‘দৃগ্ দৃশ্য বিবেক’ কী?

বিভিন্ন শাস্ত্রের সূচনাগ্রন্থকে‌ সূত্র বলে। সূত্র সবসময়ই লঘু অর্থাৎ নাতিদীর্ঘ, অল্পঅক্ষর ও অল্পপদযুক্ত, অনেক অর্থের বাচক। কোনো দর্শনশাস্ত্রের সমস্ত সারভূত বাক্যকে পণ্ডিতেরা সূত্র বলেন। সূত্রে অল্প কথায় সারভূত সমস্ত বিষয়‌ই বিন্যস্ত থাকে। প্রাচীন প্রায় সকল দর্শনশাস্ত্রই সূত্রাকারে গ্রথিত। সূত্রগুলি অল্পাক্ষর দ্বারা গ্রথিত থাকায় সাধারণের বোধগম্য নয়, এজন্য এর ব্যাখ্যা আবশ্যক। সূত্রের সুব্যাখ্যা যেমন-তেমনভাবে করলেই হয় না, তারও নির্দিষ্ট লক্ষণ আছে। সূত্রের ব্যাখ্যা করতে হলে প্রথমে পদচ্ছেদ অর্থাৎ সূত্রে কয়টা পদ আছে, তা স্পষ্টভাবে বলতে হবে। পদচ্ছেদের পর কোন পদের কী অর্থ, তার নির্দেশ; সূত্রস্থ পদের বিগ্রহ অর্থাৎ সমস্তপদের ব্যাসবাক্যে বিন্যাস; সূত্রস্থ পদগুলির বাক্যযোজনা অর্থাৎ সমস্ত বাক্যটার বা সূত্রটার অন্বয় (এক পদের সঙ্গে অন্য পদের সম্বন্ধ); বাক্যগঠনকারী পদগুলির অর্থ এবং সেগুলির মধ্যকার সম্বন্ধ প্রদর্শন করা; আক্ষেপের সমাধান অর্থাৎ সম্ভাব্য আপত্তি বা আশঙ্কার সম্যক প্রকারে নিরাকরণ—সূত্রের ব্যাখ্যা করতে হলে এই পাঁচটা লক্ষণ থাকা প্রয়োজন।




সকল ব্যাখ্যাগ্রন্থে সবসময় সমভাবে ওই পাঁচটা বিষয় বর্ণনা করা থাকে না। বাক্যযোজন দ্বারা পদচ্ছেদের কাজটি সম্পন্ন হয় বলে অনাবশ্যক বিবেচনায় প্রায় সব জায়গায় পদচ্ছেদ উপেক্ষিত হয়েছে। ব্যাখ্যাকারকগণ ক্ষেত্রবিশেষে পদের অর্থ নির্দেশ করেছেন বটে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পদের অর্থ আলাদা আলাদাভাবে নির্দেশ করেননি; বরং বাক্যযোজনাগুলিকেই পদের অর্থ বলা হয়েছে। তাঁরা আক্ষেপের সমাধানের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে একাধিক কল্প বা প্রণালী নির্দেশ করে থাকেন। যে-ক্ষেত্রে অনেক কল্প নির্দিষ্ট হয়, সেক্ষেত্রে সচরাচর শেষ কল্পই সমীচীন, আগের কল্পগুলি কিছুটা দোষদুষ্ট বা আপত্তিযোগ্য। এসব ব্যাখ্যা বৃত্তি, ভাষ্য, বার্তিক, টীকা, টিপ্পনী প্রভৃতি নানা ভাগে বিভক্ত। সূত্রের অর্থবিবরণ বিশদভাবে বর্ণনা করার নাম বৃত্তি। সূত্রানুসারিপদ দ্বারা যে-গ্রন্থে সূত্রের অর্থ এবং পদগুলি বর্ণিত হয়, তাকে ভাষ্য বলে। সূত্রের বিস্তৃত ব্যাখ্যাকে বার্তিক বলে। সূত্র বা ভাষ্যের অর্থ বিশদ করার জন্য আদ্যন্ত ব্যাখ্যা, বিবৃতি বা ব্যাখ্যান‌ই টীকা। সূত্রের বিশেষ অংশ সম্পর্কে ব্যাখ্যাকে টিপ্পনী বলে।




সূত্রনিবদ্ধ ষড়্‌দর্শনশাস্ত্র (কপিল মুনির সাংখ্য, মহর্ষি পতঞ্জলির যোগ, মহর্ষি গৌতমের ন্যায়, মহর্ষি কণাদের বৈশেষিক, মহর্ষি জৈমিনির পূর্বমীমাংসা বা মীমাংসা এবং ঋষি বাদরায়ণের উত্তরমীমাংসা বা বেদান্ত) আকারে ছোটো, তবে সেগুলি বোঝা কঠিন। সাংখ্যসূত্র দর্শনে পুরুষ ও প্রকৃতির দ্বৈতবাদী তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। যোগসূত্র দর্শন একজন ব্যক্তি-ঈশ্বরের ধারণাকে গ্রহণ করে এবং যোগানুশীলনের (ধ্যান, সমাধি ও কৈবল্য) উপর গুরুত্ব আরোপ করে। ন্যায়সূত্র দর্শনে ‘প্রমাণ’ বা জ্ঞানের উৎসের (কর্মবাদ) প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বৈশেষিকসূত্র দর্শন পরমাণুবাদের একটি অভিজ্ঞতাবাদী শাখা। মীমাংসাসূত্র দর্শন বেদের পূর্বকাণ্ড বা কর্মকাণ্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে একে ‘পূর্ব-মীমাংসা’-ও বলা হয়। ব্রহ্মসূত্র দর্শন উপনিষদের উপর অর্থাৎ বেদের জ্ঞানকাণ্ড বা উত্তরকাণ্ডের উপর সাক্ষাৎভাবে প্রতিষ্ঠিত বলে একে ‘উত্তর-মীমাংসা’-ও বলা হয়।




শাস্ত্রগুলির সূত্রের বৃত্তি, ভাষ্য, বার্তিক, টীকা, টিপ্পনী প্রভৃতি আকারে বড়ো এবং সংস্কৃত ভাষায় লেখা বিধায় সবাই সহজে বোঝে না। শাস্ত্রের প্রমাণানুসারে যা নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করা হয়, তাকে সিদ্ধান্ত বলে। কোনো অনিশ্চিত বিষয়ে শাস্ত্রনির্ধারিত প্রমাণ দ্বারা পরীক্ষা করে শাস্ত্রানুরূপ উপসংহারে আসাকে সিদ্ধান্ত বলে। কী করলে দুঃখ দূর হয়, এমন প্রশ্ন উঠলে দুঃখের কারণ কী, কোন উপায় অবলম্বন করলে ওই কারণের নিবৃত্তি হয়, ইত্যাদি বিষয় শাস্ত্রানুসারে পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত হলো যে, অপবর্গ অর্থাৎ মুক্তিলাভ করলে দুঃখ দূর হয়। এটাই সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্তের একাংশ অবলম্বন করে যে-গ্রন্থে আলাদাভাবে বা মৌলিকভাবে অধিকতর অর্থের নিরূপণ করা হয়, তাকে প্রকরণগ্রন্থ বলে। সাধারণ মানুষ মূলত স্বল্পায়তন প্রকরণগ্রন্থের অনুবাদের উপর ভর করে দর্শনশাস্ত্রের গভীরতম প্রদেশে প্রবেশ করে।




এসব গ্রন্থ মূলশাস্ত্রের একাংশ নিয়ে নূতন নূতন যুক্তি দ্বারা শাস্ত্রের মূলসুরটিকেই সহজ অবয়বে প্রতিষ্ঠিত করে। ফলে এই প্রকরণ গ্রন্থগুলির সাহায্যে 'আকর' শাস্ত্রগুলির মূলসুরে যথার্থভাবে প্রবেশ করা যায়।




