দুঃখের সুখ

এ পৃথিবীর যেদিকে তাকাই, সেদিকেই আমরা দুইটা অবস্থা দেখতে পাই। চঞ্চল পৃথিবীর পরিবর্তন প্রতিনিয়তই চলছে; এক দিকে ভাঙছে তো আরেক দিকে গড়ছে। সমুদ্রের মধ্য হতে হঠাৎ পাহাড় জেগে উঠছে, আবার দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই ফলে-ফুলে ভরা স্থলভাগ জলগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যখন গোধূলির সময় আকাশের দিকে সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি ছুড়ে দিই, তখন একটার পর একটা নানা রঙের সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাই। সেসকল অপূর্ব ছবি আঁকতে গিয়ে কবিরাও পরাস্ত হয়ে যান। আবার যখন সেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে ঘোর ঘনঘটায় পূর্ণ হয়, সমুদ্রে উত্তাল তরঙ্গ বেপরোয়া ধরনে খেলতে থাকে এবং প্রবল বেগে বয়ে চলে সমুদ্রের বুকে প্রকৃতির ভীষণ ভয়ংকর রূপ আঁকে, তখন সেইসব পরিবর্তন বিস্ময়কর মনে হয়!




এই প্রকৃতির সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রয়েছে বলে আমরা এইসব পরিবর্তনে কখনো সুখ, কখনো দুঃখ অনুভব করি। এই সুখ-দুঃখ মূলত মানুষের শিক্ষা ও মনের গঠনের পার্থক্যের উপর নির্ভর করে। সাধারণত লোকে আলো ও সুন্দর দৃশ্য হতে সুখ পেয়ে থাকে, কিন্তু চিন্তাশীল মানুষ অন্ধকার ও পৃথিবীর ভীষণ পরিবর্তনের মধ্যে তাদের চিন্তাস্রোত প্রবাহিত করে একপ্রকার সুখ সম্ভোগ করেন। সুখের অর্থ অমিশ্র সুখ নয়, কেননা পৃথিবীতে তা মানুষের ভাগ্যে ঘটে না। অবস্থাবিশেষে একজনের সুখ আরেকজনের দুঃখে এবং একজনের দুঃখ অন্যজনের সুখে পরিণত হয়। দুঃখ, ক্লেশ ও যন্ত্রণার অংশ অল্প হলেই আমরা ওটাকে সুখের অবস্থা বলি। সুখের মানে দুঃখের অনুপস্থিতি নয়, বরং দুঃখের অল্পতা বা দুঃখের বিষয়ে মানুষের অভ্যস্ততা।




সুখের সামগ্রী সঞ্চয় ও দুঃখের সামগ্রী দূর করতে সবাই-ই চায়। আমাদের মনের মধ্যে সুখবোধ ও দুঃখবোধ নামে যে দুইটা বৃত্তি আছে, তার একটা অর্থাৎ সুখবোধ বৃত্তিকে আমরা অসীম পরিমাণে চরিতার্থ করতে সবসময়ই ব্যস্ত এবং দুঃখবোধ বৃত্তিকে একেবারে বিনাশ করতে এবং যা-কিছু দুঃখ আনে, তার সব‌ই ছুড়ে ফেলে দিতে সবসময়ই সচেষ্ট থাকি।




সুখ-দুঃখকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়: পারিবারিক ও মানসিক। এদের কিছু নিবার্য, কিছু অনিবার্য। কতগুলি আমরা নিজেরাই সৃষ্টি করে থাকি, কতগুলি আমাদের জীবনধারণের আনুষঙ্গিক নিয়ম বললেই হয়, কেননা সেগুলি বাদে আমাদের জীবনরক্ষা কখনও সম্ভব নয়। মানসিক উন্নতি ও অবনতিতে যে সুখ ও দুঃখ, তা আমাদের সৃষ্ট; ভালো ব‌ই পাঠে যে সুখ এবং তার অভাবে যে দুঃখ, তা-ও এই শ্রেণীর। ক্ষুৎপিপাসার পরিতৃপ্তিতে যে সুখ এবং তার অতৃপ্তিতে যে দুঃখ, তা আমাদের জীবনধারণের আনুষঙ্গিক নিয়ম। সভ্যতার স্রোতে পড়ে আমরা অনেক প্রকার কৃত্রিম সুখ-দুঃখের সৃষ্টি করেছি।




