অস্পষ্ট জার্নাল: ১৬



একশো ছয়।


আমরা হচ্ছি সেই কুকুরটা, যে কুকুর নিজের লেজ ধরতে নিজেই সারাক্ষণ নিজের পিছু ছুটে চলেছে। এভাবে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করতে বসলে একটাসময় আমরা পাগল হয়ে যাব, কেননা নিজের লেজের পিছে ছুটে বেড়ানো সম্ভব হলেও সেটি ছুঁয়ে ফেলা অসম্ভব। এভাবে আমরা সারাজীবন কেবল ছুটতেই থাকব, কিন্তু কখনও তা ছুঁতে পারব না।


দর্শন বিষয়টি ঠিক এমনই, কেননা সব দার্শনিকই এভাবে নিজের লেজের পিছু ছুটে বেড়ান এবং দিনশেষে পাগল হয়ে ফেরেন। আমাদের সমস্যাগুলো আমাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ফলে যখন আমরা নিজেদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে নানা কৌশল অবলম্বন করতে থাকি, অস্থির হয়ে, উদ্‌গ্রিব হয়ে সমস্যাগুলোর পিছু পাগলের মতো ছুটতেই থাকি, তখন সমস্যাগুলোও আসলে চক্রাকারে ঠিক সেভাবেই আমাদের পিছু ছুটতে থাকে। যতই আমরা সমস্যাগুলোর হাল ধরতে যাই না কেন, কোনও সমাধান বের হয় না বরং ওরা আমাদেরকে পাগল করে ছাড়ে। এমনকী যদি আমরা কোনও সমাধান খুঁজেও পাই, তারপরও সমস্যাগুলো শেষ হয়ে যায় না, ভেতরেই থেকে যায়।


যখন আমরা নিজেরা নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে উদ্যত হই, তখন আমরা আমাদের ইগোর দ্বারা পরিচালিত হই। তারপর যখন আমরা খেয়াল করি, সেটি আমরা সমাধান করতে পারব না, তখন আমরা আমাদের বন্ধু কিংবা বিশেষজ্ঞের কাছে যাই। বিশেষজ্ঞ হচ্ছেন এমন কেউ, যিনি একটি বিষয়ের উপর অনেক কিছু জানেন, যিনি আমাদেরকে বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে পারেন। তিনি আমাদেরই মতো একজন মানুষ, যিনি একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে বেশ কিছু জানেন। একজন বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে তাঁর কাছে সমর্পিত হবার কিছু নেই, আমরা কেবল কিছু অর্থের বিনিময়ে তাঁর কাছে উপদেশ লাভ করি, যা আমাদের কোনও কাজেই আসে না, কেননা তিনি যদিও দৃঢ়তার সাথে বলেন যে তিনি সমস্যাটির সমাধান করে ফেলেছেন, তবু কিছুদিন পরই সমস্যাটি ফিরে আসে শুধু অন্য কোনও রূপে। ফলে আমাদেরকে সারাজীবনই বিশেষজ্ঞের কাছে দৌড়োতে হয়।


যখন আমরা এমন কারও সান্নিধ্যে যাই, যাঁকে দেখে আমাদের ভেতরের স্রষ্টা জেগে ওঠেন, আমাদের মনে হয় যেন আমরা স্রষ্টার দ্বারে এসে ঠেকেছি, ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের সমস্যাগুলোই অদৃশ্য হয়ে যায়। মনে হতে থাকে যেন আমরা আমাদের সকল সমস্যাকেই জয় করে ফেলেছি, আর এখানেই একজন গুরু এবং একজন বিশেষজ্ঞের পার্থক্য। একজন গুরু আমাদের সামনে সমগ্র অস্তিত্বকে তুলে ধরেন, স্রষ্টার সামনে এনে দাঁড় করান যেন আমরা আমাদের সকল সমস্যার কথা স্রষ্টার সামনে তুলে ধরতে পারি, যেন আমরা স্রষ্টার সাথে কথা বলতে পারি। আমি এবং আমার অস্তিত্বের মাঝে মধ্যবর্তী বলে কিছুই নেই, এমনকী একজন গুরুর পক্ষেও আমি এবং আমার স্রষ্টার মাঝে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। যখন আমাদের অস্তিত্বের সাথে এমন কোনও সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়, তখন আমরা অতি সহজেই নিজেকে স্রষ্টার সামনে অনাবৃত করতে পারি। যখন আমরা পরিপূর্ণভাবে স্রষ্টার কাছে নিজেকে প্রকাশ করি, তখন আমাদের ভেতরে আর কিছুই লুকানো থাকে না, আমাদের ভেতরে তখন এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়, সেই শূন্যতা আমাদেরকে আমাদের সকল প্রশ্নের সমাধান এনে দেয়। স্রষ্টার কাছে অথবা অস্তিত্বের সামনে যে যতটা অনাবৃত, সে ততটাই স্রষ্টার নৈকট্যলাভে সক্ষম হয়।


এজন্যই আমরা দেখতে পাই, একটি শিশু কিংবা পবিত্র ব্যক্তি, সাধু কিংবা ঋষির প্রার্থনা জলদি জলদি ফলপ্রসূ হয়ে থাকে। কেননা একটি শিশু বোঝে না ভণ্ডামি কী, কী করে লুকোতে হয়। আবার একজন পবিত্র, পরিশুদ্ধ মানুষ স্রষ্টার সামনে নিজেকে মেলে ধরার সঠিক পথটি আগেই জেনেছেন। ফলে এই দু-জনের প্রার্থনাই দ্রুত তাঁর কাছে পৌঁছে যায়। আমাদের সকল অনুভূতি, সকল সমস্যা তুলে ধরার একটি অজুহাত হচ্ছেন স্রষ্টা, কেননা সমগ্র অস্তিত্বের মাঝেই স্রষ্টা রয়েছেন, স্রষ্টাকে কোনও এক জায়গায় স্থির খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্রষ্টা চলমান, স্রষ্টা চিরস্থির, স্রষ্টা সমগ্র, কিংবা আমিই স্রষ্টা, আমার মাঝেই স্রষ্টা নিহিত। স্রষ্টা সূর্যের আলোর মতো, যেটি সমগ্রে ছড়িয়ে থাকে, কিন্তু তাকে ছুঁয়ে দেখা যায় না। যখন আমরা প্রার্থনায় জড়ো হই, তখন আসলে আমরা সেই সমগ্রকেই অনুভূতিতে জড়াই, আমাদের অস্তিত্বের কাছে ফিরে যাই।


একশো সাত।


ভালোবাসা আমাদের সেই প্রার্থনা, যা আমাদের অনুভবে জড়িয়ে থাকে, কিন্তু তাকে আলাদা করে ধরা যায় না। যখন আমরা স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসায় সমর্পিত হই, তখন এমনকী কিছুই বলার প্রয়োজন নেই, কেবল আমাদের ভালোবাসাই তখন যথেষ্ট। আমাদের বিশুদ্ধ ভালোবাসাই আমাদেরকে স্রষ্টার কাছে নিয়ে যায়। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, যিনি ভালোবাসেন, তাঁর প্রার্থনার প্রয়োজন নেই, কেননা তাঁর ভালোবাসাই একটি প্রার্থনা। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, ভালোবাসা কখন প্রার্থনা হয়ে ওঠে? একদিন প্রচণ্ড শীতের রাতে একজন মা তাঁর ছোট্ট শিশুকে দৈনন্দিন প্রার্থনার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। প্রচণ্ড শীতে শিশুটি বিছানায় কম্বল মুড়িয়ে খেলছিল, মায়ের কথা শুনে শিশুটি বলে উঠল, ‘এমন শীতের রাতে প্রার্থনার জন্য স্রষ্টার ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে? এই প্রচণ্ড শীতে আমার প্রার্থনা শুনতে স্রষ্টার কি কষ্ট হবে না?


