দ্বিতীয় কবর (তৃতীয় অংশ)


- জানো মা, আজ কী যে একখানা কাণ্ড হয়েছে! সুধাবুর দুলাভাইয়ের কথা সেদিন বলল না...ওই যে মনে আছে?
- হ্যাঁ, তো কী হয়েছে?
- আজকে আমি বায়না ধরেছিলাম আমি, দাদা আর সুধাবু মিলে আমতলায় ফুচকা খাব বলে। তখন হুট করেই রাজীব সাহেব এসে পড়লেন, আমাদেরকে নিয়ে গিয়ে ফুচকা খাওয়ালেন। সেদিন যেমন সুধাবু বলেছিলেন, সেরকম মোটেও মনে হয়নি লোকটাকে। দেখতে বেশ লাগে, মা!
- তুই চুপ করবি? সারক্ষণ বকবক করেই যাচ্ছে সমানে! মা, তুমি ওর কথায় কান দিয়ো না তো!
- আচ্ছা চল, অনেক হয়েছে গল্প। এখন খেতে বসবি। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি।


প্রথম দিনে একটুখানি আলাপ হলো কি হলো না, আর তাতেই খুশবুর এত উচ্ছ্বাস আমার মোটেও ভালো লাগছে না। সে যা-ই হোক, কথায় কথায় ভুলেই গেছি সুধার ফোন নম্বরটা নিতে! আমাকে দিয়ে আর কিছু হলো না!


- দাদা, এই নে ধর! সুধাবু এই কাগজটা তোকে দিতে বলল। আর হ্যাঁ, আমি জানি এখন তুই জানতে চাইবি আমি খুলে দেখেছি কি না। তোর অবগতির জন্য জানানো হচ্ছে যে, ইতোমধ্যে আমি খুলে দেখে নিয়েছি।
বলেই ভোঁ দৌড় দিল খুশবু...ভীষণ লজ্জা পেলাম আর সাথে রাগও হচ্ছে ওর উপর। দিন দিন পেকে যাচ্ছে একেবারে। কাগজটা খুলে বুকটা টনটন করে উঠল!


কেতুর বাপটা আমার! তুই কোনওদিন মানুষ হবি না, এতদিনেও সাহস করে আমার নম্বরটা নিতে পারলি না! কী যে রাগ হচ্ছে তোর উপর! ভাবছিস, তুমি থেকে তুই করে বলছি কেন? বলছি, বেশ করছি! তোকে তুই করেই বলা উচিত, গাধা কোথাকার! আমার ফোন নম্বর দিলাম। আগামী দশ সেকেন্ডের মধ্যে যদি ফোন না দিয়েছিস, তাহলে ঘুসি মেরে তোর নাক ফাটিয়ে দিব, বজ্জাত ছেলে!


ইতি-
সুধা


আমার সম্পর্কে সুধা এসব ভাবে জানতে পেরে খুবই কষ্ট পেলাম, ইমেজের একেবারে ফালুদা হয়ে গেল! যাক, তাড়াহুড়ো করে ফোন দিলাম...
- হ্যা হ্যা হ্যা...লোওওও...! কেক্‌কে? সু-সু-সুধাআআআ বলছ?
- তোর যম বলছি, খাটাশ কোথাকার! এমন সু-সু করছিস কেন, ফাজিল? তুই আর কবে একটু ম্যাচুউরড হবি বল? হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে আমার!
- সুধা, শান্ত হও, প্লিজ। এমন করতে নেই।
- আহা, ঢং কত! শান্ত হও, সুধা...আর কোনও ভাষা কি নেই তোমার রাগ ভাঙানোর?! আস্ত ছাগল একটা!
- ইয়ে না, মানে...সুধাবু শান্ত হোন...এমন করতে নেই।
- তোকে না, আল্লাহ! নিকুচি করেছে তোমার রাগ ভাঙানোর! শয়তান, কচ্ছপ, ব্যাঙ, বিলাই, বান্দর! তোরে পাইলে আমি মেরে তক্তা পাটাতন সব বানিয়ে দেবো...ধ্যাৎ!
দুম্ করে ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে গেল।


সুধা যা খেপেছে না! কাল কলেজে ওর সামনে পড়া যাবে না, নইলে আর আস্ত ফিরে আসতে পারব না। খেপাতেই তো দেখছি আসল মজা...আমার সু-সু-সুধাবুটা! আর পারছি না হাসতে, গাল-চোয়াল সব ব্যথা হয়ে গেল, উফফফফ্‌! বেচারি নিশ্চয়ই আমাকে এখনও ইচ্ছেমতো বকে যাচ্ছে একা একা!


