‘দৃগ্ দৃশ্য বিবেক’ (শ্লোক: ৫)

তাই চৈতন্য অন্যপ্রকাশ নিরপেক্ষ, ফলে স্বয়ংপ্রকাশমান বলে তার দৃশ্যত্ব হতে পারে না—এই অর্থের দ্বারা সূচনা করে পঞ্চম শ্লোক স্পষ্টভাবে বোঝাচ্ছেন যে, চৈতন্য চৈতন্যবিরহিত যা যা পদ বা শব্দ, যেমন তুমি বা এটা, এই দুই শব্দ যে-সকল বস্তুর প্রতি প্রযোজ্য হতে পারে, সে সমস্ত বস্তু হতে সম্পূর্ণভাবে পৃথক। পঞ্চম শ্লোকটি প্রথম শ্লোকের ‘ন তু দৃশ্যতে’ অংশের বিস্তৃত ব্যাখ্যা।




নোদেতি নাস্তমেত্যেষা ন বৃদ্ধিং যাতি ন ক্ষয়ম্।
স্বয়ং বিভাত্যথান্যানি ভাসয়েৎ সাধনং বিনা।। ৫




অন্বয়। এষা চিতিঃ ন উদেতি, ন অস্তম্ এতি, ন বৃদ্ধিং যাতি, ন ক্ষয়ং (যাতি)। স্বয়ং বিভাতি, অথ সাধনং বিনা অন্যানি ভাসয়েৎ।




অনুবাদ। এই চৈতন্যের উদয় (জন্ম) নেই, অস্ত (তিরোভাব) নেই, বৃদ্ধি নেই, ক্ষয় নেই। এটা স্বয়ংপ্রকাশ (নিজে নিজেই প্রকাশিত) এবং সাধননিরপেক্ষ (যার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে সাক্ষীর প্রয়োজন নেই) হয়ে অপর সকল বস্তুকে প্রকাশ করে থাকে।




টীকা। বৃহদারণ্যকোপনিষদ (৩/৪/১-২, ৩/৫/১) বলছেন—যৎ সাক্ষাদপরোক্ষাদ্ ব্রহ্ম—যিনি দ্রষ্টা হতে ব্যবহিত বা দূরবর্তী নন, বরং দ্রষ্টার স্বরূপভূত, এমন অপরোক্ষ বা স্বজ্ঞালব্ধ বা অগৌণ ব্রহ্ম অর্থাৎ যিনি দ্রষ্টার মুখ্য প্রত্যক্ষাত্মক বা প্রত্যক্ষ রূপপ্রকাশক। এই শ্লোক ‘এষা চিতিঃ’ বা ‘এই চৈতন্য’—এই দুই শব্দ দ্বারা প্রত্যক্ষাত্মক প্রসঙ্গের‌ই উল্লেখ করছেন।




‘আমি’ শব্দ দ্বারা যে-অহঙ্কারকে বোঝায়, সেই অহঙ্কার হতে আরম্ভ করে যুষ্মদ্ বা মধ্যম পুরুষ—‘তুমি’ বা ইদং বা ‘এই’—এই দুই শব্দ দ্বারা যা-কিছু বোঝানো যায়, তাদের সবারই প্রাগভাব (প্রাক্-অভাব) আছে, অর্থাৎ উৎপত্তির আগেই তাদের অভাব আছে। উদাহরণস্বরূপ, পাত্র না থাকলে পাত্রের ঢাকনার কী কাজ? তাই ঢাকনার মধ্যেই পাত্রের প্রাগভাব আছে। পাত্রের উৎপাদন বা উপস্থিতি বা আনয়ন এই প্রাগভাবের অবসান ঘটায়। ‘আমি’ না থাকলে ‘তুমি’ বা ‘এই’ বা এমন বাকি সব আসবে কোথা থেকে? তাই সকল ‘তুমি’ বা ‘এই’-তে ‘আমি’-র প্রাগভাব আছে। এ কারণেই তাদের উদয় বা জন্ম হয়।




কিন্তু সর্বসাক্ষী চৈতন্যের তেমন কোনো প্রাগভাব নেই। এই কারণে ‘ন উদেতি’—তা উৎপন্ন হয় না এবং তার প্রধ্বংসাভাব (কোনো কিছু ধ্বংস বা বিনষ্ট হয়ে যাবার পর তার যে-অভাব) নেই বলে ‘ন অস্তম্ এতি’—এটা অস্ত বা বিনাশপ্রাপ্ত হয় না।




‘ন বৃদ্ধিং যাতি’, ‘ন ক্ষয়ং (যাতি)’—এটা বৃদ্ধি ও ক্ষয় প্রাপ্ত হয় না। এই দুইটি দ্বারা অধিকন্তু বোঝানো হলো যে, যাস্কপঠিত ষড়্‌বিকারের মধ্যে ‘(কিছুকালের জন্য) অস্তিত্ব’ ও ‘পরিণাম বা পরিণতি বা পূর্ণতা’ নামক অপর দুই বিকারও এর নেই। (বাকি দুই বিকার জন্ম ও বিনাশ‌ও এর নেই।)




এখানে ‘অস্তিত্ব’ শব্দটি দ্বারা উৎপত্তির পর, যে ভবিষ্যৎ ‘ব্যাবহারিক অস্তিত্ব’, তা বিকারের অন্তর্গত বলে তারই নিষেধ বা বিলোপ করা হলো। সত্তা তিন প্রকার: (১) প্রাতিভাসিক (ভ্রমজ্ঞান বা অবিদ্যা), (২) ব্যাবহারিক (বিজ্ঞান বা অপরাবিদ্যা) ও (৩) পারমার্থিক (তত্ত্বজ্ঞান বা পরাবিদ্যা)।




দড়িকে সাপরূপে নয়, বরং প্রকৃত রূপ তথা দড়ি হিসেবে চিনতে পারলে দড়িতে সাপের ভ্রান্ত সত্তা আরোপিত হতে আর পারে না। অবচ্ছিন্ন বা বিশিষ্ট বা নির্দিষ্ট চেতনজ্ঞান দ্বারা যে-সত্তা বাধাগ্রস্ত হয়, তাকে প্রাতিভাসিক সত্তা বলে। এই সত্তার উৎপত্তিকে বাধা দেবার জন্য ব্রহ্মজ্ঞান লাগে না। দড়িতে সাপের বোধ বা সত্তাটি প্রাতিভাসিক। এটা দূর করতে ব্রহ্মজ্ঞানের দরকার নেই, দড়ি আর সাপ আলাদা করে চিনলেই চলে।




