দেশপ্রেম ও গুরুভক্তি কতটা গভীর স্তরে পৌঁছে যেতে পারে, তা নিয়ে আমরা অনেক ঘটনাই জানি। আরও তিনটি ঘটনা জানা যাক। ঘটনা ১। রুশ-জাপান যুদ্ধের সময় যখন দলে দলে জাপানি সৈন্য কোরিয়ায় ঢুকছিল, তখন একজন জাপানি মজুর সৈন্যদলের সাথে তাকেও পাঠানোর জন্য আবেদন করে। জাপানের নিয়ম, দরিদ্র বৃদ্ধ বাবা-মা'য়ের ভরণপোষণের উপায় একমাত্র ছেলেকে, পাঠানোর মতো লোকের নিতান্তই অভাব না হলে, যুদ্ধে পাঠানো হয় না। ওই মজুরের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে সৈন্যসংগ্রহকারী ক্যাপ্টেন জানতে পারলেন, ছেলেটি পিতৃহীন; তার সঞ্চিত ধন বা জমিজমা কিছুই নেই; সে দিন আনে, দিন খায় এবং তার বৃদ্ধা মায়ের আর খেটে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। তখন প্রচলিত নিয়মানুসারে তিনি ছেলেটিকে ফিরিয়ে দিলেন, রেজিমেন্টে ভর্তি করলেন না। ওদিকে মা-ই ছেলের আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা বুঝে যুদ্ধে যাবার জন্য পাঠিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, "দেশের জন্য পবিত্র যুদ্ধক্ষেত্রে তোমার যদি প্রাণ যায়, তাহলে নাহয় ঘরে আমারও অনাহারে প্রাণ যাবে, তাতে এমন ক্ষতিই-বা কী?" ছেলে মনক্ষুণ্ণ হয়ে ঘরে ফিরে এলে বৃদ্ধা সবকিছু শুনে বললেন, "আমার এই তুচ্ছ জীবনের জন্য তুমি দেশের ও সম্রাটের জন্য প্রাণদান করতে পারবে না, এ যে বড়ো লজ্জার কথা। আমি তোমার যশের ও ধর্মের পথে কাঁটা হয়ে থাকব না। তুমি আমার আশীর্বাদ-সহ কর্তব্যকর্মে যাও।"—এই বলে বৃদ্ধা নিজেই নিজের পেটে ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করলেন। ছেলেও মায়ের শেষকৃত্য শেষ করে যুদ্ধে গেল। যেখানে কুলিমজুর পর্যন্ত সবারই দেশের প্রতি এমন প্রগাঢ় ভালোবাসা, সেই দেশের উন্নতি ঠেকিয়ে রাখার সাধ্য কার! ঘটনা ২। যখন সম্রাট আওরঙ্গজেবের আদেশে শিখগুরু তেগ বাহাদুরের দিল্লিতে শিরশ্ছেদ করা হয়, তখন এই নির্দেশ ছিল যে, ওই মৃতদেহের কোনো প্রকারের সৎকার করতে দেওয়া হবে না---ওটা যেখানে কাটা হবে, সেই প্রকাণ্ড রাজপথে পড়ে থেকে পচেগলে শেষ হবে! তাঁর ছেলে গুরু গোবিন্দ সিং, যিনি পরে শিখদের ধর্মগুরু হবেন, তখন ষোলো বছরের বালক। তিনি বাবার মৃতদেহ উদ্ধারের জন্য পাঞ্জাব থেকে দিল্লির দিকে রওনা হলেন। পথিমধ্যে একজন দরিদ্র শিখ শকটচালক ও তার ছেলের সাথে তাঁর দেখা হয়। ওদের একান্ত অনুরোধে গুরু ওদেরই উপর বাবার মৃতদেহ উদ্ধারের দায়িত্ব দিলেন। ওরা কিছুতেই শিখদের একমাত্র ভরসা গুরু গোবিন্দকে বিপদসংকুল দিল্লির ভেতর যেতে দিল না। গোবিন্দ সিংকে বাইরে রেখে দিল্লিতে ঢুকে ওরা