কেন? সময় কি শেষ? কষ্টের দিনগুলিই কি চূড়ান্ত কিছু? এর পরে কী আছে আমরা কি জানি? তোমাদের পরিবারের দিনগুলি এরকমই থেকে যাবে সবসময়? একটু অপেক্ষা করে দেখোই-না কী হয়! আমাদের ক্ষতি হয় কেবলই পাপ-পুণ্যের হিসেবে নয়, এখানে আরও অনেক হিসেব থাকে। মনে রেখো, বেঁচে থাকার জন্য, কৃত পুণ্যের নগদ পুরস্কারপ্রাপ্তির চাইতে অকৃত পাপের আগাম শাস্তিমুক্তি অনেক বেশি জরুরি। ওই ভবিষ্যতের শাস্তিমুক্তিই এই বর্তমানের পুরস্কারপ্রাপ্তি। সামনে কী হবে, তা আমরা কেউই তো জানি না! একটা মজার ব্যাপার জেনে রাখো। ওই যে বললাম না, আমরা জীবনে কী পেলাম, তা জানতে পারি, এটাও কিন্তু ভুল! জানতে আমরা আসলে পারিই না! আজকের দিনে যা বৃথা মনে হচ্ছে, অপ্রাপ্তি মনে হচ্ছে, হয়তো তা-ই একদিন তোমাকে অনেক বড়ো বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দেবে! অপেক্ষা করো, নিজেই সব দেখতে পাবে! তোমার বয়স অল্প, জীবনটা দেখেছও অল্প। যতটুকু দেখেছ, তার সবটুকু কেবলই কষ্ট আর কষ্ট, এটাও যদি ধরে নিই, তবুও নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলব, প্রায়ই, অল্প বয়সের দুর্ভাগ্য বেশি বয়সের সৌভাগ্যকে টানে। জীবনটাকে শুধুই আজকের ভেবো না। আজই সবকিছুর শেষ নয়। যদি তোমার নিয়ত ঠিক থাকে, তবে নিশ্চিতভাবে জেনে রেখো, আজকের দুঃখগুলি নিয়ে একদিন হাসিমুখে বিজয়ীর বেশে গল্প করতে পারবে। আমার কথা শুনে হাসি পেয়ে যাচ্ছে? হেসো না, ভাই! জীবন আমাকে অনেক কিছুই দেখিয়েছে, সেইসব দেখা থেকে শিখেই এত কথা বলছি। নিজের কাজগুলি মন দিয়ে করে যাও। ভালো করে ভেবে করবে, যা-ই করো না কেন! মাথায় যা আসে, তা-ই করে ফেলতে পারার মতো সৌভাগ্য নিয়ে তুমি জন্মাওনি। যে যা-ই বলুক, এক নিজের মন বাদে আর কারও কথা মাথায় নিয়ো না। আপাতত একদমই চুপ থাকো, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাও, সময়ই সব বলে দেবে। দুঃখ ভোগ করার পরমসৌভাগ্যটা সবার কপালে লেখা থাকে না! সবচাইতে বড়ো কথা, তুমি নিজের বাবা-মা’য়ের সেবা করার যে সুযোগটা পাচ্ছ ও তা কাজে লাগাচ্ছ, তার পুরস্কার পাবার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব নয়! তুমি তোমার নিজের কিংবা তোমার বাবা-মা’য়ের সজ্ঞানে বা অজান্তে করা কোনও কৃতকর্মের ফল ভোগ করছ কি না আমি জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, আমাদের জীবনটা হাসি ও কান্না দিয়েই তৈরি। আমরা প্রত্যেকেই একটা মাস্টারপ্ল্যানের অংশ মাত্র। তুমি আজ যা ভোগ করছ, তা তোমার জীবনে ঘটারই কথা ছিল। এখন না ঘটলে পরে তা ঘটতই ঘটত! দুঃখ থেকে পালিয়ে যেতে তুমি পারবে না। মানুষ যে সবসময় কেবল কৃতকর্মের ফল ভোগ করে, তা নয়। এমনও হয়, এখন যে শাস্তি তুমি পাচ্ছ, তা হয়তো পরবর্তীতে তোমার প্রাপ্য কোনও শাস্তির জামানত। বেশি বয়সের কষ্টের জামানত যত পারো অল্প বয়সেই কুড়িয়ে নাও। আমি প্রায়ই বলি, পুণ্যে পাপ কাটে। একইভাবে, পাপেও কিন্তু পুণ্য লাগে! আজকের পুণ্যফলই আগামী দিনের পাপমোচন! তুমি হয়তো তোমার অতীতের কৃত পুণ্যের হিসেব রেখেছ, কিন্তু ভবিষ্যতের অকৃত পাপের হিসেবটা তুমি এখনও কি জানো? তোমার আজকের এই অনর্জিত দুর্ভাগ্যের জোরে ও জেরে ভবিষ্যতে তুমি হয়তো এমন কোনও দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে, যা তোমার জন্য প্রাণঘাতীও হতে পারত! এরকম প্রাপ্য দুঃখগুলি মানুষের জীবনে আসবেই আসবে; কারও আগে, কারওবা পরে, কিন্তু পার কেউই পাবে না! তোমার ও তোমার পরিবারের জন্য প্রকৃতির ন্যায়বিচার অপেক্ষা করছে হয়তো! আজ যা হচ্ছে, তা-ও সেই বিচারেরই একটা অংশ মাত্র! কে বলতে পারে! সোহেল, তোমার আত্মসম্মানবোধ দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। এটা অনেক বড়ো সম্পদ। অনেকেই খুব চেষ্টা করেও এটা অর্জন করতে পারে না, কেননা এটা ভেতর থেকেই আসে আশৈশব কিছু অভিজ্ঞতা, বিশ্বাস ও সামর্থ্যের মধ্য দিয়ে। আগুনে পুড়ছ বলেই খাঁটি সোনা হয়ে ক্রমশ গড়ে উঠছ। আগুন কিন্তু সবাইকে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলতে পারে না, কেউ কেউ আগুনে পুড়তে অভ্যস্ত হয়ে যায়। যে মানুষ আগুন সহ্য করতে শিখে নিয়েছে, তাকে আগুনের তাণ্ডবনৃত্য ধ্বংস করবে কী করে? জীবনে এমন অভ্যস্ততা যত আগে আসে, তত ভালো। পুনশ্চ এক। সংগত কারণেই, সোহেলের নাম সোহেল নয়। পুনশ্চ দুই। আমাদের যাদের জীবনটা সোহেলের জীবনের মতো নয়, তারা যে কতটা ভালো আছি, তা কি অনুভব করতে পারছেন? নিজের জীবনের এতটা সৌন্দর্য ও সৌভাগ্য দেখার পরও কি আমরা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে ভুলে যাব? ভাবুন তো, আমাদের এমন কোন যোগ্যতা বা গুণ বাড়তি আছে, যা সোহেলের নেই? তবুও কি আমরা বলেই যাব, কী পেলাম এ জীবনে! পুনশ্চ তিন। এই যে এমন কোভিড-মহামারির সময়ে সুস্থ শরীরে বেঁচে আছি, এর চেয়ে বড়ো আনন্দের কথা আর কী হতে পারে!