ব্রহ্মজ্ঞান না জাগলে যে-সত্তার বাধা হয় না এবং ব্রহ্মজ্ঞান জাগলে যার অধিষ্ঠানের অর্থাৎ দ্রষ্টার সত্তাই কেবল টিকে থাকে, বাকি সব ভ্রম‌ই বিলুপ্ত হয়, তাকে ব্যাবহারিক সত্তা বলে। অবিদ্যার (আত্মজ্ঞানরহিত বিদ্যা) ও আকাশাদির (বিভিন্ন ভৌত বস্তুর) সত্তা এরকম। ব্রহ্মজ্ঞান হলে এদের সত্তা ব্রহ্মসত্তায় বা চৈতন্যে লীন হয়ে যায়। দড়িতে দড়ির‌ই বোধ বা সত্তাটি ব্যাবহারিক।




ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান—এই তিন কালের কোনোটিতেই যার বাধা হয় না, সেই সত্তাকে পারমার্থিক সত্তা বলে। চৈতন্যের সত্তাই একমাত্র পারমার্থিক সত্তা।




অদ্বৈতবাদিগণ এই তিন স্তরের সত্তা স্বীকার করেছেন। এই মতবাদের নাম সত্তা-ত্রৈবিধ্য-বাদ। যা কখনও বাধিত অথবা অসত্যরূপে প্রতীত হয় না, তা-ই পারমার্থিক সত্তা, যথা ব্রহ্ম। যা ব্রহ্মজ্ঞানোদয়ের আগ পর্যন্ত সত্যরূপে প্রতীত হয়, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই বাধিত হয়ে যায়, তা ব্যাবহারিক সত্তা, যথা জগৎ। যা-কিছু সময়ের জন্য প্রত্যক্ষ হয়, পরে সংসারাবস্থাতেই অপর ব্যাবহারিক প্রত্যক্ষ দ্বারা বাধিত বা অসত্য বলে প্রমাণিত হয়, তা প্রাতিভাসিক সত্তা, যথা রজ্জু-সর্প-ভ্রমকালে দৃষ্ট সর্প অথবা কোনো স্বপ্নদৃষ্ট বস্তু। এভাবে, প্রাতিভাসিক ব্যাবহারিক প্রত্যক্ষ দ্বারা এবং ব্যাবহারিক পারমার্থিক প্রত্যক্ষ দ্বারা বাধিত হয়।




প্রাতিভাসিক ও ব্যাবহারিককে প্রকৃতপক্ষে ‘সত্তা’ বলা যায় না, কারণ তারা উভয়ই ‘মিথ্যা’ মাত্র। কিন্তু তাদের ভেতরও প্রভেদ আছে। তা হচ্ছে এই, প্রাতিভাসিক ব্যাবহারিক অপেক্ষা অল্পস্থায়ী, অর্থাৎ খুব তাড়াতাড়িই বাধিত হয়ে যায়। প্রতিদিন সকালে স্বপ্নভ্রমের অবসান হয় এবং দড়ি বা রজ্জুতে দৃষ্ট সাপ বা সর্পও শীঘ্রই বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু চৈতন্য বা ব্রহ্মের জাগরণে জগদ্‌ভ্রমের অবসান এমন সহজসাধ্য নয়। এটা অতিদীর্ঘকাল স্থায়ী, জন্মজন্মান্তরব্যাপী—ব্রহ্মোপলদ্ধির আগে এর বিনাশ নেই।




পরমার্থিক সত্তাই স্বরূপ বা প্রকৃত অস্তিত্ব। আলোচ্য শ্লোকে এ সত্তার স্বরূপ-অস্তিত্বের নিষেধ করা হলো না, কেননা চৈতন্য সকল অবস্থাতেই এক ও অভিন্ন রূপবিশিষ্ট বলে অবিকারী, তাই চৈতন্যের ক্ষেত্রে কোনোরূপ বিকার প্রযোজ্য নয়।




সেই চৈতন্যে কেন যাস্ক-পঠিত ছয়টি ভাববিকার নেই, তারই কারণ প্রদর্শন করা হয়েছে এভাবে—স্বয়ং বিভাতি, অন্যানি সাধনং বিনা ভাসয়েৎ—সেই চৈতন্য অন্য কোনো প্রকাশকের অপেক্ষা রাখে না বলেই নিজেই প্রকাশমান হয়ে নিজের সচ্চিদানন্দাত্মক স্বরূপ প্রকাশ করার পরেই, নিজ বা আপনা ভিন্ন অন্য যাবতীয় আরোপিত বস্তুকে প্রকাশ করে।




শ্রুতি (কঠোপনিষদ ২/২/১৫, মুণ্ডকোপনিষদ ২/২/১১, শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ ৬/১৪) বলছেন—তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি—তম্ এব ভান্তম্ (তিনি প্রকাশমান বলেই) সর্বম্ (সমস্ত বস্তু) অনু-ভাতি (সে অনুযায়ী প্রকাশ পায়), তস্য (তাঁর) ভাসা (জ্যোতির দ্বারা) ইদম্ সর্বম্ (এই সমস্ত) বিভাতি (বিবিধরূপে প্রকাশ পায়)—সর্বম্ (সমস্ত জগৎ) তম্ এব ভান্তম্ অনুভাতি (তিনি দেদীপ্যমান বলেই সে অনুযায়ী দীপ্তিমান হয়), ইদম্ (এই) সর্বম্ (সমুদয়) তস্য (তাঁর) ভাসা (দীপ্তি দ্বারা) বিভাতি (বিবিধরূপে প্রকাশশীল হয়)।




অর্থ: তিনি প্রকাশমান বা দেদীপ্যমান বলেই সমস্ত জগৎ ও বস্তু সে অনুসারে দীপ্তিমান হয়, তাঁরই দীপ্তিতে এই সব কিছু বিবিধরূপে প্রকাশ পায়। অতএব, তিনি প্রকাশস্বরূপ এবং বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়ে প্রকাশিত হন। ঘটাদি অপ্রকাশ বস্তু বা জাগতিক বস্তুসমূহ অন্যের প্রকাশক হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে আগুনই পোড়ায়, কাঠ বা মশাল ইত্যাদি পোড়ায় না; অথচ আগুনের সাথে যুক্ত হলে ওদের সম্বন্ধে আমরা বলি, “কাঠ বা মশাল পোড়াচ্ছে।” ঠিক একইভাবে, ব্রহ্মচৈতন্যের দ্বারা সকলে জ্যোতিষ্মান হয়। (বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ৪/৪/১৬)




নির্বিকল্পক জ্ঞান হতেই সবিকল্পক জ্ঞানের উৎপত্তি। কীরকম? দেখা যাক।




প্রত্যক্ষ দু-প্রকার: লৌকিক ও অলৌকিক। পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে-প্রত্যক্ষ, তাকেই লৌকিক প্রত্যক্ষ বলে। লৌকিক প্রত্যক্ষকে দু-ভাগে ভাগ করা হয়: নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ (Indeterminate Perception) এবং সবিকল্প প্রত্যক্ষ (Determinate Perception)। বস্তুত নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ এবং সবিকল্প প্রত্যক্ষ, প্রত্যক্ষের দুটি ভিন্ন স্তর।




