দ্য সেভেন্থ সিল (১৯৫৭)

একটা মাথার খুলি একজন নগ্ন মহিলার চাইতে বেশি আকর্ষণীয়।

—-মুভিতে একজন চিত্রকর কথাটি বলেন। কেন বললেন অমন কথা? বুঝতে হলে কিছু কথার মিছিলে হাঁটতে হয়।

দ্য সেভেন্থ সিল। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে খুব ভাল ফরেন মুভির আদর্শ হিসেবে সেরা মুভির তালিকায় মাত্র ৩৫ দিনে চিত্রায়িত বার্গম্যানের এই মুভিটির নাম প্রথম ৫টির মধ্যেই উচ্চারিত হয়ে আসছে। মুভির দর্শন ও বক্তব্য এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং প্রশংসিত। অবশ্য, জীবন মিথ্যা, মৃত্যু সত্য—এই দর্শনকে উপজীব্য করে যে মুভি নির্মিত, সেটি গরম রুটির মতোই চির-সুস্বাদু!

মুভিতে আমরা দেখি মানুষ তার নিয়তির সাথে দাবা খেলছে। খেলার মধ্য দিয়ে নিয়তিকে আটকে রাখার কী প্রাণান্তকর চেষ্টা! যতক্ষণ সে ভাল খেলবে, ততক্ষণ সে নিয়তিকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে। হেরে গেলেই সব শেষ! মানুষ তার অর্জনের মধ্য দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। মৃত্যুর আগে, মৃত্যুর পরে। এ কাজ করতে গিয়ে নানান পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন কৌশলে সে জীবন কাটায়। খেলা এগোয়, মৃত্যু নাচতে থাকে। এ খেলায় ক্রমাগত জিততে থাকা অসম্ভব, সবচাইতে পারদর্শী খেলোয়াড়ও একসময় হার মেনে যায়। সে হারের নাম মৃত্যু। দৈহিক কিংবা আত্মিক। এ হার মানতেই হয়। হার মানাই জেতার নিয়ম।

মানুষ ঈশ্বরের তৈরি, নাকি ঈশ্বর মানুষের তৈরি? এ দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ফাঁকে বার্গম্যান আমাদের বারবারই স্মরণ করিয়ে দেন মৃত্যুর অবিনশ্বরতার কথা। এ মুভিতে মৃত্যুকে পারসনিফাই করা হয়েছে। সে সত্তা বলে, আমার হাত থেকে কারো রেহাই নেই! আশ্চর্যের বিষয়, মৃত্যুর এ ঘোষণা মুভিতে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর কিছু মানুষকেও একতাবদ্ধ করেছে। সবাই হাতে হাত রেখে মৃত্যুকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছে, এই যে চেষ্টাযাপন, তা সবার ক্ষেত্রেই একই; আবার মৃত্যু যখন চূড়ান্ত আহ্বান নিয়ে হাজির হয়, তখনও সবার যাত্রাপথ একই, একই অভিমুখেই। জীবন আর মৃত্যুর এই আটপৌরে রূপের ফাঁদে আটকে নেই, এমন প্রাণী ঈশ্বর বানাননি। তবে কি বৈচিত্র্যের কৃতিত্ব ঈশ্বরের নয়, আমাদের অনুভবের?

জেতার অর্থই বেঁচেথাকা। মৃত্যুর কাছাকাছি না পৌঁছানো পর্যন্ত এ বিশ্বাস কারো হৃদয়ে আসে না। মানুষ যেখানে নিজেকেই বিশ্বাস করে না, সেখানে এ বিশ্বাস কী করে মানুষকে জিতিয়ে বাঁচিয়ে রাখবে? এ বিশ্বাস এমনই এক বিশ্বাস, যা মানুষকে ভয়মুক্ত করে, বাঁচার আনন্দ দেয়। আর মানুষ কিনা এ বিশ্বাসে না বেঁচে এমন সব বিশ্বাস ধারণ করে বাঁচে, যেগুলি বেঁচেথাকার পুরো সময়টাকে ভীত-বিবর্ণ করে রাখে। মানুষ ভয়ের মধ্য দিয়ে বাঁচতে ভালোবাসে। ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস, এর কোনোটাই আমাদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে না, এটা ঠিক, তবে বেঁচেথাকার সময়টাতে মৃত্যুকে সামলে চললে মৃত্যুর কোনো অর্থ খুঁজে পাওয়া যাক না যাক, জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়ই।

মনে খুব দাগ রেখে যায়, মুভিতে দেখানো এমন একটা কনসেপ্ট হচ্ছে, দন্স ম্যাকাবের বা মৃত্যুর নাচ। মধ্যযুগের শেষের দিকে ইউরোপে চিত্রকরদের মধ্যে দন্স ম্যাকাবের খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। বিশেষত গির্জার দেয়ালে সমাজের সর্বোচ্চ স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তরের মানুষ আঁকা হতো, যারা হাতে হাত রেখে নাচতে নাচতে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। জীবনে আমরা অর্জন ও অবস্থান-ভেদে যতো যা-ই কিছু হই না কেন, এ অন্তিম নৃত্য সবার জন্যই অভিন্ন। মনে প্রশ্ন আসে, সত্যজিত রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ মুভিতেও কি আমরা ইংমার বার্গম্যানের ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ প্রদর্শিত এই নৃত্যের ভাব-চিত্রায়ন দেখি না?