শয়তানের হাড়গোড়! কাল একটি বার এসো কলেজে, তখন দেখাচ্ছি মজা! সু-সু-সুধাবু বলা আমাকে না? বের করছি, দাঁড়াও! আনরোমান্টিক ছাগল একটা! কোন দুঃখে যে এই বদের হাড্ডিকে ভালোবাসতে গেলাম...!
ইসসস্‌! কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছি।
দু-হাতে মুখ ঢেকে হাসতে শুরু করল সুধা।
এ-ই কি সে-ই সৌরভ, একদিন যাকে দু-চোখের আড়েও দেখতে পারতাম না! নাম শুনলেই রাগে-হিংসেয় গা রি রি করত যে আমার, এখন তাকেই কিনা সে আমি এত্ত ভালোবাসি! কী অদ্ভুত বিধাতার লীলা! আমাকে যখন ছেড়ে চলে এলে ঠিক তখনই বুঝতে পারলাম, তোমার সাথে লাগতে এসে কখন যে তোমাকে মনে মনে প্রচণ্ড ভালোবেসে ফেলেছিলাম, নিজেই বুঝিনি আগে! তোমাকে কখনও তা বলা হয়নি।
তুমি কি এখন আমার কথাই ভাবছ, সৌরভ? ভাবছ বুঝি, মেয়েটা অনেক পচা, খুব খারাপ! এতগুলো কথা শুনিয়ে দিল আমাকে! অমন যাচ্ছেতাইভাবে বকেছে!
কী করব বলো! আমায় যে তুমি একটুও বোঝো না!
হুম, হয়তো বলবে, আমিই-বা তোমায় কত বুঝে বসে আছি! তোমরা মেয়েরা এমনই সবসময় চাও, কাছের মানুষগুলো তোমাদের মনের কথা বুঝে নিক, নিজেরা কখনওই মুখে কিছুই বলতে চাও না। আর আমাদের বোঝার বেলায় শুধু যুক্তি আর প্যাঁচ কষো!
তোমায় কি আর না বুঝি আমি? তোমায় বুঝেছি একটু একটু করে, প্রতি মুহূর্তে চিনেছি। তাই তো এই সুধা তার সবটুকু সুধা তোমার নামেই ঢালতে চায়।
আমার চোখে তুমি হারিয়েও কেন লুকিয়ে যাও, সৌরভ?
কেন স্বীকার করতে চাও না, তুমিও আমায় খুব ভালোবাসো?! তোমার আত্মসম্মানবোধ অমন প্রবল, কিন্তু দ্যাখো, আমি সেই জায়গায় বার বার আঘাত করা সত্ত্বেও তুমি আমাকে ঘেন্না করতে পারলে না, ঠিকই ভালোবাসলে!
আসলে কী জানো, মানুষ যখন খুব বেশি ভালোবেসে ফেলে কাউকে, তখন নিজের ভেতরে নতুন কেউ আপনাআপনিই গড়তে থাকে। কেউই চায় না নিজের ভেতরের আমিটাকে অন্য কারও জন্য বিসর্জন দিতে, নিজেকে অন্য কারও জন্যে পালটাতে। ভালোবাসলে যেন নতুন জন্ম হয়, আগের জন্মের মানুষটার অনেক কিছুই তখন বদলে যায়।


- সুধা! তুই কী করছিস বাগানে? একটু এদিকে আয় তো!
চমকে তাকাল সুধা, সুমি আপু ডাকছে ওকে।
- হ্যাঁ, এই তো আসছি!
- বাবা তোকে দেখতে চাইছে সুধা। যা, বাবার ঘরে যা।


- বাবা, আসব?
- হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন সুধার বাবা।
- কী হয়েছে, বাবা? কিছু লাগবে?
ইশারায় আবারও বললেন, না, এদিকে এসে আমার কাছে বোস কিছুক্ষণ।
- মা, বাবাকে ওষুধ খাইয়েছ তো?
- হুম, এই তো রাজীব বাবাজি একটু আগে খাইয়ে গেছে। তোর বাবা কাল থেকে কিছু একটা বলতে চাইছে, জানিস তো, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না।
- বাবা, কী বলতে চাও, আমাকে বলো।
বাবা নওয়াজ সিদ্দিকীর হাতে হাত রাখল সুধা।
- মা, বাবা কী যেন আমার হাতে লেখার চেষ্টা করছেন।
- দ্যাখ, বুঝিস কি না।
ভাঙা ভাঙা শব্দ, R..S..Z..M.. 1..1..2..
- এগুলো কী, বাবা? আমি বুঝতে পারছি না।