লৌকিক প্রত্যক্ষে আমরা বস্তুটিকে প্রথমে নিছক বস্তু বলেই জানি, অর্থাৎ কেবলই তার অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করি। বস্তুটির জাতি, ধর্ম বা নামের কোনো পরিচয় লাভ করি না। প্রত্যক্ষের প্রথম স্তরে কোনো বস্তু, ধরা যাক, একটি গোলাপ ফুলের সঙ্গে যখন আমাদের ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটে, তখন আমি এটিকে কেবল একটি বস্তু বলেই জানছি। এটি যে একটি গোলাপ ফুল, তার যে লাল রঙ রয়েছে, সুগন্ধ রয়েছে—এসব বিষয়ের জ্ঞানলাভ করছি না। সে জ্ঞান আসে পরের স্তরে, তখন নির্বিকল্প (নামধামহীন) প্রত্যক্ষ সবিকল্প (নামধামযুক্ত) প্রত্যক্ষে পরিণত হয়। সুতরাং নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে বস্তুর সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট এবং স্পষ্ট জ্ঞান হয় না। এ জাতীয় প্রত্যক্ষে কোনো বচনের সাহায্যে জ্ঞানকে ব্যক্ত করা হয় না বা যায় না। নির্বিকল্প হলো সহজ উপলব্ধি মাত্র।




যে-প্রত্যক্ষ কোনো নামের সঙ্গে যুক্ত নয়, প্রাচীন নৈয়ায়িকেরা একেই নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ বলছেন। নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ হলো সম্পর্ক-বিযুক্ত প্রত্যক্ষ, যা নাম, জাতি বা ওই জাতীয় কোনো কিছুর অনুষঙ্গ বা সংযোগ থেকে মুক্ত।




সবিকল্প প্রত্যক্ষে আমরা বস্তুর ধর্ম বা জাতি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করি এবং বস্তুটির প্রকৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান লাভ করি। সবিকল্প প্রত্যক্ষে আমরা জানি যে, কোনো বস্তু, যেমন গোলাপ ফুল—তার লাল রঙ আছে, সুগন্ধ আছে; অর্থাৎ বস্তুটির প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা অনেক তথ্য লাভ করি। আমরা বস্তুটির জাতি-ধর্ম, বিশেষ গুণ, নাম ইত্যাদি সম্পর্কে অবহিত হই। ‘বিকল্প’ কথাটির অর্থ ‘বিশেষ্য-বিশেষণ ভাব’, সবিকল্প প্রত্যক্ষে এই বিশেষ্য-বিশেষণ ভাব থাকে, যা নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে থাকে না।




নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ ছাড়া সবিকল্প প্রত্যক্ষ হয় না। কোনো বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রথমে বোধ না জন্মালে সে বস্তুটি যে গোলাপ ফুল এবং তার যে বিভিন্ন গুণ আছে, তা জানা সম্ভব নয়। বস্তুর সঙ্গে যখন ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটে এবং পূর্ব-প্রত্যক্ষের দ্বারা উৎপন্ন যে-সকল সংস্কার অবচেতন মনে বিরাজ করে, সেগুলি যুক্ত হলেই সবিকল্প প্রত্যক্ষ হয়। সুতরাং সবিকল্প প্রত্যক্ষকে বলা যেতে পারে উপস্থাপনমূলক-পুনরুজ্জীবনমূলক প্রক্রিয়া। বস্তুটি ইন্দ্রিয়ের কাছে উপস্থাপিত হচ্ছে, যার ফলে ইন্দ্রিয়-সংযোগ ঘটছে, আবার এই সংযোগের ফলে অতীতলব্ধ অন্যান্য অভিজ্ঞতা, যেগুলি বস্তুর সঙ্গে যুক্ত, সেগুলি পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে।




শ্রীমদ্‌বিদ্যারণ্য মুনির কথায় এই সবিকল্প-নির্বিকল্প বিরোধের সম্যক মীমাংসা হবে:




স্বতস্তাবদিদং জগচ্চিজ্জড়োভয়াত্মকং ভাসতে। যদ্যপি শব্দস্পর্শাদিজড়বস্তুভাসনাযৈবেন্দ্রিয়ানি সৃষ্টানি “পরাঞ্চিখানি ব্যতৃণৎ স্বয়ম্ভুঃ” ইতি শ্রুতেঃ তথাপি চৈতন্যস্যোপাদনতয়া বর্জ্জয়িতুমশক্যত্বাৎ, চৈতন্যপূর্বকমেব জড়ং ভাসতে। “তমেব ভান্তমনুভাতি সর্বং তস্যভাসা সর্বমিদং বিভাতি” ইতি শ্রুতেঃ। তথা সতি পশ্চাদ্ভাসমানস্য প্রথমতো ভাসমানমেব চৈতন্যং বাস্তবং রূপমিতি নিশ্চিত্য জড়মুপেক্ষ্য চিন্মাত্রং চিত্তে বাসয়েৎ।” ( জীবন্মুক্তিবিবেকঃ, বাসনাক্ষয়প্রকরণম্)




অর্থ: এই জগৎ স্বভাবতই চিৎ ও জড়, এই উভয় স্বরূপেই প্রকাশিত হয়। যদিও শব্দ, স্পর্শ প্রভৃতি জড়বস্তুর প্রকাশের জন্য ইন্দ্রিয়সমূহের সৃষ্টি হয়েছে—কেননা শ্রুতিতে আছে (কঠোপনিষদ, ২/১/১) “পরাঞ্চি ([স্বভাবতই] বহির্মুখ) খানি (শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়সমূহকে) স্বয়ম্ভূঃ (পরমেশ্বর) ব্যতৃণৎ (হিংসা করেছেন, মেরেছেন)—বহির্মুখ ইন্দ্রিয়সমূহকে পরমেশ্বর বিনাশ করেছেন, (সুতরাং জীব বহির্বিষয়সমূহই দর্শন করে, অন্তরাত্মাকে নয়।)—যতক্ষণ তারা বহির্মুখ থাকে, ততক্ষণ আত্মজ্ঞান লাভ করতে পারে না; এটাই তাদের বিনাশ। পরমাত্মা বহির্মুখ ইন্দ্রিয়সমূহের নিকট আত্মপ্রকাশ করেন না। যে-সকল লোক বহির্মুখ, তারা বস্তুত আত্মাকে চায় না, সুতরাং তাঁর দর্শনও পায় না।—তবুও চৈতন্য জড়ের উপাদান (কারণ অর্থে) বলে এবং সে কারণে চৈতন্যকে বর্জন করা যায় না বলে, চৈতন্যকে অগ্রবর্তী করেই জড় প্রকাশিত হয়। শ্রুতিতে (কঠ ২/২/১৫, মুণ্ডক ২/২/১১, শ্বেতাশ্বতর ৬/১৪) আছে—সেই আনন্দস্বরূপ আত্মা দীপ্যমান থাকার ফলেই সূর্যাদি সকলেই তাঁর প্রকাশের পর, তাঁর অনুগতভাবে প্রকাশ পাচ্ছে, এই সূর্যাদি পদার্থসমূহ তাঁর দীপ্তিতেই বিভাত হয়। তাহলে, শুরুতে প্রকাশমান চৈতন্যই, পরবর্তীতে প্রকাশমান জড়ের বাস্তবরূপ—এই সত্যকে নিশ্চিতভাবে জেনে জড়কে উপেক্ষা করে কেবল চৈতন্যের জাগরণ বা সংস্কারই চিত্তে স্থাপন করতে হবে।




