জলঘড়ি পাখা (৬ষ্ঠ অংশ)

- তুমি বললে, আমি উদাসীন! খুব একটা ভুল পথে হাঁটোনি। বিষয়টা মূলত জীবনের কাছে ব্যক্তির চাওয়া-পাওয়া নিয়ে। যখন কেউ জীবনের কাছে তার আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পায় না, তখনই সে উদাসীন হয়। এটাকে ঘুরিয়ে বলা যায়, জীবন দেয়নি, তাই জীবনই ব্যক্তিকে অবহেলা করেছে; যদি না করত, তাহলে নিশ্চয়ই দিত। ব্যাপারটা আসলে একই।
- ‘জীবন’ একটা শব্দ, সেটাকে কীভাবে বাক্যে সাজাবে, সেটা ব্যক্তির নিজের কাছে, যদি না সে অদৃষ্টবাদী হয়। ব্যক্তির কাছেও জীবনের কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকে।
- কথা মন্দ নয়। আসলে মানুষ একটা ধারক। চালক কে, বিষয়টা নির্ণেয়, কেননা জীবনের কাছে চাওয়ার মৌলিক মাত্রা অনেকটা একই, যেমন ক্ষুধানিবৃত্তির দাবিটা সর্বজনীন। খাদ্যের মান হয়তো ভিন্নতায় থাকে, কিন্তু যখন ক্ষুধাটাই অনাহারী, তখন প্রশ্ন আসে, কে অবহেলা করল—জীবন, না ব্যক্তি? এখানে জীবন মনে হয় সময়ের সামষ্টিক নাম। জীবন বর্জিত হতে পারে, যুদ্ধ করে জীবিকা ছিনিয়ে নিতে হয়, সহজাত জীবনটা যখন বাতিল হয়ে যায়। 




- সহজাত জীবনটা বাতিল হয় মূলত অর্থনৈতিক বন্যতার প্রভাবে। আমাদের কাব্যিক চায়ের আড্ডায় রাজনীতি-শিক্ষা-অর্থনীতি, এই ত্রিপাণ্ডা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, মনে আছে, নীল? তুমি ছাত্রী এবং শ্রোতা হিসেবে বেশ পছন্দনীয় অবস্থানে থেকেছ বরাবরই। 
- আমার বরাবরই শেয়ার মার্কেট নিয়ে কৌতূহলটা একটু বেশিই। আমি যে খুব অর্থনীতি বুঝি, ব্যাপারটা তা নয়। মুক্ত অর্থনীতিতে গুডউইল নামের যে-চমকটা আছে, সেটাই আমাকে একটু তাড়িয়ে বেড়ায়। ইঁদুর-বেড়াল খেলা মনে হয় সাধারণ মানুষও উপভোগ করে।




- যারা স্টকমার্কেটে শেয়ার কেনা-বেচা করেন, তারা এগুলো হরদম করেন—entry at support, exit at resistance, আবার same stock  price ওই resistance level break করে আরও বাড়লেই re-entry…re-exit।
- বুঝলাম, বেশ উপাদেয়। মূলত বিষয়টা প্রতিযোগীনির্ভর। এতে প্রতিযোগিতা আছে, পুঁজি প্রতিযোগী চায়। আমার মনে হলো, বোধ কেনা-বেচা যোগ্য নয়, বিবেক মৃত্যুযোগ্য কিন্তু বিক্রয়যোগ্য নয়, বোধ-বিবেকের আঁতুরঘর শিক্ষা, সেই শিক্ষাই আজ লাভজনক পণ্য। বললাম, আমাদের শিক্ষাকাঠামোর বণিক মানসিকতার কথা ভেবে। এই যেমন, একদিকে শিক্ষাক্রয় এখন বেশ দামি, আবার ছাত্রছাত্রীদের প্রতি অতিআবেগী দেখভাল করার সিস্টেম্যাটিক অ্যাডভান্টেজ নেওয়াও এখন বেশ বুনিয়াদী চর্চা বলা যায়। 
- শিক্ষা ব্যবসায়ী শ্রেণির বণিক মানসিকতার চাবিকাঠি, তবে সেটা চতুর মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত। 
গুডউইল, মুক্ত অর্থনীতি অথবা শেয়ার মার্কেট যা-ই বলো না কেন, সব কিছুর সূত্রপাত শিক্ষা এবং তার সঙ্গে একদল মানুষের উচ্চাভিলাষ। শিক্ষা মৌলিক চাহিদা মেটানোর পথ দেখায়, মানুষ সেটাকে কাজে না লাগিয়ে বরং ব্যবহার করে এবং ফলস্বরূপ অর্থনীতির আঠালো চটচটে সব শাখা-প্রশাখার জন্ম।




- তা মেয়ে, নিজের পছন্দসই প্রসঙ্গ পেলে তো খুউব কথার ফুলঝুরি ছোটাও দেখছি। এই তুমিই কিনা রসবোধের ধারেকাছেও ঘেঁষতে চাও না। যদি সুদূরে দেখা যেত নীলাম্বরী, তবে হয়তো তুমিও বলতে, ভালোবাসি। পৃথিবীটা এত নির্জন, বড্ড বেশি শব্দহীন সময়গুলো।
- আমি অবিরত তোমার মুখোমুখি বসে থাকি। তোমাকে ছুঁয়েও দেখি, বিশ্বাস হবে কি? কিন্তু আমার কাছে আমার শব্দগুলো নেই।
- তোমার তো রাখার কথা নয়, তোমার কাছে থাকবে কেন? এগুলো আমার সময়ের সমষ্টি, আমার একান্ত।
- অলক্ষ্যে থাকবে নারী,
বুকের গহিনে ডুবুরি পুরুষ, 
দিনশেষে আমি দরিদ্র মানুষ।
- অলক্ষ্যে আর কই! আমি যে উন্মুক্ত মানুষ। 
- হয়তো তোমার এমন ভাবনা, কিন্তু খোলসের আড়ালে তোমাকে মুক্ত করে মুখোমুখি কতটা হওয়া যায়! আমিও স্তব্ধ মানুষ তখন।
- অবশেষে, কৃষ্ণচূড়া আছে। কৃষ্ণকুমারী আজও আসেনি।