- সুধা...সুধা...কই গেলে?
- মা, রাজীব ভাইয়া ডাকছে মনে হচ্ছে। বাবা, আমি একটু আসছি।
- তোমাকে খুঁজেই পাই না। কোথায় থাকো তুমি?
- বাবার ঘরে গিয়েছিলাম একটু। তা কীজন্য ডেকেছেন?
- শোনো, সেদিন যে সৌরভবাবুর সাথে দেখা হয়েছিল, তার সাথে একটা মেয়ে ছিল, কী যেন নাম...?
- খুশবু, সৌরভের ছোটো বোন।
- হ্যাঁ...হ্যাঁ...খুশবু। মেয়েটাকে এখন অবধি ওঁরা নাকি স্কুলে ভর্তি করাতে পারেননি?
- আপনি কীভাবে জানলেন!?
- না, আজ যাবার পথে সৌরভের বাবা, মানে কবীর সাহেবের সাথে দেখা। তা আমি তো চিনতাম না, তোমার সুমি আপু পরিচয় করিয়ে দিলেন। কথা বলার একপর্যায়ে খুশবুর কথা বললেন।
- ও আচ্ছা।
- আমি ভাবছি, এখানেই প্রেসিডেন্সি কলেজের পাশেই একটা ভালো স্কুল আছে, স্কুল-কমিটির সাথে কথা বলে ওকে ওখানে ভর্তি করিয়ে দিব। তুমি কী বলো?
- বাহ্! এ তো খুব ভালো কথা! ওঁরা খুব খুশি হবেন।
এই প্রথম রাজীব ভাইয়ার কোনও কথা আমার ভালো লাগল। মানুষটাকে যত খারাপ ভাবি, আসলে মানুষটা অত খারাপ না।
- আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি সৌরভকে বলব আজ কলেজে গেলে। ও বাসায় কথা বলে নিবে।
- আচ্ছা, সমস্যা নেই। আমার কাছে কবীর সাহেবের নম্বর আছে, আমিও কথা বলে দেখব।


কলেজে ঢুকেই সৌরভকে খবরটা দিব। আশা করি, ও না করবে না। এমনিতেও কয়েক মাস হয়ে গেছে, খুশবু পিছিয়ে পড়েছে পড়ালেখায়। ওই তো বাঁদরটা আসছে!


- এই যে, এদিকে আসেন, নবাবজাদা!
- কেমন আছ, সুধা?
- সেসব পরে হবে। আগে একটা ভালো খবর দিই তোমাকে।
- হ্যাঁ, বলো।
- কাল নাকি আঙ্কেলের সাথে রাজীব ভাইয়ার দেখা হয়েছে, সঙ্গে সুমি আপুও ছিল। সে-ই পরিচয় করিয়ে দিল। তো কথা বলার একপর্যায়ে খুশবুর কথা উঠল, ওকে নাকি কলকাতায় আসার পর এখনও ভর্তি করানো হয়নি। তাই রাজীব ভাইয়া চাইছেন যে আমাদের কলেজের পাশে একটা ভালো স্কুল আছে, ওখানে স্কুল কমিটির সাথে কথা ওকে ভর্তি করিয়ে দিতে। তুমি কী বলো?
- না না, লাগবে না। ওঁকে কষ্ট করতে হবে না। আমি দেখি ভর্তি করাব কয়েক দিনের মধ্যে।
- আরে, তুমি না করছ কেন? রাজীব ভাইয়া নিজ থেকে সাহায্য করতে চাইছেন। আর এমনিতেও খুশবু অনেক পিছিয়ে পড়েছে। তুমি না কোরো না।


সুধার মুখের উপরে আর কিছু বলতে পারলাম না। আর ও কিছু ভুলও বলেনি।
- আচ্ছা, ঠিক আছে, ওঁকে বোলো আমার সাথে দেখা করতে।


