দুইটা ভুল

বহু বছর আগের দুইটা ভুল নিয়ে বলি।


প্রথম ভুল।


তখন ব্যাবসা করতাম। একদিন আমার গিফটশপ দোভানা’তে কয়েকজন কাস্টমারকে প্রোডাক্ট দেখাচ্ছি, বেশ ব্যস্ত। মাঝে মাঝে দোকানে ভিখিরি ঢুকে পড়ত, জিনিসপত্রে হাত দিত। এ কারণে অনেক বার নষ্টও হয়েছে প্রোডাক্ট। ব্যস্ততার সময়ে দোকানে ভিখিরি দেখলে ভালো লাগত না।


তো সেদিন খুবই মলিন পোশাকের এক লোক দোকানে ঢুকে পড়লেন। পরনে তালি-মারা ময়লা পাঞ্জাবি, পায়ে কমদামি স্যান্ডেল। দেখতে ভিখিরির মতোই লাগে! তিনি দোকানে ঢুকে জিনিস দেখছেন, হাতে এটা-ওটা ধরছেন। আমি খেয়াল করামাত্রই ধরে নিলাম, উনি ভিখিরি। আমার আগের অভিজ্ঞতা ওরকমই বলছিল।


আমি লোকটার কাছে গিয়ে দোকানের বাইরের দিকে হাত বাড়িয়ে চোখে-মুখে খুব বিরক্তি নিয়ে বললাম, ‘বাইরে যান! বাইরে যান! কাজের সময় বিরক্ত করবেন না!’


হাতের প্রোডাক্টটা আস্তে করে শেলফে রেখে দিয়ে উনি আমার দিকে শান্তচোখে তাকালেন, আর নম্রস্বরে স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, ‘আমি কি প্রোডাক্ট কিনতে পারব না? ঠিক আছে। আসসালামু আলাইকুম। ভালো থাকবেন।’


আমি সংবিৎ ফিরে পেলাম যেন! এ আমি কী করলাম! কাকে বের করে দিলাম দোকান থেকে! কেন না জেনে লোকটাকে এমন কষ্ট দিলাম! তাঁর পোশাক দেখেই কেন এত বড়ো ভুলটা করলাম! কেন লোকটার দীর্ঘশ্বাস আমার আমলনামায় যোগ করে নিলাম নিজের হাতে ধরে?


সত্যিই খুব কান্না পাচ্ছিল। পুরোপুরিই থ হয়ে গিয়েছিলাম কিছু সময়ের জন্য! বুঝতে পারছিলাম না, কী করব, এখন কী করতে হয়! আমি যা নই, উনি তো আমাকে তা-ই ভেবে চলে গেলেন! এত কষ্ট দিলাম ওঁকে! বিনা কারণে একজন ভদ্রলোককে এমন অপমান করে বের করে দিলাম দোকান থেকে! আমিও কি মানুষ!


দোভানা থেকে বেরিয়ে পাগলের মতো অনেক খুঁজলাম তাঁকে। কোথাও পেলাম না। আমাকে আমার প্রাপ্য উত্তরটা দিয়ে মানুষটা হারিয়ে গেছেন!


গত বারোটি বছর ধরে আজও আমি তাঁকে খুঁজে চলেছি। কত কত বার যে গুলজার টাওয়ারের সামনের রাস্তায় হেঁটেছি তাঁকে একটু খুঁজে পাবার আশায়! ঈশ্বর যদি কোনোদিন তাঁর সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দেন, হাতজোড় করে ক্ষমা চাইব! তিনি আমাকে ভুল বুঝেছেন। এর জন্য আমিই দায়ী। আসলে তিনি আমাকে ভুল বোঝেননি, আমার সেদিনের আচরণটা চিন্তা করলে তো তিনি আমাকে ঠিকই বুঝেছেন! প্রায় সময়ই, কেউই আসলে আমাদের ভুল বোঝে না, আমরাই নিজেদের ভুল বোঝাই!


যাঁকে আমি ক্ষমা চাইবার জন্য খুঁজছি, তাঁকে কোনোভাবেই খুঁজে না পাওয়া যে কী যন্ত্রণার! যদি মৃত্যুর আগে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা আর না হয়...! আহারে, কত কত যে অনুতাপ ও দীর্ঘশ্বাস বুকে পুষে রেখেই আমাদের এ পৃথিবী ছাড়তে হয়! মানুষ সত্যিই বড্ড অসহায়!


দ্বিতীয় ভুল।


দিল্লির একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছি। ফেইসবুকিং করছি, কোল্ডকফি-পেস্ট্রি’র অর্ডার দিয়েছি, টেবিলে অপেক্ষা করছি।


পাশেই ওদিকের টেবিলে ছোট্ট একটা মেয়ের বার্থডে উদ্‌যাপন হচ্ছে। মাত্র চার-পাঁচজন মানুষ সেখানে। ওদিকে একটু তাকিয়েই আমি আবারও মোবাইলে মুখ গুঁজে রইলাম। ‘অতি জরুরি’ চ্যাট করছি, পৃথিবী চুলোয় যাক!


হঠাৎ খেয়াল করলাম, সাদা শার্ট-পরিহিত এক লোক এসে একটা প্লেটে পেস্ট্রিকেক দিয়ে গেলেন। ‘প্লিজ, এনজয় ইট!’ আমি তাঁর দিকে একটুও মন না দিয়ে, ‘টিস্যুপেপার, প্লিজ!’ বলেই আবার মোবাইলে ডুবে গেলাম। উনি কিছু না বলে টেবিলে টিস্যু দিয়ে গেলেন। ‘হিয়ার ইট ইজ! প্লিজ, এনজয় ইয়োর কেক!’ মোবাইল থেকে একটু চোখ উঠিয়ে ‘থ্যাংকস!’ বলেই আবার মেসেঞ্জারে ডুব দিলাম!