সাধারণত এইসব অবস্থায় আমরা সুখ পাই, যেমন বেড়াতে যাওয়া, পরিশ্রমের পর বিশ্রাম, বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের সুস্থ অবস্থা, পরিমিত ইন্দ্রিয়সুখ সম্ভোগ, ক্ষুৎপিপাসার পরিতৃপ্তি, মিষ্টি কিছু আস্বাদ, সুগন্ধ নেওয়া, কোমল ও ঈষদুষ্ণ বস্তুর স্পর্শ, ভালো মান সমন্বিত শ্রুতিমধুর শব্দ, নানা বর্ণে রঞ্জিত দৃশ্য, আলোর নাচন, বন্দিত্ব থেকে মুক্তি, আশ্চৰ্য নূতন কিছু দেখা, বিভিন্ন কোমল বৃত্তির পরিচালনা, দাম্পত্য প্রণয়, বাবা-মা'য়ের স্নেহ, সন্তানের ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধাভক্তি, আত্মপ্রসাদ, প্রশংসা, শক্তি, প্রভুত্ব, আধিপত্য, প্রতিশোধ নেবার ক্ষমতা, জ্ঞান, মানসিক শক্তির বিবিধ সঞ্চালন, সংগীত, চিত্রবিদ্যা, কবিতা, স্বাভাবিক সৌন্দর্য, সহানুভূতি, নীতি ও জ্ঞানের স্ফূর্তি, ঐশ্বর্য, ধর্ম, সমাজ, জীবনধারণ ইত্যাদি। আবার এইসব অবস্থায় আমরা ক্লেশ, দুঃখ বা যন্ত্রণা পেয়ে থাকি, যেমন পেশির ক্লান্তি, শরীরের কোন‌ও যন্ত্রের বিকার এবং রোগ, শীতলতা, বিশ্বাস, দুর্গন্ধ, অন্ধকার, আলোর অতিআধিক্য, স্ত্রীর মুখের অতৃপ্তি, মুক্তির পর হঠাৎ বন্দিত্ব, সকল প্রকার ভয়, শোক, স্নেহ ও ভালোবাসার কোনও কিছু হতে বিচ্ছেদ, লজ্জাপ্রাপ্তি, অবিচ্ছেদে এক‌ই ধরনের অবস্থায় থাকা বা বৈচিত্র্যহীনতা, আত্মঅবনতি এবং অপমান করার ও সহ্য করার শক্তিহীনতা, দাসত্বস্বীকার, প্রতিশোধ নিতে অপারগ হওয়া, অজ্ঞানতা, কদর্যতা, অসুস্থতা, অতিরিক্ত পরিশ্রম, মূর্খতা, নীচতা, মৃত্যু, ব্যর্থতা ইত্যাদি।




এই সুখ-দুঃখের অবস্থা হতে কেউ ইচ্ছে করলেও পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেন না। প্রভাব, প্রতিপত্তি, প্রতিষ্ঠা পেলেও মানুষ দুঃখ ভোগ করার হাত থেকে মুক্তি পায় না। আবার ইচ্ছে করলেও আজীবন কেউ দুঃখভোগ করে কাটাতে পারবে না; তাকে কিছু-না-কিছু সুখের অংশ নিতেই হবে। ঠিক তেমনি দুঃখও মানুষের জীবনে অনিবার্য ঘটনা। অসম্পূর্ণ মানুষ কোনও বিষয়ে সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। পৃথিবীর বৰ্তমান অবস্থা দুঃখময় কি না, সে বিষয়ে ঘোর সন্দেহ আছে। অনেকে হয়তো এ কথা শুনে হাসছেন, অথবা ধর্ম ব্যবসায়ীরা এটা প্রলাপবাক্য বলে উপহাস করে উড়িয়ে দেবেন।




