‘দৃগ্ দৃশ্য বিবেক’ (শ্লোক: ৪)

প্রথম শ্লোকের শেষার্ধ যে-বিষয়টি প্রতিপাদন করেছেন, চতুর্থ শ্লোক তা-ই স্পষ্ট করে বোঝাচ্ছেন:




কামঃ সঙ্কল্পসন্দেহৌ শ্রদ্ধাশ্রদ্ধে ধৃতীতরে।
হ্রীর্ধীর্ভীরিত্যেবমাদীন্ ভাসয়ত্যেকধা চিতিঃ।। ৪




অন্বয়। চিতিঃ, কামঃ, সঙ্কল্পসন্দেহৌ, শ্রদ্ধাশ্রদ্ধে, ধৃতীতরে, হ্রীঃ, ধীঃ, ভীঃ ইত্য এবমাদীন্ একধা ভাসয়েৎ।




অনুবাদ। কূটস্থ জীবচৈতন্য কাম, সঙ্কল্প, সন্দেহ, শ্রদ্ধা, অশ্রদ্ধা, ধৃতি (দৃঢ়তা বা ইচ্ছাশক্তি), অধৃতি, লজ্জা, প্রজ্ঞা, ভয় ইত্যাদি অন্তঃকরণ বৃত্তিসমূহকে এক প্রকারেই বা তুল্য রূপেই বা অভিন্ন চৈতন্যে বা চিত্তের অনুভূতিতে প্রকাশ করে থাকে।




টীকা। কেউ যদি না জানে, দড়ি কেমন হয়, তবে সে দড়িকে সাপের মতোই কিছু-একটা ধরে নেয়, যদি সে জানে, সাপ কেমন হয়। দড়ি যেমন তার কাছে সাপের প্রকাশক, ঠিক একইভাবে, আত্মস্বরূপ না জেনে আত্মাতে যে বিশেষ বিশেষ অন্তঃকরণ বৃত্তি আরোপিত করা হয় এবং যে-সকল অন্তঃকরণ বৃত্তি (দড়িতে আরোপিত সাপের রূপের মতো) আত্মস্বরূপের জ্ঞান দ্বারা বিদূরিত হয়, তাদের সকলকেই কূটস্থ সর্বসাক্ষী জীবচৈতন্য এক ও অভিন্ন প্রকারেই প্রকাশ করে থাকে।




সেই কূটস্থ জীবচৈতন্য স্বগত, স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদশূন্য এবং সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মস্বরূপ হতে অভিন্ন।




বৃক্ষস্য স্বগতো ভেদঃ পত্রপুষ্পফলাদিভিঃ। বৃক্ষান্তরাৎ সজাতীয়ো বিজাতীয়ঃ শিলাদিতঃ।।
(পঞ্চদশী, ২/২০)




অন্বয়: বৃক্ষস্য (বৃক্ষের) পত্রপুষ্প-ফলাদিভিঃ (পত্র, পুষ্প, ফল প্রভৃতি দ্বারা) স্বগতঃ ভেদঃ ([যে ভেদ, তা নিজ অবয়ব-মধ্যস্থ ভেদ বা] স্বগত ভেদ), বৃক্ষান্তরাৎ (অন্য বৃক্ষ হতে [যে ভেদ, তা]) সজাতীয়ঃ (স্বজাতীয় ভেদ, অর্থাৎ একই জাতির দুইটি সদস্যের মধ্যে যে ভেদ), শিলাদিতঃ (শিলা প্রভৃতি হতে [যে ভেদ, তা]) বিজাতীয়ঃ (বিজাতীয় ভেদ)।।




বঙ্গানুবাদ: পত্র, পুষ্প, ফল প্রভৃতি দ্বারা বৃক্ষের স্ব-অবয়ব-মধ্যস্থ যে-ভেদ, তাকে স্বগত ভেদ বলে। এক বৃক্ষের অন্য বৃক্ষ হতে যে ভেদ, তা স্বজাতীয় ভেদ; আর পাথর, মাটি প্রভৃতি হতে বৃক্ষের যে-ভেদ, তা বিজাতীয় ভেদ৷