এমন একটি শিশুর কি স্রষ্টাকে প্রার্থনার জন্য কোনও শব্দের প্রয়োজন আছে? স্রষ্টার প্রতি শিশুটির আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসাই কি স্রষ্টার কাছে যথেষ্ট নয়? এই শিশুটি বলতে চাইছে, এত গভীর শীতের রাতে প্রার্থনার জন্য স্রষ্টাকে ডেকে তুললে স্রষ্টার ভীষণ কষ্ট হবে, সে স্রষ্টাকে কষ্ট দিতে চাইছে না। এমন ভালোবাসায় কোনও শব্দের প্রয়োজন নেই। স্রষ্টা আমাদের হৃদয় দেখেন, আমরা কোন ভাষায় কথা বলি অথবা কী বলি, তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, স্রষ্টার প্রতি আমাদের অনুভূতি এবং আমাদের একাগ্রতা। যিনি স্রষ্টার প্রতি একাগ্র, তাঁর বাক্‌শক্তি না থাকলেও তিনি স্রষ্টাকে পেতে পারেন। কেননা ভালোবাসা হৃদয় দেখে হয়, ভালোবাসা হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের হয়; বাক্যে কিংবা শব্দে নয়, বাক্যের সঙ্গে কিংবা শব্দের সঙ্গেও নয়। আমাদের ভালোবাসার অনুভূতিগুলোই স্বর্গীয়। যখন আমাদের মাঝে স্বর্গীয় অনুভূতি হতে থাকে, তখন আমরা সমগ্র অস্তিত্বের সাথে একাত্ম হই। আমাদের সমস্যার সমাধানগুলোও সমগ্রের সাথে সম্মিলিত। আমরা যা-কিছু চেয়ে এসেছি, তার সব কিছু পেয়ে যাবার পরও শূন্যতা অনুভব যে করি, তার কারণ, আমরা নিজেদেরকে সমগ্রের থেকে ও আমাদের অস্তিত্বের থেকে আলাদা করে ফেলেছি। ফলে আমাদের মাথার উপরে বৃষ্টি ঝরলেও বৃষ্টির জল আমাদের গোড়া অবধি পৌঁছাচ্ছে না। ফলস্বরূপ আমরা তৃষ্ণার্তই থেকে যাচ্ছি, কেননা আমরা নিজেকে মাটির থেকে আলাদা করে ফেলেছি।


প্রার্থনা হচ্ছে সেই অনুভূতি, যা আমাদেরকে সমগ্রের সাথে একাত্ম করে তোলে। ভালোবাসার শক্তি এতটাই যে, এমনকী স্বয়ং স্রষ্টাও একে প্রেমিকের হৃদয় থেকে, উপাসকের হৃদয় থেকে আলাদা করতে পারেন না। একজন মানুষের মধ্য থেকে তার জ্ঞান, স্মৃতি, শব্দ সবকিছুকে মুছে ফেলা গেলেও তার প্রার্থনা, তার ভালোবাসাকে কখনও মুছে ফেলা যায় না। ভালোবাসা ও প্রার্থনা কোনও গুণ নয়, এটি অস্তিত্বের প্রকৃতি, ভালোবাসা স্রষ্টারই প্রকৃতি। এ বিষয়ে একটি বিখ্যাত কাহিনি প্রচলিত আছে। কোনও একসময় স্রষ্টার খুব অদ্ভুত এক ভক্ত ছিলেন যাঁর নাম বালশ্যাম। তিনি স্রষ্টার এতই কাছের ছিলেন যে তিনি জাগতিক সকল বিষয়ে যা তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেত, যা তাঁর কাছে অন্যায্য মনে হতো, সেইসব বিষয় নিয়ে স্রষ্টার সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া শুরু করে দিতেন। প্রতিদিন তিনি স্রষ্টার কাছে শতশত অভিযোগ করতেন আর বলতেন, ‘স্রষ্টা, তুমি বলেছ, যখনই পৃথিবীতে কোনও সমস্যা আবির্ভূত হবে, কোনও অন্যায় সংঘটিত হবে, তখনই তুমি পৃথিবীতে হাজির হবে। তাহলে কেন তুমি এখনও আসছ না?’ তাঁর এক শিষ্য ছিল, যিনি তাঁর সকল বাণী, তাঁর জীবনী, এমনকী স্রষ্টার সাথে তাঁর প্রতিদিনকার সকল কথা লিখে রেখে দিত। এভাবে তিনি স্রষ্টাকে সারাক্ষণ এতটাই জ্বালাতন করতেন যে স্রষ্টা একবার ভাবলেন, তাকে কী করে থামানো যায়!


স্রষ্টা তাঁর এক দূত পাঠালেন যেন তাঁর দূত এসে বালশ্যামের মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ খালি করে দিতে পারে, যাতে করে বালশ্যামের কিছুই মনে না থাকে এবং সে যেন স্রষ্টাকে নানা অভিযোগ-অনুযোগে সারাক্ষণ জ্বালাতন করতে না পারে। স্রষ্টার দূত তাঁর কথামতো নির্দেশিত কৌশল অনুযায়ী বালশ্যামের মস্তিষ্ক থেকে তাঁর স্মৃতিগুলোকে পুরোপুরি মুছে দিল। অতঃপর বালশ্যাম প্রার্থনা থেকে জাগ্রত হয়ে দেখতে পেলেন, তাঁর কিছুই মনে পড়ছে না, এমনকী তিনি তাঁর শিষ্যকেও ভুলে গেছেন। তাঁর শিষ্যই তাঁর কাছে এল এবং তাঁর পরিচয় মনে করিয়ে দিল। তখন বালশ্যাম তাঁর শিষ্যকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এমন কিছুই কি নেই যার মাধ্যমে আমি আমার পেছনের স্মৃতি ফিরে পেতে পারি?’ তাঁর শিষ্যও সেগুলো কিছুই মনে করতে পারছিল না, কেননা তারও আংশিক স্মৃতিভ্রষ্ট করা হয়েছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাঁর শিষ্য একটি চিরকুটে স্রষ্টার সাথে বালশ্যামের কিছু কথোপকথন খুঁজে পেলেন এবং সেটি বালশ্যামকে জানাতেই বালশ্যামের স্মৃতিশক্তি পুনরায় ফিরে এলেই বালশ্যাম আবার আগের মতোই স্রষ্টার কাছে নানা অভিযোগ শুরু করে দিলেন এবং আর্জি জানালেন, তিনি যেন পৃথিবীর এই দুরবস্থা কাটানোর জন্যে অবিলম্বে যিশুখ্রিস্টকে পুনরায় পৃথিবীতে প্রেরণ করেন।


স্রষ্টা বিরক্ত হয়ে তাঁর দূতকে দোষারোপ করে বললেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি তোমার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করোনি!’ তখন তাঁর দূত তাঁকে জানালেন, এই ব্যক্তি ভীষণ অদ্ভুত এবং কোনও কৌশলই তাঁর উপরে কাজ করে না। প্রকৃত ভালোবাসা ঠিক এমনই, প্রার্থনার কোনও কিছুই হৃদয় থেকে মুছে যায় না, এমনকী স্রষ্টার পক্ষেও সেটি সম্ভব নয়। ভালোবাসাই হচ্ছে পরম সত্য, একমাত্র সত্য। যখন স্রষ্টা নিজেই সকল সমাধান এবং যখন তিনি আমাদের সামনেই রয়েছেন, তবে কেন আমরা আমাদের সমস্যা নিয়ে অন্য কোথাও যাব? আমরা সবসময় কোলাহলের মধ্যে থাকি, কেননা আমরা আমাদের অস্তিত্বকে ভয় পাই, অস্তিত্বের কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে চাই। যদিও আমরা নিজেকে এবং সমগ্র অস্তিত্বের অস্তিত্বকে ভয় পাই, তা সত্ত্বেও আমরা নিজেদের একটি ক্ষুদ্র অস্তিত্ব গড়ে তুলি, কেননা আমাদের মনে সবসময় একটি প্রশ্ন জাগে, যদি সৃষ্টি এবং স্রষ্টা দুটোই সত্য হয়ে থাকেন, তবে কোনটি প্রথম সত্য? সৃষ্টি, না কি স্রষ্টা? অস্তিত্বের দুটি ধরন রয়েছে, একটি একক, অন্যটি সমগ্র। যখন আমরা নিজেদের কোনও ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ যে-কোনও গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করি, তখনই সাধারণত আমাদের মনে শ্রেণিচিন্তার জন্মলাভ করে।