আমার ঠিক সামনের চেয়ারের ভদ্রলোক এতক্ষণ চুপচাপ এসব দেখছিলেন। তাঁর সামনেও একটা কেক দেওয়া হয়েছে, আমি এতক্ষণ খেয়াল করিনি। তিনি টেবিলে চামচ দিয়ে মৃদু আঘাত করে আমার ফেইসবুক-ধ্যান ভেঙে হিন্দিতে যা বললেন, তার বাংলা তরজমা এরকম: ভাই, আপনি কী করলেন এটা! যিনি আপনাকে তাঁর মেয়ের জন্মদিনের কেক খেতে দিলেন, তাঁকে দিয়েই আপনি টিস্যু আনালেন! ভাই, ফেইসবুকের বাইরের দুনিয়াটাও একটু দেখুন! ওটাই তো বেশি সুন্দর!


তাঁর কথা শুনে হঠাৎ আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরল! দু-হাতে মাথাটা রেখে কেকটার দিকে বিস্ফারিত চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ততক্ষণে আমার অর্ডার-করা খাবারও পৌঁছে গেছে। আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না, আমি এখন কী করব! মুহূর্তেই আমি কথাবলার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম! ক্রমাগত ঠোঁট কামড়াচ্ছিলাম আর সেই সাদা শার্টের ভদ্রলোকের দিকে ঠায় তাকিয়ে ছিলাম।


তিনি একটি বারের জন্যও আমার এদিকে তাকাননি। প্রচণ্ড রকমের অপরাধবোধ আমাকে ছেয়ে ফেলল! এ আমি কী করলাম! ফেইসবুক কেড়ে নেয় জানতাম, তাই বলে আজ এতটা কেড়ে নিল! মানুষ অন্যের কাছে নিজেকে ভুল বোঝায়, আর আমি তো নিজেকে রীতিমতো বেয়াদব বানিয়ে দিলাম!


সেদিন আমি সকল সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা চাইতে পারিনি। ক্ষমা চাইতে না পারার ব্যর্থতা যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে, যে এর মধ্য দিয়ে যায়নি, সে এটা কিছুতেই বুঝতে পারবে না। কখনও কখনও, ক্ষমা চাইবার চাইতে অধীর হয়ে কান্না করাও অনেক সহজ! আমার সমস্ত শরীর সেদিন অবশ-বিবশ হয়ে গিয়েছিল। দুই-পা যেন প্যারালাইজড হয়ে পুরোপুরি অনড়-নিথর হয়ে রইল। আমি শুধুই ওই টেবিলের দিকে অসহায় চোখে অনুতপ্ত খুনির মতন তাকিয়ে ছিলাম। সেদিন আমি নিজের বোধকে খুন করেছিলাম, মানুষটার মহত্ত্বকে তাচ্ছিল্য করেছিলাম। সেদিনের অনুভূতিটা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।


না, তিনি আমার দিকে এক বারের জন্যও তাকালেন না। বার্থডে সেলিব্রেশন-শেষে ভদ্রলোক পরিবার নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলেন। রেস্টুরেন্টে অথর্বের মতো পড়ে রইল অনুতাপে পুড়তে-থাকা একটা চরম বেয়াদব লোক!


আইনে খুব চমৎকার একটা কথা আছে: বিচারকের ভুলে দশ জন অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায় তো যাক, কিন্তু এক জনও নিরপরাধ ব্যক্তি যেন বিচারকের ভুলে সাজা না পায়!
আমি যেরকম মানুষ, আমার সেরকম কোনও ভুল আমি নাহয় মেনেই নিলাম; কিন্তু আমি যেমন নই, আমার তেমন একটাও ভুল কী করে মেনে নিই আমি?


আমি খুব করে ওই দুইটি পাপের শাস্তি পেতে চাই। বিনা কারণে মানুষকে অতটা কষ্ট দেওয়া সত্যিই অনেক বড়ো পাপ। শাস্তি হয়তো পেয়েও গেছি এর মধ্যেই! পেয়ে গেলে তো খুবই ভালো! আর যদি না পেয়ে থাকি, তবে আমি শাস্তি পাবার জন্য অপেক্ষা করছি ও করব। আমাদের ভুলগুলি তো ঈশ্বরের খাতায় সবই লেখা থাকে। আমি চাই না, ক্ষমার মধ্য দিয়ে আমার এই দুই হিসেবের শেষ হোক। আমার পুণ্যে আমার অন্য পাপ কেটে যায় তো যাক, তবে এ দুটি পাপ কিছুতেই না কাটুক! আমি হিসেব মেটাতে চাই। আমি আমার প্রাপ্য শাস্তি পেতে চাই।


আমি শাস্তিকে যতটা ভয় করি, তার চাইতেও অনেক বেশি ভয় করি প্রাপ্য শাস্তির ক্ষমাকে। শাস্তি নাহয় আমাকে এক বারই কষ্ট দেবে; কিন্তু প্রাপ্য শাস্তির ক্ষমা আমাকে সারাজীবনই তীব্র অপরাধবোধে ভোগাবে, যা সত্যিই আরও অনেক বেশি কষ্টের!