‘সচ্চিদানন্দ’ একটি সংমিশ্রিত সংস্কৃত শব্দ, যা ‘সত্, চিত্ ও আনন্দ’ নিয়ে গঠিত—তিনটিই ‘ব্রহ্ম’ নামক চূড়ান্ত বাস্তবতার প্রকৃতি থেকে অবিচ্ছেদ্য বলে বিবেচিত।
সত্: সংস্কৃতের ‘সত্’ মানে ‘সত্তা বা অস্তিত্ব’, ‘বাস্তব বা প্রকৃত’, ‘সত্য, ভালো, সঠিক’, অথবা ‘যা আসলে আছে’।
চিত্: ‘চিত্’ অর্থ ‘চেতনা’।
আনন্দ: ‘আনন্দ’ অর্থ ‘সুখ’ বা ‘বিশুদ্ধ সুখ’, বেদান্ত দর্শনে যা আত্মা বা ব্রহ্মের তিনটি গুণের মধ্যে একটি।
‘সচ্চিদানন্দ’-কে তাই ‘সত্য চেতনা সুখ’, ‘বাস্তব চেতনা সুখ’, ‘অস্তিত্ব চেতনা পরমানন্দ’ হিসেবে অনুবাদ করা হয়।




কূটস্থ জীবচৈতন্যে কোনো বিকারের কারণ না থাকাতে সেই কূটস্থ জীবচৈতন্য, দড়িকে সাপরূপে ভ্রমের মতো—বস্তুসমূহের নানান মিথ্যা বিকার বা রূপারোপ থাকা সত্ত্বেও, নিজের মধ্যে কোনো স্বগত-বিকার উৎপাদন না করে, এক রূপেই বা আকৃতিতেই তাদেরকে প্রকাশ করে থাকে।




শ্লোকে যে ‘কামঃ’, ‘সঙ্কল্প’ ইত্যাদি অন্তঃকরণ বৃত্তির উল্লেখ হয়েছে, তা বৃহদারণ্যকোপনিষদ (১/৫/৩) হতে সংগৃহীত—




কামঃ সঙ্কল্পো বিচিকিৎসা শ্রদ্ধাহশ্রদ্ধা ধৃতিরধৃতির্হ্রীর্ভীরিত্যেতৎ সর্বং মন এব।




কামঃ (কাম বা স্ত্রীসঙ্গের অভিলাষ) সঙ্কল্পঃ (সামনে উপস্থিত কোনো বস্তুর বিষয়ে বিশেষ কোনো বিবেচনা, অর্থাৎ এটা সাদা, লাল, নীল ইত্যাদি বিবেচনা) বিচিকিৎসা (সংশয়াত্মক জ্ঞান) শ্রদ্ধা (অদৃষ্টফলে বা পুণ্যপাপাত্মক কর্মফলে এবং দেবতা প্রভৃতি বিষয়ে আস্তিক্য বা বেদবিহিত বুদ্ধি অর্থাৎ সত্যতাজ্ঞান বা বিশ্বাস) অশ্রদ্ধা (শ্রদ্ধার বিপরীত) ধৃতিঃ (দেহ-মন অবসন্ন হলেও দৃঢ়তা ধারণ করা) অধৃতি (ধৃতির বিপরীত) হ্রীঃ (লজ্জা) ধীঃ (প্রজ্ঞা অর্থাৎ বোধশক্তি) ভীঃ (ভয়) ইতি এতৎ (ইত্যাদি) সর্বম্ এব (সমস্ত‌ই) মনঃ (এরা মনের‌ই বিবিধ রূপ)।




এই শ্লোকে উক্ত ‘আদি’ শব্দের দ্বারা ঐতরেয়োপনিষদে (৩/১/২) বিবৃত অন্তঃকরণ বৃত্তিসমূহকেও বুঝতে হবে, যথা—