এক শ্রেণীর দার্শনিক পৃথিবীতে এই দুঃখের অস্তিত্ব আছে বলে ঈশ্বরের তিনটি স্বরূপে সন্দেহ করেন। তাঁরা বলেন, ঈশ্বর একাধারে সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান ও দয়াময় হতে পারেন না। তিনি দয়াময় ও সর্বশক্তিমান হলে কেন জীবের দুঃখ দেখেও তা দূর করেন না? আর সর্বজ্ঞ হলে তিনি কেন পৃথিবীকে এমনভাবে সৃষ্টি করলেন না, যাতে সকল জীব দুঃখের অতীত হতো? এতে স্পষ্ট‌ই বোঝা যায় যে, হয় তিনি নির্দয়, নয় তিনি জীবের দুঃখের প্রতি উদাসীন। পৃথিবীর গঠনপ্রকৃতি যেমন দেখা যায়, তা হতে ভিন্নরূপ ঈশ্বর কেন করলেন না, এ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমরা অক্ষম। তবে আমরা এ কথা বলতে পারি যে, পৃথিবী যেভাবে সৃষ্টি হয়েছে ও ক্রমান্বয়ে সৃষ্ট হয়ে আসছে, (আমরা বিশ্বাস করি যে, পৃথিবীর সৃজনক্রিয়া প্রতিমুহূর্তে চলছে।) তাতে বর্তমান সুখ-দুঃখের অবস্থা জীবন রক্ষার্থেই নিতান্ত প্রয়োজন।




উক্ত মতাবলম্বীদের মধ্যে জন স্টুয়ার্ট মিল অন্যতম। মনে করা যাক, আমরা সৰ্বশক্তিমান দয়াশীল ঈশ্বরের সাথে জগতের সুখ-দুঃখের অস্তিত্বের সমন্বয় করতে আপাতত পারছি না। কিন্তু এজন্য কি এমন কিছু বলা যাবে যে, পৃথিবীতে এমন কোনও সত্য নেই, যা দিয়ে ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান ও দয়াময় স্বরূপের সাথে সুখ-দুঃখের অস্তিত্বের কোনও সমন্বয় আদৌ হতে পারে না? যন্ত্রণার অতীত হওয়া মানুষের সবচাইতে স্বাভাবিক প্রার্থনা। সর্বশক্তিমানের অর্থ কী? যে শক্তি দ্বারা সকল বস্তু উৎপন্ন হতে পারে, অথবা সকল কাজ সম্পন্ন হতে পারে, তাকেই সর্বশক্তিমান শক্তি বলা যায়। এবং যা-কিছু চিন্তায় সম্ভব হয়, তাকেই বস্তু বা কাজ বলা যায়। কিন্তু পানদোষশূন্য মাতাল, সাধু চোর, চতুর্ভুজ সমন্বিত পঞ্চভুজ, দুই পাশের পর্বতশূন্য উপত্যকা ইত্যাদি আমাদের চিন্তায় সম্ভব হয় না।




যদি কেউ বলেন, ঈশ্বর একটি ত্রিভুজ দুইটি সরলরেখার সাহায্যে নিৰ্মাণ করতে পারেন না, সুতরাং তিনি শক্তিহীন, তাহলে আমরা তাকে অজ্ঞান বা পাগল ছাড়া অন্য কিছু মনে করি না। যেমন দুইটি সরলরেখার সাহায্যে ত্রিভুজ নির্মাণ সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি সুখোৎপত্তির উপাদান যে দুঃখ হতে পারে না, এ কথা কোন বিবেচক মানুষ শপথ করে বলতে পারবেন? সুখ ও দুঃখের মধ্যকার এরূপ সম্বন্ধ থাকা যে একেবারে অসম্ভব, তা আমরা বিশ্বাস করি না। ঈশ্বরের সর্বশক্তিমানতার স্বরূপ তাঁর দয়ার মতো অন্য স্বরূপ দ্বারা বিধিবদ্ধ নয়, তা কে বলতে পারে? এটা ধ্রুব সত্য যে, ঈশ্বর বা প্রকৃতি সকল স্থানে ও ক্ষেত্রেই সুবিচারক।




