নিজের কাছে ফেরা



ক্যাফেতে বসে অপেক্ষা করছি।


আমরা সবাই-ই আসলে কিছু-না-কিছু’র জন্য অপেক্ষা করছি। কেউ সাফল্যের জন্য, কেউ কামনানিবৃত্তির জন্য, আবার কেউবা ভালোবাসার জন্য!


ভালোবাসা পাবার জন্যও নাকি মানুষ অপেক্ষা করে!? অদ্ভুত না ব্যাপারটা?!


অবশ্য ভালোবাসার জন্যই তো মানুষ অপেক্ষা করে; ওসবের আমি কী বুঝব?! আমি তো রোবট! আমার তো ভালোবাসা শব্দটা শুনলেও এখন হাসি পেয়ে যায়!


আচ্ছা, আমিও কি ভালোবাসা পাবার যোগ্য? হয়তো ছিলাম একসময়, যখন মানুষ ছিলাম…হ্যাঁ, যখন আমি মানুষ ছিলাম! আমি তখন খুব করে ভালোবাসতে জানতাম। হলুদ-মরিচ লেগে-থাকা শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজতে গুঁজতে ভালোবাসতে আমিও জানতাম। জানতাম অশ্রুভেজা রোমশ বুকে মাথা রেখে ভালোবাসার গল্প বুনতে।


অফিসশেষে বাড়ি ফেরার আগ অবধি, আমি ওর জন্য অপেক্ষা করতে ভালোবাসতাম। ভালোবাসতাম ওর সমস্ত লেখা; ওর কবিতা, ওর শায়েরি, ওর বোকা-বোকা দর্শন। ভালোবাসতাম ওর “হ্যালো” বলার ধরনটাকে, ভালোবাসতাম ওর সমগ্র অস্তিত্বকে।


তবে হয়তো আজ আর বাসি না, খুব চেষ্টা করেও বাসতে পারি না। নিজেকে আমার লাশ মনে হয়। শরীরটাকে টেনেটুনে কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখাকে তো আর জীবন বলে না, তাই না?


আচ্ছা, এমন কেন হয়? কেন হয় এমন?! কেন আমরা সারাজীবন ধরে ভালোবাসতে পারি না? ভালোবাসার সব ক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে কেন মানুষ জ্যান্তলাশে পরিণত হয়?


আমি জানি না এইসবের উত্তর। আজ আমি শুধুই অপেক্ষা করতে জানি। আমি ক্যাফেতে অপেক্ষা করছি, সায়েমের জন্য। প্রায় সাত মাস আগে এখানেই আমাদের শেষ দেখা হয়।


সায়েম এখন আমার সামনে বসা। বসেই প্রথমে নিঃশব্দে সে তার হাতটা আমার হাতের উপরে রাখে।


একসময় এই হাতটা একটি বার ছুঁয়ে দেখার জন্য আমি দিনকে রাত আর রাতকে দিন করে ফেলতে পারতাম। কিন্তু আজ সেই হাতের ছোঁয়া আমাকে কোনও অনুভূতি দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে, আমার সারাটা শরীর অবশ, আমি কিছুই অনুভব করতে পারছি না।


সায়েম আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করছে প্রথম থেকেই, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। আমি তো খুব বেশিক্ষণ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছি না; আর তাকিয়ে থাকলেই-বা কী! সায়েম কি বুঝতে পারে না, এখন আমি আর আগের সেই তিতলি নেই?! আমি যে এখন অন্য কেউ, সেটা কি আমার চোখে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না? কেন চিৎকার করে করে এইটুকুও তাকে আমার বলে বোঝাতে হবে? না কি সে ইচ্ছে করেই এসব না বোঝার ভান করছে? অনেকটা জোর করেই বিশ্বাস করতে চাইছে না সে?!