বৃহদারণ্যকোপনিষদ (৩/৭/২৩) ঘোষণা করছেন:




যো রেতসি তিষ্ঠন্ রেতসোহন্তরো যং রেতো ন বেদ যস্য রেতঃ শরীরং যো রেতোহন্তরো যময়ত্যেষ ত আত্মাহন্তর্যাম্য-মৃতোহদৃষ্টো দ্রষ্টাহশ্রুতঃ শ্রোতাহমতো মন্তাহবিজ্ঞাতো বিজ্ঞাতা নান্যোহতোহস্তি দ্রষ্টা নান্যোহতোহস্তি শ্রোতা নান্যোহতোহস্তি মন্তা নান্যোহতোহস্তি বিজ্ঞাতৈষ ত আত্মহন্তর্যাম্যমৃতোহতো-হন্যদার্তং ততো হোদ্দালক আরুণিরুপররাম।।




রেতসি (শুক্রে, অর্থাৎ জননেন্দ্রিয়ে)। [মহাশক্তিশালী পৃথিব্যাদিদেবতাও কেন আপনাদের অন্তরে অধিষ্ঠিত ও আপনাদের নিয়ন্তা অন্তর্যামীকে জানেন না, তা বলা হচ্ছে]—অদৃষ্টঃ ([স্বয়ং অন্য কারও] দৃষ্টির বিষয়ীভূত নন) [অথচ] দ্রষ্টা ([চক্ষুতে সন্নিহিত চৈতন্যস্বরূপ বলে সাক্ষী); [এইরূপে] অশ্রুতঃ শ্রোতা ([সর্বকর্ণে সন্নিহিত] অলুপ্ত শ্রবণ-শক্তি); অমতঃ (মনঃসঙ্কল্পের অবিষয়) মন্তা (মননকারী); অবিজ্ঞাতঃ (নিশ্চয়ের অবিষয়ীভূত) বিজ্ঞাতা। [কিন্তু তাই বলে পৃথিব্যাদিদেবতা পৃথক ও তাঁদের নিয়ন্তা অন্তর্যামী পৃথক নন; কারণ] অতঃ (এই অন্তর্যামী হতে) অন্যঃ (ভিন্ন) দ্রষ্টা ন অস্তি (নেই); অতঃ অন্যঃ শ্রোতা ন অস্তি; অতঃ অন্যঃ মস্তা ন অস্তি; অতঃ অন্যঃ বিজ্ঞাতান অস্তি। অন্তর্যামী অমৃতঃ এষঃ (অন্তর্যামী ও অমৃত ইনিই) তে আত্মা




যিনি জননেন্দ্রিয়ে, অর্থাৎ জননেন্দ্রিয়দেবতার অন্তরবর্তী রূপে থাকেন, জননেন্দ্রিয়দেবতা যাঁকে জানেন না, জননেন্দ্রিয় যাঁর শরীর, যিনি অন্তরবর্তীরূপে থেকে জননেন্দ্রিয়দেবতাকে নিয়ন্ত্রিত করেন, তিনিই অন্তর্যামী ও অমৃত এবং আপনার আত্মা। তিনি অদৃষ্ট হলেও দ্রষ্টা, অশ্রুত হলেও শ্রোতা, মননের অবিষয় হলেও মন্তা, অবিজ্ঞাত হলেও বিজ্ঞাতা। ইনি হতে ভিন্ন কোনো দ্রষ্টা নেই, ইনি হতে ভিন্ন কোনো শ্রোতা নেই, ইনি হতে ভিন্ন কোনো মন্তা নেই, ইনি হতে ভিন্ন কোনো বিজ্ঞাতা নেই। অন্তর্যামী ও অমৃত ইনিই আপনার আত্মা। ইনি (যিনি সাক্ষী, সর্ব-সংসারধর্ম-বর্জিত ও সর্বপ্রাণীর কর্মফলবিভাগের কর্তা) হতে যা-কিছু ভিন্ন, তা বিনাশী। এতে উদ্দালক আরুণি নিরস্ত হলেন।




যিনি দৃষ্টি প্রভৃতির স্বরূপ, তিনি দৃষ্টি প্রভৃতির বিষয় হতে পারেন না। তিনিই সকল চোখ, কান, মন ও বুদ্ধি দ্বারা দ্রষ্টা, শ্রোতা, মন্তা ও বিজ্ঞাতা রূপে বিভাবিত হন। তিনি ব্যতীত দ্রষ্টা, শ্রোতা প্রভৃতি নেই। যিনি সকলের চেতনাস্বরূপ, তিনি অক্ষর। ব্রহ্মে ভেদ বা অভেদ কিছুই নেই (বৃহদারণ্যক ২/৫/১৯, মুণ্ডক ২/১/১)। অবিদ্যা, কাম ও কর্মবিশিষ্ট দেহেন্দ্রিয়ে উপহিত (নিহিত বা আরোপিত) পরমাত্মাকে ক্ষেত্রজ্ঞ বা জীব বলে। নিত্য নিরতিশয় জ্ঞানশক্তিতে উপহিত তাঁকেই অন্তর্যামী ঈশ্বর বলে। আবার তিনিই নিরুপাধিক (ভেদকারক-ধর্মশূন্য) শুদ্ধ স্বরূপে অক্ষর নামে কথিত হন। এরূপে উপাধিবশে একই আত্মা হিরণ্যগর্ভ (ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা), দেবতা, মানুষ, তির্যক (মানবেতর জীব) প্রভৃতি বিভিন্ন নামও প্রাপ্ত হন।




ন দৃষ্টের্দ্রষ্টারং পশ্যের্ন শ্রুতেঃ শ্রোতারং শৃণুয়া ন মতের্মন্তারং মন্ত্রীথা ন বিজ্ঞাতের্বিজ্ঞাতারং বিজানীয়াঃ।
বৃহদারণ্যকোপনিষদ (৩/৪/২)