শোপেনহার, হার্টম্যান ও লিওপারডাই প্রমুখ পণ্ডিত পৃথিবী কেবলই দুঃখের আগার বলে প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করেছেন। দুঃখ ও নৈরাশ্যের প্রাদুর্ভাব, রোগের আধিক্য এবং যন্ত্রণার সর্বব্যাপিত্ব দেখে পৃথিবীর বর্তমান অবস্থার প্রতি প্রায় সকলেই অসন্তুষ্ট, সুতরাং দুঃখই পৃথিবীর আদি ও অন্ত, এই মত প্রচারিত হয়েছে। দুঃখবাদীদের অন্তত একটা মত ভ্রান্ত বলে মনে হয়। তাঁরা যেসকল দুঃখ, যন্ত্রণা ও অশুভ ঘটনার উপর তাঁদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিস্থাপন করেন, সেই সকলই অনেকসময় মানুষের চিত্তসাধন করে থাকে। এটা কেবলই কথার কথা নয়, অথবা ঈশ্বরানুরাগী ধার্মিকদের হৃদয়ের ভাব নয়। যতই আমরা এ বিষয়ে আলোচনা ও চিন্তা করি, ততই আমরা দেখতে পাই যে, অমিশ্র অশুভের অস্তিত্ব কোথাও নেই। ঘোরতর বিপদের মধ্যেও আমরা কিছু-না-কিছু শুভ দেখতে পাই। এবং ইচ্ছে করলে দুঃখকে আমরা সময়ে সময়ে সুখে পরিণত করতে পারি। স্পেন্সার তাঁর First Principles of Religion and Science নামক গ্রন্থেও এই মত প্রকাশ করেছেন।




প্রবল ঝড় ধ্বংসের অবতার। এর অনিষ্টকারী শক্তি সম্পর্কে সকলেই জানি। কিন্তু এই ঝড়ের আনুষঙ্গিক ঘটনার মধ্যে আমরা কিছু ভালো কাজের সংযোগও দেখতে পাই। এর দ্বারা বায়ু পরিষ্কার হয, রোগ নির্বাসিত হয়, এবং ফল ও শস্য উৎপাদনকারী বৃষ্টি হয়ে থাকে। যন্ত্রণা ও কষ্ট যদিও সর্বব্যাপী, তবু এর মধ্যে আমরা কিছু-না-কিছু শুভ ফলাফল দেখতে পাই।




ঈশ্বর তাঁর বৃত্তের পরিধির সকল স্থানেই প্রথমত বেদনা বা যন্ত্রণা রেখে দিয়ে আমাদের জীবন রক্ষার্থে বিশেষ কিছু কাজ করে থাকেন। অগ্নির দহনে যদি আমরা জ্বালা-যন্ত্রণা অনুভব না করতাম, অস্ত্রের দ্বারা আমাদের মাংসবিদ্ধ হলে যদি আমরা কোনও যন্ত্রণা বোধ না করতাম এবং দুর্গন্ধে যদি আমাদের কোনও কষ্ট অনুভব না হতো, তাহলে আমাদের বর্তমান শারীরিক গঠন নিয়ে জীবিত থাকা অসম্ভব হতো। এরূপ অবস্থায় আমরা সবসময় নিজেই মৃত্যু চেয়ে নিতাম এবং আসন্ন বিপদও আমরা বুঝতে পারতাম না, অথবা যখন বিপদ হতে উদ্ধারের কোনও উপায় নেই, তখনই আমাদের চৈতন্য হতো।




অসংখ্য অপদার্থ ও নির্বোধ মানুষ আগুনে হাত পুড়িয়ে, অস্ত্ৰের ঘায়ে আহত হয়ে, ক্ষতিকর খাবার খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে, এটা সত্য বটে, কিন্তু এর মাধ্যমে তারা আত্মরক্ষার শিক্ষা পেয়ে থাকে। আমাদের শিক্ষা তিন প্রকারে হয়: দেখে, শুনে ও ঠেকে; কিন্তু শেষোক্ত প্রকারে যে শিক্ষা হয়, তা সবচাইতে স্থায়ী। স্বভাবের নিয়ম ভেঙে আমরা অনেকসময় অবিলম্বে শান্তি পাই না বটে, কিন্তু ধীরে ধীরে স্বভাব আমাদের চৈতন্য সৃষ্টি করে দেয়, যখন আমরা তার ইঙ্গিত গ্রহণ না করি এবং নিয়ম ভাঙার কাজ থেকে বিরত না হই, তা আমাদেরকে কর্কশ স্বরে লাঞ্ছনা করে। এতেও যদি আমরা তার আদেশ গ্রহণ না করি, তাহলে শীঘ্রই আমরা যথোচিত শাস্তি পাই। যদিও তার সতর্কতা ও শাস্তি আমাদের পক্ষে কষ্টদায়ক, তবু এর মাধ্যমেই আমাদের ব্যক্তিগত ও জাতিগত জীবন রক্ষা পেয়ে থাকে।