আমি আর সায়েম লুকিয়ে লুকিয়ে সংসার করেছি, সাড়ে চার বছর। সংসার যে করেছি, কেউ তা টেরই পায়নি! কাউকেই জানতে দিইনি আমরা, কাউকে বুঝতেই দিইনি, ভার্সিটির পুরোটা সময় আমরা একরকম সংসার করে পার করেছি। আর ওইটুকু সময়ের মধ্যে আমাদের সন্তানও এসেছিল। হ্যাঁ, পেটেই কেবল এসেছিল; বেচারা পৃথিবীতে আসতে আর পারেনি! আমার মনে প্রায়ই আসে…সবার আড়ালে প্রেম ও যৌনতার যে যাপন, তা কি সংসার নয়? সত্যিই কি নয়?! ভালোবাসা কি তবে শুধুই ভ্রূণহত্যার নিষ্ঠুর আয়োজন?!


যা-ই হোক, সেই তখন থেকে সায়েমের খামখেয়ালিপনা, ব্যস্ততা, অফিসের ডেডলাইন, প্রমোশন, প্রায় রাতেই দেরিতে ঘরে-ফেরা, অনুভূতিশূন্যতা একটু একটু করে জমছিল আমার মনের ডায়েরিতে। আর জমতে জমতে আমার সমস্ত হৃদয়ে কখন যে একটার পর একটা ক্ষত তৈরি হতে হতে…আজ সব শেষ হয়ে গেল কীভাবে যেন!


না না, একটু ভুল হলো! আজ নয়, আসলে শেষটা অনেক আগেই হয়ে গেছে, আমি টের পাইনি। বেঁচে থাকার অভ্যেসটা একবার রপ্ত করে ফেললে মানুষ কখন যে ভেতরে ভেতরে মরে পড়ে থাকে, তা সে নিজেই টের পায় না; আমিও পাইনি।


সায়েম এসেছে আমাকে ফিরিয়ে নিতে, যদিও মুখে এখনও একটিও কথা বলেনি। কিন্তু আমি জানি, আমি বুঝতে পারি, ওর না-বলা সব কথাই আমি বুঝতে পারি। বুঝতে পারি বলেই এত কষ্ট পাই!


এখন আমার মন তো আর সংসারে নেই, আমি বিবাগি একজন মানুষ। আমি এখন আর কারও কেউ হই না, হতে চাইও না।


সায়েমের হিমশীতল চোখজোড়া কীরকম জানি ভিজে ভিজে উঠছে, আশ্চর্য! ও কি বুঝে ফেলেছে যে আমি ফিরব না আর? ভালোবাসা দিয়ে যে সংসার আমি গড়েছিলাম, ব্যস্ততা দিয়ে আমার সেই সংসার সায়েম ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে।


একবার যখন সংসার থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি, তখন আর কিছুতেই ওই জাহান্নামে ফিরে আমি যাব না। হয়তো ভালোই হতো যদি লোভী হতে পারতাম, যদি শাড়ি-গয়নার চাকচিক্যে সব দুঃখ ভুলে যেতে পারতাম!


বেয়ারা কফি এনে টেবিলে রাখল। ‘ঠান্ডা হোক, একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।’…এটুকু বলেই আমি সায়েমের পেছন দিয়ে সোজা ক্যাফের বাইরে চলে এলাম, ও দেখতে পায়নি। বেরিয়েই একটা সিএনজি ডেকে ওতে লাফিয়ে উঠে পড়লাম।


খুব জোরে চালাতে বললাম ড্রাইভারকে। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রেখে লম্বা একটা দম নিলাম। মোবাইলটা বের করে সায়েমকে টেক্সট দিলাম, ‘তোমার নতুন জীবনে যে আসবে, তাকে অত ব্যস্ততা উপহার দিয়ো না; ওটা স্রেফ একটা বিষ। বিষ খেয়ে খেয়ে বেঁচে থাকার অভ্যেস একবার হয়ে গেলে, একদিন খুব করে চাইলেও আর মরা যায় না। ভালো থেকো।’