দৃষ্টেঃ ([লৌকিক] দৃষ্টির) দ্রষ্টারম্ (দ্রষ্টাকে, [সাক্ষী আত্মাকে]) ন পণ্যেঃ (দেখতে চাইবেন না, কেউ দেখতে পারেন না); শ্রুতেঃ শ্রোতারম্ (শ্রবণের শ্রোতাকে) ন শৃণুয়াঃ (শুনতে চাইবেন না); মতেঃ (মননের, মনোবৃত্তির) মন্তারম্ (মননকারীকে) ন মন্ত্রীথাঃ (মনন করতে চাইবেন না); বিজ্ঞাতেঃ (বিজ্ঞান-ক্রিয়ার, বুদ্ধিবৃত্তির) বিজ্ঞাতারম্ ন বিজানীয়াঃ (জানতে চাইবেন না)




অর্থাৎ, দৃষ্টির দ্রষ্টাকে কেউ দেখতে পারেন না; শ্রবণের শ্রোতাকে কেউ শুনতে পারেন না; মনোবৃত্তির মননকারীকে কেউ ভাবতে পারেন না; বুদ্ধিবৃত্তির বিজ্ঞাতাকে কেউ জানতে পারেন না। (সর্বান্তর বা সবার অন্তরে স্থিত ইনিই আপনার আত্মা; তা বাদে আর সমস্ত‌ই বিনাশী।)




দৃষ্টি দুই প্রকার—লৌকিক ও পারমার্থিক। চোখের সাথে সংযুক্ত অন্তঃকরণ বৃত্তিবিশেষকে লৌকিকদৃষ্টি বলে। লৌকিকদৃষ্টি বিষয়াকারে রঞ্জিত হয় এবং তার উৎপত্তি ও বিনাশ আছে। এটি পারমার্থিক দৃষ্টির সাথে সংসৃষ্ট বা সম্বন্ধযুক্ত আছে বলে বোধ হয়। বস্তুত এটি আত্মদৃষ্টিরই প্রতিচ্ছায়ামাত্র এবং আত্মদৃষ্টির দ্বারাই এটি ব্যাপ্ত। আত্মদৃষ্টি কিন্তু আত্মারই স্বরূপ; তার উৎপত্তি বা বিনাশ নেই (বৃহদারণ্যক, ৪/৩/২৩)। প্রদীপ যেমন লৌকিক জ্ঞানের দ্বারা (কীভাবে প্রদীপ তৈরি করতে হয়, জ্বালাতে হয়) প্রকাশ্য, অথচ নিজে ওই জ্ঞানকে প্রকাশ করতে পারে না, তেমনি লৌকিক দৃষ্টি আত্মদৃষ্টির দ্বারা উদ্‌ভাসিত হলেও সে সাক্ষিস্বরূপ ওই দৃষ্টিকে প্রকাশ করতে পারে না। লৌকিক দৃষ্টির সাথে সম্পর্ক ঘটে বলে, অর্থাৎ লৌকিক দৃষ্টি আত্মার দ্বারা ব্যাপ্ত হয় বলে, সাক্ষী আত্মাকে দ্রষ্টা, অদ্রষ্টা ইত্যাদি বলে মনে হয়; বস্তুত তিনি ক্রিয়াহীন (বৃহদারণ্যক, ৪/৩/৭)। শ্রবণ, ঘ্রাণ, আস্বাদন, অনুভবগ্রহণ প্রভৃতি সম্বন্ধেও এরূপ বুঝতে হবে। লৌকিক দৃষ্টি প্রভৃতি হতে পৃথক করে নিত্যদৃষ্টিস্বরূপ আত্মাকে বুঝতে হবে।




এভাবে অসংখ্য শ্রুতিবচনের তাৎপর্য দ্বারা স্থির বা প্রতিপাদিত হলো, আত্মা আছেন এবং তিনি সর্বান্তর, কূটস্থ ও নিত্যজ্ঞানস্বরূপ। এ কারণে ‘তুমি’ বা ‘এই’—এমন জ্ঞানের আলম্বন বা ভিত্তি অন্তঃকরণ প্রভৃতি বস্তু দৃশ্যই; আর ‘আমি’—এমন জ্ঞানের আলম্বন বা ভিত্তিস্বরূপ প্রত্যক্‌চৈতন্য বা অবচেতনা বা কূটস্থচৈতন্য স্বরূপত দ্রষ্টা; অতএব, প্রত্যক্‌চৈতন্যই পরমব্রহ্ম—এটাই পরমসত্য।




এখন কথা হচ্ছে, প্রথম শ্লোকে বলা হলো—’তুমি’ বা ‘এই’ বা ‘ওই’, এমন শব্দ দ্বারা সূচিত যাবতীয় বস্তু তথা ‘দৃশ্য’কেই ‘সাক্ষী’ প্রকাশ করে থাকে। আবার পঞ্চম শ্লোকে কিন্তু বলা হলো—’চিতি’ বা ‘চৈতন্য’-ই সেসব বস্তুর প্রকাশক। তাহলে কথা দুই রকমের হয়ে গেল না? না, এতে কোনো ভুল হয়নি; কেননা ‘চিতি’ শব্দের দ্বারা প্রথম শ্লোকে ঘোষিত সাক্ষীই পঞ্চম শ্লোকে ‘চৈতন্য’-রূপে সূচিত হয়েছে।




এই ‘দৃগ্ দৃশ্য বিবেক’ প্রকরণের পরিসমাপ্তি পর্যন্ত প্রতিটি অংশে প্রথম শ্লোকের অর্থেরই যে বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তাতে বিভিন্ন স্থানে ‘সাক্ষী’ শব্দের দ্বারা সেই চিতি-বস্তুই বোঝানো হয়েছে এবং ‘সাক্ষী’, ‘চিতি’, ‘চিৎ’, ‘চৈতন্য’, ‘জ্ঞান’, ‘বোধ’, ‘প্রত্যগাত্মা’, ‘কূটস্থ’ ইত্যাদি শব্দ সমার্থক এবং একই বস্তুকে লক্ষ্য করে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।




অন্তঃকরণ কী? বেদান্ত বলেন, অন্তঃকরণ (অভ্যন্তরীণ অঙ্গ) চারটি ভাগে বিভক্ত:




অহঙ্কার (অহম্)—দেহের সাথে আত্মাকে ‘আমি’ হিসেবে চিহ্নিত করে
বুদ্ধি—সিদ্ধান্তগ্রহণকে নিয়ন্ত্রণ করে
মনস (মন)—নিয়ন্ত্রণ করে সংকল্প (ইচ্ছা বা রেজোলিউশন)
চিত্ত (স্মৃতি)—মনে রাখা এবং ভুলে যাওয়া নিয়ে কাজ করে




