দ্বিতীয় কবর (শেষ অংশ)



- কী রে, তুই কোথায় পড়ে রইলি? পরীক্ষা কেমন দিয়েছিস? আমাদের সবার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।
- তুমি চিন্তা কোরো না, মা। আমি ঠিক আছি। আর পরীক্ষা কেমন হয়েছে, সে নাহয় সারপ্রাইজ রইল!
- তুইও না! এত ইনিয়ে-বিনিয়ে না বলে সোজাসুজি বলতে পারিস না, বাপু!
- আচ্ছা মা, বাসায় এসে তারপর কথা হবে।
- আচ্ছা, জলদি আয়।


- সুধা, চলো, এবার যাওয়া যাক।
- হুম, চলো।


- মা...বাবা, দ্যাখো, দাদা এসেছে, সাথে সুধাবুও আছে।
- কী রে বাবা, তোর পরীক্ষা কেমন হলো? চিন্তায় চিন্তায় আমাদের প্রাণ বেরিয়ে যাবার জোগাড়।
- বাবা, শান্ত হও। চিন্তার কোনও কারণ নেই। তোমার ছেলে ইনশাআল্লাহ্‌ প্রথম পঞ্চাশ জনের মধ্যেই থাকবে।
- আলহামদুলিল্লাহ্‌! বড়ো শান্তি পেলাম, বাবা!
- এই দাদা, শোন, এবার কিন্তু তোকে একটা সুন্দরী দেখে ভাবি আনতে হবে। আর বাপু একা একা থাকতে আমার আর মায়ের মোটেও ভালো লাগে না।
- ওই যে, পেঁচির পাকনামি শুরু হয়ে গেছে। দেবো কানের নিচে একটা!
- সুধাবু, তুমিই বলো, দাদার চুলে পাক ধরেছে না? এখন যদি না করে, তাহলে দু-দিন পরে কেউ মেয়েই তো দেবে না!
সুধা আর খুশবু হাসতে শুরু করল। আমি লজ্জা পেলাম, বাবার সামনে।
- মা, তুমি বাঁদরটাকে চুপ করতে বলবে? দ্যাখো না, কী শুরু করেছে এসব। ধ্যাৎ! ভাল্লাগে না। আমি গেলাম।
আরেক দফা হাসির রোল পড়ে গেল!


- সুধা-মা, আয়, পাশে এসে বোস। পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
- জি আন্টি, আপনাদের দোয়ায় ভালোই হয়েছে।
- তা মা, আমার ছেলেটাকে তোর কেমন লাগে?
- জি আন্টি, ও তো ভালোই পড়ালেখায়! আমি এখন আসি, আন্টি। বাসায় সবাই চিন্তা করছে।
লজ্জায় লাল হয়ে গেল সুধা। দ্রুতপায়ে বাসার দিকে রওনা দিল।


- মেয়েটা লজ্জা পেয়েছে, তুমিও না! সবার সামনে ওসব জিজ্ঞেস করতে আছে!?
- মেয়েটাকে আমার সেই ছোটোবেলা থেকে পছন্দ। কী বলো তুমি?
- হ্যাঁ, আমাদের সৌরভের পাশে ওকে মানাবে ভালো।
পাশের রুম থেকে মা-বাবা’র কথাগুলো একনিমিষে আমার লজ্জা এক-শো গুণ বাড়িয়ে দিল! খুশি খুশি মনে দু-চোখ জড়িয়ে এল ঘুমে।


- কী...! বাবা, শুধু দাদার বিয়ে নিয়ে সব চিন্তা তোমাদের। তা ঘরে একটা সুন্দরী মেয়ে যে বড়ো হয়েছে, সে খেয়াল আছে তোমাদের?
খুশবুর মুখে এসব কথা শুনে, মা-বাবার হাসি যেন আর থামেই না!
- আসছে আমার মুরুব্বি রে! পাকনা বুড়ি একটা! দেবো দেবো, ঘটা করে রাজপুত্র এনে তোর বিয়ে দেবো!
খুশবু লজ্জা পেয়ে চলে গেল, কী আজব প্রকৃতি এই মেয়েদের! নিজে এতগুলো কথা বলার সময় একটুও বাধল না, আর বাবার মুখে একটুখানি শুনেই লজ্জায় মরি মরি অবস্থা! সত্যিই মেয়েদের বোঝা বড়ো দায়!