যদেতদ্ধৃদয়ং মনশ্চৈতৎ—সংজ্ঞানমাজ্ঞানং বিজ্ঞানং প্রজ্ঞানং মেধা দৃষ্টির্ধৃতির্মতির্মনীষা জূতিঃ স্মৃতিঃ সঙ্কল্পঃ ক্রতুরসুঃ কামো বশ ইতি—সর্বাণ্যেবৈতানি প্রজ্ঞানস্য নামধেয়ানি ভবন্তি।।




যৎ (যা) হৃদয়ম্ মনঃ চ (হৃদয় ও মন, এই দুই শব্দের বাচ্য) [তা-ই] এতৎ (এই করণ), [এবং] এতৎ (এই অন্তঃকরণই) [নিম্নোক্ত বিবিধভাবে বিভক্ত]—সংজ্ঞানম্ (সংজ্ঞপ্তি, চেতনা) আজ্ঞানম্ (আজ্ঞা, প্রভুত্ব), বিজ্ঞানম্ (নৃত্য, গীত ইত্যাদি চৌষট্টি কলা-বিষয়ক জ্ঞান), প্রজ্ঞানম্ (গ্রন্থার্থে বুদ্ধির উন্মেষ, প্রতিভা), মেধা (গ্রন্থার্থধারণ-সামর্থ্য), দৃষ্টিঃ (ইন্দ্রিয় দ্বারা বিষয়োপলব্ধি), ধৃতিঃ (ধৈর্য, শরীরাদির অবসাদ-নিবারক বৃত্তি), মতিঃ (মনন, কর্তব্যচিন্তা), মনীষা (মনন-বিষয়ে স্বাতন্ত্র্য), জূতিঃ (রোগাদিজনিত মানস দুঃখ), স্মৃতিঃ (স্মরণ), সঙ্কল্পঃ (নিশ্চয়, সামান্যাকারে প্রতিভাত রূপাদির শ্বেতপীতাদি বিশেষরূপে কল্পনা), ক্রতুঃ (অধ্যবসায়), অসুঃ (জীবনক্রিয়া-সম্পাদক প্রাণাদিবৃত্তি), কামঃ (বিষয়তৃষ্ণা), বশঃ (মনোজ্ঞ বস্তুর স্পর্শাদি-কামনা)—ইতি এতানি (এই সকল) সর্বাণি এব (সমুদয়ই) প্রজ্ঞানস্য (প্রজ্ঞানস্বরূপ আত্মার) নামধেয়ানি (ঔপাধিক নামবিশেষমাত্র) ভবন্তি (হয়)।




হৃদয় ও মনের বাচ্য এই অন্তঃকরণ চক্ষুরাদিরূপে বা পাঁচটি বাহ্যিক ইন্দ্রিয়রূপে ভিন্ন ভিন্ন ভাগে বিভক্ত। চেতনভাব, প্রভুত্বভাব, কলাবিজ্ঞান, প্রতিভা, ধারণাশক্তি, বিষয়োপলব্ধি, ধৈর্য, চিন্তা, চিন্তাবিষয়ে স্বাতন্ত্র্য, রোগাদিজনিত দুঃখ, স্মৃতি, নিশ্চয়, অধ্যবসায়, প্রাণাদিবৃত্তি (প্রাণ: অভ্যন্তরীণ গতিশীল শক্তি, আপান: বাহ্যিক গতিশীল শক্তি, ব্যান: শক্তির সঞ্চালন, উদান: মাথা ও গলার শক্তি এবং সমান: হজম ও আত্তীকরণ), বিষয়তৃষ্ণা, মনোজ্ঞবস্তুর স্পর্শ-কামনা ইত্যাদি সমস্তই প্রজ্ঞানস্বরূপ আত্মার (অন্তঃকরণের বিবিধ বৃত্তির সাক্ষী বা দ্রষ্টা; আত্মা এদের সাক্ষী ও অবিষয়—এগুলি তাঁর উপলব্ধির দ্বার) ঔপাধিক বা নামমাত্র।