দুই দিন পর খুশবুকে সাথে নিয়ে বাবা, আমি আর রাজীব সাহেব স্কুলে ভর্তি করিয়ে আনলাম। কিন্তু আমার মন এতে সায় দেয়নি।
খুশবুকে নতুন একটা ফোন কিনে দিলেন রাজীব সাহেব, আমি না করেছিলাম, কিন্তু সবাই-ই আমার না-তে আপত্তি জানাল; বলল, উনি আমাদেরকে আপন ভেবেই কাজটা করেছেন। খুশবুকে উনি ছোটো বোনের মতো দেখেন।
এতে খুশবুও খুব খুশি, কিছুই মনে করেনি সে। আমার বোনটা এখনও অনেক ছোটো, ও কি আর এতকিছু বোঝে! সরল মনে সবাইকে সে বিশ্বাস করে। প্রায়ই দেখতাম, খুশবুর কোনও সমস্যা হলেই রাজীব সাহেব সবার আগে এসে হাজির হতেন, আমাদের কোনও অসুবিধা জানতে পারলেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ওঁর আচরণে আমি খারাপ বা অসৎ কিছু আবিষ্কার করতেই পারলাম না কখনও!


সুধার সাথে দিন দিন আমার সম্পর্ক গভীর হতে থাকল, দু-জনে বেশ সময় কাটাই, গল্প করি, ঘুরতে যাই, পড়াশোনাও চলছিল বেশ। এদিকে খুশবু এসএসসি পরীক্ষার্থী, দেখতে আগের থেকে আরও সুন্দর হয়েছে। রাজীব সাহেব নিয়মিত খোঁজখবর নেন। আর সুধাকেও আমাদের পরিবারের সাথে মিশতে কখনও বাধা দেননি। বরং সুধার প্রতি ওঁর কেয়ারিং ভাবটা আগের থেকে বেড়ে গেছে। সুধা এখন আর রাজীব ভাইয়া সম্পর্কে কোনও বাজে মন্তব্য কারও কাছ থেকে শুনতেই পারে না! এই ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন যেন একটা লাগত! এই সুধা সেই সুধা তো!?


দেখতে দেখতে কলেজের পার্ট চুকে গেল। স্বপ্ন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোনো, তখন একটু তো স্বার্থপর হতেই হবে! সুধার সাথে এখন আর দেখা করা সম্ভব হয় না, সারাদিনে সময়ও খুব একটা পাই না কথা বলার জন্য। খুব ভোরে উঠে এক শুভসকাল আর রাতে ঘুমোতে যাবার সময় শুভরাত্রি, এটুকুই আমাদের কথা। সুধা মাঝে মাঝে অভিমান করে, কিন্তু পরে ঠিকই বুঝতে পারে। আমার ব্যাপারটা হয় কী, অনেক পড়তে হয়, আর সুধা অল্প কিছুক্ষণ পড়লেই সব গুছিয়ে নিতে পারে, তাই সময় বের করাটা আমার চাইতে ওর পক্ষে বেশি সহজ। আমরা দু-জন দু-জনকে বেশখানি বুঝতে পারি, এই যে কানেকশনটা কাজ করে, এতেই ভালোবাসার পূর্ণতা।


মাঝে মাঝে এমন হতো, দুই-তিন দিনও কথা হতো না, তখন সুধা আমাদের বাসায় আসত, মায়ের সাথে দেখা করে যেত, আমরা কিছুক্ষণ একসাথে সময় কাটাতাম। আমাকে সুমি আপুর মোটেও ভালো লাগত না, তাই উনি প্রায়ই বাধ সাধতেন দেখা করতে চাইলে। এক্ষেত্রে আশ্চর্যজনকভাবে রাজীব ভাইয়াই সাহায্য করতেন, আপুকে বলে ম্যানেজ করতেন। এই কয়েক বছরে রাজীব ভাইয়ার সাথে সম্পর্কটা অনেকটা সহজ হয়ে গেছে, তা অবশ্য আমাদের ভালোবাসা মেনে নেওয়ার কারণেই হয়েছে! উনি সুধার সব চাওয়া পূরণ করতেন, সুধাকে সুযোগ করে দিতেন আমার সাথে দেখা করতে, আর সুধাও রাজীব ভাইয়াকে অনেক বিশ্বাস আর ভরসা করতে শুরু করে। আর খুশবু তো সেই প্রথম থেকেই রাজীব ভাইয়াকে পছন্দ করে, মানে রাজীব ভাইয়া মোটামুটি সবারই একটা স্বস্তিদায়ক অভ্যেসে পরিণত হয়েছেন।