- হ্যালো! রাজীব ভাইয়া?
- হুম, কেমন আছ, আমার সুন্দরীটা?
- ধ্যাৎ ভাইয়া, আপনি সবসময়ই বাড়িয়ে বলেন!
- হা হা হা হা! কী যে বলো না তুমি! আয়না কখনও মিথ্যে বলে?
- সেসব আমি বুঝি না। আপনাকে একটা ভালো খবর দেবার ছিল। জানেন, আজকে মা-বাবা দাদার জন্য সুধাবুকে চাইছে।
- বাহ্! এ তো খুব ভালো খবর। এতদিনে দু-জোড়া হাত এক হবে। ইসসস্‌! কবে যে আমি কারও হাত ধরতে পারব!
- তা কেন? আপনার হাতে বুঝি কারও হাত বাঁধা পড়েনি?
- না গো, ভালো আমায় আর কেই-বা বাসল বলো!?
- আচ্ছা, তখন কথা হবে। এখন রাখি।
ঘুমের ঘোরে খুশবুর কথাগুলো আবছা আবছা কানে এল! ঘুমের মধ্যেই একধরনের অস্বস্তি টের পেলাম। দেড়টা নাগাদ ঘুম ভাঙল...


- খুশবু খুশবু, এদিকে আয় শিগ্‌গির!
- কী হলো? অমন মটকা ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন?
- তুই তখন কার সাথে কথা বললি রে?
- কে? আমি! কই? কখন? কারও সাথেই বলিনি তো!
- মিথ্যে বলবি না। আমি শুনেছি। আমার আর সুধার বিয়ের কথা বলছিলি। মনে হয় রাজীব ভাইয়ার সাথে!
- রাজীব ভাইয়ার সাথে কেন কথা বলতে যাব শুনি! আর তোকে মিথ্যে বললাম কবে?! আমি তো সেই কখন থেকে মায়ের সাথে রান্নাঘরেই আছি। মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে নে না!
- আচ্ছা থাক, লাগবে না। যা তুই রান্নাঘরে।


আমি কি তবে স্বপ্ন দেখেছিলাম? তা কী করে হয়, খুশবুর গলা স্পষ্ট শুনতে পেলাম তো! আর ও এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে মিথ্যে বলবে কেন!? কিছুই মাথায় ঢুকছে না, এত ভুল শুনলাম আমি! হবে হয়তো।
দুপুরে খেয়ে মাঠে গেলাম। সন্ধ্যের কিছু আগে সুধা ফোন দিল।
- সৌরভ, খুশবু কোথায়?
- কেন? ও তো বাড়িতেই আছে।
- তুমি শিওর?
- হ্যাঁ, ওকে বাসায়ই দেখে এলাম। কেন?
- ও আচ্ছা! না, মনে হয় যেন খুশবুর গলার স্বর পেলাম! আমার মনে হয় ভুল হচ্ছে!
- কী! কোথায়? কখন?
- একটু আগে। বাগানে হাঁটছিলাম, কেমন একটা খুশবুর মতো গলা ছিল, আর্তনাদ করে উঠল মনে হলো!
- কোথায়?!
কেমন জানি খুব ভয় হতে লাগল, গলা দিয়ে আর স্বরই বেরোচ্ছিল না!
- বাসার উত্তর দিকেই যেন মিলিয়ে গেল আওয়াজটা!
- এক্ষুনি আসছি আমি, তুমিও যাও ওদিকে।
- আচ্ছা।


কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়েছি সবে, আরেক বার ফোন বেজে উঠল! ভয় যেন আরও গেড়ে বসল!
- কে, সৌরভবাবু বলছেন?
- জি, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না!
- আমাকে আপনি চিনবেনও না, আমার নাম অভিষেক ব্যানার্জি, রুমি অ্যাপার্টমেন্টের মালিক, আপনাদের গলি থেকে বাঁয়ে চার নম্বর মোড়ের উত্তর দিকে।
- সেসব বুঝলাম, কিন্তু আমাকে কী দরকার?!
- আপনি একটু কষ্ট করে এসে আমার সাথে দেখা করুন, খুবই জরুরি!
- দেখুন মশাই, আমি আপনাকে চিনি না, আর আমি একটু সমস্যায় আছি, এখন আসতে পারব না।
- আঠারো-কুড়ি বছরের একটা মেয়ের কাছ থেকে আপনার নম্বর পেলাম। বলছে, আপনি ওর দাদা!


