জলঘড়ি পাখা (৫ম অংশ)

- ভালোবাসার প্রত্যাশা আমার ছিল না অনেকটা জীবন। নিজেকে আমি নীরস পাত্র হিসেবেই মানি।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলাম তোমাকে দেখে। বলতে দ্বিধা নেই, ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা জন্মাল; তা-ও এক প্রচণ্ড অসম্ভবের মাত্রা ছুঁয়ে। মনে হলো, হয়তো আমি পারব একটা সরল মাত্রায় জীবনকে সরস রাখতে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমার সে সক্ষমতা নেই।
- তোমার সক্ষমতা আছে এবং বেশ ভালো রকমেরই আছে। তাই অনেকটা পথ বেশ ভালোভাবে একসঙ্গে চলতে পারলে। সমস্যাটা হলো, আমি মানুষ হিসেবে সরল নই। আমার প্রকৃতিও সরল নয়। আমি সহজে কোনো কথায় বা কাজে কিছু মনে করি না, কোনো বাধ্যবাধকতা তো দিই-ই না। 
সবাইকে নিজের স্পেসেই থাকতে দিই। তবে যখন কোনোকিছু মনে করি, তখন ব্যাপারটা বেশ জটিল ছিল, এটা নিশ্চিত থাকতে পারো।
- তোমাকে বিতর্কিত মাত্রায় নেওয়াটা অযৌক্তিক বলে মনে করি। পৃথিবীতে আমার সময়টা বেশি গত হয়েছে। সুতরাং, তুমি সরল মানুষ নও, এটা বলা ঠিক নয়। তুমি যথার্থ।




- কী বলব! তোমার আস্থার জায়গাগুলো অটুট থাকুক। কারণ আমরা যা ভাবি বা বিশ্বাসে রাখি,
তার পূর্ণতা বা অপূর্ণতার অর্থ তাৎক্ষণিক হয় না। একটা সময় পর সময়ই এর প্রকৃত অনুবাদ তুলে ধরে। সে পর্যন্ত সবাইকে নিজের উপলব্ধির যথার্থতা জানতে অপেক্ষা করতে হয়। তোমাকেও করতে হবে—নিজের প্রকৃত নিরেট যথার্থ আমি-টাকে চিহ্নিত করতে। আর বাধ্যবাধকতা কেউ কাউকে দিতে পারে না। এটা ব্যক্তির বিকাশ সম্পর্কিত। 
ব্যক্তিই বোঝে, সে কোথায় থাকতে পারবে অথবা পারবে না; আমরা কেউ তার বাধ্যবাধকতা দিতে পারি না, এটা পারার কথাও না।




- নিজেকে নিজের মতো রাখতে চাওয়া, এটা ব্যক্তির স্বাধিকার। সেখানে অন্য যে-কেউ অনাহুত। তবে একই স্বাধিকারবোধ থেকে যে-কেউ নিজেকে প্রলম্বিত করতে পারে।
- আমি কখনও কাউকে ব্রিদিং-স্পেস দেবার যোগ্যতা রাখিনি। আমি বিশ্বাস করি, ব্যক্তি নিজেই নিজের পরিসর নির্মাণ করে।
- আমাকে যেটা নিশ্চিত করেছ, সেটা তো বুঝেছি। তবে জটিল ব্যাপারের কথা বলছ, সেটা নিজের দখলে না রেখে বরং সময়ের কাছে জমা দিতে পারো, তাতে অন্তত আগামীকে মেনে নেওয়া সহজ হবে।
- জানো, কেউ একটা কথা বলতে যতটা সময় নেয়, সেই কথার অর্থবিশ্লেষণ, পর্যালোচনা এবং ফলাফল নির্ধারণ করতে আমার এর চেয়ে কম সময় লাগে। এক-একটা ঘটনা পর পর সাজাতে আমার বেগ পেতে হয় না। বিশ্বাসের কথা বললে, এটা কিন্তু আমার বিশ্বাস নয়; পরীক্ষিত অভিজ্ঞতা বলতে পারো। বিশ্বাসে মানুষ কিছুটা অন্ধ হয়েই থাকে, অভিজ্ঞতা বাস্তব সত্য। যা-ই হোক, এখন পর্যন্ত আমি নিজেকে এতটুকুই চিনি; সময় এবং পরিস্থিতির জন্য পরিবর্তন হতে পারে কিছুটা, এতে আমার বলার কিছু নেই। নতুন কিছু মেনে নেবার মতন হলে মেনে নেব। সময়ের কাছে অনেক কিছুই জমা দেওয়া, নিজের কাছে নিজের জন্য হলেও কিছু রাখতে পছন্দ করি। সময় যতক্ষণ না বলছে, পরিবর্তন অপরিহার্য, অন্তত ততক্ষণ পর্যন্ত। সহজ কথা, মনের উপর জোর করে কপট অভিনয় কখনও পারি না।
- অনেক রাত জাগিয়ে রাখলাম। কথাগুলো বলা হলো, এ-ওবা কম কীসে! অন্তত নিজেকে আমি আরও এক বার দেখার সুযোগ পেলাম। তোমার অনেক কথার সাথে আমার তাত্ত্বিক দ্বিমত আছে। এগুলো আসলে কথার মোড়ে মোড়ে ভেঙে নিতে হয়, এখানে তো তেমন সুযোগ নেই।