মানসিক বৃত্তিসমূহের চর্চার সহায়ক হিসেবেই অধিকাংশ বেদান্ত-প্রকরণ গ্রন্থ রচিত। ‘দৃগ্ দৃশ্য বিবেক’ গ্রন্থের রচনায় গ্রন্থকার সেই উদ্দেশ্যকেই বিশেষভাবে মাথায় রেখেছেন। মুক্তির ইচ্ছায় উন্মুখ চিত্তকে সব অবস্থায় কীভাবে সমাধিপ্রবণ রাখা যেতে পারে, সে উদ্দেশ্যে গ্রন্থকার মাত্র ৪৬টি শ্লোকে তার উপায় নির্ধারণ করেছেন। মুমুক্ষু চিত্তে বৈরাগ্য ও মুমুক্ষা সুপ্রতিষ্ঠিত হলে, এই ভাবনাপ্রধান উপায়গুলি অবলম্বন করলে সাধারণ মানুষের পক্ষে চিত্তের উৎকর্ষসাধন সহজ হবে।




‘দৃগ দৃশ্য বিবেক’ গ্রন্থটি ‘বাক্যসুধা’ নামেও পরিচিত। শ্রীমদ্‌ভারতীতীর্থের লেখা এই গ্রন্থের টীকা রচনা করেছেন তাঁর‌ই শিষ্য শ্রীমদ্‌ব্রহ্মানন্দভারতী। গ্রন্থের বিষয়বস্তু বোঝার জন্য টীকাকারের প্রাথমিক আলোচনা বিশেষ ভূমিকা রাখে।




যস্মাৎ সর্বং সমুৎপন্নং চরাচরমিদং জগৎ।
ইদং নমো নটেশায় তস্মৈ কারুণ্যরূপিণে।। ১




যা হতে বিদ্যমান চরাচর, জঙ্গম ও স্থাবরের সঙ্গে অর্থাৎ স্থাবর-জঙ্গমাত্মক অথবা ব্যক্ত-অব্যক্তক এই সমগ্র জগৎ উৎপন্ন হয়েছে এবং যিনি জীবরূপ ধারণ করে স্বাত্মভূত আনন্দকে করুণার আকারে প্রকটিত করেন, সেই নটরাজকে আমার এই প্রণাম।




‘স্বাত্মভূত আনন্দ’। তৈত্তিরীয় উপনিষদে (২/১/২) ব্রহ্মের লক্ষণ পাচ্ছি: “সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম।” অর্থাৎ “ব্রহ্ম সত্য জ্ঞানস্বরূপ এবং অনন্ত।” এই বাক্যটি ব্রহ্মের লক্ষণ। ‘সত্য’ অর্থ যা যে-রূপে নিশ্চিত বা প্রকটিত হয়, সেই রূপটিকে পরিত্যাগ করে নিজের মতো করে ভেবে না নেওয়া; ‘জ্ঞান’ অর্থ জ্ঞাত হ‌বার ভাব বা অনুভবমাত্র, জ্ঞানের কর্তা নয়; ‘অনন্ত’ অর্থ দেশ, কাল ও বস্তুর দ্বারা অপরিচ্ছিন্ন (অন্ত বা ছেদ ঘটানো হয়নি, এমন)। এই তিনটিই ব্রহ্মের বিশেষণ এবং তিনটিই পৃথকভাবে ব্রহ্মে অন্বিত বা সম্পর্কযুক্ত হবে। বিশেষণ বিশেষ্যকে অপর বস্তু হতে পৃথক করে দেখায়। ‘সত্য’ শব্দটি বিকারী বা কল্পিত বস্তু হতে পৃথক করে ব্রহ্মকে সকলের অবিকারী বা আদি ও স্থির তথা নিত্য সত্তার কারণরূপে নির্দেশ করছে, অর্থাৎ দেশ, কাল ও বস্তুর দ্বারা ব্রহ্মের উৎপত্তি বা বিনাশ হয় না, কোনো কালেই তাঁর অভাব (অনস্তিত্ব) হয় না। ‘জ্ঞান’ শব্দ কর্তৃত্বের (তাঁর মধ্যে পূর্ণরূপে অজ্ঞানের অভাব) ও ‘অনন্ত’ শব্দ সসীমত্বের নিষেধ (দেশ, কালের সীমাতীত) বা সমাপ্তি নির্দেশ করছে। ব্রহ্ম জ্ঞানবান নন, জ্ঞানস্বরূপ; সত্তাবান নন, সত্তাস্বরূপ। মোট কথা, এখানে সেটা, ওখানে নয়; এখন সেটা, তখন নয়; এটা, তাই ওটা নয়—এই তিনটা কথা তাঁর সম্বন্ধে আদৌ খাটে না।




এই বর্ণনার রহস্য বুঝে নিলে ঈশাবাস্যোপনিষদের প্রথম মন্ত্রে সাধকের জন্য প্রদত্ত উপদেশার্থও স্পষ্ট হয়। সেখানে বলা হয়েছে: “এই ব্রহ্মাণ্ডে যা-কিছু জড়-চেতনরূপে জগতে দৃশ্যমান, তা ঈশ্বরময়। ওই ঈশ্বরকে নিরন্তর চিন্তা করে ত্যাগের মাধ্যমে আবশ্যক বিষয়ের সেবন করা উচিত।” সাধকের জন্য যে-উপদেশ সেখানে প্রদত্ত হয়েছে, তা-ই এখানে সিদ্ধ মহাত্মার জন্য বলা হয়েছে। “তিনি ব্রহ্মের সাথে সব ভোগের অনুভব করেন”—এ কথার অভিপ্রায় এই যে, ঈশ্বরপ্রাপ্ত সিদ্ধ পুরুষ ইন্দ্রিয়সমূহ দ্বারা বিষয়সমূহের সেবন করতে করতেও স্বয়ং সদা ঈশ্বরেই স্থিত থাকেন। তাঁর মন, বুদ্ধি এবং ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার, তা কর্তৃক সমস্ত চেষ্টা পরমাত্মাতে অবস্থানরত থেকেই সম্পন্ন হয়। প্রয়োজনানুসারে ইন্দ্রিয় দ্বারা বিষয়ের যথাযোগ্য উপভোগকালেও তিনি একমুহূর্তও পরমাত্মা থেকে বিচ্যুত হন না (গীতা, ৬/৩১)। অতএব, তিনি সর্বদাই সমস্ত কর্মে নির্লিপ্ত থাকেন।




ব্রহ্ম তাই ‘অনন্ত’। এই ‘অনন্ত’ শব্দের অর্থ দ্বারাই ব্রহ্মের আনন্দরূপতা সিদ্ধ হলো, কেননা ছান্দোগ্য উপনিষদে (৭/২৩/১) সনকাদিগুরু নারদকে উপদেশ দিচ্ছেন: যা ভূমা (পরিপূর্ণ), তা-ই সুখ। অল্পে (পরিচ্ছিন্ন বস্তুতে) সুখ নেই, ভূমাই সুখ। স্বাত্মভূত আনন্দ তাই অনন্তরূপ ভূমা, যা ব্রহ্মা করুণার আকারে প্রকাশ করেন।




‘নটরাজ’। কোনো অভিনেতা কুমোরের কাজ করতে চাইলে তাকে মাটির জন্য অন্যের দ্বারস্থ হতে হয়, কিন্তু পরমব্রহ্ম জগৎকর্তার কাজ করতে চাইলে জগতের নানান উপাদানের জন্য কারও দ্বারস্থ হন না। তিনি মাকড়সার মতো—একাই নিমিত্ত বা কর্তা ও উপাদান। তাই তিনি নটরাজ বা অভিনয়ের (নাটকের) রাজা। আবার জগৎকর্তাই যখন সচ্চিদানন্দস্বরূপ অদ্বৈততত্ত্ব, তখন জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় লীলার প্রত্যেক কাজই তাঁর স্বরূপভূত আনন্দের অভিব্যঞ্জক বা প্রকাশক। তিনি স্বকীয় মায়া দ্বারা, তাঁর সৃষ্ট জীবকে জগৎকর্তা হতে, নিজেকে পৃথক মনে করাচ্ছেন বলে, জীব নিজের অনুকূল কাজকে জগৎকর্তার করুণা বলে মনে করে। বস্তুত জগৎকর্তা নিজের রূপ থেকে উৎপন্ন আনন্দকেই, জীবের দৃষ্টিতে, কৃপারূপে প্রকাশ করেন। এ কারণেই তিনি নটরাজ।