কষ্ট, যন্ত্রণা, শোক ও দুঃখ যে কেবল দৈহিক বা শারীরিক নিয়ম রক্ষার্থে কাজ করে, তা নয়, কিন্তু এদের দ্বারাই মানসিক পরিবর্তন ও চরিত্রের বিকাশ হয়ে থাকে। এর একটা দৃষ্টান্ত দিই।




চতুর্দশ শতাব্দীতে ইতালির অবস্থা অতি শোচনীয় হয়ে গিয়েছিল। নগরবাসীদের প্রায় সকলেই কোনো-না-কোনো ডাকাতের দলের সদস্য, চারিদিকে অরাজকতার একশেষ, আততায়ীরা অবাধে তাদের দুর্বৃত্তি চরিতার্থ করত। আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বিচার চেয়েও পেত না। এই সময়ে ইতালির দুইজন সহোদর যুবক আশা, স্বপ্ন, উন্নতি ইত্যাদি নিয়ে গল্প করতে করতে সন্ধ্যাবেলায় রাস্তায় হাঁটছিলেন। হঠাৎ বড়ো ভাই ছোটো ভাইকে রেখে কোনও কাজে একটু দূরে কোথাও গেলেন। ফিরে এসে দেখলেন, ভাইয়ের রক্তাক্ত মৃতদেহ পথের ধুলায় লুটাচ্ছে। এই ঘটনাটা তাঁর জীবনকে পুরোপুরি বদলে দিল। এ ঘটনা থেকে ইতালির পরিত্রাণকর্তার জন্ম হলো। সেই বড়ো ভাইটির নাম রিয়াঞ্জি। তিনি বলেছিলেন, "আমরা কি সত্যিই বিচার পাবো না? সময়‌ই সবকিছু বলে দেবে।" তিনি মাটিতে বসে পড়লেন, ভাইয়ের মৃতদেহের কাছে গিয়ে বিড়বিড় করে প্রার্থনাই হয়তো করলেন, এবং ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখমণ্ডল ছিল মৃত ভাইটির মুখমণ্ডলের মতোই বিবর্ণ, তবে সেখানে দুঃখের বদলে ছিল সমাজটাকে বদলে দেবার দৃপ্ত শপথ। তাঁর সাহসিকতা পরবর্তীতে কবি ও লেখকদের লেখায় বন্দিত হয়েছে যুগে যুগে। মানুষ এভাবেই একদিন নিজে বদলায়, সমাজ বদলায়।




ইতিহাস হতে এরূপ শত শত দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করা যাবে। স্বার্থত্যাগ, আত্মজ্ঞান, সাহস, বিক্রম, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা প্রভৃতি সদ্গুণ কোনও সময়ে কষ্ট ও যন্ত্রণা ছাড়া সম্পূর্ণ বিকশিত হয় কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। যাঁরা কষ্ট সহ্য করেছেন, তাঁরাই শক্তিশালী। যাঁরা নিজ শরীরে যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, তাঁরা পরের দুঃখ ও যন্ত্রণা নিবারণ করতে ও তাঁদের সহমর্মী হতে সক্ষম। এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, ব্যক্তিগত দুঃখ ও যন্ত্রণাই পারস্পরিক আনুকূল্যের প্রস্রবণ। অন্যের দুঃখ নিবারণ করতে গিয়ে নিজের দুঃখ অনেক পরিমাণে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। কষ্ট ও যন্ত্রণা হতে অন্য ধরনের উপকারও হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে কেবল যে দুঃখী ও যন্ত্রণাভোগী নিজের হৃদয়কে পরিশুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে শক্তি লাভ করে, তা নয়; এটি আশ্রয়দাতার হৃদয়েও সহানুভূতি ও পরোপকারের ভাব জাগিয়ে দেয়। Oliver Wendell Holmes বিষয়টি নিয়ে সুন্দর কথা বলেছেন। দীর্ঘকাল ধরে রোগগ্রস্ত বন্ধুর সেবাশুশ্রূষায় নিজেকে ব্যস্ত রাখলে যেমন চুল-দাড়ি কাটার ও যত্ন করার সময় পাওয়া যায় না বলে দুই-ই সাদা ও দীর্ঘ হয়ে যায়, ঠিক তেমনি এতে নিজের হৃদয়‌ও শুভ্র বা পবিত্র হয়।