সাপেক্ষক নিয়ে জানা যাক। শতপথব্রাহ্মণ বলছেন:




ন ইব বৈ ইদং অগ্রে অসদাসীৎ ন ইব সদাসীং। আসীৎ ইব বৈ ইদং অগ্রে ন ইব আসীৎ। তদ্ হ তৎ মনাঃ ইব আস।। ১




তস্মাদ্ এতদ্ ঋষিণাং ভ্যনূক্তং "ন অসদ্ আসীদ্ ন সদ্ আসীৎ তদানীং” ইতি। ন ইব হি সদ্ মনো ন ইব অসৎ।। ২




তদ্ ইদং মনঃ সৃষ্টং আভিরবুভূষদ্ নিরুক্ততরং মূর্ততরং। তদ্ আত্মানং অন্বৈচ্ছৎ। তৎ তপোহতপ্যত। তৎ প্রামূচ্ছর্ৎ। তৎ ষট্‌ত্রিংশতম্ সহস্রাণি অপশ্যৎ আত্মনোহগ্নীন্ অর্বান্ মনোময়ান্ মনশ্চিতঃ।। ৩




অনুবাদ: অগ্রে (সৃষ্টির পূর্বে) এটা সৎ-এর (অস্তিত্বশীল) মতনও ছিল না, অসৎ-এর (অনস্তিত্বশীল) মতনও ছিল না। এটা থাকার মতনও ছিল, না থাকার মতনও ছিল। তা সেই ‘মনঃ’-এর মতো কিছু ছিল। ১। সেজন্য ঋষিরা এটা বলেছেন যে, “তখন সৎও ছিল না, অসৎও ছিল না।” মনঃ সৎ-এর মতোও নয়, অসৎ-এর মতোও নয়। ২। সেই মনঃ সৃষ্ট হয়ে অধিকতর প্রকাশিত ও মূর্তিমানরূপে আবিভূত হলো। তা আত্মলাভ করতে ইচ্ছা করল। তা তপঃ করল। তা মূর্ছিত হলো। তা আত্মা হতে মনোময়, মনে নিশ্চিতভাবে অধিষ্ঠিত ছত্রিশ হাজার শ্রেষ্ঠ অগ্নিকে দেখল। ৩।




এতে বলা হচ্ছে, সৃষ্টির পূর্বে মনের মতো কোনো বস্তু ছিল—তাকে সৎও বলা যায় না, অসৎও বলা যায় না। তা-ই মূর্তিমানরূপে আবির্ভূত হয়ে আত্মলাভ করার পর এ সকল সৃষ্টি করে। জগৎকারণ চৈতন্য এই প্রপঞ্চসৃষ্টির ভেতর দিয়ে সাফল্য লাভ করেন, সৃষ্টি ছাড়া চৈতন্য সত্তাহীন, আর চৈতন্য ভিন্ন সৃষ্টির অন্য কোনো সত্তা তো নেই-ই। সৃষ্টি ও চৈতন্য তাই পরস্পর ‘সাপেক্ষক’। এই শতপথোদ্ধৃত বাক্যানুসারে আমাদের মন বাস্তবিকই কি সৎও নয়, অসৎও নয় এবং আবির্ভূত হয়েই কি আত্মলাভ বা সাফল্য লাভ করে? একটু নিবিষ্টচিত্তে ভাবলে দেখা যায়, মন যতক্ষণ বিষয়াকারে আবির্ভূত না হয়, ততক্ষণ তা অন্তর্নিহিত শক্তি মাত্র এবং সৎ বা অস্তিত্বশীল হলেও বস্তুত অসৎ বা অস্তিত্বহীন মাত্র। আবির্ভূত না হওয়া পর্যন্ত তা আত্মলাভ বা সাফল্য লাভ করে না।




‘প্রপঞ্চ’। হিন্দু ষড়দর্শনের অন্যতম হলো বেদান্তদর্শন। এর সারাংশ হলো: ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা; এখানে ‘মিথ্যা’ মানে অস্তিত্বহীন নয়—ব্রহ্ম অবিনশ্বর এবং জগৎ পরিবর্তনশীল এবং ক্ষণস্থায়ী। মানুষ মায়ায় আচ্ছন্ন এবং এই মায়া অপসারিত হলেই সে ব্রহ্ম-সাযুজ্য লাভ করবে। সংক্ষেপে এটাই ‘মায়াবাদ’। এই ‘মায়া’র অপর নাম ‘প্রপঞ্চ’।




স্বাভাবিকভাবেই, অন্তঃকরণের সাপেক্ষক দ্রষ্টাত্ব। তাহলে ‘তুমি’ বা ‘এই’ শব্দ দ্বারা সূচিত পদ যদি অন্তঃকরণকে বোঝায়, তবে তা দ্রষ্টা হয় কী করে? তখন তো অন্তঃকরণ ভূতনির্মিত ঘটের মতোই আচরণ করে।




পুরাণবচন কী বলছেন, দেখি—




দ্রষ্টরি নাস্তি দৃশ্যত্বং দৃশ্যস্য দ্রষ্টৃতা নহি।
দৃশ্যরূপস্য কুড্যাদে র্দ্রষ্টৃতা নহি দৃশ্যতে।।




যিনি দ্রষ্টা, তিনি কখনও দৃশ্য হতে পারেন না; আর যা দৃশ্য, তা কখনও দ্রষ্টা হতে পারে না। দেয়াল প্রভৃতি দৃশ্যবস্তু দ্রষ্টা হয়েছে, এমন কখনও দেখা যায় না।




সহজ করে বলি। যখন জগৎ দৃশ্য, তখন ইন্দ্রিয় দ্রষ্টা। যখন ইন্দ্রিয় দৃশ্য, তখন অন্তঃকরণ দ্রষ্টা। যখন অন্তঃকরণ দৃশ্য, তখন চৈতন্য দ্রষ্টা। চৈতন্য পরম দ্রষ্টা, চৈতন্য কখনোই দৃশ্য হতে পারে না। কোনো একটি ধাপে দ্রষ্টা একইসাথে দ্রষ্টা ও দৃশ্য হতে পারেন না, দৃশ্য একইসাথে দৃশ্য ও দ্রষ্টা হতে পারে না।