কথাগুলো যেন আকাশ পাতাল এক দিল আমার!
আর কিছু না বলেই একদৌড়ে রুমি অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি, সুধা শূন্যদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে, যেন ওর উপরে কেউ হিপনোসিস করেছে, নড়ছেও না পযর্ন্ত!
- কথা বলো, সুধা! তোমার এ অবস্থা কেন!? ওখানে কে?
পেছন দিকে বাড়ির মালিক নেমে এলেন, আমাকে ইশারায় উপরে যেতে বললেন।
উপরের একটা ঘরের মেঝে থেকে সমানে পাতলা সরু লাইন ধরে রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে, কে যেন উপুড় হয়ে গোঙাচ্ছে! আমি শান্তপায়ে ধীরগতিতে এগিয়ে গেলাম, উপুড়-করা মেয়েটাকে চিৎ করে শোয়ালাম...


এ যে আমার ছোট্ট পরীটা!
- কী রে আমার সোনাজাদুটা! তুই এভাবে মেঝেতে শুয়ে কেন!?
আমার মুখের দিকে ধীরে তাকিয়ে চোখের কিনারা বেয়ে অঝোরে জল ছেড়ে দিল খুশবু! একটুও কথা যেন মুখ থেকে বের করতে পারছে না সে! ওর সারাগায়ের জামা ছিঁড়ে ছিঁড়ে আছে কোথাও কোথাও...গলার নিচে কয়েকটা বেশ গভীর আঁচড়ের দাগ দেখা যাচ্ছে...পায়ের নিচ থেকে রক্তের প্রবাহ ধীরে দরজা দিয়ে বাইরে চলে গেছে...


আমার সমস্ত বোধশক্তি যেন মুহূর্তেই লোপ পেয়ে গেল! নিজেকে উন্মাদ, পাগল মনে হচ্ছে। হাসি আসছে, আবার ডুকরে ডুকরে দলা পাকিয়ে কান্নাও আসছে। আবার ওর জন্য খুব মায়া মায়া লাগছে। রাগও হচ্ছে আবার, ও কেন এমন ছিঁড়ে-যাওয়া জামা গায়ে দিয়ে মেঝেতে শুয়ে আছে, আমার অমন সুন্দর বোনটা...পেছনে প্রচণ্ড জোরে কান্নার শব্দে চমকে উঠলাম! সব অস্পষ্ট ঝাপসা লাগছিল, বেশ কয়েকটা মুখ দেখতে পেলাম, কিন্তু কাউকে ঠিক চিনে উঠতে পারলাম না। তবে এটা বেশ বুঝতে পারছি, ওরা খুশবুর জন্যই এভাবে চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে। খুশবুর মাথাটা আমার কোলের উপরে ছিল, সবাই ওর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্নাকাটি করতে লাগল, কে একজন আমাকে ধাক্কার পর ধাক্কা মেরে কী কী যেন জানতে চাইছিল, কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পেলাম না।


খুশবু মনে হচ্ছে মরে যাবে যাবে... কেমন একটা ছটফট করছে... গলা-কাটা মুরগি যেমন করে, ঠিক তেমন... আমার ওর জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল বোধ হয়, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না, আমি শুধু তাকিয়ে আছি... শেষ মুহূর্তে ও খুব কষ্টে একটা লাইন বলেছিল, ‘তুই সেদিন ঠিক শুনতে পেয়েছিলি, আমায় সে-ই ছিঁড়ে খেয়েছে!’ এরপর নিস্তেজ প্রাণহীন একটা দেহ আমার কোলে চুপ হয়ে গেল চিরদিনের জন্য। কারা কারা যেন ওর ছিন্নভিন্ন দেহটাকে নিয়ে যাচ্ছিল আমার চোখের সামনে দিয়ে...আমি সেন্সলেস হয়ে গেলাম।


যখন চোখ খুললাম, তখন সারাবাড়িতে কান্নার শব্দ... সুধা এসে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলল, একমুঠো মাটি রাখা আছে তোমার জন্য, খুশবুর কবরে... বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল, আমি স্বাভাবিকভাবেই উঠে মাটিগুলো হাতে নিয়ে একটা মাটির স্তূপের উপরে ছড়িয়ে দিলাম... গগনবিদারী চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠল, আমার গলা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়বে মনে হচ্ছে...