‘চৌষট্টি কলা’। গীতবিদ্যা: গান গাওয়া, বাদ্যবিদ্যা: বাদ্যযন্ত্র বাদন করা, নৃত্যবিদ্যা: নাচের কলা, নাট্যবিদ্যা: নাটক করা, আলেখ্যবিদ্যা: একপ্রকার চিত্রকলা, বিশেষকচ্ছেদ্যবিদ্যা: ললাটে ও গাত্রে বর্ণিল তিলক আঁকা, তণ্ডুলকুসুমবলিবিকার: চালের গুঁড়ো দিয়ে আল্পনা করা, পুষ্পাস্তরণ: ফুলশয্যা তৈরি করা, দশনবসনাঙ্গরাগ: দাঁত, বস্ত্র ও অঙ্গ পরিষ্কার করে সজ্জা করা, মণিভূমিকাকর্ম: মণিরত্ন দ্বারা মেঝে সজ্জিত করা, শয্যারচনা: বিছানা তৈরি করা, উদকবাদ্য: জলতরঙ্গ বাজানো, উদকাঘাত: জলক্রীড়া করা, চিত্রযোগ: বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ ব্যবহার করা, মাল্য-গ্রন্থনা-বিকল্প: ফুল দিয়ে মালা গাঁথা ও অলংকার তৈরি করা, শেখরকাপীড় যোজন: মস্তকের ভূষণ বানানো, নেপথ্যযোগ: বিচিত্র পরিচ্ছদ ও সজ্জা গ্রহণ করা, কর্ণপত্রভঙ্গ: কানের দুল বানানো, সুগন্ধযুক্তি: গন্ধদ্রব্য প্রস্তুত করা, ভূষণযোজন: অলংকার পরা, ঐন্দ্রজাল: জাদুবিদ্যা, কৌচুমার: রূপচর্চা, হস্তলাঘব: হাতের কাজে দক্ষতা বাড়ানো, বিচিত্র শাকযূষ ভক্ষ্য বিকারক্রিয়া: সুস্বাদু খাদ্য প্রস্তুত করা, পানক রস রাগসভা যোজন: সুপেয় পানীয় তৈরি করা, সূচিবাণ কর্ম: সূচ-সুতার কাজ করা, সূত্রক্রীড়া: নালীর ভিতরে সুতা ভেদ করানো, বীণাডমরুকবাদ্য: বীণা ও ডমরু বাদন করা, প্রহেলিকা: অর্থ অস্পষ্ট রেখে কাব্য রচনা করা, দুর্বাচকযোগ: কঠিন ভাষার প্রয়োগ করা যাতে অন্যরা সহজে বুঝতে না পারে, পুস্তকবচন: সুর করে পুস্তকপাঠ করা, নাটিকাখ্যায়িকাদর্শন: নাটক বিষয়ক জ্ঞান, কাব্যসমস্যাপূরণ: কাব্যের একাংশ থেকে অবশিষ্ট চরণাদি রচনা করা, পট্টিকাবেত্রবয়নবিকল্প: বেত বয়নের শিল্প, তক্ষকর্ম: সুতা তৈরি করা, তক্ষণ: কাঠের শিল্প, বাস্তুবিদ্যা: গৃহনির্মাণবিদ্যা, রৌপ্যরত্নপরীক্ষা: রূপা ও অন্যান্য ধাতুর পরীক্ষা ও ব্যবহার করার জ্ঞান, ধাতুবাদ: ধাতুর পাতন, শোধন ও ব্যবহারজ্ঞান, মণিরাগজ্ঞান: স্ফটিকাদি মণির ব্যবহারজ্ঞান, আকরজ্ঞান: খনি বিষয়ক জ্ঞান, বৃক্ষায়ুর্বেদযোগ: বৃক্ষরোপণ ও যত্ন নেওয়া, মেষ-কুক্কুট-লাবক যুদ্ধবিধি: ভেড়া, মোরগ প্রভৃতিকে যুদ্ধ শেখানো এবং তা দিয়ে খেলা দেখানো, শুক সারিকা প্রলাপন: টিয়ে-ময়না প্রভৃতি পাখিকে কথা শেখানো, উৎসাদন: প্রসাধনক্রিয়া, কেশমার্জন কৌশল: চুল আঁচড়ানো, অক্ষরমুষ্টিকাকথন: সাংকেতিক লিখনপদ্ধতি, ধারণমাতৃকা: শ্রুতিধর হওয়ার উপায়, দেশভাষাজ্ঞান: বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার জ্ঞান, নিমিত্তজ্ঞান: নিমিত্ত অবলম্বন পূর্বক বলতে পারা, যন্ত্রমাতৃকা:যন্ত্রের ব্যবহারিক জ্ঞান, ম্লেচ্ছিতকুতর্কবিকল্প: জটিল শব্দের দ্বারা অর্থ অস্পষ্ট করে প্রকাশ করা, সংবাচ্য: কথোপকথন, মানসী কাব্য ক্রিয়া: মনে মনে কবিতা রচনা করা, ক্রিয়াবিকল্প: রোগ প্রতিকার, ছলিতকযোগ: ছদ্মবেশ ধারণ, অভিধানকোষ ছন্দোজ্ঞান: শব্দের সঠিক অর্থ জানা, বস্ত্রগোপন: বস্ত্র পরিধানের কৌশল, দ্যূতবিশেষ: তাস খেলা, আকর্ষক্রীড়া: পাশা খেলা, বালক্রীড়নক: ছেলেদের খেলার সামগ্রী নির্মাণ, বৈনয়িকীবিদ্যা: বন্য প্রাণী পোষ মানানো ও খেলা শেখানো, বৈজয়িকীবিদ্যা: বিজয় লাভের বিদ্যা, বৈয়ামিকীবিদ্যা: ব্যায়াম ও শরীরচর্চা