আরও ভেঙে বলা যাক। কারও চোখে হঠাৎ ময়লা উড়ে এসে পড়লে তার নিজের হাত আপনাআপনিই সেই ময়লা সরিয়ে ফেলার জন্য প্রবৃত্ত হয়। আত্মপ্রীতিই এর কারণ। হাত সেই কাজে সক্ষম হলে, ওই ব্যক্তি হাতের ‘দয়া’ অনুভব করে হাতের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, কেননা সে হাতকে নিজের থেকে অভিন্ন বলে জানে; আবার হাত সেই কাজ করতে অক্ষম বা ব্যর্থ হলে, সেই একই ব্যক্তিই যখন অন্য কারও সাহায্যে নিজের চোখ থেকে ময়লাটা সরিয়ে ফেলে এবং সেই উপকারীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, আর তখন ভেদবুদ্ধির কারণেই অর্থাৎ উপকৃত ব্যক্তির উপকারীকে নিজের থেকে পৃথক মনে করার কারণে সেই আত্মপ্রীতিই অন্যদেহে কৃপা-রূপ ধারণ করে।




জীবকে কর্তা ও ভোক্তা রূপে ভুলিয়ে তিনি নিজের লীলার বিস্তার করছেন। ঠিক একই দৃষ্টিতে সেই নটরাজই শঠরাজ, বস্তুত নাটক ও শঠতা উভয়েই প্রতারণামূলক, তাই ‘নটরাজ’ শব্দ ব্যবহার করায় সৃষ্টিকর্তার ‘শঠতার’ উপরও কটাক্ষ করা হয়েছে। বিষ্ণুর হাজার নামের মধ্যে ‘সুচতুর’ অন্যতম। সেই কটাক্ষও, অজ্ঞ ও দুঃখী জীবের প্রতি সমবেদনার পরিচায়ক এবং জীবকে উপদেশ শুনতে প্ররোচিত করে। ‘এই প্রণাম’ শব্দগুচ্ছ অদ্বৈতবাদীদের অনুমোদিত অভেদচিন্তনাত্মক প্রণাম নয়, বরং এটা সাষ্টাঙ্গ প্রণামের অভিনয়সূচক। (জীব তথা সব কিছুই যখন ব্রহ্মের প্রতিভূ, তখন এই প্রণাম নিঃসন্দেহে ব্রহ্মের‌ই অভিনয় প্রকাশ করে।)




কারণং খাদিজগতাং তারণার্থমনাগসাম্।
বারণানন মাত্মান মদ্বয়ং সমুপাস্মহে।। ২




যে অদ্বিতীয় আত্মা আকাশাদি জগতের কারণ, তিনিই (স্বকীয় অনন্ত শক্তির মধ্যে বিঘ্নবিধ্বংসিনী শক্তিকে আশ্রয় করে) গজানন বা গণেশ রূপে আবির্ভূত। নিষ্পাপ মুমুক্ষুগণের উদ্ধারের জন্য আমরা তাঁর উপাসনা করি।




‘অদ্বিতীয় আত্মা’। একমাত্র চেতন বা চৈতন্য বা আত্মাই সত্য বস্তু; এটা বাদে আর সবই মিথ্যা—এটাই সিদ্ধান্ত। যিনি এর প্রতিবাদ করেন, তিনি প্রতিবাদী এবং তিনিও সিদ্ধান্তী। তিনি তাঁর নিজের ও প্রথম সিদ্ধান্তীর প্রতীত বা (মিথ্যা বা অনুমিত) জ্ঞানযুক্ত কোনো বস্তু সম্বন্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করেন—এটা সত্য, না কি মিথ্যা? তার উত্তরে প্রথম সিদ্ধান্তী বলেন: প্রতীত হচ্ছে বলে ওটাকে মিথ্যা বলতে পারি না বটে, তবে ওটাকে সত্য বলেও মানি না। এক কথায় উত্তর চাও? তবে ‘সত্য’ বা ‘মিথ্যা’, কিছুই না বলে বলব ‘অনির্বচনীয়’ (বর্ণনার অতীত বা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না, এমন); কিন্তু মনে মনে ঠিকই বুঝি, ওটা মিথ্যা, কেননা বিচারে বা যুক্তিতে ওটাকে পাই না। গন্ধর্বনগর গন্ধর্বলোক বা মরীচিকার মতো সকল মায়া বা প্রপঞ্চই সতত পরিবর্তনশীল দৃষ্ট-নষ্ট স্বভাব জগৎ—সত্য কেবল চেতনই—এর উপর আকাশাদি সকল মায়া বা প্রপঞ্চ অধ্যস্ত (এক বস্তুতে অন্য বস্তুর বা তার গুণের কল্পনা আরোপিত) রয়েছে মাত্র।




‘নিষ্পাপ মুমুক্ষু’। জীবের পাপ বা দোষ তার অন্তঃকরণকেই আশ্রয় করে থাকে এবং সেই অন্তঃকরণে তিন মূর্তিতে দেখা দেয়—মল, বিক্ষেপ ও আবরণ। মনের মধ্যে অপরের অনিষ্ট চিন্তা করা তথা আত্মায় পাপের সংস্কার পড়াকে মল বলে। সদাসর্বদা বিষয়চিন্তন অথবা মনকে সদা চঞ্চল রাখাকে বিক্ষেপ বলে। জগতের যাবতীয় নাশবান বা অনিত্য পদার্থের অভিমান বা অহংকার মনের উপর পর্দার মতো পড়ে থাকাকে আবরণ বলে। যিনি নিষ্কাম কর্ম দ্বারা মল দোষ, উপাসনা দ্বারা বিক্ষেপ দোষ দূর করে কেবল আবরণ দোষ নিয়ে মোক্ষলাভে তৎপর হয়েছেন, তিনিই নিষ্পাপ মুমুক্ষু।




‘আমরা’। এই অংশে অভিপ্রায় এই যে, গুরু ও শিষ্য উভয়েই যেন নির্বিঘ্নে এই ব্রহ্মবিদ্যার দান ও গ্রহণ করতে পারেন। এখানে ‘আমরা’ অর্থ ‘গুরু ও শিষ্য উভয়ের’ (ইচ্ছা বা অভিপ্রায়)—বহুবচন নির্দেশক।




পরাপশ্যন্ত্যাদিদেহাং প্রণতাভীষ্টদায়িনীম্।
সত্যজ্ঞানানন্দরূপাং ধ্যায়ে হ্যাদ্যাং সরস্বতীম্।। ৩




পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা ও বৈখরী, এই চার প্রকার বাণী যাঁর দেহ, অর্থাৎ যে ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী সরস্বতী ব্রহ্মবিদের জাগ্রৎ, স্বপ্ন, সুষুপ্তি ও সমাধি অবস্থায় যথাক্রমে বৈখরী, মধ্যমা, পশ্যন্তী ও পরা, এই চার প্রকার বাণীতে অভিব্যক্ত হয়ে, প্রণত মুমুক্ষুজনের মনস্কামনা পূর্ণ করে থাকেন এবং যিনি ব্রহ্মের জ্ঞানশক্তিরূপে শক্তিমান সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম হতে অভিন্ন, আমি সেই পরাবিদ্যারূপিণী সর্ববিদ্যাপ্রতিষ্ঠা সরস্বতীকে ধ্যান করি।




মল্লিনাথ কর্তৃক কুমারসম্ভব টীকায় (২/১৭) উদ্ধৃত হয়েছে:
বৈখরী শব্দনিষ্পত্তি মধ্যমা শ্রুতিগোচরা।
দ্যোতিতার্থ্য তু পশ্যন্তী সূক্ষ্মাবাগনপায়িনী।।




