কথায় ও কাজে কৃষ্ণপান্তী

যাঁরা অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সময়মতো কিংবা কখনোই ফেরত দেন না, যাঁরা কথা দিয়ে কথা রাখেন না, সকালে দুপুরে বিকেলে সন্ধেয় রাতে যাঁদের কথার কোনো ঠিকঠিকানা থাকে না, তাঁদেরকে কৃষ্ণপান্তীর গল্প শোনাই।

ভদ্রলোকের নাম কৃষ্ণকান্ত পালচৌধুরী (১৭৪৯ – ১৮০৯); রানাঘাট পালচৌধুরী বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পড়াশোনা জানতেন না; দারিদ্র্যের কারণে পান বেচে জীবিকার্জন শুরু করেন বলে সবার কাছে তিনি ‘কৃষ্ণপান্তী’ নামে আখ্যাত হন। পরবর্তীতে নিজের চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের জোরে নানান ব্যবসায়ে যুক্ত হয়ে প্রচুর অর্থের অধিকারী হয়েছিলেন। তিনি কয়েকটি জমিদারি কিনেছিলেন; ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে রানাঘাট ক্রয় করে সেখানে বাসভবন নির্মাণ করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। কৃষ্ণনগরের রাজার কাছ থেকে তিনি ‘চৌধুরী’ উপাধি পান এবং ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে মার্কুইস অব হেস্টিংসের রানাঘাট পরিদর্শনকালে তাঁর কাছ থেকে ‘পালচৌধুরী’ পদবি ও আসাসোঁটা ব্যবহারের অনুমতিলাভ করেন।

রানাঘাটের পালচৌধুরীদের পূর্বপুরুষ কৃষ্ণপান্তী, মুখে যা বলতেন, কাজেও তা-ই করতেন, কখনোই কথার অন্যথা করতেন না। তাঁর জীবনের কিছু ঘটনা জানা যাক।
(ক) সত্যপালন সম্বন্ধে তাঁর এমন সুখ্যাতি ছিল যে, চোর-ডাকাতেরাও তাঁকে বিশ্বাস করতে কিছুমাত্রও দ্বিধা করত না। তিনি একদিন কলকাতা হতে নৌকাযোগে রানাঘাটে যাচ্ছিলেন; পথে কতগুলি ডাকাত তাঁকে আক্রমণ করল। ওদের মধ্যে কয়েকজন এসে নৌকায় বেশি টাকা না পেয়ে মারপিট আরম্ভ করায় কৃষ্ণপান্তী ওদের বললেন, “তোমরা আমার গদিতে নির্ভয়ে যেয়ো, খুশি করব; এখন চলে যাও।” ওরা কর্তাবাবুর কথা শুনেই চলে গেল। পরে ওরা কৃষ্ণপান্তীর বাড়িতে এলে তিনি বিপন্নাবস্থায় ওদেরকে যত টাকা দেবেন বলে মনে মনে ঠিক করেছিলেন, তা-ই দিয়ে বিদায় করলেন।

(খ) একদিন, একটি তালুক কিনে দেবেন বলে কোনো ব্রাহ্মণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। উপযুক্ত সময় পেয়ে সেই প্রতিশ্রুত তালুকটি কিনে দেবার উদ্যোগ নিলে তাঁর ছেলেরা “এই তালুকে অনেক লাভ আছে, এটা অন্যকে দেওয়াটা ঠিক হবে না।” বলে আপত্তি করলেন। তাতে তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, “আমি যে তাঁকে একটা দেবো বলেছি!” তাঁর কাছে কথার মূল্য অর্থমূল্যের চাইতে অনেক বেশি ছিল।

(গ) এক ব্যক্তি একদিন কৃষ্ণপান্তীর কাছে লবণ নেবে বলে কিছু বায়না দিয়ে যায়। কিন্তু বাকি টাকা জোগাড় করতে না পারায় সে আর তাঁর সাথে সাথে দেখা করেনি কিংবা বায়নার টাকার কোনো ব্যবস্থাও করেনি। কিছুদিন পরেই লবণের দর অত্যন্ত বেড়ে গেলে কৃষ্ণপান্তী সব লবণ বিক্রি করে ফেলেন। সেই ব্যক্তি যত লবণ কিনবে বলে বায়না দিয়েছিল, সেই লবণের বাকি মূল্য কেটে নিয়ে সমস্ত মুনাফাই তার নামে জমা রাখেন এবং অনেক দিন পরে ওই ব্যক্তির দেখা পেলে ওই মুনাফার টাকা তাকে দেন।