অ্যাই পাগলিটা আমার! ওখানে তুই কী করতে শুয়ে আছিস রে? ওখানে যে তেলাপোকা আছে! তুই না খুব তেলাপোকা ভয় পাস! উঠে আয় বলছি, নইলে দেবে এক্ষুনি কামড় বসিয়ে। তোর জন্য একটা দেখতে বেশ সুন্দর রাজকুমার এনে দিব, তুই না বিয়ে করবি? আচ্ছা চল, আমার আগেই তোর বিয়ে দেবো রে! বাবা না বলেছিল, খুব ঘটা করে তোর বিয়ে হবে? কী হলো রে? কথা কস না ক্যান তুই? পেঁচিমুখী বান্দর... উঠে আয় আমার ছোট্ট পরীটা...বোন রে, তুই কোথায় গেলি? তোর দাদা যে তোকে ডেকে ডেকে সারা হলো... আয় না রে আমার বাঁদরটা! খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে আমার... আমার লক্ষ্মী বোনটা! আচ্ছা বাবা, তোকে আর পেতনি বলব না, এই কানে ধরলাম, যা! তুই পৃথিবীর সব থেকে সুন্দরী বোন আমার। তুই কথা দিয়েছিলি না, কোথাও যাবি না, সারাজীবন আমার ঘাড়ে পেতনি সেজে চেপে বসবি! তুই তোর কথা রাখলি না কিন্তু! তুই ফিরে আয়, তোকে ফিরে আসতে হবে... খু...শ...বু... ফি...রে... আ...য়...না...রে...


খুশবু চলে যাবার পর এ কয়েক দিনের সব কাজ রাজীব ভাইয়া সামলাল... হসপিটাল থেকে ওর ধর্ষণের রিপোর্ট, ডেথ সার্টিফিকেট...সব...! বাবা হার্ট-অ্যাটাক করে তিন নম্বর ওয়ার্ডের আইসিইউ’তে ভর্তি। যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে, ততক্ষণ বেঁচে থাকে। ঘুম ভাঙলেই পালস ক্রমাগত কমতে থাকে, আর বাঁচার সম্ভাবনা কমে যায়।
মা আজ তিন দিন কিছুই খায়নি। কথাও বলে না, কাঁদেও না, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সুধা সব দেখাশোনা করে। বাবার এক বন্ধু, আমরা তাঁকে কাশিম চাচা বলি, তিনি সরকারি উকিল, আমাদের হয়ে লড়বেন।


বাবা এখন আগের থেকে কিছুটা ভালো আছে। মা আগের মতোই কারও সাথে কথা বলে না, হাসে না, কেউ খেতে দিলে তবে খায়, নাহলে এমনিই কেটে যায় দু-তিনদিন! শুনানির দিন কোর্টে অনেক মিথ্যে সাক্ষ্য, যুক্তিতর্কের একপর্যায়ে... উকিল সাহেব আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, এমন কেউ কি আছে যে কিছু শুনেছে বা দেখেছে, যাকে তুমি বিশ্বাস করো, যে সত্যি কথাটা বলবে আদালতে? আমার তখন একজনের কথাই মাথায় এল...
- সুধা, তুমি একটি বার আদালত আসো।
- কেন? কী হয়েছে?
- প্রসিকিউশন এটাকে দুর্ঘটনা বলে প্রমাণ করতে চাইছে। তুমিই একমাত্র ব্যক্তি, যে সেদিন প্রথম খুশবুর চিৎকার শুনেছিলে।
- আচ্ছা, আমি আসছি।
আদালতের সময় শেষ হতে এক ঘণ্টা বাকি।
সুধা কুড়ি মিনিটের মধ্যে এসে পৌঁছোল।


যাবতীয় নিয়মকানুন সেরে সুধাকে প্রশ্ন করা শুরু হলো। আমার বিশ্বাস ছিল, সবাই মিথ্যে বলতে পারে, কিন্তু সুধা কিছুতেই নয়।
- মিস সুধা, আপনি সেদিন ঠিক কী শুনেছিলেন?
- আমি বাগানে হাঁটছিলাম, হঠাৎ করেই একটা চাপাআর্তনাদ শুনতে পাই।
- আপনি চিনতে পেরেছিলেন? কার আওয়াজ হতে পারে?
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সুধা উত্তর দিল।
- না, আমি ঠিক চিনতে পারিনি।
- সত্যিই পারেননি?
- আওয়াজটা অনেকটা খুশবুর মতন মনে হলো। আমি কাউকে দেখতে পাইনি। তবে ও মনে হয় খুশবু ছিল না।
- কিন্তু আপনি খুশবুর দাদাকে, অর্থাৎ মিস্টার সৌরভকে ফোন করে খুশবু কোথায় জানতে চেয়েছিলেন, এবং বলেছিলেন, আওয়াজটা খুশবুর মতোই ছিল, আর উত্তর দিকে যেতে যেতে মিশে গেল। আর খুশবুর দেহটাও উত্তর দিকের একটা ফ্ল্যাটের মেঝেতে পাওয়া গেল। মিস্টার সৌরভের আগেই আপনি সেখানে গিয়েছিলেন। এখন আপনি মিথ্যে কেন বলছেন?
- আমি কথাগুলো এমনি বলেছিলাম। সে খুশবু ছিল না। অন্য কেউও তো হতে পারে!
- মিস্টার রাজীব শেষ বার সেদিন বিকেলে খুশবুর সাথে কথা বলেছেন, একথা আপনি জানতেন?
- জি, আমি শুনেছিলাম। রাজীব ভাইয়া বলেছিলেন, খুশবু নাকি ভুল করে ফোন ধরেছিল, ব্যস্, এইটুকুই। আর তা ছাড়া খুশবুর ঘটনার সাথে রাজীব ভাইয়ার কোনওরকমের যোগসূত্র নেই, সেদিন সেসময় তিনি বাড়িতেই ছিলেন। সবচাইতে বড়ো কথা, তিনি অনেক ভালো একজন মানুষ।