জাগ্রদবস্থায় সকল জীব শুনতে পায়, এমন শব্দোচ্চারণ বৈখরীবাণী; স্বপ্নাবস্থায় কেবলমাত্র স্বপ্নদ্রষ্টার শ্রুতিগোচর শব্দ মধ্যমা; সুষুপ্তাবস্থায় (শব্দ না করে) সুখ ও অজ্ঞান নামক সত্তার প্রকাশক বাণী পশ্যন্তী; সমাধিঅবস্থায় চৈতন্যরূপিণী নিত্যবাণী পরা।




‘বাণী’। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “পঞ্চভূত লয়ে যে-দেহ, সেইটি স্থূলদেহ। মন, বুদ্ধি, অহংকার আর চিত্ত, এই লয়ে সূক্ষ্ম শরীর। যে শরীরে ভগবানের আনন্দলাভ হয়, আর সম্ভোগ হয়, সেইটি কারণ শরীর। তন্ত্রে বলে, ‘ভগবতী তনু।’ সকলের অতীত ‘মহাকারণ’ (তুরীয়) মুখে বলা যায় না।” (কথামৃত, ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ) কারণ, সূক্ষ্ম ও স্থূল, এই তিন ভেদে শরীর তিন প্রকার। শ্রীমতী মৃণালিনী বসুকে লিখিত পত্রে স্বামী বিবেকানন্দ লিখছেন, “অনেকগুলি ব্যক্তির একত্র নাম ‘সমষ্টি’, এক-একটির নাম ‘ব্যষ্টি’, তুমি আমি ‘ব্যষ্টি’, সমাজ ‘সমষ্টি’। তুমি আমি পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ বৃক্ষ লতা পৃথিবী গ্রহ নক্ষত্রাদি এক একটি ‘ব্যষ্টি’, আর এই জগৎটি ‘সমষ্টি’ — বেদান্তে ইহাকেই বিরাট বা হিরণ্যগর্ভ বা ঈশ্বর বলে।” চেতনার তিনটি স্তর হলো—বিশ্ব বা বৈশ্বনার বা জাগ্রত পর্যায় পৃথক স্থূল শরীর দ্বারা চিহ্নিত; তৈজস বা স্বপ্নচেতনা, যার বস্তু হিসাবে সূক্ষ্ম শরীর রয়েছে; এবং প্রজ্ঞা বা গভীর নিদ্রা চেতনা, যা একীভূত অবিভেদ্য চেতনা বা প্রজ্ঞানঘন ও আনন্দময় কার্যকারক দেহের বৈশিষ্ট্য, ব্রহ্মের চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা। সমষ্টি ও ব্যষ্টি শরীরের যথাক্রমে সুষুপ্তি, স্বপ্ন ও জাগ্রৎ নামক তিন অবস্থা আছে, এবং সর্বোপরি পরিণামাতীত বা তুরীয় নামক এক অবস্থা আছে।




মাণ্ডূক্য উপনিষদের সপ্তম শ্লোকে তুরীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ছান্দোগ্য উপনিষদের ৮/৭ থেকে ৮/১২ পর্যন্ত শ্লোকে ‘চেতনার চারটি অবস্থা’ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যেমন জাগ্রত, স্বপ্নে ভরা ঘুম, গভীর ঘুম ও গভীর ঘুমের বাইরে। একইভাবে, বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৫/১৪/৩ শ্লোকে তুরীয় রাজ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন, মৈত্রী উপনিষদ করেছেন ৬/১৯ ও ৭/১১ শ্লোকে। মাণ্ডূক্য উপনিষদের সপ্তম শ্লোক তুরীয়কে বর্ণনা করে:




নান্তঃপ্ৰজ্ঞং ন বহিঃপ্ৰজ্ঞং নোভয়তঃপ্রজ্ঞং ন প্রজ্ঞানঘনং ন প্রজ্ঞং নাপ্রজ্ঞম্। অদৃষ্টমব্যবহার্যমগ্রাহ্যমলক্ষণমচিন্ত্যম্ অব্যপদেশ্যমেকাত্মপ্রত্যয়সারং প্রপঞ্চোপশমং শান্তং শিবমদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে। স আত্মা। স বিজ্ঞেয়ঃ।।




যেহেতু ‘নিখিল’ শব্দ আত্মা হতেই প্রবৃত্ত হয়, অতএব তিনি সমস্ত কার্যভূত শব্দের অতীত। এজন্য সমস্ত বিশেষ-প্রতিষেধপূর্বক নির্বিশেষ তুরীয় বিষয় বলা হচ্ছে]-অন্তঃ-প্রজ্ঞম্ ন (ইনি অন্তরে অনুভূতি করেন না, অর্থাৎ তৈজস নন), বহিঃ-প্রজ্ঞম্ ন (বাহ্য বিষয়ে অনুভূতি করেন না, অর্থাৎ বিশ্ব নন) উভয়তঃ-প্রজ্ঞম্ ন (জাগ্রৎ ও স্বপ্নের মধ্যাবস্থায় অনুভূতিসম্পন্ন নন), ন প্রজ্ঞান-ঘনম্ (প্রাজ্ঞ নন), ন প্রজ্ঞম্ (যুগপৎ সর্ববিষয়ের জ্ঞাতা নন), ন অপ্রজ্ঞম্ (অচৈতন্য নন)] [ইনি] অদৃষ্টম্ (অদৃষ্ট) অব্যবহার্যম্ (‘এটা অমুক’, এভাবে বলার বা ব্যবহারের অযোগ্য), অগ্রাহ্যম্ (কর্মেন্দ্রিয়ের অগ্রাহ্য), অলক্ষণম্ (অননুমেয়) অচিন্ত্যম্ (চিন্তার অতীত), অব্যপদেশ্যম্ (শব্দের দ্বারা অনির্দেশ্য), একাত্ম-প্রত্যয়সারম্ (সর্বাবস্থায় একই আত্মা আছেন, এমন প্রত্যয়ের দ্বারা অনুসন্ধেয়, অথবা কেবল ‘আত্মা’—এই প্রকার প্রতীতির গম্য) প্রপঞ্চোপশমম্ (জাগ্রদাদি মায়া বা প্রপঞ্চের বিরাম স্থান), শান্তম্ (অবিক্রিয়) শিবম্ (মঙ্গলময়) অদ্বৈতম্ (ভেদ-বিকল্প-রহিতক) চতুর্থম্ (তুরীয়) মন্যন্তে (মনে করে থাকেন)। সঃ (তিনি) আত্মা (আত্মা), সঃ বিজ্ঞেয়ঃ (তাঁকেই জানতে হবে)।




তিনি বহির্বিষয়ের জ্ঞাতা নন, অন্তর্বিষয়ের জ্ঞাতাও নন, জাগ্রত ও স্বপ্নাবস্থার মধ্যবর্তীও নন। তিনি সুষুপ্ত অবস্থায় প্রজ্ঞানঘন নন, সর্বজ্ঞ নন, অচৈতন্যও নন। তিনি দৃষ্টির অগোচর, লৌকিক ব্যবহারের অতীত, ইন্দ্রিয়গণের অগ্রাহ্য, অনুমানের অযোগ্য, মনের অগোচর, প্রমাণের অতীত। কেবলমাত্র আত্মারূপে ইনি অনুভবযোগ্য, জগৎ চরাচর হতে ভিন্ন, শান্ত, শিব ও অদ্বিতীয়। এঁকে চতুর্থ বা তুরীয় বলে বিবেকীগণ মনে করে থাকেন। ইনিই আত্মা; এঁকেই জানতে হবে।