(ঘ) ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে মধ্যম ঠাকুর, অর্থাৎ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের মেজোছেলে শম্ভুচন্দ্র রায়ের মাসহারা নিয়ে তখনকার নদীয়ার রাজা ঈশ্বরচন্দ্র রায়ের সাথে এক মামলা হয়। টাকার বিশেষ প্রয়োজন হওয়ায়, শম্ভুচন্দ্র তাঁর ভাই রাজা ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে প্রস্তাব করেন, “আপাতত আমাকে কিছু টাকা দিন, মোকদ্দমা নিষ্পত্তির পর যদি দায়ী সাব্যস্ত না হন, টাকা ফেরত দেবো।” ঈশ্বরচন্দ্র চক্ষুলজ্জায় পড়ে ওই প্রস্তাবে উপরে উপরে সম্মত হয়ে একজন ধনী ও সম্ভ্রান্ত লোকের জামিন চাইলেন। কৃষ্ণপান্তীর কাছে শম্ভুচন্দ্র তাঁর জন্য জামিন হওয়ার প্রস্তাব করায় তিনি রাজি হলেন। রাজা ঈশ্বরচন্দ্র যখন শুনতে পেলেন, কৃষ্ণপান্তী জামিন হবেন, তখন রাজা নিষেধ করে খবর পাঠালেন যে, তিনি যেন মধ্যম ঠাকুরের জামিন না হন। কৃষ্ণপান্তী বললেন, “আমি ছ্যাপ ফেলেছি, এখন আর তা কীভাবে গ্রহণ করব?” কৃষ্ণপান্তীর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, ‘থুতু’ ফেলে তা যেমন আর পুনরায় মুখে নেওয়া যায় না, কোনো কথা বলে সেই কথার অন্যথা করাও ঠিক তেমনি অসম্ভব। ঈশ্বরচন্দ্র এই উত্তরে অসন্তুষ্ট হন, এবং যখন জামানতনামায় স্বাক্ষর করার জন্য কৃষ্ণপান্তী কৃষ্ণনগরে যান, তখন তাঁকে অপমানিত করার অনেক চেষ্টা করেন। জজসাহেব জামানতে স্বাক্ষর করার আদেশ করলে কৃষ্ণপান্তী বললেন, “আমার হাতের লেখা ভালো হবে না, আমার দেওয়ান স্বাক্ষর করলেই হবে।” রাজার তরফ হতে আপত্তির কারণে দেওয়ানের স্বাক্ষর নামঞ্জুর হওয়ায় তাঁকেই অনেক কষ্টে কোনো প্রকারে স্বাক্ষর করতে হয়। এটা দেখে জজসাহেব কৃষ্ণপান্তীর দিকে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন এবং ভালোভাবেই বুঝলেন যে, লেখাপড়া, সদ্‌গুণ এবং কর্মদক্ষতা এগুলি আলাদা আলাদা জিনিস।

(ঙ) একসময়ে, কোনো এক বাক্তি টাকা পাবে দাবি করে কারও নামে আদালতে নালিশ করে কৃষ্ণপান্তীকে সাক্ষী মেনেছিল। শপথ করা ব্যাপারটা হিন্দুধর্মবিরুদ্ধ আচরণ, এই দৃঢ় সংস্কারটি তাঁর মধ্যে থাকায় তিনি বিচারালয়ে উপস্থিত হয়ে বললেন, “ফরিয়াদি টাকা পাবেন সত্য, আমি সেই টাকা নিজেই দিয়ে দিচ্ছি; তবে আমি হলফ করতে পারব না।” এতে বিচারকর্তারা অবাক হয়ে এই ফরমান জারি করে দেন যে, ভবিষ্যতে আর কেউই কৃষ্ণপান্তীকে সাক্ষী মানতে পারবে না।
(চ) এক ইংরেজ মহাজন কৃষ্ণপান্তীর কাছ থেকে আতপ চাল নেবে, এমন কথা হয়। তখন চালের বাজার খুব নরম ছিল। কথা হবার কয়েক মাস পরে চালের মূল্য তিনগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু কাগজেকলমে কোনো প্রমাণ না থাকলেও কৃষ্ণপান্তী সেই ইংরেজ সাহেবকে ডাকিয়ে এনে তাঁর প্রার্থিত সমস্ত চাল, আগের দরেই দিতে চাইলেন। কৃষ্ণপান্তীর গোলা হতে জাহাজে চাল উঠতে লাগল। বেশ কিছু উঠে গেছে, এমন সময় সাহেব নিজের লোকদেরকে এই বলে নিষেধ করে দিলেন যে, “এমন লোকের জিনিস আর তুলিস না, জাহাজ ডুবে যাবে!”

আত্মমর্যাদাবোধ অনেক দামি একটা জিনিস। যার মাথা উঁচু, সে গরিব হলেও মাথা উঁচু, গরিব থেকে ধনী হলেও মাথা উঁচু। অন্যদিকে সস্তা মানসিকতার লোক অনেক অর্থবিত্তের মালিক হলেও দিনশেষে সস্তাই থেকে যায়।