জীবনের ইতিহাস বলে, যাদের জন্য আমরা কষ্ট ভোগ করি, তাদের প্রতিই আমরা অধিক অনুরক্ত হই। গৰ্ভধারণ, প্ৰসবকালীন বেদনা এবং সন্তান লালন-পালনে মায়ের যে কষ্ট ও চিন্তা হয়ে থাকে, তা-ই সন্তানের প্রতি অকৃত্রিম স্নেহের মূল। এতক্ষণ যা বললাম, তা পড়ে কেউ এটা ভাববেন না যে, দুঃখ-কষ্টের ভয়াবহতা নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করতেই এত কিছুর অবতারণা করেছি। তবে এটা বলা যেতে পারে, উপযুক্ত চিন্তার মাধ্যমে আমরা এর অন্ধকারাচ্ছন্ন পথকে কিছুটা হলেও আলোকিত করতে সমর্থ হই। এই বিচারে আমরা কিছু সিদ্ধান্তে আসতে পারি:




১। পৃথিবী কেবল সুখের অথবা কেবল দুঃখের আগার নয়, সুখ ও দুঃখ দুই-ই সকল মানুষের জীবনে অনিবার্য ঘটনা।




২। জ্ঞান, বিদ্যা ও ধর্মের আলোচনায় পৃথিবীতে যা দেখা ও অনুভব করা যায়, তার বাইরেও সুখের অনেক অনুষঙ্গের সৃষ্টি যেমন আমরা করি, ঠিক তেমনি আমাদের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে নতুন নতুন দুঃখের সৃষ্টিও এই প্রক্রিয়ায় হয়ে থাকে।




৩। দুঃখকে যেভাবে অপ্রিয় কিছু বলে আমরা সাধারণত অসন্তোষ প্রকাশ করে থাকি, প্রকৃতপক্ষে তা তেমন অহিতকর কিছু নয়। বর্তমানে পৃথিবীর যেরূপ গঠন ও বাহ্য বস্তুর সাথে আমাদের যেরূপ সম্বন্ধ আছে, তা অনুভব করলে দুঃখ-যন্ত্রণা আমাদের জীবন রক্ষার্থে আবশ্যক বলেই মনে হয়। তবে এর জন্য দুঃখের সৌন্দর্য অনুভব করা শিখতে হয়।




৪। দুঃখ-কষ্ট হতেই ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, স্বার্থত্যাগ, সাহস, বিক্রম, সহানুভূতি, স্নেহ, মমতা প্রভৃতি সদ্গুণের জন্ম হয়।