এখানে আত্মার চতুর্থ বা তুরীয় পাদের কথা অর্থাৎ পরব্রহ্মের কথা বলা হয়েছে। ঋষিগণ যাঁকে নির্গুণ ব্রহ্ম বলে থাকেন, সেই ব্রহ্মের বিবরণ এখানে দেওয়া হয়েছে। আত্মার এই চতুর্থ পাদ অন্যান্য তিন পাদ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। সেই পরব্রহ্মের স্বরূপ এখানে বলা হচ্ছে—তিনি অন্তঃপ্রজ্ঞ অর্থাৎ তৈজস নন। তিনি বহিঃপ্রজ্ঞ বা বৈশ্বানর নন। জাগ্রত ও স্বপ্নের অন্তর্বর্তী জ্ঞানসম্পন্নও নন। তিনি প্রজ্ঞানঘন বা প্রাজ্ঞ নন। তিনি সকল বিষয়ের জ্ঞাতাও নন, আবার চেতনাহীনও নন। তিনি অদৃশ্য—এই চক্ষু দ্বারা তাঁকে দেখা যায় না। তাঁকে কোনো কর্মেন্দ্রিয় দ্বারা গ্রহণ করা যায় না, মন দিয়ে তাঁকে চিন্তা করা যায় না, বাক্য দ্বারাও তাঁকে সম্পূর্ণরূপে বর্ণনা করা যায় না।




“যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ।” (তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ২/৪) [যতঃ-যেখান থেকে; মনসা সহ-মনের সাথে; বাচঃ-বাণী আদি ইন্দ্রিয়সমূহ; অপ্রাপ্য-তাঁকে না পেয়ে; নিবর্তন্তে-প্রত্যাবর্তন করে]




সাধক সাধনার শেষ অবস্থায় নির্বিকল্প সমাধিতে সেই আত্মাকে বা পরব্রহ্মকে অন্তরে অনুভব করেন মাত্র। সেজন্য ভগবান শঙ্করাচার্য সেই পরব্রহ্মের কথা বলেছেন—আত্মার একটি অনুভূতি মাত্র সমাধিতে অনুভব করা যায়। সেই সমাধিতে জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞানের কোনো বিভিন্নতা থাকে না; তখন জগতের অস্তিত্ব লোপ পায় এবং সমস্ত দ্বৈতভাব দূর হয়। তখন তিনি শান্ত, শিব, অদ্বৈত। তাঁকে চতুর্থ বা তুরীয় বলা হয়। নির্বিকল্প সমাধিতে সেই আত্মাকে বা পরব্রহ্মকে এইরূপে উপলব্ধি করাই হলো সাধকের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।




নির্বিকল্প সমাধি বা অহংবোধ ব্যতিরেকে আত্মমগ্নতা হলো একটি নিমজ্জিত মানসিক অবস্থা, যেখানে আত্ম-চিত্তবৃত্তি এমন পর্যায়ে উন্নীত হয় যে, জ্ঞাতৃজ্ঞেয়ত্বভেদ রহিত হয়; ঠিক যেমন ঢেউ জলে বিলীন হয়, ফেনা সমুদ্রে মিশে যায়। অন্যান্য সমাধি অবস্থা থেকে এর পার্থক্য এই যে, এই সমাধিতে নিম্নস্থ কোনো চেতনায় প্রত্যাবর্তনের সুযোগ নেই। তাই এই সমাধিই একমাত্র সত্য সর্বশেষ জ্ঞান। ধ্যান মনকে অতীন্দ্রিয় আত্ম-চৈতন্যে উন্নীত করে এবং একটি স্বাভাবিক ও কার্যকারণবোধযুক্ত ক্রিয়া মনের এই অতীন্দ্রিয় দিব্য প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়। মন যখন ক্রিয়াক্ষেত্রে নিযুক্ত, তখনও সেই ভাব বিলুপ্ত হয় না। এইভাবেই আত্মচৈতন্যবোধ বিশ্বচৈতন্যবোধে উন্নীত হয়—আত্মানন্দ থেকে ব্রহ্মানন্দে, সবিকল্প থেকে নির্বিকল্পে—সবশেষে যোগাবস্থায় বিশ্বচৈতন্যবোধ ঈশ্বরচৈতন্যবোধে পরিপূর্ণতা লাভ করে। জ্ঞানের প্রথম আলো তার পূর্ণ গৌরবে উপনীত হয়।




শরীরের মতো শব্দেরও সুষুপ্তি, স্বপ্ন ও জাগ্রদবস্থায় যথাক্রমে পশ্যন্তী, মধ্যমা ও বৈখরী নামক তিনটি ভাব আছে। পরা নামক এক নির্বিশেষ ভাব হতে পশ্যন্তী বিনির্গত হয়, অর্থাৎ এই পরাই শব্দের পশ্যন্তী ভাবের কারণাবস্থা। পরা অবস্থা একেবারে নিষ্পন্দ, তারই সস্পন্দাবস্থা পশ্যন্তী। মধ্যমা হচ্ছে হিরণ্যগর্ভ শব্দ। এই সূক্ষ্ম শব্দ ও তার অনুরূপ সকল অর্থ লিঙ্গশরীরেরই আশ্রিত। (লিঙ্গশরীর বা জীবাত্মা। মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার — এ চারিটি জড়িয়ে লিঙ্গশরীর।~~শ্রীরামকৃষ্ণ) সৃষ্টিকালে জগৎস্রষ্টার মন হতে প্রথমে পশ্যন্তী শব্দ ও তার অনুরূপ সকল অর্থ বিনির্গত হয়। তারপর সৃষ্টিকর্তা সেই সূক্ষ্ম অর্থকে ইন্দ্রিয়ের অনুভবাধীন জগতে নিক্ষেপ করেন এবং কণ্ঠ হতে উৎপন্ন মুখ থেকে নির্গত উচ্চারিত শব্দে সেই অর্থের নামকরণ করেন। সেটিই বৈখরী বা বিরাট শব্দ। সেই শব্দ এবং তার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অর্থ স্থূল শরীরেরই আশ্রিত। এই শেষোক্ত স্থূল শব্দই ভাষা অর্থাৎ বাক্য, পদ ও বর্ণ—যা দ্বারা মনের ভাব ও মন্ত্র প্রকাশিত হয়। পশ্যন্তী শব্দের স্বরূপ বিবেচনায় আনলে তা সামান্য বা নির্বিশেষ স্পন্দন অর্থাৎ শব্দ দ্বারা সৃষ্ট অভিব্যক্তির উপক্রমে বায়ুর প্রথম অবিস্পষ্ট বা অস্পষ্ট তাড়ন। মধ্যমা মূলত বিশেষ ধরনের শব্দ; এতে বায়ু বিশেষ আকার ধারণ করতে আরম্ভ করে। বৈখরী স্পষ্টতর শব্দ, অর্থাৎ উচ্চারিত বাণীর পৃথক পৃথক পরিস্ফুট শব্দ।




চিৎশক্তিরই নামান্তর‌ই ‘পরা’ অর্থাৎ ‘পরাবাক্’। চৈতন্যের আভাস পেয়ে মায়া একে প্রকাশ করে বটে, কিন্তু একে স্পন্দিত করতে পারে না। শব্দের বাকি তিনটি বাণীই সস্পন্দাবস্থা। পশ্যন্তী বাণী বিন্দুতত্ত্বাত্মিকা।




সৃষ্টি করতে উদ্যতাবস্থাকে বিন্দু বলে। প্রথম উৎপাদিত স্পন্দকে নাদ বলে। নাদ ও বিন্দু উভয়ই শক্তির অবস্থা বিশেষ—যে-অবস্থার ‘ক্রিয়া শক্তি’ বিকাশোন্মুখ হয়ে অধিক পরিমাণে অঙ্কুরিত হবার মতো হয় এবং তার ফলে শক্তির ঘনীভূতাবস্থা হয় এবং সৃষ্টি বিষয়ে প্রবৃত্তি জন্মে। শক্তির ঘনাবস্থাকে বিন্দু বলে।




