দ্বৈরথ

প্রেমের পড়ার কি কোনও বয়স আছে? আমি জানি না এর উত্তর। আমার কাছে একসময় মনে হতো, আছে। কিন্তু আরাফের সাথে দেখা হবার পর থেকে আর মনে হয় না যে, প্রেম কোনও বয়স মানে।




আমাদের আশেপাশে অনেক নারী-পুরুষ আছে, যারা বিশ-পঁচিশের মধ্যেই মনে মনে বুড়িয়ে যায়। যারা মনের ভেতরে বুড়ো, তাদের কাছেই মনে হয়, প্রেম-ভালোবাসার নির্দিষ্ট কোনও বয়স আছে। আরাফের একটা মাত্র চাহনিতে আমার সারাশরীরে কী যে এক ঝড় বয়ে যায়, আমি সেটা বুঝিয়ে বলতে পারব না! তবে একেই কি বলে চোখ দিয়ে খুন করা?




ওই এক চাহনি আবীরের শত শত রাতের আদরগুলোকে কোথায় যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আবীর আমার স্বামী, ভালোবেসে তিন বছর আগে বিয়ে করেছি আমরা। ওকে বিয়ে করার পর থেকে আমি জানলাম, ভালোবাসা সম্পর্কে আমার সব ধারণাই ভুল। বিয়ের আগে ওর যে ছোঁয়া পাবার জন্য আমি মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করতাম, বিয়ের পরে ওর সেই ছোঁয়াই আমার কাছে আগুনের মতন লাগে। ওর ঠোঁট, চোখ, গাল, বুক যেখানেই স্পর্শ করতাম, সুখ পেতাম, আর আজ ওর সেই শরীর‌ই আমার কাছে বিদঘুটে লাগে।




আরাফ আমার সাথে একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। পড়াশোনা শেষ করে আমাদের মতো চাকরির বাজারে না দৌড়ে ও আমাদের বাসার এদিকে একটা ছোট্ট খুপরির মতন জায়গা ভাড়া নিয়ে চায়ের দোকান খোলে। সে এখন একজন চা-বিক্রেতা। আমার বাসার দুই গলি পরেই আরাফের চায়ের দোকান। নানান রকমের চা বানাতে পারে সে। তার সাথে সাথে ওর অমায়িক ব্যবহার যুক্ত হয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ওর দোকানটাই আমাদের এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় চায়ের দোকান হয়ে গেছে।




একটা স্কুলের পাশে দোকানটা হওয়ায় সবসময়ই সেখানটায় ভিড় লেগে থাকে। আমি প্রথম যেদিন ওর দোকানে গেলাম, খুব তাড়ায় ছিলাম সেদিন। সারাদিন অফিসে দৌড়াদৌড়ির পর কিছু জরুরি কাগজের ফটোকপি আর ছবি তুলতে তুলতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ওইদিন বিথীও ছিল আমার সাথে। সাধারণত আমি টং-দোকানের চা খাই না, খুবই বিস্বাদ লাগে, তবুও ওইদিন বিথীর কথায় চোখের সামনে যে দোকান পেলাম, ওতেই ঢুকে পড়লাম।




"কী চা খাবেন, আপু?"... বিথীকে এটা জিজ্ঞেস করেই আরাফ তাকাল আমার দিকে। আমার এখনও ওই মুহূর্তের কথা মনে পড়ে। কেমন যেন গায়ের লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল আমার। "দু-কাপ হলেই চলবে।" এটুকু বলতে পেরেছিলাম কোনোমতে।




আমি এর-ওর মুখে শুনতাম আরাফের দোকানের কথা, কিন্তু কখনও আসিনি। ওর সামনে গেলেই হয়তো আমার ভালোবাসার কথা সব ও বুঝে ফেলবে, এটা নিয়ে বরাবরই আমার ভয় ছিল, তাই আমি সবসময়‌ই ওকে এড়িয়ে চলতাম।




একটা ছেলে সার্টিফিকেটের দোহাই দিয়ে, মানুষের কথার দোহাই দিয়ে ঘরে বসে রয়নি, নিজের আর পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর জন্য সে যে কাজটা সামনে পেয়েছে শুরু করে দিয়েছে, এটা ভেবে ওর প্রতি যেন আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়লাম। ভালোবাসার তীব্র এক অনুভব যেন আমার চোখে পানি এনে দিল।




না, আমি উঠে পড়ি জলদি। কেউ দেখে ফেলার আগেই চোখের জল আড়াল করতে হবে। কেন কাঁদছি, এই প্রশ্নের কোনও উত্তর তো দিতে পারব না। আর বিবাহিত হবার পরেও কাউকে ভালোবেসে ফেলা তো আমাদের  সমাজে খুনের চেয়েও বড়ো অপরাধ! আমি আরাফকে ভালোবাসি জানলে সবাই ছিঃ ছিঃ করবে। আর আজীবন আবীরের সাথে সংসার করে আমাকে মনে মনে হায় হায় করতে হবে।




এই সমাজ ভালোবাসা নিয়ে আকাশ-পাতাল গল্প সাজাতে ভালোবাসে, কিন্তু কখনোই ভালোবাসাকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারে না। যে নিজে কখনও ভালোবাসার স্বাদ পায়নি, অন্য কোনও মানুষকে সেই ভালোবাসার স্বাদ পেতে দেখলে সে সাধারণত সহ্য‌ই করতে পারে না। আমাদের সমাজের উঁচুতলা, নিচুতলা সব তলারই অধিকাংশ মানুষ ভালোবাসাবঞ্চিত। তারা কিছু বানিয়ে নেওয়া শেকলকে ভালোবাসা বলে ধরে নেয়। কেউ যদি সেসব বানোয়াট শেকল না পরে নিজের মতন করে ভালোবেসে ভালো থাকতে চায়, তাকে এই সমাজ মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেয়। বড়ো অবিবেচক ও নির্দয় এ সমাজ।




না, এভাবে আর না। আমি আরাফকে কখনোই ভালোবাসার কথা জানাতে পারব না, কিন্তু আবীরের সংসারেও আর ফিরব না। আমি একাই বাঁচব নিজের মতো করে। তবুও সামাজিক কোনও শেকলের কাছে আমি বাঁধা পড়ে থাকব না।