যখন ইন্দ্রিয় দৃশ্য, তখন অন্তঃকরণ দ্রষ্টা বিধায়, তাঁর পক্ষে সংসারানুভব করা বা অনিত্য হ‌ওয়া সম্ভবপর হয় না, যদিও পরের ধাপে অন্তঃকরণ দৃশ্য হয়ে সংসারানুভব করে বা অনিত্য হয়। পক্ষান্তরে, এক‌ই ধরনের যুক্তি দিয়ে দেখানো যায়, যিনি অহঙ্কার-বুদ্ধি-মনস-চিত্তের বিপরীত স্বভাববিশিষ্ট, কূটস্থ, স্বয়ংপ্রকাশ, প্রত্যক্ বা পরম বোধস্বরূপ সাক্ষী, তাঁর পক্ষে জাগ্রদবস্থা হতে আরম্ভ করে বিমুক্তি পর্যন্ত সংসারানুভব বা অনিত্যতা বা পরিবর্তনশীলতা সম্ভবপর হয় না, কেননা সেই সাক্ষী অসঙ্গ ও উদাসীন, অর্থাৎ তিনি বন্ধনমুক্ত, নিত্য, পরব্রহ্ম, নির্বিকার, অবিকারী; অতএব সাক্ষী চিরঅসংসারী বা চিরমোক্ষযুক্ত।




বৃহদারণ্যকোপনিষদ (৪/৩/১৫) বলছেন: অসঙ্গো হ্যয়ং পুরুষঃ (হি অয়ম্ পুরুষঃ অসঙ্গঃ)—পুরুষ অসঙ্গ (সঙ্গীহীন বা মুক্ত)। যে-বাক্যের সাহায্যে সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়, তা হলো হেতু বা যুক্তি বা আশ্রয়। সাক্ষী অসঙ্গ ও উদাসীন—একে অসিদ্ধ বা অপ্রমাণিত হেতু বলা যায় না, কেননা সাক্ষীর অসঙ্গতা-রূপ শ্রুতিবচনসিদ্ধ বলে নির্দোষ।




অন্তঃকরণ ও তার সাক্ষী চৈতন্য উভয়েই অসংসারী বলে প্রতিপাদিত হলে, যে সংসারের বা অনিত্যতার বা পরিবর্তনশীলতার নিবৃত্তি বা অপসারণ করতে হবে, তা আদৌ না থাকায় সেই সংসার-নিবর্তক জ্ঞান‌ও (বা বিদ্যা) নিরর্থক হয়ে পড়ে। তাহলে সংসার-প্রবর্তক জ্ঞান‌ বা অবিদ্যার বিকাশ হয় এবং সকল জ্ঞানপ্রতিপাদক বেদান্ত বাক্য অপ্রামাণিক (প্রমাণসিদ্ধ নয়) হয়ে পড়ে।




সাক্ষী বা আত্মা সব বিচারেই বিশেষ-পরিশূন্য বা বিশেষ-বর্জিত। ‘অনুভূতিপ্রকাশ’ (১৯/৩৮) জানাচ্ছেন, ‘বিশেষ’ অর্থ মূলত—গুণ, ক্রিয়া, জাতি বা সম্বন্ধ। তেমন কোনো ‘বিশেষ’ সাক্ষীতে নেই বটে, কিন্তু সাক্ষীর গুণ বা বৈশিষ্ট্য ‘সাক্ষিত্ব’ তো একটা ‘বিশেষ’ বলে গণ্য হতে পারে। ‘সাক্ষিত্ব’ আছে বা ‘সাক্ষিত্ব’ নেই, তথা গুণের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি—এমন আশঙ্কার উদ্ভব হতে পারে।




এই নিত্যমুক্ত সাক্ষী আত্মা বা ব্রহ্মের সাক্ষিতাও বাস্তব নয়, তা সাক্ষ্যের অর্থাৎ দৃশ্যবস্তুর তথা দৃশ্যের সাথে সম্বন্ধ ধরে বা কল্পনা করে শুদ্ধ চৈতন্যে আরোপিত হয়ে থাকে। ২৮টি শ্লোকসমৃদ্ধ ‘অদ্বৈত মকরন্দ’ গ্রন্থের রচয়িতা লক্ষ্মীধর কবি বিষয়টিকে এভাবে বলেছেন:




চেত্যোপরাগরূপা মে সাক্ষিতাপি ন তাত্ত্বিকী।
উপলক্ষণমেবেয়ং নিস্তরঙ্গচিদম্বুধেঃ।। ২০




টীকা: আত্মার ব্রহ্মরূপতা সম্ভবপর হয় না, কেননা আত্মার সংসারসাক্ষিতারূপ বিকল্পবৃত্তি রয়েছে। বৃহদারণ্যকোপনিষদ (৩/৮/৮) ব্রহ্ম সম্পর্কে বলছেন: ইনি অস্থূল, অনণু, অহ্রস্ব, অদীর্ঘ, আলোহিত, অস্নেহ, অচ্ছায়, অতমঃ, অবায়ু, অনাকাশ, অসঙ্গ, অরস, অগন্ধ, অচক্ষুষ্ক, অশ্রোত্র, অবাক্, অমনঃ, অতেজস্ক, অপ্রাণ, অমুখ, অমাত্র, অনন্তর, ও অবাহ্য। তিনি কাউকে ভক্ষণ বা গ্রাস বা বিনাশ বা অদৃশ্য করেন না, এবং অপর কেউ তাঁকে ভক্ষণ বা গ্রাস বা বিনাশ বা অদৃশ্য করে না।




এক‌ই শ্রুতির ২/৩/১-৬, ৩/৯/২৬, ৪/৫/১৫ ইত্যাদি শ্লোক আত্মা তথা ব্রহ্ম তথা পরম সাক্ষী সম্পর্কে ‘নেতি নেতি’ অভিব্যক্তির মাধ্যমে ঘোষণা করছেন। ‘নেতি নেতি’ অর্থ: “এটি নয়, ওটি নয়”, বা “এটিও নয়, ওটিও নয়”। এটি অস্বীকারের বৈদিক বিশ্লেষণের পদ্ধতি। এটি বৈদিক অনুসন্ধানের মূল বিষয়। এর সাহায্যে জ্ঞানী এই জগতের সমস্ত কিছুর সাথে পরিচয়কে অস্বীকার করেন—যা আত্মা নয়—এভাবে তিনি অনাত্মাকে অস্বীকার করেন। (আত্মা নিরাকার ও অংশহীন, এর প্রকৃত প্রকৃতি উপলব্ধি করা যায় না; অপরদিকে অনাত্মার রূপ আছে, অংশ আছে, এর প্রকৃতি উপলব্ধি করা যায়।) এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি মনকে অস্বীকার করেন এবং সমস্ত জাগতিক অভিজ্ঞতাকে অতিক্রম করেন। সব কিছুকেই ক্রমান্বয়ে অস্বীকার করা হয়, যতক্ষণ না স্বয়ং আত্মা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তিনি দেহ, নাম, রূপ, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয় ও সমস্ত সীমাবদ্ধ অনুষঙ্গকে অস্বীকার করে পরম ব্রহ্মের সাথে মিলন অর্জন করেন এবং যা অবশিষ্ট থাকে, তা থেকে আবিষ্কার করেন: ব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র সত্য ‘আমি’ বা ‘ব্রহ্ম’ বা ‘আত্মা’। ব্রহ্ম তাই নির্বিকল্পক।