আমরা মনে করতে থাকি, কেবল আমরাই সত্য, বাকিরা মিথ্যা। আমাদের এই দ্বন্দ্বই আমাদেরকে স্রষ্টার থেকে আলাদা করে স্রষ্টার কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। অথচ এটি যে কেবলই এক কল্পনা, এটির সাথে বাস্তবের কোনও মিল নেই, সে সত্যের দিকে আমরা কখনও কর্ণপাত করি না। সমগ্র এবং একক সত্তা ব্যতীত বাকি সবকিছুই আমাদের কল্পনা। সুতরাং যখন আমরা নিজেকে ক্ষুদ্র কোনও গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করি, তখন সংখ্যায় আমরা যতই হই না কেন, সেটি একক, কেননা আমাদের বাইরেও ভিন্ন ভিন্ন একক সত্তা রয়েছে। যখন আমরা নিজেদের ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা করি, তখনও আমরা একক; যখন আমরা আমাদের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর থেকে বের হয়ে তার চাইতে অপেক্ষাকৃত আরও বড়ো কোনও গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হই, তখনও আমরা একক, কেননা তখনও তার বাইরে একাধিক গোষ্ঠী রয়েছে। আমাদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর একটি অস্তিত্ব রয়েছে, কিন্তু সেই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কোনও অস্তিত্ব নেই। কীভাবে? যদি একজন মানুষ মৃত্যুবরণ করে, তবে একটি ক্ষুদ্র অস্তিত্বের মৃত্যু ঘটলেও তার ধর্মের মৃত্যু ঘটবে না, অর্থাৎ যে ধর্মের অনুসারী ছিল, তা থেকে যাবে।


গোষ্ঠীকে আলাদা করা গেলেও সমাজকে আলাদা করা যায় না, প্রকৃতিকে অথবা সমগ্রকে কখনও ভাগ করে দেওয়া যায় না। যদিও আমরা একটি ভ্রান্তচিন্তার আবর্তে নিজেদেরকে এক এক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করে নিজেদের আলাদা প্রমাণ করতে চাইছি, তা সত্ত্বেও এটি সম্ভব নয়। এটি কেবলই আমাদের কল্পনা, অস্তিত্বের মাঝে কোনও ভিন্নতা নেই, অস্তিত্ব একক। সমগ্র যেমন একক হতে পারে, তেমনি বহু এককের মিলনেও সমগ্রের সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু এর মাঝামাঝি কিছু নেই। যদি কোনও কিছু থেকে থাকে, তবে তা শুধুই আমাদের কল্পনায় আবদ্ধ, এটি অবাস্তব। চিরন্তন খণ্ড নয়। আমরা এটি ভেবে বসে থাকি যে প্রতিটি একক গোষ্ঠী যেমন হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ যার যার অবস্থানে বাস্তব, কিন্তু আমরা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণার মাঝে বাস করছি, কেননা একমাত্র একক অস্তিত্ব স্রষ্টা এবং সমগ্র সেই এককের বিশাল রূপ। সমগ্রের সবই এককের মধ্যে একীভূত। জাতি, গোষ্ঠী, দেশ এইসব কিছু কেবল শব্দ। এসব একক কিংবা সমগ্র থেকে আলাদা কিছু নয়। সমগ্রের অংশ হয়ে ওঠা অথবা অস্তিত্বের জন্য তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠা ভ্রান্ত নয়, কিন্তু যখন আমরা আমাদের কল্পনার দ্বারা সেই তৃষ্ণাকে মেটাবার চেষ্টা করি, তখন সেটি অবাস্তব।


একশো আট।


তৃষ্ণার্ত থাকার অর্থ হচ্ছে, যতক্ষণ না আমরা স্রষ্টা হতে উঠি, ততক্ষণ আমরা তৃষ্ণার্ত থেকে যাব, কারণ মানুষের সত্যতা এককে এবং স্রষ্টার সত্যতা সমগ্রের সাথে বিদ্যমান। মানুষ তখনই সমগ্র হয়ে ওঠে, যখন সে একক হতে পারে। আবার সমগ্রের সাথে মিশে গেলেও তাকে এককভাবে আলাদা করা যায়। আমরা নিজেদের স্বতন্ত্রতায় আলাদা করি। আমরা আমাদের চারপাশে এক বলয় তৈরি করি, যে বলয় ভেদ করে আমরা কেউ কারও অংশ হয়ে উঠি না। অথচ আমরা ভিন্ন ছিলাম কি কখনও? একটি অস্তিত্বের অংশ হয়ে কখনও আমরা পারব ভিন্ন হয়ে যেতে? আমাদের চারপাশ ঘিরে কেবল মানুষ আর মানুষ, অথচ মনুষ্যত্ব কই! আমরা বলি, কেবল আমরাই ভালো এবং আমরাই বেঁচে থাকব, তারপর আমরা অন্যদের উপর অত্যাচার করি, আমরা একে অন্যের উপরে নিজের ইচ্ছে চেপে ধরি। আমরা চাই, অন্যেরা নির্মূল হয়ে যাক, কেবল আমরাই টিকে থাকি, আমাদের গোষ্ঠী টিকে থাকুক, অথচ কখনও কি আমরা ভেবে দেখি, আমরা ঠিক যেমন করে চাইছি, অন্যেরাও আমাদের বেলায় তেমন করেই চাইছে কি না?


যদি আমরা একে অপরের শত্রু হয়ে উঠি, যদি আমরা সকলেই একে অপরকে ধ্বংস করে দিতে চাই, তবে শেষঅবধি আমাদের কারও পক্ষেই কি বেঁচে থাকা সম্ভব? যদি মানুষ না বাঁচে, তবে মনুষ্যত্ব কোথায় বাঁচে? যদি মনুষ্যত্ব না বাঁচে, তবে মানুষ কী করে বাঁচে? এজন্যেই বলা হয়ে থাকে, বড়ো বড়ো শব্দ সবসময় ভয়ানক ধ্বংস ডেকে আনে। কেউ কেউ বলি, ‘ইসলাম ধর্ম বিপদে রয়েছে!’ আবার কেউবা বলি, ‘হিন্দু ধর্ম বিপদে রয়েছে!’ আসলে বিপদে থাকে কে? এই শব্দগুলো? না কি এই শব্দের ছায়ায় আশ্রিত মানুষগুলো? যখন কোনও ধর্মের উপরে আঘাত আসে, তখন সেটি সেই ধর্মকে নির্মূল করে? না কি সেই ধর্মের মানুষকে? অবশ্যই ধর্ম রয়ে যায়, অর্থাৎ এই শব্দগুলি রয়ে যায়, শুধু কিছু মানুষ সমগ্র থেকে বিলীন হয়ে যায়। এতশত ধ্বংসের পরও ধর্ম ঠিক রয়ে গেছে, শুধু কিছু নির্বোধ, কিছু বোকা, কিছু শব্দজয়ী মানুষ চলে গেছে। হয়তো তারা আরও কিছুদিন বেঁচে থাকত, হয়তো স্রষ্টা তাদের সমগ্রকে জানার আরও কিছুটা সুযোগ করে দিতেন। তবে আমরা নিজেরাই কখনও নিজেদেরকে সেই সুযোগ করে দিইনি, কেননা আমাদের ভেতরে অন্ধত্বের রাজত্ব চলছিল, আমরা আমাদের ভ্রান্ত ইগোর দ্বারা পরিচালিত হয়ে এসেছি।


কখনও কখনও আমরা আমাদের নির্বুদ্ধিতার মূল্য দিয়েছি, কখনওবা অজ্ঞানতার, কখনও আমাদের ভ্রান্ত ইগো আমাদেরকে দিয়ে তার মনোবাসনা পূরণ করিয়ে নিয়েছে, আবার কখনও আমাদের উপরে আমাদের অসচেতনতা জয়ী হয়েছে। এভাবেই আমরা যুগে যুগে ধ্বংস হয়ে গেছি। আমরা নিজেরা নিজেদের বিপদ ডেকেছি, নিজেরা নিজেদেরকে নির্মূল করেছি, অথচ আমরা কখনও আমাদের সমস্যার সমাধান চেয়ে স্রষ্টার সামনে হাজির হইনি। বড়ো বড়ো শব্দ সবসময় শূন্যতায় পূর্ণ হয়ে থাকে, ফলে সেটি সহজেই আমাদের মৃত্যু ডেকে আনে। অথচ যে শব্দ আমাদের জীবন কেড়ে নেয়, সে শব্দই টিকে থাকে, মানুষ নয়। আমাদের বুঝতে হবে, শব্দ সবসময় মৃত, এর প্রাণ নেই আর যার নিজের মাঝে প্রাণ নেই, তা জীবনশূন্য চরম নিষ্ঠুরতা। এজন্যই একজন আরাধক কখনও কোনও সমস্যায় অন্যের কাছে সমাধান খুঁজতে যান না, তিনি নিজের মাঝে থাকেন। তিনি জানেন, স্রষ্টা তাঁর সামনে, অন্য কোথাও নয়, কোনও শব্দে নয়, কোনও ধর্মালয়ে কিংবা অন্য কোনও মানুষের মাঝে নয়; সকলের স্রষ্টা তাঁর নিজের কাছে নিজের সামনেই। আমাদেরকে কেবল বাইরের থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্তর্মুখী হতে হবে।