এখন দেখা যাক, সুখবৃদ্ধি ও দুঃখহ্রাস করতে হলে আমাদের কী করা দরকার। যখন দেখছি, দুঃখ অনিবার্য, তখন আমরা যেখানেই যাই না কেন, যত‌ই সুখ খুঁজে বেড়াই না কেন, আমাদের কর্তব্যকাজ যতই ভালোভাবে সম্পন্ন করি না কেন, তবুও অসম্পূর্ণ মানুষের দুঃখের হাত থেকে রক্ষা নেই, শারিরীক বা মানসিক বা উভয় প্রকারের কষ্ট কিছু হলেও সহ্য করতে হবেই হবে। অনেকসময় আমরা আমাদের নিজেদের উপর বিরক্ত হই। প্রতিজ্ঞাপালনে অক্ষম হলে, আশানুযায়ী উন্নতি লাভ করতে না পারলে আত্মগ্লানি এসে আমাদেরকে বিহ্বল করে দেয়। দুঃখ, কষ্ট ও যন্ত্রণা চারিদিকে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। যদি আমরা ওদের নিজের ইচ্ছেয় বহন করি, তবে ওরাও আমাদেরকে বহন করবে এবং আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। যদি আমরা অনিচ্ছাপূর্বক ওদের বহন করি, তাহলে ওরা আমাদের উপর আধিপত্য প্রকাশ করবে এবং আমরা ওদের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ব, অথচ ওদের হাত থেকে মুক্তিলাভ করতে পারব না।




একটা অপ্রীতিকর অশুভ জিনিস যখন আমরা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হই, তখন দেখতে পাই, আরেকটা গুরুতর অশুভ কিছু এসে উপস্থিত হয়। যা কিনা এ পর্যন্ত কেউই সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে পারেনি, তার হাত থেকে আমরা কীভাবে মুক্তি পাবো? বরং ওরকম মুক্তির আশা দুরাশা মাত্র। ধার্মিক লোকেদেরও দুঃখ অল্প নয়। যতই তাঁরা উন্নতি লাভ করেন এবং ঈশ্বরপ্রেমে অনুরক্ত হন, ততই তাঁরা ঈশ্বরের বিচ্ছেদে দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করেন।




দুঃখের সময় ঈশ্বরের প্রেমসুখ যেমন সুমিষ্ট বোধ হয়, তেমন আর কোনও সময়ই হয় না। যখন সমস্ত পৃথিবী আমাদের বিমুখ হয়, আমরা নিঃসহায় ও নিরাশ্রয় হয়ে ঊর্দ্ধে দৃষ্টিপাত করি ও নয়নাশ্রু বিসর্জন করি, তখন অনুতাপিত হৃদয় কত‌ই-না সুখ পায়! তখনই বলি, দুঃখই পরিত্ৰাণের মূলমন্ত্র! যখন দুঃখ এসে আমাদেরকে অধিকার করে, তখন শত্রুরা আর আমাদেরকে আক্রমণ করে না। দুঃখই মানুষের হৃদয়ের বল বৃদ্ধি করে।




আলেকজান্ডার বেইন তাঁর পৃথিবীবিখ্যাত গ্রন্থ 'মেন্টাল অ্যান্ড মরাল সায়েন্স'-এ সুখলাভের জন্য কিছু নিয়ম সম্পর্কে লিখেছেন:




(১) কোনও সুখের পরাকাষ্ঠা লাভ করতে হলে সুখের কারণ সম্পূর্ণ নূতন হওয়া আবশ্যক। যেমন বাবা-মা'য়ের প্রথম সন্তানের সুখ, নূতন প্রেমের সুখ, নূতন জায়গায় ভ্রমণের সুখ, নূতন যে-কোন‌ও অভিজ্ঞতা লাভের সুখ ইত্যাদি।




(২) প্রত্যেক সুখের কিছুকাল নিবৃত্তি থাকা আবশ্যক, নাহলে তা সুখ বলে অনুভূত‌ই হবে না। আমরা কোনও আহ্লাদ বা সুখ কেবল কিছুকালের জন্য সম্ভোগ করতে পারি, তার অতিরিক্ত আর পারি না। সুখোৎপত্তির জন্য সুখের বিষয়ে কিছুকালের বিরাম থাকা দরকার। নিত্য অভিজ্ঞতা সাধারণত কার‌ও কাছেই সুখের মনে হয় না।