সুধার কথাগুলো যেন আমার কলিজায় গিয়ে বিঁধল! এ কাকে দেখছি আমি! কে এই ছলনাময়ী, মিথ্যেবাদী! এ তো আমার সুধা নয়, হতেই পারে না! পৃথিবীর শেষ যে মানুষটাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি ভেবেছি সবসময়ই, সে-ই এমন করল আমার সঙ্গে! এ কীভাবে সম্ভব!


আদালতের সামনে সুধা আমার সামনে দাঁড়িয়ে...
- তুমি কেন শুধু শুধু রাজীব ভাইয়াকে দোষ দিচ্ছ, সৌরভ?
আমি ভাবতেই পারছি না, তুমি প্রতিশোধ নিতে পাগল হয়ে শেষ পর্যন্ত কিনা রাজীব ভাইয়ার মতো মানুষকে জড়াবে!
তুমি হাজার চেষ্টা করলেও খুশবু আর ফিরে আসবে না! তুমি তো দেখোনি রাজীব ভাইয়াকে সেদিন খুশবুর সঙ্গে, আর না আমরা কেউ দেখেছি! রাজীব ভাইয়া খুশবুকে নিজের বোনের মতন ভালোবাসতেন, কী না করেছেন উনি খুশবুর জন্য, তোমাদের জন্য, আমাদের সম্পর্কের জন্য! এখনও করে যাচ্ছেন নিঃস্বার্থভাবে! আর আজ তুমি সেই মানুষটাকে এই জঘন্য অভিযোগে অভিযুক্ত করছ! তুমি ভুলে গেলে সব! আর এর জের ধরে তুমি আমাদের সম্পর্কটাও নষ্ট করতে চাইছ! বাহ্ সৌরভ, বাহ্!


- কখনও মৃত্যুপথযাত্রীকে মিথ্যে বলতে দেখেছ, সুধা? দেখেছ খুশবুর মতো কোনও মেয়েকে তার সতীত্ব নিয়ে মিথ্যাচার করতে? ছিন্নভিন্ন একটা দেহকে মিথ্যে বলতে শুনেছ, সুধা? কখনও দেখেছ, গলাকাটা মুরগি কীভাবে ছটফট করে?
আমি তোমাকে চিনি না, সুধা! তুমি আমার কেউ নও। আমার সুধা মরে গেছে, তুমি অন্য কেউ, পথটা সোজা ওইদিকে, সুধা...


সুধার দিকে তাকাতে আর ইচ্ছে করছিল না, ওখান থেকে সোজা বের হয়ে এলাম, হাতে একটা শিশি নিয়ে বাসায় ফিরলাম!
খুশবুর কবরে গেলাম, বাগান থেকে আধফোটা কিছু বেলিফুলের কলি নিয়ে, ওগুলো ওর কবরে রেখে তাকিয়ে রইলাম নিষ্পলক।


- আমার ছোট্ট পরীটা, পেঁচিমুখী বাঁদর...তুই ঠিকই বলেছিলি! তুই কষ্ট পাসনে, এই যে আজই আমি আরেকটা কবর খুঁড়ব। ঠিক তোর পাশেই...
আমার অনেক কাজ বাকি রে, এবেলা যাই। পরে আবার আসব, ঠিক আছে...!