একজন উপাসক খুব স্পষ্ট করেই জানেন, মানুষের মানুষকে সাহায্য করার কিছু নেই যদি সে মানুষের মাঝে স্রষ্টা না থাকেন। যে সমাজে স্রষ্টার বোধ কেবল কয়েকটা শব্দের মাঝে সীমাবদ্ধ, সে সমাজ মানুষকে কীই-বা দিতে পারে? যখন আমাদের মাঝে সমগ্র জেগে ওঠে, তখন আমাদের ভেতরে কেবল দুটি তীর থাকে, অস্তিত্ব আর স্রষ্টা; এর বাইরে অন্য সব কিছুই কাল্পনিক। নদীর দুই তীরের মাঝখানে যে ঢেউ বয়ে যায়, সেটিই প্রার্থনা। আমরা সর্বদা নিরাপত্তা খুঁজি, আমরা ভিড়ের মাঝে জীবন খুঁজি, কেননা মানুষ একাকিত্বে ভয় পায়; আমরা বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কাছে সাহায্য চাই, মানুষের উপরে নির্ভরশীল হয়ে বাঁচি। যখন আমরা ভিড়ের মাঝেই জীবন খুঁজে নেব, ভিড়কেই অনুসরণ করে বাঁচব, তখন যেন সেইসাথে আমরা এ-ও জেনে নিই যে, আমরা একটি ছলনাময় জীবন নিয়ে বাঁচছি, যা আঁকড়ে আমরা বেঁচে আছি, সেটি প্রকৃত বাস্তবতা নয়, আমরা প্রবল ভ্রান্তিতে রয়েছি।


একবার মোল্লা নাসিরউদ্দিন প্রচণ্ড মদ্যপান করলেন। এতটাই যে, বাড়ির যাত্রাপথেই তিনি রাস্তায় চেতনা হারাতে বসেছিলেন। তিনি ভাবছিলেন, এবার তিনি মরে যাচ্ছেন, তৎক্ষণাৎ এক পুলিশ তাঁকে সাহায্য করতে এলে তিনি সেই পুলিশকে এক ব্রাহ্মণ ডেকে দিতে বললেন। পুলিশ তাঁর নাম জেনে বুঝেছিলেন তিনি মুসলিম। এ কারণে পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি একজন মুসলিম হয়ে ঠাকুর ডাকতে বলছেন কেন? আমি আপনার জন্যে মসজিদ থেকে মাওলানাকে ডেকে আনছি।’ তখন মোল্লা পুলিশকে বললেন, ‘আমি হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে চাই।’ তখন পুলিশ অবাক হয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, ‘আপনি সারাজীবন মুসলিম হয়ে বেঁচে থেকে হিন্দু হয়ে মরতে কেন চাইছেন?’ তখন মোল্লা পুলিশকে বললেন, ‘আমি চাই, আর-একজন হিন্দুও আমার সাথে মৃত্যুবরণ করুক!’


মৃত্যুর সময়ও আমাদের গোষ্ঠীর ভূত ছাড়ে না; ফলে আমরা চাই, আমাদের মৃত্যুর সময়ও আমাদের গোষ্ঠী যেন ক্ষুদ্র হয়ে না যায়। গোষ্ঠীর মাঝেই আমরা জীবনের নিরাপত্তা খুঁজে পাই। এজন্য আমরা আমাদের জীবনের শেষমুহূর্তেও ভিড়কে ছাড়তে চাই না, আমরা ভিড়ের কাছে সমর্পিত হই যেন আমরা একটি নিরাপদ জীবন লাভ করি। একজন উপাসককে সবসময় ভিড় এড়িয়ে থাকতে হয়, ভিড়ের পথ আরাধকের জন্যে নয়, এজন্যই যে পথে সকলে চলে গেছে, যে পথ ভিড়ের পথ, একজন উপাসক সবসময় সে পথের ভিন্ন পথ ধরে হাঁটেন। যিনি সকলের বিপরীত পথে হাঁটার সাহস রাখেন, তিনিই কেবল সঠিক গন্তব্যে পৌঁছোন, তাঁরাই নিজেদের জন্য যাত্রা করে থাকেন। যখন আমরা নিজেকে সম্পূর্ণ একা করে ফেলি, তখনই আমাদের হৃদয়ে প্রার্থনা উদিত হয়, কেননা শুধুমাত্র এই পথেই স্রষ্টাকে পাওয়া সম্ভব। এর একটি তীর আমাদের থেকে শুরু হয়ে অন্য তীর স্রষ্টার দ্বারে থামে, আর এরই মাঝে প্রার্থনা খেলা করে। প্রার্থনা ততক্ষণ পর্যন্ত গভীর থেকে গভীরে যেতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না দুটি তীর ছাপিয়ে যায়। যখন এই দুটি তীরই অদৃশ্য হয়ে পড়ে, তখন আরাধ্য এবং আরাধক এক হয়ে যান, দুইয়ের মাঝে কেবলই প্রার্থনা থেকে যায়, ভালোবাসা থেকে যায়। স্রষ্টা ততক্ষণই বিরাজমান, যতক্ষণ উপাসক রয়েছে। যখন প্রেমিক নেই, তখন প্রেমিকের সাথে ভালোবাসাও অদৃশ্য।


একশো নয়।


আমাদের ভেতরে দু-ধরনের আমি বাস করে; একটি সংসারী হতে চায় এবং অন্যটি আধ্যাত্মিক হতে চায়। আমাদের প্রকৃতি আধ্যাত্মিক, কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক আধ্যাত্মিক নয়। আমাদের মস্তিষ্ক বিশাল এক চিন্তার ঢেউ সমৃদ্ধ, এখানে প্রতি মুহূর্তে নানা রকমের চিন্তা স্রোতের মতো আসতেই থাকে। কিন্তু মস্তিষ্কের বাইরের আমিই প্রকৃত আমি। আমরা কি বুঝতে পারি, আমরা সংসারী, না কি আধ্যাত্মিক? যদি আমরা আমাদের মস্তিষ্কের পথ অনুসরণ করে চলি, তবে আমরা সংসারী, কিন্তু যদি আমরা আমাদের মস্তিষ্ককে ছাপিয়ে যাই, যখন আমাদের মধ্যে মস্তিষ্ক বলে কিছু কাজ করে না, কেবলই আত্মার সঙ্গে নিবিড় কথোপকথন চলে, তখনই মূলত আমরা আধ্যাত্মিক। যদি আমরা হঠাৎ রেগে যাই, প্রতিক্রিয়া দেখাই, তবে বুঝতে হবে, আমরা আমাদের ইগোকে অনুসরণ করছি, আমরা তখন সংসারী, আমরা পার্থিব জগতকেই প্রাধান্য দিই। আমাদের মস্তিষ্কের কাজ হচ্ছে, রাগ, ঘৃণা, জেদ তৈরি করা, অবান্তর স্বপ্নের পিছু ছুটতে নিজেকে উদ্‌বুদ্ধ করা। যখন আমরা আমাদের মস্তিষ্ককে অনুসরণ করি, আমরা তখন পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই। আমরা নিজেদেরই ভুলে একটি ভ্রান্ত আমি’র পিছু ছুটতে থাকি।


