জলঘড়ি পাখা (শেষ অংশ)

- জানো, নীল, তুমি অনু হলে কৃষ্ণজীবন নতুন সংসার চাইত। অনুকে নিয়েও চেয়েছে। সেটা হয়নি। তুমি হলে হতো।
- আমি হলেও হতো না। অবস্থান একটা বড়ো ফ্যাক্টর। সেটা ডিঙোতে পারা অনেকসময় অসম্ভবের কাছাকাছি।
- হুঁ, এটা গভীর, মানুষ ইচ্ছেকে হত্যা করেও তার নিজের নির্মিত সত্তাকে পার হতে যখন ব্যর্থ হয়। তবুও উচ্চারণ করব—নিঃসঙ্গ থেকো না বন্ধু, সদা ব্যস্ত জীবনেও নিজের মানুষ রেখো, নিজের জন্য সময় রেখো।
- আমরা তো দুর্যোগময় জীবন পার করলাম, নিজের হতে পারিনি, পারা যায়নি। বন্ধু হিসেবেই বললাম। কাজের মানুষও একসময় ভীষণ একা হয়ে যায়, তখন একজন মানুষের শূন্যতা জীবনকে গ্রাস করে ফেলে। বেশি বলছি গো, তুমি তো জীবনের আরও বহুমুখী মাত্রা জানো।




- আমায় যা বললে, তাতে যদি তোমার নিজেরই আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে, তাহলে আমি সেটাকে গ্রহণ করব কীভাবে!
- আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি না, বন্ধু। তোমার প্রতি নিরেট আত্মবিশ্বাস থেকেই বলি। তুমি আমার অসম, কিন্তু সমবয়সী বন্ধু। মাঝে মাঝে মনে হয়, তোমাকে নিয়ে আমার প্রেমটা যৌক্তিক। হ্যাঁ, তোমাকে নিয়ে আমার একটা নিজস্ব প্রেম আছে। আমি তার সাথে বসি, কথা বিনিময় হয়, জীবনকে দেখি।
- বেশ! তুমি প্রেমটা বোঝো ভালো।
- না, তেমন নয়, আমার একটা নিজস্ব ঘরানার চিন্তাজগত আছে, দু-জন স্বাধীন মানুষের প্রেম তো লৌকিক হয় না, সেখানে চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে আবার প্রাপ্তিতেও পৌঁছতে হয়। এখানে সহমত যতটা থাকে, দ্বিমত আরও বেশি থাকে; যতটা উদাসীনতা থাকে, তার চেয়েও বেশি কাছাকাছি হওয়া থাকে; ভুলভ্রান্তির দরকষাকষি থাকে; সাময়িক বিষণ্ণতা থাকে; আবার অনিবার্য ফিরে যাওয়াও থাকে।




- সরব প্রেমিক আমি কখনও ছিলাম না। আমার অনেক বিপর্যয় আছে, আমার নিজস্ব দুঃখবিলাসী চিলেকোঠা আছে, আমার ব্যক্তিত্বহীন দৈন্য আর লজ্জাও কম নয়। এসব নিয়ে আমার নির্বাসিত জীবনও আছে। আমি সেখানে একাই বক্তা, একাই শ্রোতা, নিজেই বিজয়ী, আবার নিজেই পরাজিত।
- বিপর্যয় সবারই থাকে। প্রেমিক হিসেবেও তুমি যথেষ্ট ভালো। ওই সরব থেকে নীরবই যথার্থ। কোনো গল্পে সম্পর্কের মাত্রা বদলে মূল চরিত্রে থাকা, আবার সহযাত্রী হওয়া, আবার কাউকে ভালোবেসে অবশেষে নতুন বাসরে এগিয়ে দিয়ে আসা—এগুলো পরাবাস্তব কি না জানি না, তবে এমন হতেই পারে।




- সংসারবিবাগী সংসারী মানুষগুলো কষ্টে থাকবে, এটাই নিয়ম। 
- অথবা এটা কোনো নিয়মই নয়, বরং এটা অনিয়ম। বড়ো বেমানান এই সময়ে আমার আমিত্ব বলে, তুমি তো বেঁচে নেই, প্রাণময় মানুষগুলো থাক না ভালো।
- তোমাকে সামনে বসালে আমি নিজস্ব সময়ে অনেক নীরবতা কিনে রাখি। নীরবে কথা হয় বেশ।
- হুঁ, দেখি তোমাকে। বহুবোধে দেখি, কিছু বলা হয় না, আসলে তুমিবিচ্ছিন্ন জীবনটা একরকম ছিল, এখন রাতের অবশেষে অশ্রুর শিশির ছুঁতে হয়।