এদিকে খুশবু এখন কলেজছাত্রী। খুশবু আগের থেকে পড়ালেখায় মনোযোগী হয়েছে, রাজীব ভাইয়া ভালো টিউশনির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, সব বিষয়ের খেয়ালও রাখেন। কলেজের ফাইনাল পরীক্ষার শুরু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পর্যন্ত অন্য কোনও দিকে আমার খেয়াল নেই, কারও জন্য সময় বের করতে পারি না, পরিবারের সবার সাথে আগের মতো গল্প করা হয় না, খুশবুর সাথে ঝগড়া হয় না, একসাথে ঘুরতে যাওয়াও হয় না। বলতে গেলে, এক রাজীব ভাইয়াই সবকিছু একাহাতে সামলে আসছেন।


ওদিকে আবার সুধার বাবা আর মাকে সুধার ভাই সজীব ভাইয়া আমেরিকায় নিয়ে গেছেন ভালো চিকিৎসার জন্য। তাই বাড়িতে সুধা, সুমি আপু আর রাজীব ভাইয়া থাকেন। আঙ্কেল চলে যাবার পর থেকে রাজীব ভাইয়ার অন্য রূপটা সুধার নজরে পড়তে শুরু করল।


সুধা আগের মতো কোনও বিষয় নিয়ে সিরিয়াস হয় না, ওভাবে গভীরভাবে ভেবে দেখে না, বিশেষ করে রাজীব ভাইয়ার ব্যাপারে! রাজীব ভাইয়া আমাদের সবার জন্য অনেক করছেন, কখনও কোনও ত্রুটি কেউ ধরতে পারেনি। কিন্তু কেন জানি আমার মন কিছুতেই ওঁর ব্যাপারে সায় দিত না, ওঁর দৃষ্টিতে কেমন যেন হিংস্রতা প্রকাশ পেত, যদিও তা কেবল আমার কাছেই!


দীর্ঘ পাঁচ মাস বিরামহীন পরিশ্রমের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার কাঙ্ক্ষিত দিনটা অবশেষে এসেই গেল! আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম, এত এত মেধাবীদের ভিড়ে আদৌ আমার জায়গা হবে তো!? কিন্তু নিজের উপরে একটা বিশ্বাস ছিল, এতগুলি বিনিদ্র রাত বৃথা যেতে পারে না! কত-না জ্যোৎস্নাশোভিত সন্ধ্যা কি রাত, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, আকাশভেঙে মুষলধারে বৃষ্টি, কখনওবা বৃষ্টিশেষে রংধনু, গোধূলির রক্তিম আভা, বিকেলের শেষে ডাহুকপাখির ঘরে-ফেরা, ভোরবেলার হিমেল হাওয়া, ঘাসের উপর খালি পায়ে প্রিয়তমার হাত ধরে হাঁটতে যাওয়া, রাত জেগে কবিতা লেখা, অর্থহীন আলাপে-প্রলাপে হোয়্যাটসঅ্যাপের দেয়াল ভরে ফেলা, সেই আমতলায় ফুচকা খাওয়ার আনন্দ, এই সবকিছুই একগাদা বই-খাতার কাছে বিসর্জন দিলাম, নামাজের গালিচায় অঝোরে অশ্রুপাত করেছি, দু-হাত তুলে রোজ কেঁদেছি; সৃষ্টিকর্তা আমায় কী করে ফেরাবেন!? এতটা কঠিন তিনি কখনওই হতে পারেন না!


পরীক্ষার দিন মা-বাবা’কে সালাম করে, আমি আর সুধা একসাথে বের হলাম। দু-জন আলদা আলাদা দুই ওয়ার্ডে পড়েছি। সুধাকে অত চিন্তিত মনে হয়নি। এত হাজার ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক, দেখে আমি আরও ঘাবড়ে গেলাম, বিশেষ করে চশমা-পরা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে দেখে আমার মুখ শুকিয়ে গেল। আমার কেন জানি মনে হতো, চশমা-পরা ছেলেমেয়েরা অনেক মেধাবী হয়! কেমন একটা সর্বজান্তা পণ্ডিত গোছের লাগত ওদের। যা-ই হোক, পরীক্ষা দিয়ে হল থেকে বের হলাম যখন, তখন আমায় আর পায় কে!


ফলাফলের জন্য অপেক্ষা না করেই ভার্সিটির ক্যাম্পাস চত্বরে চুরি করে একটা কৃষ্ণচূড়ার ডাল ভেঙে সুধার বের হবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আজ আমি শান্ত, নির্ভীক। আমার কোনও তাড়া নেই, আজ আমি নিশ্চিন্তমনে ভালোবাসার মানুষটির হাত চিরদিনের জন্য ধরতে প্রস্তুত! ইয়ে, না, মানে যদিও চুরি-করা কৃষ্ণচূড়া দিয়েই শুরুটা করছি!