রাগ হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্কের এমন একটি অবস্থা, যেটি এক বার কোনও কারণে আমাদের ভেতরে অবস্থান করলে আমরা তখন অপরাধী হতে বাধ্য, কেননা রাগের একটি স্রোত রয়েছে, যখন এটি আমাদের ভেতরে সৃষ্টি হয়, তাৎক্ষণিকভাবে হোক অথবা কিছু পরে, আমাদেরকে এটির সম্মুখীন হতেই হবে। একবার আমাদের মাঝে রাগের কারণ তৈরি হয়ে গেলে আমরা কিছুতেই একে এড়িয়ে যেতে পারব না। রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার চাইতে বরং যখন আমাদের ভেতরে রাগ সৃষ্টি হবার কারণ তৈরি হয়, তখন সেই মুহূর্তে সেটিকে দমন করতে হবে, সেটি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কেননা যে সত্তা রাগান্বিত হয় না, তার প্রতিক্রিয়া দেখাবারও কিছু থাকে না। আমরা অনেকসময় ভেতরে ভেতরে রেগে থাকি, কিন্তু কাউকে বুঝতে দিই না। এটিও খারাপ, কেননা হয়তো এটি এখন চুপ করে আছে, তবে অচিরেই এটি প্রতিফলিত হবে, বরং ততক্ষণে ঢেউটি অনেক বড়ো হয়েও যেতে পারে। যখন আমাদের ভেতরে রাগের সৃষ্টি হয়, তখন গভীরভাবে একে পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাবো, এটি ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে এবং একটাসময় যখন এটি এতটাই বড়ো হয় যে এটিকে বয়ে নিয়ে বেড়ানো আমাদের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। তখন আমরা অনেকটাই অপরাধী হতে বাধ্য, প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য। মস্তিষ্ককে নিজের মাঝে বয়ে নিয়ে বেড়াবার অর্থই হচ্ছে, এর নানা ক্ষতিকর দিকের লালন করা।


যখন আমাদের ভেতরে মস্তিষ্ক প্রবাহিত হতে থাকে, তখন স্রষ্টা আমাদের থেকে দূরে সরে যান। যখনই আমরা মস্তিষ্কের ঊর্ধ্বে চলে যাই, তখনই আমরা স্রষ্টার দেখা পাই, আমরা স্রষ্টা হয়ে উঠি, স্রষ্টা আমাদের মাঝে প্রকট হয়ে প্রকাশিত হন। মস্তিষ্কের আমি, এমন এক আমি, যা প্রকৃতপক্ষে আমি নই, বরং এমন এক সত্তা, যা আমার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আত্মা থেকে আলাদা হয়ে যে আমি’কে আমরা নিজের সামনে তুলে ধরি, সেই আমির সাথে প্রকৃত আমি’র যোজন যোজন দূরত্ব। নিজের আধ্যাত্মিক সত্তাকে খুঁজে পাওয়াই হচ্ছে প্রকৃত আমি’র খোঁজ পাওয়া। আমরা নিজেদের যেভাবে জানি, সেটি বহির্জগতের জানা, তা আমাদের অন্তর্মুখী সত্তাটি নয়। যখন আমরা গভীরভাবে অন্তর্মুখী হই, সেটিই নিজেকে জানার পথ। আমাদেরকে নিজের এতটাই গভীরে যেতে হবে যেন নিজেকে সম্পূর্ণভাবে জানার পর আর অন্য কিছুই অবশিষ্ট না থাকে, কেবল জ্ঞান অবশিষ্ট থাকে। এখানেই জ্ঞানী এবং হৃদয়বান ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি তিনিই, যিনি নিজের সম্পর্কে সম্পূর্ণ জানেন, কিন্তু একজন হৃদয়বান ব্যক্তি তিনিই, যিনি নিজের ভালোবাসাকে জানেন। যিনি ভালোবাসার রাজ্যকে জয় করেছেন, নিঃসন্দেহে তিনি অনেক বড়ো বিজয়ী; কিন্তু যিনি কেবলই আধ্যাত্মিকতাকে জয় করেছেন, তাঁর আরও একটি জয় বাকি, আর সেটি হচ্ছে ভালোবাসা।


ভালোবাসা মানুষের সব থেকে বড়ো অর্জন, যা মানুষকে অন্যান্য সকল জয়ের আনন্দ এনে দেয়। শুধুই আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে এমন একটি গাছ, যে গাছে প্রাণ আছে কিন্তু তা প্রাণবন্ত নয়, যে গাছে কখনও ফুল অথবা পাতা কোনওটাই খেলা করে না, সুগন্ধি ছড়ায় না, অক্সিজেন ছাড়ে না। এমন কোনও গাছের মালিক আপনি হতে চাইবেন, যে গাছ অক্সিজেন, বাতাস, এমনকী সুগন্ধিটুকুও ছড়াবে না? এমন কোনও গাছের মালিক আপনি হতে চাইবেন, যে গাছে কেবলই প্রাণ রয়েছে, কিন্তু যা কেবল ভেঙে পড়তে বাকি? আধ্যাত্মিকতা আমাদের মনের বাগানের আগাছা পরিষ্কার করে, মনকে স্বচ্ছ রাখে, মনে ভালো চিন্তার বীজ বপন করে, মনের মাটিকে ভালো চাষের জন্য খনন করে, কিন্তু ভালো ফুল এবং ফল লাভ করতে হলে আপনাকে ভালোবাসার বীজ বপন করতেই হবে। কেননা ফুলের সুগন্ধি, সৌন্দর্য, ফলের তৃপ্তিই আমাদের মনের বাগানের পরিপূর্ণ তৃপ্তি এনে দেয়। ধ্যান আমাদের মনের বাগান চাষের প্রস্তুতি, আর ভালোবাসা সেই বাগানের ফুল ও ফল। এজন্যই কেবলই জ্ঞান যথার্থ নয়, যে জ্ঞান আমাদেরকে ভালোবাসার উপলদ্ধি থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, সে জ্ঞান অসম্পূর্ণ।


একশো দশ।


ভালোবাসা জ্ঞানের পূর্ণতা এনে দেয়। ভালোবাসা ছাড়া জ্ঞান শুকনো রুটির মত, এটি এমন কিছু, যা আমাদের মনের বাগানের মাটি খনন করে রাখে, কিন্তু সেখানে বীজবপন করতে অক্ষম। যখন আমরা সেই মাটিতে ভালোবাসার বীজবপন করি, তখন আমাদের সকল পরিশ্রম উবে যায়, কেবল সুগন্ধটুকু অবশিষ্ট থাকে। যে মাটিতে বীজ বপন করব না, সে মাটিচাষের কী মূল্য? যদি আমরা পরিশ্রম করে কেবল মাটিকে চাষের উপযোগী করে তুলি, অথচ বীজ না বপন করি, তবে আমাদের সকল শ্রমই পণ্ডশ্রমে পরিণত হবে। যে হৃদয়ে ফুল ফোটে না, যে হৃদয় সুগন্ধ ছড়ায় না, তার সাথে পাথরের কোনও পার্থক্য নেই। ভালোবাসা আমাদের মনকে নরম করে, সুশোভিত করে। ভালোবাসা চূড়ান্ত প্রাপ্তি, ধ্যান আমাদের হৃদয়ে ভালোবাসার চারা রোপন করার একটি প্রস্তুতি মাত্র, যদি ভালোবাসাই রোপন করতে না পারি, তবে সে হৃদয়ের কোনও মূল্য নেই।


যে হৃদয়ে ভালোবাসার ফুল ফোটেনি, বুঝে নিতে হবে, সে হৃদয় এখনও ইগো দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। আমাদের অহম্‌ সত্তাটি এখনও আমাদের হৃদয়ের গভীরে কোথাও রয়ে গেছে। আমাদের ইগোর ফলেই আমরা ভালোবাসতে পারছি না, কেননা ইগোই হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক। আমাদের মস্তিষ্কই আমাদের কাছে সব কিছু তুলে ধরে, এমনকী অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যা-কিছু অর্জন করি বলে আমাদের ধারণা, তার সবটাই আমাদের মস্তিষ্কের তৈরি। এটি কীভাবে? আমরা আমাদের সামনে যা-কিছু স্পর্শ করতে পারি, সেটিই তার অস্তিত্বের প্রমাণ, কিন্তু আমরা যা-কিছু দেখিনি, অথবা যা-কিছু এখনও আমাদের স্পর্শে আসেনি, তার কোনও অস্তিত্বই কি নেই? আমাদের সামনে আমরা যা-কিছু দেখি, তার সব কিছুই দেখি আমাদের চোখ ওই নির্দিষ্ট জিনিসের একটি প্রতিচ্ছবি আমাদের মস্তিষ্কে প্রেরণ করে বিধায়, আর তখন আমরা সেটির অস্তিত্ব টের পাই। এই মুহূর্তে আমরা যা-কিছু চোখ দিয়ে দেখি, সেটি আসলেই কি ওখানটাতেই আছে? আমরা চোখ সেই নির্দিষ্ট জিনিসটির উপস্থিতি আমাদের মস্তিষ্কে প্রেরণ করলে আমরা সেটি জানতে পারি, অন্যথায় আমাদের নিজস্ব আর কোনও পথ নেই জানার। কিন্তু তাই বলে এর বাইরে কি কিছুই নেই, যা আমরা দেখতে পাই না? যা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে অথবা যা-কিছুকে আমরা স্পর্শ করিনি?