পঞ্চেন্দ্রিয়ের মতো মনও অন্য কারও দৃশ্য, এখানে এটা বলা হয়েছে। সুখ, দুঃখ, ঈর্ষা, ভয়, সহানুভূতি, দয়া, ঘৃণা ইত্যাদির আবেশে মনের অবস্থা একেক রকমের হয়। আবার অজ্ঞতা, জ্ঞান, সন্দেহ, বোঝার ক্ষমতা, এরকম বিভিন্ন জ্ঞানভিত্তিক বিভাজনের ফলেও মন ব্যভিচারী হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে মন দৃশ্য, দ্রষ্টা নয়।




শ্লোকে ‘এবমাদীন্’ পদ থাকাতে ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতিকেও বিবেচনায় আনতে হবে। এভাবে অনেক অবস্থাসম্পন্ন হয় বলে অনেক প্রকারের অর্থাৎ ব্যভিচারী অন্তঃকরণকে চিতিঃ বা চৈতন্য এক রূপেই দেখে থাকে। সেই চৈতন্য কিন্তু ‘একধা’ বা একই প্রকারের। তাঁর অবস্থান্তর বা ধর্মান্তর বা ভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রাপ্তির কোনো সম্ভাবনাই নেই।




যে-প্রক্রিয়ায় ইন্দ্রিয় ও মনের দৃশ্যত্ব প্রতিপাদিত হয়েছে, সেই প্রক্রিয়ায় (সকল অবস্থায় দ্রষ্টা) জীবচৈতন্যেরও তো দৃশ্যত্ব প্রতিপাদিত হতে পারে—এই আশঙ্কা দূর করার জন্য বলা হয়, দ্রষ্টা না থাকলে দৃশ্য থাকতে পারে না। তাহলে চৈতন্যের দ্রষ্টা থাকলে অবশ্যই অন্য এক চৈতন্যকে দ্রষ্টা বলে মেনে নিতে হয়। তাহলে অনবস্থা বা অসীম প্রত্যাবর্তন নামক দোষ ঘটে, অর্থাৎ সেই চৈতন্যেরও আবার দ্রষ্টারূপ অপর এক চৈতন্য স্বীকার করতে হয়—এভাবে অনন্ত সংখ্যক দ্রষ্টা চৈতন্য স্বীকার করা অনিবার্য হয়ে পড়ে।




