অনুমান থেকে অনুভবে

তোমার ভেতর আমাকে আর আমার ভেতর তোমাকে দেখে আমি কৃতার্থ হচ্ছি। তুমি আর আমার অনুমানের বিষয় নও, অন্ধবিশ্বাসের বিষয় নও; তোমায় প্রাণরূপে, আত্মারূপে, বিশ্বরূপে দেখে আমি সন্দেহমুক্ত হয়েছি। কিন্তু আমি যে তোমাকে বুঝেছি মনে করি, তা দেখছি তুমি আমায় দেখা দিয়ে আমার সন্দেহ দূর করেছ, আমার সাধ্যি নেই যে তোমাকে সন্দেহ করি। তুমি একেবারে দৃষ্টির সমস্ত বেড় ঘিরে রয়েছ। যতদূর দৃষ্টি যায়, চিন্তা যায়, ততদূর তুমি। যেখানে না যায়, সেখানেও তুমি। তুমি একমাত্র, অনন্ত, অখণ্ড বস্তু। তুমি ছাড়া আর কিছু থাকলে বরং তোমাকে সন্দেহ করতে পারতাম; তুমি একেবারে সর্বরূপে প্রকাশ পেয়েছ।




আমি যে তোমার সঙ্গে এক অথচ ভিন্ন হয়ে তোমাতে রয়েছি, তা-ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু তুমি কেমন করে এক অখণ্ড হয়েও আমায় তোমা থেকে ভিন্ন করে সৃষ্টি করলে, আর ভিন্ন করে লালন-পালন করছ, তা দেখেও বুঝতে পারছিনে। আমি তোমাতে থেকেও যে তোমার সব জানিনে, তা তো স্পষ্টই দেখছি। যা এক বার, এক বার কেন, সহস্র বার জানিয়েছ, তা-ও যে আমার কাছ থেকে লুকিয়ে যায়, আবার আমার কাছে আসে, তা তো প্রতিমুহূর্তেই দেখছি। এই দেখা না দেখায়, এই লুকোচুরিতেই তো আমার জীবন।




আমার আর সন্দেহ নেই যে তোমার মধ্যে দুটো রূপ আছে---অসীম আর সসীম, মাতা আর পুত্র। আকারে এক, অথচ ভিন্ন। আমি দেখছি, অথচ বুঝছি না। তুমি যা করেছ--- অসীম হয়ে, অসীম থেকেই, নিজের ভেতরে সসীমকে সৃষ্টি করা, পালন করা... এ তো কোনও জীব পারে না। তাই কি এ বুঝি না? নিজের ভিতরে যা নেই, তা বুঝব কী করে? বুঝিনে অথচ দেখছি, তুমি চোখ ধরে দেখাচ্ছ। ভালোই হলো। বোঝাটাকে অনেক সময় বড়ো বেশি বাড়াই, আর বোঝাটাতে অনেক সময় বোধ হয় অহংকারও আসে, যদিও অহংকারে বার বারই আঘাত করছ। ভালোই হলো, ধর্মে যে রহস্য থাকবে, সবই আলোক হয়ে যাবে না, এটা তুমি স্পষ্ট দেখাচ্ছ।




কী অদ্ভুত রহস্য... তুমি মা, আমি ছেলে, অথচ তোমার সঙ্গে আমি এক, এক অথচ ভিন্ন! এক অথচ অত ভিন্ন যে তুমি আমার জন্য নিত্য ব্যস্ত। এই ব্যস্ততাটা তো আর কেউ আমাকে কাল্পনিক বলে বোঝাতে পারবে না। কেন যে তুমি ব্যস্ত, তা-ও আমি বুঝি না, কেবল দেখি যে, তুমি ব্যস্ত। এই ব্যস্ততাই তোমার মহিমা, তোমার সৌন্দর্য, তোমার মাধুৰ্য। তুমি যদি একাকী হতে, এই ছেলে না গড়তে, এই ছেলের জন্যে শয়নে-স্বপনে-জাগরণে ব্যস্ত না হতে, এই বিচিত্র জগৎ তার ভোগের জন্যে বিস্তার না করতে, তবে কোথায় থাকত তোমার মহিমা, তোমার সৌন্দর্য, তোমার মাধুর্য?




যে একাকী থাকে, কারও জন্যে ভাবে না, কারও জন্যে ব্যস্ত হয় না, তার জীবনের কী মূল্য? কী অদ্ভুত তত্ত্ব দেখাচ্ছ, কী অদ্ভুত কথা শোনাচ্ছ! আমি এই তত্ত্ব দেখে, এই কথা শুনে, কেমন করে শুষ্ক, উদাসী, প্রেমহীন জীবন কাটাই! তোমার ব্যস্ততার এককণা আমাকে দাও। আমার ব্যস্ততা তার ব্যস্ততার পরিচয় দিক এবার।