এর অর্থ, আমাদের মস্তিষ্ক একটি সংকীর্ণ সত্তা, এটি তার ক্ষমতার বাইরে কিছুই মেলে ধরতে জানে না, যেখানে অস্তিত্বের সীমাবদ্ধতা শুরু, সেখানেই আধ্যাত্মিকতার সূচনা। আমাদের জগতের বাইরেও একটি জগত থাকতে পারে, যা-কিছু আমরা আবিষ্কার করি, তার বাইরে যা-কিছু আমরা জানিনি, তার অস্তিত্বকে কী করে অস্বীকার করি? এটিই কি আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নয়? আমরা এই পৃথিবীকে দেখেছি, কিন্তু আমরা আমাদের নিজস্ব আয়নায়, অর্থাৎ আমাদের নিজস্ব আয়ত্তের মাঝে, আমাদের সীমাবদ্ধতার ভেতরে যতটুকু আমাদের দেখা সম্ভব হয়েছে, ঠিক ততটুকুই আমরা দেখেছি। তাই বলে কি এর বাইরে কিছু নেই? আমরা কী করে নিশ্চিত যে, এর বাইরে আর কিছুই নেই? যখন আমরা কোনও কিছু নিয়ে শতভাগ নিশ্চয়তা দিই, তখনই আমাদের বুঝতে হবে, আমাদের জ্ঞানের পরিধি সীমাবদ্ধ এবং আমাদের মস্তিষ্কই সেটিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, কেননা যদি আমরা আমাদের অন্তরের চোখজোড়া খুলে রাখতে জানতাম, তবে এর বাইরের সকল অদৃশ্যই আমাদের উপলব্ধ হতো।


আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দৃষ্টির বাইরেও একটি জগত রয়েছে, সেটি হচ্ছে আমাদের উপলব্ধির জগত, আমাদের সচেতনতার জগত দিয়ে যাকে আমরা দীর্ঘকাল আমাদের মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণে পরিচালনা করে আসছি। আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের উপলব্ধির সীমাহীন জগতকে আটকে রেখেছে, যার ফলে আমরা ঠিক যতটুকু আমাদের দৃষ্টিসীমার ভেতরে দেখতে পাই, ঠিক ততটুকুই সত্যি বলে ধরে নিই। আমাদের অস্তিত্বের বিশালতা আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে, আর সেটিকে দেখতে হলে, তার সম্পর্কে জানতে হলে আমাদেরকে আমাদের সীমানার বাইরে বেরোতে হবে। আমরা জানি, বায়ুপ্রবাহের গতিতেই স্রোত প্রবাহিত হয় অথবা স্রোতের দিক নির্ণীত হয়, কিন্তু এর বিপরীতটাও কি অসম্ভব কিছু? যদি স্রোতই বায়ুকে পরিচালিত করে, তখন? আমরা নিজেরা যা-কিছু অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, কেবল সেটিকেই সত্য অথবা অনিবার্য ধরে নেওয়াই জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। এমনও তো হতে পারে, স্রোত অথবা বাতাস কোনওটাই অন্যটির জন্য দায়ী নয়! কেবল আমাদের মস্তিষ্কেই এইসব কিছু বিদ্যমান, যা-কিছু আমরা কল্পনা করি এবং ঠিক বলে ধরে নিই।


আমরা জানি, স্রষ্টা সর্বজ্ঞ, কিন্তু যিনি স্রষ্টাকে জেনেছেন, তিনি কী করে স্রষ্টার সমকক্ষ নন? কখনও কখনও একজন গুরু কি স্রষ্টাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেন না? যিনি স্রষ্টাকে তাঁর চাইতে অধিক জানেন, তিনি কি কেবলই একজন জ্ঞানী? অথবা যিনি স্রষ্টাকে জেনেছেন, তিনি কি স্রষ্টার সৃষ্টি, স্রষ্টার শক্তি, সক্ষমতা সম্পর্কে জানেননি? তবে কি তাঁর জানার পরিমাণ স্রষ্টার নিজস্বতার চাইতেও অধিক নয়? এই জগত একটি মায়া। আমরা যা-কিছু দেখি অথবা যা-কিছু আমাদের দৃষ্টির আড়ালে, তার সবকিছুই মায়া। আমরা যেমন ঘুমের ভেতরে স্বপ্নে বিভোর থাকি, তেমনি কে জানে হয়তো আমরা দীর্ঘসময়ব্যাপী কোনও স্বপ্নেই রয়েছি? হয়তো সেই ঘোর কেটে গেলেই আমাদের প্রকৃত জীবন শুরু, অথবা কে জানে আমাদের শুরু বা শেষ কবে কোথায় কখন হয়েছিল, অথবা হয়েই গেছে? হতে পারে এটিই আমাদের শেষ, নয়তো হতে পারে এটিই আমাদের প্রথম শুরু। হতেও পারে, এই পৃথিবীর বাইরের কোনও জগত থেকে এসে আমরা এই জগতের মায়ায় আটকে গেছি, অথবা আমরা জানিই না, এই জগতের বাইরে কোনও জীবন আদৌ আছে কি না। হতে পারে, মানুষের ক্ষয় কেবল তার মস্তিষ্ক অথবা তার শরীরের মাঝেই নয়, মানুষের আত্মার সাথে হতে পারে এই শরীরের ক্ষয়। শরীরের অন্য কোনও অংশ কোথাও রয়ে গেছে, কিংবা আত্মার কিছু অংশ আমাদের মাঝে এসে আমাদের অসম্পূর্ণ অংশকে পূর্ণ করেছে!


একশো এগারো।


আমাদের যা-কিছু আমরা জানি, তার সবকিছু এতটাই সংকীর্ণ যে একটি ঘুম শেষ হয়ে গেছে, ঘুমের মাঝে দেখা স্বপ্ন যতটা দ্রুত সম্ভব আমাদের মস্তিষ্ক থেকে বিলীন হয়ে যায়। আমাদের সব স্বপ্নই কি আমাদের মনে থাকে? আজ অবধি জীবনের কয়টি স্বপ্ন আপনার মনে আছে? সত্য সেটিই, যার সম্পর্কে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। আমাদের সব চাইতে বড়ো সত্য হচ্ছে, যখন আমাদের ভেতর থেকে আমিত্বটিই শেষ হয়ে যায়, তখন আমরা নিজেরাও আর অবশিষ্ট থাকি না। যখন আমার মাঝে আমি বলেই কিছু থাকে না, তখন কোনও সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে না, কেননা সন্দেহ করতেও একজন আমি’র প্রয়োজন। আমাদের ভেতরের এই মিথ্যা আমি’র অস্তিত্বই হচ্ছে মায়া, যে মায়া আমাদেরকে জগতের প্রতি আকৃষ্ট করে রাখে, আমাদেরকে মস্তিষ্ককেন্দ্রিক করে রাখে, আমাদের চিন্তাচেতনা, আমাদের উপলব্ধিগুলোকে বিবশ করে রাখে। সত্য তা-ই, যা আমাদের অস্তিত্বের সত্যতায় এবং অনস্তিত্বের সত্যতাতেও টিকে থাকে। সত্যের অস্তিত্বে চিন্তা অবাস্তব, অনস্তিত্বের অস্তিত্বেও চিন্তার কোনও অস্তিত্ব নেই। এই দুয়ের মাঝেই মায়ার অস্তিত্ব বিদ্যমান। মায়া এমন কিছু, যাকে প্রমাণ করা যায় না, অথচ অস্বীকারের কোনও পথ নেই, এবং এটিই সন্দেহজনক। কীভাবে? কেননা এর সঙ্গে আমাদের সরাসরি কোনও সংযুক্তি নেই। যেখানে আমাদের মস্তিষ্কের কোনও অস্তিত্ব থাকে না, সেখানেই স্রষ্টার শুরু, স্রষ্টাকে দেখার পথ সেখান থেকেই। যখন আমাদের ভেতর থেকে মস্তিষ্ক অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে, তখন আমাদের মাঝে দুটি অবস্থা থাকে, এক আমাদের হৃদয়, অন্যটি আমাদের বিশুদ্ধ অস্তিত্ব।