আবার যদি বলা হয়, চৈতন্যই চৈতন্যের দ্রষ্টা, তাহলে কর্মকর্তৃ-বিরোধরূপ দোষ বা আত্মাশ্রয় দোষ ঘটে, অর্থাৎ যেখানে কোনো বস্তু বা ব্যক্তি নিজেই ক্রিয়ার কর্তা এবং নিজেই ক্রিয়ার কর্ম হয়, তথা ক্রিয়ার বিষয়রূপ কাজটি হয়, সেখানে আত্মাশ্রয় দোষ হয়। যেমন কুমোর ক্রিয়ার কর্তা এবং ঘট বা মাটির পাত্র সেই ক্রিয়ার কর্ম। এখানে ক্রিয়া ও কর্ম পরস্পর ভিন্ন, উভয়ের অভিন্ন বা এক হওয়া সম্ভবপর হয় না। আর তেমন কিছু হলে, আত্মাশ্রয় দোষ ঘটে। যা-কিছু কাজের বিরোধী, তার নাম দোষ। আত্মাশ্রয় বাস্তব কাজের বিরোধী বলে আত্মাশ্রয় একটি দোষ।




চৈতন্য বা পরা প্রকৃতি সম্পর্কে গীতার সপ্তম অধ্যায়ের পঞ্চম শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন:




অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্।
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ।।




অর্থ: এই পূর্বোক্ত অষ্টবিধা প্রকৃতি (ক্ষিতি বা পৃথিবী, অপ্ (জল), তেজ বা আগুন, মরুৎ বা বায়ু, ব্যোম বা আকাশ বা স্থান, মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার—দৃশ্য) আমার অপরা-প্রকৃতি (দৃশ্য)। এগুলি ছাড়া জীবরূপা চেতনাত্মিকা আমার পরা প্রকৃতি (পরম দ্রষ্টা) আছে জেনো; হে মহাবাহু, সেই পরা প্রকৃতি দ্বারা জগৎ বিধৃত রয়েছে।




‘পরা প্রকৃতি—পুরুষ’। অপরা-প্রকৃতি জড়, পরা-প্রকৃতি চেতন, জীবভূতা; এটাই সাংখ্যদর্শনের পুরুষ (জগৎ দুটি সত্যের দ্বারা গঠিত; পুরুষ: সাক্ষ্য-চৈতন্য ও প্রকৃতি: আদি-পদার্থ), এটাই ক্ষেত্রজ্ঞ (যিনি দেহ, আত্মা ও ভৌত বিষয়ের ক্ষেত্র জানেন) বা জীবচৈতন্য। প্রকৃতি-জড়িত খণ্ডচৈতন্যই এই পরা-প্রকৃতি। আধার যেমন আধেয়কে ধরে রাখে, তেমনি এই অধিষ্ঠান-চৈতন্য দৃশ্যপ্রপঞ্চকে বা মায়াকে ধরে আছেন। জীবদেহে যেমন যতদিন প্রাণ থাকে, ততদিন দেহ থাকে; নয়তো দেহ নষ্ট হয়ে যায়। এই দেহধারণের হেতুই জীবচৈতন্য, জড় প্রকৃতির সর্বত্রই তেমন চেতন আত্মা বা পরা-প্রকৃতি আছেন বলেই তার সত্তা আছে, নয়তো তার সত্তাই থাকে না। এই চৈতন্য কোথাও অভিব্যক্ত, কোথাও-বা নিজের আবরণে নিজেই বিশেষরূপে বদ্ধ। এই বিশেষ আবৃতাবস্থাই জড়ত্ব। এই কারণেই বলা হয়েছে, এই চরাচর জগৎ (দৃশ্য) আমার পরা-প্রকৃতি বা চৈতন্য বা পরম দ্রষ্টা দ্বারা বিধৃত।