(৩) অনবরত সুখে থাকতে হলে প্রত্যেক ব্যক্তির নানা প্রকারের সুখের বস্তু বা অনুষঙ্গ থাকা আবশ্যক। এই সকল বস্তুতে যত বৈচিত্র্য থাকবে ও ক্রমান্বয়ে সেগুলি যত মানুষের নাগালের মধ্যে আসবে, সুখ ততই বৃদ্ধি পাবে। কোনও সুর যতই সুমিষ্ট ও সুশ্রাব্য হোক না কেন, তা বার বার একটানা শুনলে কখনোই সুখলাভ হবে না। যন্ত্রণা হতে মুক্তিও  সুখের আরেকটা উপায়, যেমন রোগভোগের পর সুস্থতালাভ। মনের কোন‌ও উদ্‌বেগ বা গ্লানির অবসান। দীর্ঘকাল ধরে চলমান কোনও বিপদ হতে মুক্তিলাভ। বহুকালের ঈপ্সিত অথচ অতৃপ্ত কোনও সুখপ্রাপ্তি। এ সবই সুখের অনুভূতি সৃষ্টি করে। সুখলাভ করতে হলে তার আগে কষ্ট বা দুঃখ ভোগ করা যে একান্ত আবশ্যক, তা নয়, কিছুকাল সুখের বিরামই সুখভোগের পক্ষে যথেষ্ট। খাবার, খেলাধুলা, মেলামেশা, সংগীত, সৃজনশীলতার চর্চা ইত্যাদি থেকে আমরা যে সুখ পাই, তার মধ্যে কখনো কখনো বিরাম দেওয়া খুব দরকার। এ ধরনের বিরামের পরের সুখই যথার্থ অর্থে নির্মল ও শুদ্ধ সুখ। কিন্তু এটাও ধ্রুব সত্য যে, দুঃখ-কষ্টের পর আমরা যে সুখ পাই, প্রখরতার বিচারে তার স্থান সবার উপরে।




(৫) পরিশ্রমের কষ্ট লাঘব করার জন্য পরিবর্তনও উপকারী। সম্পূর্ণরূপে ক্লান্ত না হলে, এক ধরনের কাজে পরিশ্রান্ত হলে, অন্য ধরনের কাজ করতে আমাদের ভালো লাগে। মানসিক পরিশ্রমে ক্লান্ত হলে, আমরা শারীরিক পরিশ্রম সহজেই করতে পারি। চিন্তাতে বিরত হয়ে পড়াশোনা বা অন্য কাজ করতে পারি। বিজ্ঞানচর্চা হতে বিরত হয়ে সাহিত্য বা আর্টের আলোচনা করতে পারি আনন্দ নিয়েই। নিজে কোনও কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে অন্য লোকের সাহায্যে সেই কাজ করা যায়।




(৬) স্বভাবদত্ত সুখ ছাড়াই আমরা সুখের স্থান বৃদ্ধি করতে পারি। জ্ঞান ও ধর্মের আলোচনা এবং উৎকর্ষলাভই এই ধরনের সুখলাভের পথ। প্রকৃতি ও মানুষের জীবনের নানান গূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে জানার ও আলোচনার মধ্য থেকেও আমরা সুখ খুঁজে নিতে পারি। প্রার্থনার মাধ্যমেও অপার সুখের সন্ধান পাওয়া যায়।




আমরা দেখলাম, সচরাচর যতটা মনে করে থাকি, দুঃখ আমাদের শরীরের ও মনের ততটা ক্ষতি করে না। বরং আমরা অনেকসময় দুঃখের ভেতরেই আমাদের কল্যাণের উপকরণ খুঁজে পাই। তাই সন্তুষ্ট চিত্তে আমাদের সকল অবস্থাই গ্রহণ করা জরুরি। দুঃখের সময়ে মনে শক্তি সঞ্চয় করে নূতন উৎসাহ ও তেজের সাথে কাজে প্রবৃত্ত হওয়া আমাদের পক্ষে মঙ্গলজনক এবং এ-ও যেন আমরা মাথায় রাখি যে, সুখের সময় খুব সাবধানে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এর কারণ, সুখ ও দুঃখ উভয়ই আমাদের কৌশলে পরীক্ষা করে, উভয়ই আমাদের সহজে বিপথে নিয়ে যেতে পারে, এবং অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয়, সুখের সেই ক্ষমতা দুঃখের চাইতে অনেক বেশি। এ কারণেই মানুষ দুঃখে যতটা কষ্ট পায়, ততোধিক নষ্ট হয় সুখে।