- 'কপট অভিনয়' কথাটা আমরা আত্মপক্ষে নিয়ে রাখতে চাই, কিন্তু চূড়ান্ত বিরক্তি ঢেকে আমরা সভ্যরাই বলি, 'আবার দেখা হবে’, ‘ভালো থাকবেন’ ইত্যাদি। কপটতাকে মানুষ জন্মে অস্বীকার করার সুযোগ বোধ হয় পায় না। আমরা কেউ ইগোয়িস্টিকভাবেই কপট, কেউবা ভারসাম্যের জন্য।
- বুঝলাম, তোমার তত্ত্ব অনুযায়ী আমি অসভ্য। তাতে অবশ্য আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। আমি বরং এতেই ভালো থাকি।




- আসলেই তুমি এমন একটা কথা বললে, যা আমি কখনও উচ্চারণও করি না। এখন তোমার মুখোমুখি কথা না বলে কিছু বোঝানো সম্ভব নয়। দয়া করে, শেষবার যে-অর্থ তুমি খু্ঁজে আনলে, সেখানে আমাকে রেখো না, কথার যথার্থ ব্যবহারে ভুল হলে বলতে পারো।
- আমি বলেছি, বিরোধ-স্থানে যদি মুখোমুখি কথা হয়, তাহলে সুবিধা হয়। তুমি কী বুঝলে!
- আরে! আমি এমন বলিনি। তুমি বললে “চূড়ান্ত বিরক্তি ঢেকে আমরা সভ্যরাই বলি, আবার দেখা হবে, ভালো থাকবেন…” আমি তো কখনও তা করিনি, করবও না। তাই বললাম, এই তত্ত্ব অনুযায়ী আমি সভ্যের বাইরের মানুষ।




- তা তুমি সভ্যের বাইরে গেলে কেন! তুমি সব অপছন্দ প্রকাশ করো, এটা যদি বলো, তবে
আমার কোনো কথা নেই। তবে আমি মনে করি, মানুষের সব বিরক্তি প্রকাশ করতে নেই... জীবনটাকে সহজ রাখতে চাইলে। দেখো, তুমি দুটো শব্দ বললে: ১। অসভ্য, ২। সভ্যের বাইরে। এই দুই শব্দেই কত ব্যবধান, এটা তো মানবে!




- অপছন্দ প্রকাশ না করলেই বরং জীবন জটিল হয়। অপর পাশের মানুষগুলো পছন্দ ভেবে পুনরাবৃত্তি করতে থাকবে, আর একই বিরক্তির মুখোমুখি হতে হবে। আমি আমার সব বিরক্তি প্রকাশ করি, সেটা সবসময় শব্দে হবে, এমন নয়।
- তোমার সাথে আমি এ কথায় দ্বিমত রাখছি। তুমি হয়তো বলতে চাইছ, শব্দে হোক বা অবয়বে হোক, তুমি সব অপছন্দ ঝেড়ে দাও। না, ভাই, এটা আদৌ সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি না। আর যদি পেরে থাকো, তবে তুমি বিশেষ কেউ।
- তুমি হয়তো ছোটো ছোটো ব্যাপার লক্ষ করো না। নইলে এটা বলতেই না। তোমার ক্ষেত্রেও আমার অপছন্দগুলো আমি সবসময় প্রকাশ করে এসেছি, সেটা হোক বিদায়কালীন 'শুভ রাত্রি' সম্ভাষণ বা আরও কিছু!




- দেখোনি, একটা মানুষ কতটা নিঃসঙ্গ হয়ে গেলে নিজেকে নতুন খোলসে ভরে! এটা শব্দের তাচ্ছিল্য। বিষয়টা কি শুধু যেভাবে ভাবছ, তেমনই!?
- কী জানি! আমার মনে হয়, একটা মনোজাগতিক বিষয় হয়তো আছে। কিছুটা কঠিন মনে হলো।
- না, কঠিন হবে কেন! মৃত্যু কতটা কঠিন, তা হয়তো জানা হয়নি, তবে বেঁচে থাকা কত কঠিন, এটা তো বুঝতে পারছি!
- বন্ধু! যে 'সকাল'-এর নাম ভুলে 'বিকেল' বলে ডাকে, তাকে জীবন-বর্জনকারীই বলা যায়। তাকে জীবন সম্পর্কে, সময় সম্পর্কে উদাসীন বলা যায়। তার ভেতরে তখন বোধশূন্যতা।
- বোধশূন্যতা কী করে হয়! জীবন সম্পর্কে যারা উদাসীন হয়, তাদের ভেতরে একান্ত মানুষের‌ই শূন্যতা, আমার তা-ই মনে হয়। জীবন সম্পর্কে উদাসীন আসলে কেউ হয় কি? 
- হয়তো জীবনই ব্যক্তিকে অবহেলা করে। তবে তুমি শেষ পর্যন্ত গোছানো মানুষের গল্প। তোমার পরিধি হোক সব শুভ সুন্দরে নির্মিত।