শিশিটা হাতে নিয়ে আসুদার দোকানে গেলাম, ওখান থেকে সেরখানেক মাখাসন্দেশ কিনে আনলাম... সুন্দর করে প্যাকেট করলাম, আর একটা ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম।
খুশবুর পাশে আরেকটা কবর হলো...


বেশ কয়েক দিন কেটে গেল... একদিন সন্ধ্যায় দরজা খুলে দেখি, সুধা দাঁড়িয়ে... আমাকে দেখেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, দরজা বন্ধ করতে দিল না...


- আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও, সৌরভ! তুমি ঠিক ছিলে সেদিন... আমিই ভুল ছিলাম। খুব অন্যায় করেছি তোমার সাথে, খুশবুর সাথে... তোমার থেকে বেশি ওই নরপশুটাকে বিশ্বাস করেছিলাম... আমাকে মেরে ফেলো, সৌরভ... ওই নরপশুটা আমার সুমি আপুকেও ছাড়েনি, রুমি অ্যাপার্টমেন্টের ১১২ নম্বর রুমে রাজীব ভাইয়া সুমি আপুকে তার দল দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাইয়েছে... আব্বুর সেদিনের বলা কথা আজ বুঝতে পেরেছি আমি... সুমি আপু আর বেঁচে নেই, সৌরভ! নিজেকে শেষ করে দিল... আমি... সেদিন আমি ইচ্ছে করে রাজীব ভাইয়াকে পালাতে সাহায্য করিনি, বিশ্বাস করো... আমি বুঝতে পারিনি... আমাকে ক্ষমা করে দাও... আমাকে তুমি ফিরিয়ে দিয়ো না...


- খুশবুর পাশে একটা নতুন কবর হয়েছে, সুধা! দেখে যেয়ো।


দরজাটা বন্ধ করে খুশবুর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম...আমার ছোট্ট পরীটা একদিন বলেছিল, ‘যে আমার ভাইকে অপমান করে, সম্মান দেয় না, আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ করে, তার সাথে আমি কথা বলতে যাব কোন সুখে!?’


আমিও আজ তা-ই করেছি রে, খুশবু! তুই দেখেছিস তো সব, বোন আমার? আজ মা আবার কথা বলেছে জানিস? মা নতুন শাড়িও পরেছে, বাবা আজ আমার নাম ধরেও ডেকেছে...


আজ আমি মুক্ত, আজ আমার অনেক আনন্দ...আজ আমি ঘুমোবো...অনেক অনেক ঘুমোবো...


সুধা আজীবনই জানবে, জামান আর মামুন রাজীব ভাইয়ার বন্ধু। জানুক, এটাই ওর প্রাপ্য!
আমি ড্রয়ার খুলে দুই-শো’টা একহাজার টাকার চকচকে নতুন নোটের বান্ডিলটা একটা খয়েরি খামে ঢুকিয়ে খুব যত্ন করে বালিশের নিচে রাখলাম। আজ বারোটার পর ওরা আসবে আমতলায়। রাজীব ভাইয়ার লাশের সুস্বাদু টুকরোগুলি দিয়ে মাছেদের আজকের স্পেশাল ডিনারটা ততক্ষণে নিশ্চয়ই শেষ হয়ে যাবে! হা হা হা!


আজ আমি সুধার চোখে রাজীব ভাইয়ার জন্য ঘৃণার আগুন দেখেছি। সে তার দুলাভাইকে ক্ষমা করবে না। পৃথিবীর ওই প্রান্তে পালিয়ে গেলেও পুলিশ রাজীব ভাইয়াকে ঠিকই ধরে ফেলবে! এই পলাতক আসামিকে ধরতে আমি সুধাকে অবশ্যই সাহায্য করব, যেমন করে সে আমাকে সেদিন আদালতে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেছিল। যে মানুষটা আমার বোনের জন্য আমার পাশে দাঁড়িয়েছে, আমি কেন তার বোনের জন্য তার পাশে দাঁড়াব না? ন্যায়বিচারের স্বার্থে এইটুকু করা যে আমার পবিত্র দায়িত্ব! আমি যে সুধাকে ভালোবাসি, ভালোবাসার মানুষের প্রতি অত অকৃতজ্ঞ হই কী করে?


জামান আর মামুনের পেশাদারিত্বের তারিফ না করে পারছি না, সত্যি! ওদের কাজে আমি মুগ্ধ! আচ্ছা, আমি কি ওদের দশ হাজার টাকা বাড়িয়ে দেবো? না কি পরবর্তীতে মামলার সমস্ত খরচ আমিই বহন করব?