সুধা বের হতেই ভিড় ঠেলে দৌড়ে গেলাম ওর কাছে। দেখে মনে হলো, ওর পরীক্ষা ভালোই হয়েছে, তাই আর জানতে না চেয়ে সোজা হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। পেছন থেকে কৃষ্ণচূড়ার ডালটা বের করে...
- সুধা, তুমি কি আমায়...
- থেমে গেলে কেন, সৌরভ? বলো!
- তুমি কি আমায় সারাজীবন...
- হ্যাঁ, বলো...তোমায় সারাজীবন কী? বলো না সৌরভ!
- তুমি কি আমায় সারাজীবন রান্না করে খাওয়াতে রাজি আছ!?
আমার এই কথার জন্য সুধা মোটেও প্রস্তুত ছিল না, সত্যি বলতে কী, আমি নিজেও স্তম্ভিত! কী বলতে কী বলে ফেললাম। এখন নিশ্চয়ই পিঠের উপর কয়েক ঘা পড়বে!
- ওরে আমার প্রেমিকপুরুষ! আমাকে প্রপোজ করা হচ্ছে, না? তা-ও কৃষ্ণচূড়ার ডাল দিয়ে! রান্না করে খাওয়াব তোমায় আমি, না?! ব্যাঙ, বিলাই, কচ্ছপ কোথাকার! দাঁড়া তুই, বের করছি রান্না তোমার! বজ্জাত ছেলে, জীবনে তো কোনওদিন সামনে এসে রোমান্টিকভাবে প্রপোজ করা দূরে থাক, সামান্য ‘আই লাভ ইউ’-টাও বলতে পারোনি, আর আজ কিনা আমাকে কৃষ্ণচূড়ার ডাল দিয়ে রান্না করার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, না!
- সু-সু-সুধাবু, শান্ত হোন...এমন করতে নেই!
বলেই ভোঁ-দৌড় দিলাম! শুনতে পেলাম...
- আবার আমায় সু-সু-সুধাবু ডাকা, তবে রে!


কৃষ্ণচূড়ার ডালটা হাতে নিয়ে সুধা আমাকে তাড়া করছে, অনেকক্ষণ দৌড়োনোর পর আর পারছিলাম না, একটা হলের সামনে ঘাসের উপর শুয়ে পড়লাম। পাশে হাঁপাতে হাঁপাতে সুধাও এসে সটান শুয়ে পড়ল, ততক্ষণে দু-জনের হাসির রেশ যেন আকাশ ছোঁবে! উপরে বিস্তৃত নীল আকাশ, নিচে সবুজের সমুদ্র, মাঝে দুটো হলদে পাখি...নিবিড় প্রণয়ে মগ্ন...
ছোট্ট একটা চুমু দু-জনের ঠোঁট ছুঁয়ে...গভীর দৃষ্টিতে হারিয়ে গেল! মনে হলো যেন কয়েক জন্মের জন্য বাঁধা পড়ে গেছি দু-জনে! আমার মায়াবিনী, সুন্দরীতমা শ্রেষ্ঠার পাশে শুয়ে নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমিক মনে হলো! ভালোবাসায় এর থেকে পরম-পাওয়া আর কী হতে পারে!?


আমি কৃতজ্ঞ বিধাতার কাছে, আমাকে খুশবুর মতো একটা ছোট্ট পরী উপহার দেবার জন্য, একটা পরিবার দেবার জন্য, সুধার মতন একজন জীবনসঙ্গিনী দেবার জন্য, জীবনের প্রতিটি অধ্যায় সফলতার সাথে শেষ করতে পারার জন্য, জীবনের পথটা এত মসৃণ করে দেবার জন্য, আজকের এই মুহূর্তটা দেবার জন্য...আমি সুখী, আজ আমি বড্ড সুখী একজন মানুষ!
সুখময় ভাবনাগুলোর পাশে ভালোবাসার মানুষটিকে রাখতে পারা, এ বড়ো সৌভাগ্যের ব্যাপার!
আমার দুঃখের দিনগুলোতেও তুমি আমার পাশে থেকো, সুধা! দু-জনের প্রতি দু-জনের এই বিশ্বাস যেন কয়েকটা জন্ম ধরে বেঁচে থাকে...


ভাবনাগুলো ভেদ করে ফোনের রিংটোনটা হঠাৎ বেজে উঠল...


(পরবর্তী অংশে সমাপ্য)