মায়ার অস্তিত্ব কেবল মস্তিষ্কে। সত্য কেবল তা-ই, যার সাক্ষ্য স্রষ্টার কাছে আর তিনিই স্রষ্টা, যিনি সত্যকে সাক্ষ্য দেন। তিনিই সত্যকে দেখতে পান, যিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সত্যকে দেখতে পান। যিনি সচেতনভাবে দেখেন, তিনি যা-কিছু দেখেন, সেটাই প্রকৃত সত্য। যখন আমাদের মাঝে প্রশ্ন জাগে, একজন আধ্যাত্মিক মানুষ কি স্রষ্টার জ্ঞান ধারণ করেন, তখন যদি কেউ এটা জানতে সক্ষম হন যে, আমাদের মস্তিষ্ক এর স্রষ্টার চাইতে উৎকৃষ্ট নয়, তাহলেই আমাদের প্রশ্নের বা সমস্যার সমাধান বের হয়ে আসে। আমাদের মাঝেই আমাদের মস্তিষ্কের অবস্থান, সুতরাং যখন আমরা আমাদের মস্তিষ্ককে ছেড়ে দিয়ে চলতে শিখি, তখন কী করে আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের চাইতে বড়ো কিছু অর্থ বহন করে? আমাদের মস্তিষ্ক ঠিক ততটুকুই, যতটুকু আমরা গ্রহণযোগ্য মনে করি। আমাদের গ্রহণযোগ্যতার বাইরে মস্তিষ্ক একটি ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। যিনি স্রষ্টাকে সম্পূর্ণ জেনেছেন, তিনি অবশ্যই বাকিদের চাইতে উত্তম, কেননা তাঁর মাধ্যমেই স্রষ্টার সাক্ষ্য প্রমাণিত হয়। যিনি স্রষ্টার সম্পর্কে সম্পূর্ণ জেনে গেছেন, তাঁর জানার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, কেননা পরমজ্ঞানই সর্বোত্তম জ্ঞান।


যখন কারও ভেতর থেকে স্রষ্টা, সৃষ্টি, অস্তিত্ব সবকিছু অদৃশ্য হয়ে যায়, তখন কেবল সেই সাক্ষ্য, সেই হৃদয়, সেই উপলব্ধি অবশিষ্ট থাকে। চেতনার সর্বশেষ মুহূর্ত হচ্ছে স্রষ্টা। চেতনার সকল স্তর অতিক্রম করার পর কেবল স্রষ্টাই থেকে যান। স্রষ্টাই একমাত্র চেতনা অথবা চেতনাই স্রষ্টা। একজন আধ্যাত্মিক মানুষ যিনি স্রষ্টার জ্ঞানলাভ করেছেন, যাঁর মাঝে তিনি বলতে তাঁর স্রষ্টা, তাঁর চেতনা, তাঁর হৃদয় অবশিষ্ট রয়ে গেছে, তখন তিনিই স্রষ্টা হয়ে ওঠেন; কেননা তিনি স্রষ্টার প্রকৃতির জ্ঞানটা সম্যকভাবে লাভ করেন। আর যিনি সমগ্রের জ্ঞান লাভ করেন, তাঁর কাছে অন্য সকল বিষয় অতি ক্ষুদ্র। হতে পারে সেটি কোনও অভিজ্ঞতা, কোনও অর্জন, কোনও প্রাপ্তি। পরমজ্ঞান লাভের প্রকৃত উৎস আমাদের সকলের মাঝে সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, লুকানো রয়েছে, যার খোঁজ কেবল আমরা নিজেরাই করতে পারি। আমরা যতটাই ক্ষুদ্র অথবা তুচ্ছ হই না কেন, আমরাই সেই পরমশক্তি। আমাদের নিচে অথবা আমাদের উপরে আর কিছুই নেই। এবং যখন নিজের সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়, তখন আমাদের জানা উচিত, যা-কিছু আমাদেরকে ক্ষুদ্র করে রাখে, তা আর কিছুই নয়, আমাদের ইগো।


আমাদের ইগো আমাদের ক্ষুদ্রতা নিয়ে জন্মায়, আমাদের ক্ষুদ্রতা থেকেই ইগো জন্মলাভ করে। এবং যখন আমরা নিজেকে বৃহৎ মনে করি, সেটিও আমাদের ইগোর দ্বারা সৃষ্ট। আমাদের ক্ষুদ্রতা অথবা বৃহত্ব সবকিছুই ইগোর থেকে উৎসরিত। যখন আমরা নিজেকে বড়ো মনে করি, তখন আমরা নিজেদের তুচ্ছ প্রাপ্তিগুলোকে তুলে ধরি, যার কোনওটাই আমাদের নয়, কেবল সাময়িক সময়ের জন্য আমরা সেই জিনিসগুলোর সুবিধাভোগী মাত্র। কেননা আমরা অন্যের সামনে নিজের ক্ষমতা, অর্থ, সম্পদ, যোগ্যতাকে তুলে ধরে নিজেকে বড়ো প্রমাণিত করতে চাই, আমরা আমাদের ইগোর দ্বারা পরিচালিত হয়ে নিজের কাছে নিজেকে নিয়ে প্রশ্ন করি, আমি কী করে ছোটো, যখন আমার কাছে এত কিছু রয়েছে, যা নিয়ে অনায়াসে গর্ব করা যায়? যখন আমরা জ্ঞানের সর্বোচ্চটুকু জানি, যখন আমরা স্রষ্টাকে পুরোপুরি জানি, তখন আমাদের মাঝ থেকে সকল আকাঙ্ক্ষা শূন্য হয়ে যায়, আমাদের মাঝে একটুকরো স্রষ্টা থেকে যান, স্রষ্টার পরমানুভূতিতে আমরা ডুবে থাকি; তখন আমরা জানি, এর উপরে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমরা যত যা-কিছুই অর্জন করি না কেন, আমাদের হৃদয়ের শূন্যতা ততক্ষণ দূর হবে না, যতক্ষণ না আমরা স্রষ্টার সমগ্র জ্ঞান লাভ করব। কেননা স্রষ্টাকে অর্জন করাই সর্বোচ্চ অর্জন, এর বাইরে আর কোনও অর্জন নেই, যা আমাদের হৃদয়ের শূন্যতা দূর করে। এটা তখনই জানা সম্ভব, যখন আমরা সেই পর্যায়ে পৌঁছোতে পারি।


কেন একটি ধর্মীয় স্থানকে ধর্মীয় বিবেচনা করা হয়? কেন পীঠস্থানকে অন্যান্য স্থানের চাইতেও পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়? কেন কোনও তীর্থভূমি অন্যান্য জায়গা থেকেও অত্যধিক গুরুত্ব বহন করে? কেননা অবশ্যই সেখানে কোনও উপাসক, কোনও ভক্ত জন্মেছিলেন এবং উপাসনা করেছিলেন। সমগ্র পৃথিবীর সকল পবিত্রভূমি এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। এই স্থানগুলোকে পবিত্র ধরা হয়, কেননা সেখানে স্রষ্টার কোনও ভক্ত স্রষ্টার সাথে মিলিত হয়েছেন, সেই স্থানটিতে স্রষ্টার এক স্পন্দন অনুভূত হয়েছে, যা অন্যান্য সাধারণ জায়গায় হয়নি। যুগে যুগে যেসকল প্রজ্ঞাবান, উপাসক যে স্থানটিতে বসে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করেছেন, সে স্থানটিতে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ বিরাজ করে, কেননা মানুষ মরণশীল, কিন্তু কোনও স্থানের মৃত্যু নেই, ফলে মানুষ মরে গেলেও সেই স্থানে তাঁর আলোর প্রভাব থেকে যায়। স্থানটি ঘিরে সবসময় এক সচেতন অবস্থা গড়ে ওঠে, ফলে সেটি সর্বজনীন হয়ে ওঠে।