পশ্যন্তী বাণী ‘সামান্যপ্রস্পন্দপ্রকাশরূপিনী’ অর্থাৎ এই স্পন্দের কোনো বিশিষ্টরূপ নেই। এটা মূলাধার হতে আরম্ভ করে নাভি পর্যন্ত স্থানে অভিব্যক্ত হয়। এটা জ্ঞানাত্মিকা (গীতার ১৩/৬ শ্লোকে চেতনাকে জ্ঞানাত্মিকা মনোবৃত্তি বলা হয়েছে) বলে এর নাম পশ্যন্তী। এর সঙ্গে মন থাকে বলে এটা মনের সহযোগিতা পায়।




মধ্যমা বাণী নাদবিন্দুময়ী। এটা হিরণ্যগর্ভ শব্দ—নাভি হতে হৃদয় পর্যন্ত স্থানে অভিব্যক্ত হয়। এতে নানান বিশেষ সঙ্কল্পের তত্ত্ব বিজড়িত থাকে। এই বাণীর নাম মধ্যমা, কেননা বুদ্ধি তখন মধ্যমা অর্থাৎ মধ্যমাবস্থায় থাকে। মধ্যমা শব্দের অর্থ মধ্যবর্তিনী—পশ্যন্তী ও বৈখরীর মধ্যবর্তিনী। পশ্যন্তী ঈক্ষণার বা আলোচনার অবস্থা এবং বৈখরী উচ্চারণাবস্থা। সেই মধ্যমা বাণী পশ্যন্তীর মতোও নয়, কিংবা বৈখরীর মতো সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়ে বহির্গত‌ও হয় না, কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যম অবস্থাসপন্ন। বৈখরী বীজাত্মিকা, মধ্যমা নাদরূপিণী এবং পশ্যন্তী বিন্দু-আত্মিকা। হৃদয় হতে আরম্ভ করে মুখ পর্যন্ত স্থানে বৈখরী বাণী অভিব্যক্ত হয়। ‘সারদাতিলক’ তন্ত্রের টীকাকার রাঘব বলেন, বিশেষ খরত্বের কারণে এই বাণীর নাম বৈখরী হয়েছে। ‘ললিতাসহস্রনামস্তোত্রম্’-এর টীকাকার ভাস্কর রায় বলেন, বি-অত্যন্ত, খরা-কঠিন, এভাবে ব্যুৎপত্তি করেন। ‘সৌভাগ্য সুখোদয়’-এর মতে, বৈ-নিশ্চিতরূপে, খ-কর্ণকুহর, রা ধাতু-গমন করা।




তৃতীয় শ্লোকে “আমি ধ্যান করি”—এই ধ্যানে কৃতবিদ্য গুরুই একমাত্র অধিকারী, অকৃতবিদ্য শিষ্য নন। এ কারণেই একবচন ‘আমি’-র প্রয়োগ হয়েছে।




‘সর্ববিদ্যা’ শব্দটি মুণ্ডকোপনিষদের প্রথম মুণ্ডকের প্রথম খণ্ডের প্রথম শ্লোকে ‘ব্রহ্মবিদ্যাং সর্ববিদ্যাপ্রতিষ্ঠাম্’-এর শাঙ্কর ভাষ্য—সর্ববিদ্যার অভিব্যক্তির নিদান বলে অথবা ‘যা দ্বারা অশ্রুত বিষয়ও শ্রুত হয়, অমত (অচিন্তিত) বিষয়ও ‘মত’ হয় এবং অবিজ্ঞাত বিষয়ও বিজ্ঞাত হয়’। এই শ্রুতির বচনানুসারে জানা যায় যে, অন্যান্য বিদ্যা দ্বারা যা যা জ্ঞাতব্য, এই বিদ্যা দ্বারা তার সব কিছুই বিজ্ঞাত হয়—এ জন্যই সর্ববিদ্যার আশ্রয়রূপা।




‘ধ্যান করি’। গুরু দুই প্রকারের—এক। যিনি আত্মতত্ত্ব প্রতিপাদক বা বিশ্লেষক শাস্ত্রের কেবলই শব্দার্থ সম্পর্কে অবগত আছেন। দুই। যিনি নিজেই আত্মতত্ত্ব অনুভব করেছেন। প্রথম প্রকারের গুরু সাধারণ মানুষ, ব্রহ্ম নন; কেননা তাঁর নিজেকে মানুষ বলে ভ্রান্তি ঘোচেনি। সেই গুরু আত্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করলে, সে বিষয়ে কেবল সন্দেহই হয়ে থাকে, অর্থাৎ কৃতানুভব বুদ্ধির অভাবে নিশ্চয়াত্মক বুদ্ধি জন্মে না। কেবল বাক্যের দ্বারাই তিনি শাস্ত্রবাক্যের বিভিন্ন ধরনের অন্বয় করে থাকেন। তার ফলে আত্মা কখনো অস্তি, কখনো নাস্তি, কখনো কর্তা, কখনো অকর্তা, কখনো শুদ্ধ, কখনো অশুদ্ধ ইত্যাদি রূপে প্রতীত হন। কিন্তু আত্মতত্ত্বানুভবী গুরু স্বয়ং ব্রহ্ম। তিনি আত্মা হতে অভিন্ন ব্রহ্মের ব্যাখ্যা করলে তা বোঝা যায়।




নত্বা শ্রীভারতীতীর্থবিদ্যারণ্যমুনীশ্বরৌ।
ময়া বাক্যসুধাটীকা যথামতি বিরচ্যতে।।৪




আমি শ্রীভারতীতীর্থ ও শ্রীবিদ্যারণ্য, এই দুই মুনিবরকে প্রণাম করে নিজের বুদ্ধি অনুসারে (‘দৃগ্ দৃশ্য বিবেক’ নামক গ্রন্থের) ‘বাক্যসুধা’ নামের টীকা (অথবা ‘বাক্যসুধা’ গ্রন্থের টীকা) রচনা করছি।




নখ্যাতিলাভপূজে চ টীকাকরণকারণম্।
ন বিদ্বত্তাবলং বাত্র মুক্তিরেবাত্র কারণম্।। ৫




যশ, অর্থাদি কিংবা সৎকার লাভের উদ্দেশ্যে, কিংবা অর্জিত বিদ্যাগৌরবের পরিচয় দেবার অভিপ্রায়ে আমি এই টীকা রচনা করছি না। গ্রন্থের বিচার দ্বারা নিজের এবং অপর মুমুক্ষুগণের উপকার করাই টীকা রচনার উদ্দেশ্য।




এখন আমরা ‘দৃগ্ দৃশ্য বিবেক’ গ্রন্থের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম শ্লোকের সূচনা কেন ও কীভাবে হলো, তা নিয়ে কিছু কথা জানব।




মুনিবর ভারতীতীর্থ যে-গ্রন্থের রচনা আরম্ভ করতে চেয়েছেন, তা যাতে নির্বিঘ্নে বৃদ্ধি পেয়ে পরিসমাপ্ত হতে পারে, এই অভিপ্রায়ে প্রথম শ্লোকের অবতারণা। প্রথম শ্লোক বুঝতে না পারলে এ গ্রন্থের মর্মোদ্ধার করা কঠিন। ধার্মিক ও শিষ্ট ব্যক্তি গ্রন্থের শুরুতে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে যে-আচার পালন করে থাকেন, যাতে সেই আচারও পরিপালিত হয়, এই অভিপ্রায়ে প্রথম শ্লোক পরমাত্মস্বরূপের অনুস্মরণরূপ (যদি আমার প্রতি চিত্ত স্থির রাখতে না পারো, তাহলে আমার ‘অনুস্মরণরূপ’ অভ্যাসযোগ দ্বারা আমাকে প্রাপ্ত হতে অভিলাষ করো।~~গীতা, ১২/৯) মঙ্গলাচার পালন করলেন, কেননা প্রথম শ্লোকে ব্যবহৃত ‘সাক্ষী’ শব্দটি কেবল-কূটস্থ-জীবচৈতন্যরূপ সেই পরমাত্মস্বরূপকেই সূচনা করলেন।