আত্মা যেহেতু সাক্ষী, সেহেতু আত্মার সাক্ষিতা আছে এবং এ কারণেই তাঁর ব্রহ্মরূপতা অসিদ্ধ। এই আশঙ্কার উত্তরে বলা যায়, মিথ্যা জড়ের সাথে সম্বন্ধ ব্যতিরেকে শুদ্ধ চৈতন্যের উপলব্ধি অসম্ভব। মিথ্যা জড়ের সাথে চৈতন্যের এই কল্পিত সম্বন্ধই সাক্ষিতা।




চেত্য বা জড় বস্তু বা ঘটের উপরাগ বা বিকার বা রঞ্জনের ফলে, অর্থাৎ ঘটের প্রভাব বা কর্তৃত্ব সমস্ত জড় জগৎ-সংসার বা প্রপঞ্চের ছায়াপাত বা চিত্রসদৃশ বিধায়, প্রত্যগাত্মা বা ব্রহ্মচৈতন্য সাক্ষী বলে প্রতীত বা অনুমিত হন—তাঁর সেই সাক্ষিতাও বোঝার সুবিধার্থে কল্পিত ও আপেক্ষিক, পরমার্থভূত বা সত্য নয়। চেত্য বা জড় যখন অপরমার্থভূত বা মিথ্যা হলো, তখন তাকে নিয়ে যে-সাক্ষিতা সংঘটিত হয়, তা কখনও পারমার্থিক বা সত্য হতে পারে না।




এই সাক্ষিতা বস্তুত তটস্থতা, কূটস্থতা নয় এবং নিস্তরঙ্গ অর্থাৎ সকল ধরনের কর্তৃত্ব ও মায়া বা আরোপিত কল্পনা বা প্রপঞ্চশূন্য চৈতন্যসমুদ্রের অসত্য জ্ঞাপিকা মাত্র। ব্রহ্মের যেমন জগৎ কার্যকারণ, সাক্ষিতার‌ও ঘট কার্যকারণ। কার্যকারণ হচ্ছে সেই প্রভাব, যার দ্বারা ঘটনা, প্রক্রিয়া, অবস্থা বা বস্তু (কারণ) অন্য ঘটনা, প্রক্রিয়া, অবস্থা বা বস্তুর (প্রভাব) উৎপাদনে অবদান রাখে—যেখানে কারণটি প্রভাবের জন্য আংশিকভাবে আরোপিত এবং প্রভাব আংশিকভাবে নির্ভরশীল কারণের উপর। আত্মা বস্তুত নির্বিকল্পক বলে আত্মার ব্রহ্মত্ব অসিদ্ধ নয়।




এই চিতি বা চৈতন্য, সকলেরই সাক্ষীভূত এবং সকল বস্তুতে বা ঘটে অনুস্যূত বা সম্পর্কযুক্ত। ‘ন উদেতি’: এঁর জন্ম নেই, ‘ন অস্তম্ এতি: এঁর বিনাশ নেই। অভূতের অর্থাৎ ‘যে-বস্তু ছিল না, তার’ প্রাদুর্ভাবকে বা আবির্ভাবকে জন্ম বলে। যে-বস্তু সৎ বা আছে অর্থাৎ বিদ্যমান, তার অসত্তাপ্রাপ্তি বা ধ্বংসপ্রাপ্তিকে বিনাশ বলে। এমন আদ্যবিকার বা জন্ম ও অন্ত্যবিকার বা বিনাশ চৈতন্যে নেই। এই আদ্যবিকার ও অন্ত্যবিকারের নিষেধ হওয়াতে, এ দুইয়ের মধ্যবর্তী ‘বৃদ্ধি’ বা কোনো ধরনের পরিবর্তন তথা বিকারের নিষেধ হয়ে গেল। ‘ন বৃদ্ধি’ ইত্যাদি বাক্যে এটাই বলা হয়েছে। ‘বৃদ্ধি’ শব্দে উপচয় বা পুষ্টিসাধন বুঝতে হবে এবং ‘ক্ষয়’ শব্দে অপচয় বা হ্রাসসাধন বুঝতে হবে।




অবয়বযুক্ত বস্তুর অবয়বের উপচয় হলে তা বৃদ্ধি পায়, তার অপচয় হলে অপক্ষয় প্রাপ্ত হয়। চৈতন্য নিরবয়ব বলে তাতে এই দুইয়ের সম্ভাবনা নেই। ‘বিপরিণাম’ শব্দে অবস্থান্তরপ্রাপ্তি বুঝতে হবে। সেই অবস্থান্তরপ্রাপ্তি বৃদ্ধি-ক্ষয় না ঘটলে ঘটে না, সুতরাং বৃদ্ধি-ক্ষয়ের নিষেধ করাতে, অবস্থান্তরপ্রাপ্তিরও নিষেধ হয়ে গেল।




অস্তিত্ব-রূপ বিকারের অর্থ: কিছুকাল ধরে থাকা। যখন জন্ম-মৃত্যুকে অসম্ভব বলা হলো, তখন সেই অস্তিত্বও অসম্ভব বুঝতে হবে। এই ছয়টি ভাববিকার (জন্ম, বিদ্যমানতা, পরিবর্তন, বৃদ্ধি, ক্ষয় ও নাশ) চৈতন্যের নেই কেন? এর কারণ এ শ্লোক নির্দেশ করছেন ‘স্বয়ং বিভাতি’ ইত্যাদি পদ দ্বারা। ‘তথা বিধানি’—উক্ত বিকারবিশিষ্ট সকল পদার্থকে এবং ‘অন্যানি’—সেরূপ অন্য পদার্থকে ‘ভাসয়েৎ’—প্রকাশ করে থাকে। কীভাবে প্রকাশ করে? ভান বা প্রতীতির উৎপাদন করে? কোনোভাবেই নয়—তাহলে তো সেই চৈতন্যে বিকারিত্ব এসে পড়ল, কেননা তাঁর অবস্থান্তরপ্রাপ্তি স্বীকার করা হলো। এই যুক্তিতে বলা হয়েছে: ‘সাধনং বিনা’—অর্থাৎ সাধনত্ব বিনা বা সাধনস্বরূপ না হয়ে বা কোনো কিছুই সাধন না করে, সকল বস্তুর সাথে অপৃথক বা অভিন্ন থেকে সব ধরনের বিকারাবস্থার সাক্ষী হন বলে চৈতন্যে বিকার-সম্পর্কের বিন্দুমাত্রও আশঙ্কা নেই।