দেখল, গভীর রাত্রে প্রহরীরা মৃতদেহের পূতিগন্ধের জন্য কিছুটা দূরে আছে; ওদের সকলেই নিশ্চিন্তমনে ঘুমাচ্ছে। একটা কাপড়ে আচ্ছাদিত মৃতদেহ চৌরাস্তায় পড়ে আছে। বাবা-ছেলে নিঃশব্দে গুরুর শবের কাছে গিয়ে দেহটি উঠিয়ে নেবার সময় স্থির করল, তখনই ওদের একজনের স্বেচ্ছামৃত্যুর একান্ত প্রয়োজন; অন্য একটা মৃতদেহ কাপড়ে ঢেকে ওই জায়গায় রেখে না দিলে প্রহরীদের ঘুম ভাঙলে যখন তারা দেখবে, গুরুর মৃতদেহ কেউ সরিয়েছে, তখনই সম্রাটের ক্রোধের ভয়ে চারিদিকে লোক ছুটবে এবং গুরুর শববহনকারী নিশ্চয়ই ধরা পড়বে। এতে আরও অসংখ্য নিরীহ মানুষ প্রাণ হারাবে। পরধর্মদ্বেষী ধর্মোন্মাদ সম্রাটের এমন সম্ভাব্য অনাচারের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে ওই দুই জনের মধ্যে ছেলেটি মরতে চাইল। বাবা বলল, "তুমি সবল শরীরের অধিকারী এবং গুরুর দেহবহনে অধিকতর সক্ষম; পরবর্তীতে নুতন গুরুর অধীনে ধর্মের জন্য যুদ্ধ করতেও আমার তুলনায় অনেক বেশিদিন ধরে পারবে। তাই তোমারই বেঁচে থাকা জরুরি।" এই বলে শকটচালক নিঃশব্দে নিজের বুক ছুরিবিদ্ধ করে আত্মহত্যা করলে তার ছেলে বাবার রক্তাক্ত দেহটি কাপড়ে ঢেকে এবং তার উপর চাদরটা আগের মতো করেই রেখে গুরুর দেহ নিজের শরীরে বেঁধে নিয়ে চলে গেল। মানুষ এভাবেই গুরুভক্তি ও ধর্মবিশ্বাসের জন্য যুগে যুগে জীবন দিয়েছে। ঘটনা ৩। বিদ্রোহের সময় যখন মিরাট হতে বিদ্রোহী সিপাহি দলে দলে দিল্লিতে প্রবেশ করতে লাগল, তখন ইংরেজ রাজকর্মচারিরা পরিবার-সহ ঘোড়ায় চড়ে শহরের অন্য এক ফটক দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। আধমাইল পথ গিয়ে লেফটেন্যান্ট উইলোবির মনে হলো, "আমরা এ কী করছি! দিল্লির ম্যাগাজিন বিদ্রোহীরা পাবে এবং ওটার তোপ, গোলাগুলি, বারুদের শক্তিতে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্রভাবে যুদ্ধ করতে থাকবে। ওরা আমাদেরই দ্বারা যুদ্ধবিদ্যায় প্রশিক্ষিত। অবশেষে ইংরেজের জয় হবে বটে, কিন্তু দিল্লির ম্যাগাজিন পাবার সুবিধায় ওদের হাতে অন্তত দশ হাজার ইংরেজ সৈন্য মারা পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। নিজের হাতে দেশের উপকার করার এমন সুযোগ আর কখনও আসবে না!" এই কথা মনে হতেই তিনি বললেন, "বন্ধুরা! আমার স্ত্রী ও ছেলে-সহ তোমরা অগ্রসর হও! আমার একটা ভুল হয়েছে, আমি একটা কাজ শেষ করে দ্রুত ফিরে আসছি।" লেফটেন্যান্ট উইলোবি ঊর্দ্ধশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে ম্যাগাজিনের দিকে ফিরলেন। একটু পরেই মহাশব্দে দিল্লির ম্যাগাজিন ইংরেজ বীরের দেহ-সহ উড়ে গেল। বীরত্বই অমরত্বের প্রথম সোপান।