‘কূটস্থ’। যিনি নিশ্চল, যাঁর কখনও বিকার নেই, যিনি সর্বকালেই সমান, পরমাত্মা সেরূপ সত্তা, অর্থাৎ কূটস্থ। যাঁর কখনও পরিণাম নেই, যিনি সর্বদাই একরূপ, জাগ্রৎ-স্বপ্ন-সুষুপ্তি এই তিন অবস্থায় যিনি একরূপেই অবস্থান করেন, সেরূপ আত্মাপুরুষ‌ই কূটস্থ। গীতার ১২/৩ (জীবাত্মা) ও ১৫/১৬ (পরমাত্মা) শ্লোক দুটিতে ‘কূটস্থ’ পদটি নির্বিকার এবং সর্বদা একরসে বা একরূপে অবস্থিত সচ্চিদানন্দঘন ব্রহ্মের বাচক। সমস্ত দেশ, কাল, বস্তু, ব্যক্তি ইত্যাদিতে অবস্থান করলেও যা স্বরূপত সর্বদা নির্বিকার এবং নির্লিপ্তভাবে থাকে। এর কখনোই বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় না। তাই এটি 'কূটস্থ'। কূট বা কোনো চূড়ার উপর রেখে বিভিন্ন প্রকার গহনা, অস্ত্র-শস্ত্র বা জিনিসপত্র তৈরি করা হলেও সেটি যেমন তেমনই থাকে। এইরূপ জগতের ভিন্ন ভিন্ন প্রাণী-পদার্থের উৎপত্তি, স্থিতি ও বিনাশ হতে থাকলেও পরমাত্মা সর্বদা একইপ্রকার থাকেন।




তটস্থ। “আমরা কখনো কখনো কোনো জিনিস নির্ণয় করতে হলে তার পরিবেশ বর্ণনা করে থাকি। একে তটস্থ লক্ষণ বলে। আমরা যখন ব্রহ্মকে ‘সচ্চিদানন্দ’ নামে অভিহিত করি, প্রকৃতপক্ষে আমরা তখন সেই অনির্বাচ্য সর্বাতীত সত্তারূপ সমুদ্রের তটের কিছু কিছু বর্ণনা করছি মাত্র।” (~~স্বামী বিবেকানন্দ, ‘দেববাণী’) বাবা যখন ঘোড়া সেজে সন্তানকে চড়ান, তখন ঘোড়া হচ্ছে সেই ব্যক্তির তটস্থ রূপ, সন্তানের বাবা হচ্ছে সেই ব্যক্তির স্বরূপ এবং ব্যক্তিটির জীবাত্মা ও পরমাত্মা দুই-ই হচ্ছে তাঁর কূটস্থ রূপ।




অখণ্ড, একরস, সচ্চিদানন্দস্বরূপে অবস্থান করার নামই মোক্ষ। উপনিষদের চারটি মহাবাক্যের অর্থের অপরোক্ষজ্ঞানের ফল এবং অন্বয় ও ব্যতিরেক যুক্তি দ্বারা সেই সেই বাক্যের অন্তর্গত পদসমূহের অর্থের পরিশোধন না করলে, সেই সেই বাক্যের অর্থজ্ঞান হয় না।




মহাবাক্য চারটির প্রথমটি উপদেশবাক্য, অপর তিনটি অনুভববাক্য।




(১) ‘তত্ত্বমসি’—ত্বম্ (তুমি) তৎ (সৎ বা ব্রহ্ম) অসি (হ‌ও)—তুমি সেই সৎ (ব্রহ্ম) (সামবেদের অন্তর্গত ছান্দোগ্যোপনিষদ, ৬/৮/৭)।
(২) ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’—অয়ম্ (এই) আত্মা (প্রত্যগাত্মা বা একজন ব্যক্তিতে ব্রহ্মের অধিষ্ঠান) ব্রহ্ম—এই আত্মা ব্রহ্ম (পরোক্ষত যে-ব্রহ্ম সর্বস্বরূপ, প্রত্যক্ষত তিনি আত্মা) (অথর্ববেদের অন্তর্গত মাণ্ডূক্যোপনিষদ, ২)
(৩) ‘অহং ব্রহ্মাম্মি’—অহম্ (আমি) অস্মি (হ‌ই) ব্রহ্ম—আমি ব্রহ্ম (যজুর্বেদের অন্তর্গত বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ১/৪/১০)




(৪) ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’—প্রজ্ঞানম্ (এই প্রজ্ঞান‌ই) ব্রহ্ম—এই প্রজ্ঞান‌ই ব্রহ্ম (সর্বোপাধিবর্জিত প্রজ্ঞানই উপাধিভেদে সর্বজ্ঞ ঈশ্বর, অন্তর্যামী, হিরণ্যগর্ভ, বিরাট ও দেবতাদি হইতে স্তম্ব (হাতি) পর্যন্ত বিবিধরূপে বিবর্তিত হয়েছেন।) (ঋগ্‌বেদের অন্তর্গত ঐতরেয়োপনিষদ, ৩/১/৩)




প্রথম বাক্যে ‘ত্বম্’ পদের, দ্বিতীয় বাক্যে ‘আত্মা’ পদের, তৃতীয় বাক্যে ‘অহম্’ পদের এবং চতুর্থ বাক্যে ‘প্রজ্ঞানম্’ পদের বাচ্য জীবচেতন।
প্রথম বাক্যে ‘তৎ’ পদের, দ্বিতীয় বাক্যে ‘ব্রহ্ম’ পদের, তৃতীয় বাক্যে ‘ব্রহ্ম’ পদের এবং চতুর্থ বাক্যে ‘ব্রহ্ম’ পদের বাচ্য ঈশ্বরচেতন।
জীবচেতন ও ঈশ্বরচেতন বা জীবাত্মা ও পরমাত্মার একতাই চারটি বাক্যের তাৎপর্য।




ঈশ্বরচেতন বা ঈশ্বরের চেতন—সর্বশক্তি, সর্বজ্ঞ, বিভু, ঈশ (সকলের প্রেরক), স্বতন্ত্র, পরোক্ষ, মায়াধীশ ও বন্ধমোক্ষরহিত।
জীবচেতন বা জীবের চেতন—অল্পশক্তি, অল্পজ্ঞ, পরিছিন্ন, অনীশ, কর্মাধীন, প্রত্যক্ষ, মায়াধীন (অবিদ্যামোহিত) ও বন্ধমোক্ষবিশিষ্ট।




‘অন্বয়’। উপরে লিখিত কারণে এই দুইয়ের একতা সম্ভব হয় না, কিন্তু উপনিষদের মহাবাক্য সত্য, সুতরাং এই দুইয়ের বিরোধী বাচ্যভাগ ত্যাগ করে অবিরোধী চেতনভাগ গ্রহণ করলেই একতা সম্ভবপর হয়।




‘ব্যতিরেক’। এভাবে গ্রহণ না করলে একতা সম্ভবপর হয় না।




অর্থাৎ, যে-সব দৃষ্টান্তে বিচক্ষণ ঘটনাটি উপস্থিত, তাদের ঠিক পূর্বগামী বা অনুগামী সকল ঘটনার মধ্যে যদি একটি ব্যাপার সবসময় উপস্থিত থাকে এবং যে-সব দৃষ্টান্তে বিচক্ষণ ঘটনাটি অনুপস্থিত, তাদের ঠিক পূর্বগামী বা অনুগামী সকল ঘটনার মধ্যে যদি ওই ব্যাপারটি সবসময় অনুপস্থিত থাকে, তবে বুঝতে হবে যে, সেটি বিচার্য ঘটনার কার্য বা কারণ বা কারণের অংশ—এই ব্যাপারটিকে মিলের অন্বয়ী-ব্যতিরেকী পদ্ধতি বা অন্বয় ও ব্যতিরেক যুক্তি বলে।