একশো বারো।


পৃথিবীর সকল ধর্মগ্রন্থ এক-এক জন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি, যিনি স্রষ্টার সান্নিধ্য পেয়েছেন, স্রষ্টার প্রিয়পাত্র হয়েছেন, স্রষ্টার নিকটবর্তী হয়েছেন, তাঁদের উপরে নাজিল হয়েছে, অর্থাৎ সকল পবিত্র গ্রন্থই এক-একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপরে সমগ্র মানবগোষ্ঠীর কাছে বার্তারূপে পাঠানো হয়েছে। যেসকল ব্যক্তির উপরে অমন গ্রন্থ নাজিল হয়েছে, নিঃসন্দেহে সেসকল ব্যক্তি উক্ত গ্রন্থের চাইতে উপরে। কেন? কারণ সেই প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি হলেন একটি মাধ্যম, নদীর দুটি তীরের মধ্যবর্তী, স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মধ্যবর্তী, যাকে আমরা প্রার্থনা বলি, সচেতনতা বলি অথবা তৃষ্ণা মেটাবার জল বলে থাকি। যখন কোথাও স্রষ্টার আরাধনা করা হয়, সমগ্র হৃদয় দিয়ে, সকল সৃষ্টি, সকল বর্তমানকে তুচ্ছ করে কেবলই স্রষ্টাকে স্মরণ করা হয়, তখন সেখানে স্রষ্টা অথবা উপাসক এই দুইয়ের কোনওটাই অবশিষ্ট থাকে না এক প্রার্থনা ছাড়া, এই প্রার্থনাই সবকিছুর ঊর্ধ্বে হয়ে ওঠে। এজন্যই বলা হয়, স্রষ্টা এবং ধর্মগ্রন্থের চাইতেও উপাসক সকল কিছুর ঊর্ধ্বে। কেবলমাত্র একজন উপাসকের মাধ্যমেই স্রষ্টাকে জানা সম্ভব, ভক্ত না থাকলে স্রষ্টা অস্তিত্বহীন, ভক্তের মধ্যে দিয়েই স্রষ্টা প্রকাশিত হন।


যুগে যুগে এই উপাসকের আবির্ভাব না হলে আমাদের কাছে স্রষ্টা অচেনা, অজানা কেবল একটি নাম হিসেবেই থেকে যেত। ছাত্রের প্রয়োজনেই যেমন শিক্ষক আবির্ভূত হন, তেমনি ভক্তের প্রয়োজনে স্রষ্টা প্রকাশিত হন। ভক্ত যখন প্রস্তুত হন, তখন স্রষ্টা প্রকট হতে থাকেন ভক্তের মাঝে। তখন ভক্তই স্রষ্টা হয়ে ওঠেন। এজন্যই প্রকৃত ভক্ত ধর্মগ্রন্থের চাইতে উপরে থাকেন, তাঁদের কখনও কোনও ধর্মগ্রন্থ পড়ে স্রষ্টাকে জানবার প্রয়োজন নেই; তাঁদের মধ্য থেকেই ধর্মগ্রন্থ সমগ্রের কাছে প্রকাশিত হয়। ভক্ত হচ্ছেন স্রষ্টার সেই পূর্ণাঙ্গ রূপ, যা স্রষ্টাকে ধারণ করে। এজন্যেই ভক্ত ঠিক যে স্থানজুড়ে থাকেন, যে স্থানে বিচরণ করেন, সেই স্থান পবিত্র হয়ে যায়, সেই স্থান দিয়ে স্রষ্টার আলো ছড়াতে থাকে। সে কারণেই পবিত্র স্থানগুলো থেকে সহজে স্রষ্টার সান্নিধ্যে আসা যায়। একজন উপাসক সকল পবিত্র স্থানের চাইতে উপরে থাকে। এজন্যেই বলা হয়ে থাকে, নিজের চাইতে বড়ো কেউ নয়, কিন্তু সেজন্য নিজেকে নিজের কাছে সম্পূর্ণরূপে সমর্পিত হতে হবে। যখন আমরা নিজের কাছে সমর্পিত হব, তখন আমাদের কাছে আমাদের চাইতে বড়ো আর কেউ নেই, কিছুই নেই, এমনকী একজন গুরু, একজন ভক্তও নয়। কেননা যিনি একজন ভক্তকে জানেন, তিনি সেই ভক্তের চাইতে উপরে উঠে যান। আর সেটি তখনই সম্ভব হবে, যখন আমরা ক্ষুদ্রের চাইতেও ক্ষুদ্র হতে পারব। যখন আমরা ক্ষুদ্রের চাইতেও ক্ষুদ্র হতে জানি, তখন আমরা স্রষ্টার সমান বড়ো হয়ে উঠি।


যখন আমাদের নিজেকে জানার মাঝে খুঁত থেকে যায়, তখনই সকল সমস্যা আমাদেরকে ঘিরে ধরে। আমাদের সকল উদ্দেশ্যের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, নিজের ভেতরটাকে জানা। এর অর্থ, আমরা এমন কিছু হতে চেষ্টা করছি, যা আমাদের সকল তুচ্ছতাকে ঝেড়ে ফেলে দেয়। আমাদের ইগো হচ্ছে এমন এক ময়লা পাটি, যেটি বসার অনুপযোগী আর আমাদের হৃদয় হচ্ছে আমাদের রাজসিংহাসন। কিন্তু আমরা কখনও আমাদের রাজসিংহাসনের খোঁজ রাখিনি, ফলে আমরা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে সেই নোংরা পাটিতেই অবশেষে বসে পড়েছি, যেখানে আমাদের প্রকৃত জায়গা নয়। যেহেতু আমরা সেই রাজ সিংহাসনের খোঁজ পাইনি, তাই আমরা এই ময়লা পাটিকেই নিজেদের রাজসিংহাসন ভেবে নিয়েছি এবং অন্যের সামনে সেটিকেই রাজসিংহাসন বলে চালিয়ে নিচ্ছি। অথচ যদি কেউ এসে আমাদেরকে আমাদের ভুল ধরিয়ে দেয়, তখন আমরাই তাদেরকে বোকা প্রমাণিত করে ছাড়ি। বরং তাদেরকেই আমরা অন্ধ বলি। সমগ্র সৃষ্টি আমাদেরকে সেই ময়লা পাটির উপরেই বসে থাকতে দেখছে, অথচ আমরা নিজেরা কখনও তা দেখিনি। আবার যদি কেউ এসে আমাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমরা তাকে নিজের শত্রু বিবেচনা করি, আমরা ভাবি, সে আমার থেকে আমার রাজসিংহাসন কেড়ে নিতে চাইছে। যুগ যুগ ধরে সমগ্র মানব জাতিই নিজেকে ময়লা কার্পেটের উপরে বসিয়ে সেটিকেই নিজের সিংহাসন বলে বিবেচনা করেছে, নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়ে এসেছে যে, এর চাইতে বড়ো সিংহাসন আর নেই! এ কারণেই যখন একজন প্রকৃত আলোকিত মানুষ, একজন গুরু, একজন জ্ঞানী যখন আমাদের কাছে এসে আমাদেরকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন, আমাদের ভেতরটাকে নাড়িয়ে দেন, আমাদেরকে ইগোর দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে বলেন, আমাদের সকল আমিত্বকে ঝেড়ে ফেলতে বলেন, তখন আমরা চরম কাঠিন্যের মুখোমুখি হই।


যখন একজন আলোকিত মানুষ আমাদের ভেতরের সিংহাসনের খোঁজ আমাদের সামনে তুলে ধরেন, আমরা তখন সেটি দেখতে পাই না, আমরা কেবল আমাদের তৈরি সিংহাসন দেখতে পাই। কেননা যখন আমরা নতুন কোনও সিংহাসনে আরোহণ করতে যাই, তখন আমাদের মনে এই ভয় জন্মায় যে আমরা হয়তো আমাদের রাজত্ব হারিয়ে ফেলছি। আমরা ভাবি, আমাদের হাত থেকে আমাদের সিংহাসন পিছলে যাচ্ছে। আমরা সবসময় সন্দেহ পুষে রাখি, যে আসন আমাদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে, আদৌ সেরকম কোনও আসন আছে কি নেই। আমরা তখনই আমাদের প্রকৃত সিংহাসনটি দেখতে পাবো, যখন আমরা আমাদের আমিত্বকে সম্পূর্ণরূপে ঝেড়ে ফেলব। তখন আমাদের সেই পুরনো ময়লা কার্পেট, এই জগতসংসারের মায়া, এই পৃথিবী সবকিছুর প্রতি লোভ, আকাঙ্ক্ষা আমাদের চোখে সমাপ্ত হবে। আমরা স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুধাবন করতে শুরু করব। আমাদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে দেখা দেবে।