জ্ঞান যেখানে বৃথা

তুমি বলেছিলে, তোমাকে যে-দিন ভালোবাসব, সে-দিন বুঝব, তোমাকে ঠিক জেনেছি। ভালোবাসা আর ক‌ই হলো? তোমাকে একেবারে ভুলে না হোক, তোমায় ছেড়ে তো প্রায় সারাদিনই কাটাই। তোমার কাছে যেতে ইচ্ছে হয় না। যখন যাই তোমার কাছে, তখনও তোমাতে চোখ স্থির রাখতে পারিনে। তোমার সৌন্দর্যে ভুলিনি। তাই বুঝেছি, তোমাকে জানা হয়নি। জানলে এমন হতো না। জানলে তোমার জন্যে ব্যস্ত হতাম, তোমার অদর্শন কষ্টকর হতো, তোমার দর্শন মধুর হতো।




জ্ঞানের বড়াই ভেঙে দিলে। অত পড়াশোনা, অত চিন্তা-আলোচনাতেও, তোমাকে জানা হয়নি। তবে কি জ্ঞানচেষ্টা বৃথা হয়েছে? তাতে শ্রম কি নিষ্ফল হয়েছে? তা-ও তো ভাবতে পারছিনে। এই যে তোমাকে অত কাছে জেনে, তোমাকে একেবারে আত্মার আত্মা জেনে, সারবস্তু জেনে, তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারছি, তা তো সম্ভব হতো না জ্ঞান পাবার চেষ্টা না করলে। ঠিক জ্ঞান যে হয়নি, যে-জ্ঞানে প্রেম হয়, মুগ্ধ ভাব হয়, মগ্ন ভাব হয়, তা-ও তো এই জ্ঞানচেষ্টার ভেতর দিয়েই দেখাচ্ছ।




এখন দিব্যজ্ঞান কেমন করে হয় বলো। যে-পথ দিয়ে এনেছ, সেই পথ দিয়েই হবে বলছ। এই পথ শ্রবণের পথ, মননের পথ, সাধনার পথ, আরও ঐকান্তিকভাবে ধ্যানধারণা অভ্যেস করে সমাধিস্থ হবার পথ। আমার আলস্যই আমার পথের কণ্টক। আমার চরণ চলিতে নারে, তবু নয়ন দেখতে চায়। তোমার একটু আভাস যখন পাই, তখন তো তোমাতে ডুবতে আমার ইচ্ছে হয়। কিন্তু আভাসে আর হবে না। ভালো করে দেখা দিতে হবে আর সাধনে শ্রম করবার শক্তি দিতে হবে। যা পরম শ্রেয়, তা-ই দুর্লভ করে রেখেছ, এই বিধানের বিপক্ষে আর আমি কী বলব?




ঠিকই হয়েছে। আমাকে তো সময় দিয়েছ, এখন শক্তি দাও। একদিকে তো সুলভের চূড়ান্ত তুমি, ইচ্ছা করলেই তো তোমাকে দেখা যায়। একেবারে প্রাণের প্রাণ হয়ে আছ। সৰ্বময়, সর্বরূপী হয়ে আছ। তোমার দিকে চেয়ে থাকলেই হলো। এই চেয়ে থাকার ক্লেশটুকু নিতে পারি না কেন? এমন‌ই হোক যে চেয়ে থাকায় ক্লেশও হবে না, চেয়ে থাকলে বরং সুখই হবে। মোহ এখনও ঘোচেনি তাহলে।




এই যে বলছি, তুমি সর্বময়, সর্বরূপী, তা ঠিক বুঝিনি। যে মুহূর্তে ঠিক সৰ্বময়, সর্বরূপী, অন্তরাত্মা বলে দেখি, সেই মুহূর্তে দেখা মধুরই লাগে। কিন্তু পরমুহূর্তেই মোহ আসে। তখন তোমার সাক্ষাৎ অখণ্ড ভাব তিরোহিত হয়ে গিয়ে লৌকিক ব্যাবহারিক ধারণা আসে, আর আমি তোমা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিই। ওই যে মুহূর্তের ঠিক চাহনি, স্থির দৃষ্টি, সেটা স্থায়ী হলেই বুঝি হৃদয় তোমাতে মজে থাকবে, তোমার অদর্শন কষ্টকর হবে, তোমার দর্শন লোভের জিনিস হবে? আমার সেই দৃষ্টিরূপী জ্ঞান হয়নি, তাই আমি গরিব, তাই আমার মনে হয়, আমার কিছুই হয়নি। ওই লোভটুকু না হলে কী-ইবা হলো? অন্য সমস্ত চেষ্টা তো দেখি কেবলই জঙ্গলকাটা।




আমাকে একবিন্দু প্রেম, তোমাতে একটু লোভ, শিগ্‌গির দিতে হবে। তা না হলে মনে করব, সারাজীবনটা বৃথা হলো। তোমার সত্য যদি আমাকে দিয়ে প্রচার করাতে হয়, তবে সত্যলাভের প্রমাণ হিসেবে একটু প্রেম আমাকে শিগ্‌গির দাও। তোমার প্রেমরাজ্যের অসীম সম্পত্তি আমার কাছে অনাবিষ্কৃত রয়েছে। সেসব তুমি যখন আমাকে দেবার উপযুক্ত বোধ করো, তখন দিয়ো। প্রাণের একটু টান না হলে আমার আর চলছে না। যদি সেই টানটুকু পাই, তোমার কাছে ডোবার ইচ্ছে যদি আমার একটু হয়, তবে বুঝব, এই সংগ্রামময় জীবন বৃথা হয়নি।