উল্লেখ্য, মহাবাক্যগত ‘ত্বম্’ প্রভৃতি পদের লক্ষ্যার্থ (আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে, অন্য অর্থে ব্যবহৃত) শুদ্ধ চেতন এবং ‘তৎ’ প্রভৃতি পদের লক্ষ্যার্থ শুদ্ধ চেতন—তাই উভয়ের একতা সম্ভবপর।




‘অপরোক্ষ জ্ঞান’। প্রথাগত জ্ঞানের তিনটি ধরন হল ‘প্রত্যক্ষ’ (প্রায়োগিক), ‘পরোক্ষ’ (গতানুগতিক, বিশ্বজনীন) ও ‘অপরোক্ষ’ (স্বজ্ঞালব্দ)। ‘অপরোক্ষ’ হলো সর্বোচ্চ শ্রেণির জ্ঞান। যে-নৈতিকতা অস্তিত্বের একত্ব থেকে উৎসারিত ‘পরোক্ষ’ জ্ঞানকে রূপান্তরিত করে, তার অনুশীলন ব্যতিরেকে অপরোক্ষ জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” (এই সকলই ব্রহ্ম) হলো ‘পরোক্ষ’ জ্ঞান, কিন্তু “অহং ব্রহ্মাস্মি”-র অনুধাবনই হলো ‘অপরোক্ষ’ জ্ঞান।




‘অর্থের পরিশোধন’। বেদান্তশাস্ত্রে আটটি অন্তরঙ্গ সাধন উপদিষ্ট হয়েছে:




(১) বিবেক: যা-কিছু চিরন্তন বা নিত্যবস্তু অর্থাৎ ব্রহ্ম এবং যা-কিছু চিরন্তন নয় অর্থাৎ অনিত্য বস্তু—এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য নিরুপণের ক্ষমতা।
(২) বৈরাগ্য: এ জগতের ইহকাল ও পরকালে প্রাপ্তব্য সকল ভোগ্যবস্তু অর্থাৎ ফলভোগ সম্পর্কে বিতৃষ্ণা।
(৩) ষট্‌সম্পত্তি: ছয়টি গুণ—শম (অন্তঃকরণের সংযম), দম (বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গুলির সংযম), উপরতি (বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গুলিকে ভোগ্য বস্তু থেকে দূরে রাখা অথবা শাস্ত্রীয় কর্ম ত্যাগ করা), তিতিক্ষা (ত্রিতাপ সহ্য করা), শ্রদ্ধা (গুরু ও বেদের শিক্ষাগুলিতে বিশ্বাসস্থাপন), সমাধান (ব্রহ্ম ও গুরুতে মনোযোগস্থাপন)।
(৪) মুমুক্ষুত্ব: এই জগৎ যে প্রকৃতিগতভাবে দুঃখময়, সে সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন এবং মোক্ষ বা জন্মমৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তিলাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
(৫) শ্রবণ: উপনিষদ্‌ ও অদ্বৈত বেদান্ত সম্পর্কে ঋষিগণের উপদেশ শোনা এবং ব্রহ্মসূত্র ইত্যাদি বৈদান্তিক গ্রন্থপাঠ। এই স্তরে শিক্ষার্থী ব্রহ্মের সত্য স্বরূপ ও আত্মার স্বরূপ সম্পর্কে শিক্ষা করেন।
(৬) মনন: এই স্তরে উক্ত শিক্ষাগুলি সম্পর্কে শিক্ষার্থী চিন্তা করেন।
(৭) নিদিধ্যাসন: এই স্তরে ‘তত্ত্বমসি’ সত্যটিকে ধ্যান করা হয়।
(৮) পদার্থ পরিশোধন: এই অষ্টম সাধনের তাৎপর্য এই—দুধমিশ্রিত জল হতে হাঁস যেভাবে দুধকে আলাদা করে নেয়, নবনীত বা মাখন মিশ্রিত তক্র বা ঘোল হতে গোপগণ যেমন মাখনকে পৃথক করে নেয়, ঠিক তেমনি চেতন ও জড়ের ক্রম অনুসরণ করে, কারণ ও কার্য, অধিষ্ঠান ও অধ্যস্ত (সত্তা বা গুণাগুণ আরোপ বা অধিষ্ঠান করা হয়েছে যাতে), দ্রষ্টা ও দৃশ্য, সাক্ষী ও সাক্ষ্যকে পৃথক করার নাম‌ই পদার্থ পরিশোধন। বেদান্তশাস্ত্রে যতগুলি প্রক্রিয়া উপদিষ্ট হয়েছে, এই পদার্থ পরিশোধনই প্রায় সেগুলির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। মহাবাক্যের অর্থ সম্যকভাবে জানতে এই পদার্থ পরিশোধন সবিশেষ উপযোগী।




‘ত্রিতাপ’। তিন রকমের দুঃখ—আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক। প্রথমটি হচ্ছে দেহ ও মনোজাত দুঃখ। যে জড় দেহটি ধারণ করে আমরা রয়েছি, সেই দেহটি নানা ব্যাধি ব্যথা-বেদনার ঘর, যার ফলে আমরা দুঃখ পাই। তা ছাড়া আছে মনোজাত দুঃখ, যেমন আত্মীয়স্বজনের বিচ্ছেদ, মৃত্যুর কারণে দুঃখ, প্রিয় বস্তু হারানোর দুঃখ, অপ্রিয় বস্তুর সংযোগের ফলে দুঃখ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে অন্য জীবের দ্বারা প্রাপ্ত দুঃখ, যেমন বিষাক্ত পোকামাকড় বা জীবজন্তুর দংশন, চোর-ডাকাতের উৎপাত, প্রতারকের ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদি আমাদের দুঃখ দেয়। তৃতীয়টি হচ্ছে দেবতাদের দ্বারা সংঘটিত যে-দুঃখ, যেমন ভূকম্প, ঝড়, প্রবল বৃষ্টি, বন্যা, প্রচণ্ড গরম, কনকনে ঠান্ডা, (প্রাকৃতিক) অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদির কারণে দুঃখ।




পরিশোধনের প্রসঙ্গে আসি। প্রথমেই ‘তত্ত্বমসি’ (তৎ ত্বম্ অসি) মহাবাক্যের অন্তর্গত জীববাচক ‘ত্বম্’ (তুমি) পদার্থের পরিশোধন করতে হয়, কেননা প্রতিটি শরীরে যা ‘আমি’ ‘আমি’ বলে অনুভূত হয়, সেই জীববাচক ‘ত্বম্’ পদার্থের অর্থ প্রসিদ্ধ বা সর্বজনবিদিত। এটা বুঝলে অপ্রসিদ্ধ ‘তৎ’ (সৎ বা ব্রহ্ম) পদের অর্থ বোঝানো সহজ হবে। প্রসিদ্ধ বস্তুর উল্লেখ করেই অপ্রসিদ্ধ বস্তু বোঝাতে হয়।




এই উদ্দেশ্য মাথায় রেখেই পরম কৃপানিধি শ্রীভারতীতীর্থ—জগৎ ও ব্রহ্মকে দেহ এবং দেহধারী অর্থাৎ শারীরকের ভিত্তিতে বর্ণনাসমৃদ্ধ, ব্যাস-প্রণীত ‘উত্তরমীমাংসা’ বা ‘ব্রহ্মসূত্র’ বা ‘বাদরায়ণসূত্র’ বা ‘শারীরকসূত্র’-এর ভাষ্য ‘শ্রীমদ্‌শারীরকভাষ্য’ নামক মহাশাস্ত্রে ভাষ্যকার ভগবান শঙ্করাচার্য যে-বিষয়টি প্রতিপাদন করেছেন—তাকেই লক্ষ করে মুমুক্ষু জীবের প্রতি অনুগ্রহপরবশ হয়ে ‘দৃগ্ দৃশ্য বিবেক’ অর্থাৎ দ্রষ্টা ও দৃশ্যের বিচার দ্বারা এই প্রকরণ আরম্ভ করছেন। ‘ত্বম্’ পদের অর্থের পরিশোধন করাই প্রধানত এই প্রকরণের উদ্দেশ্য।