- তুমি ভালো আছ?
- ভালো থাকা! আমার কান্নার বয়স নেই, অথবা
কান্না আমার প্রতিবেশী নয়।
- বুঝলে, মেহু, আমার জায়গায় তোমার একজন সরল মন এবং সরল ব্রেইনের কাউকে প্রয়োজন ছিল! তোমার নির্বাচনে ভুল হয়ে গেছে। তাহলে তোমার কয়েক ট্রিলিয়ন ভারী কথা সেই সরল মন এবং সরল ব্রেইন স্টোর করে রাখত না। তুমি ভালো থাকতে একটা সুন্দর সম্পর্কে।
- না, এমনটা নয়। আমি হয়তো জানব না, তবে আমি মানি, একদিন সময় বলবে, আমি অতটা ভুল ছিলাম না। আমার বিশ্বাসে আমি সুখী, বন্ধু।
- কিছু বিষয় সময়ের কাছে ছেড়ে দিতে হয়, আমিও সময়ের কাছে সমর্পিত। তুমি নিজেকে দায়মুক্ত রাখতে পারো।
- তুমি বেপরোয়া প্রেমিক হতে পারো না।
কষ্টে ওম দিতে পারো, বেহিসেবি ছন্নছাড়া হতে পারো না।
তুমি চোখের শব্দের অনুবাদ পড়তে চাও না।
তুমি নিজেকে পরিতৃপ্ত করতে উদাসীন।
- বেশ! তারপর?




- তুমি ভুল গল্প শুনতে পারো না।
অনেক কিছু পারো না, অনেক কিছুই, অনেক কিছুই, অনেক…!
- তারপর?
- তুমি শুদ্ধতার পূজারী, এটা ভালো না।
তুমি পুড়তে জানো না।
তুমি অনুবাদ হও না।
তুমি বেশ পথ দেখিয়ে দিতে পারো!
না, কথায় থাকলে পথ ছোটো হয়,
মগ্নতা পথ ভুলিয়ে দেয়।
মধ্যরাতে মধ্য-আকাশে চাঁদের সঙ্গী লাগে না, তাই না, নীল?
- কোনো রাতেই, কোনো অবস্থান মাত্রায়ও চাঁদের সঙ্গী লাগে না।
- তবে চাঁদ কার অপেক্ষায়? 
- কারুর জন্য চাঁদের অপেক্ষা নেই, সবার অপেক্ষা চাঁদের জন্য, তাই চাঁদ নিজেকে প্রকাশ্যে আনে কখনো কখনো।
- চাঁদের বিরহ নেই বুঝি?
- না থাকাটাই স্বাভাবিক।
- তুমি জানো, কেন সে সাগরকে জাগায়?
- সাগর জাগে আকর্ষণের মোহ কাটাতে পারে না, তাই। চাঁদ নিজের পথে একাই নিজের গতি বজায় রাখে মাত্র।




- সাগর একতরফা বুঝি?
- 'একতরফা ভালোবাসা' নতুন কিছু তো নয়।
- চাঁদ লুকোয় কেন তাহলে?
- সূর্যকে জায়গা ছেড়ে দেয়। এটাই নিয়ম। জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। সূর্যের উন্মাদনা চাঁদ বোঝে।
- তোমার সঙ্গে কথায় পারা গেল না, নীল! আচ্ছা, মানুষকে জীবনে সময়েরও কি জায়গা ছেড়ে দিতে  হয়?
- সবাইকে এবং সব কিছুকেই জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। একটা তো প্রাকৃতিক অনিবার্যতা, আর একটা স্বেচ্ছা-অনিবার্যতা নিয়ে কথা নেই, কিন্তু ‘স্বেচ্ছা’ ব্যাপারটা নিয়ে হয়তো আলোচনার অবকাশ থাকে।




- বুঝলাম, এটা ভাববাদ-বিধৌত অনুভব এবং মানুষের আত্মদহনের শুদ্ধ উপলদ্ধি। আসলে ভালোবাসা স্বনির্বাচিত, স্বনির্মিত, নিজস্ব ভাষায় প্রকাশিত বিমূর্ত সুন্দর বই আর কিছু না।
- ভালো থাকবে সময়যাপনের সব মাত্রায়, জীবনের ভুলে-যাওয়া সময়ের শরীরে যেমন কষ্ট জড়িয়ে থাকে।
- 'ভালো থেকো' বলব না, ভালো থাকতে পারাতেই জীবনের সব অর্থ লুকিয়ে নেই, বলব তাই…শান্তিতে বাঁচো। শান্তিই শেষকথা।