গীতার শ্লোকার্থ: ৯/২৩

যেহ্প্যন্যদেবতাভক্তা যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ।
তেহপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যবিধিপূর্বকম্।।
(গীতা, ৯/২৩)




অনুবাদ: যারা অন্য (কোনো) দেবতার ভক্ত এবং শ্রদ্ধার সাথে (সেই অন্য দেবতার) পূজার্চনা করে, হে কৌন্তেয়, তারাও কিন্তু অবিধিপূর্বক আমারই পূজা করে।




পদ্যানুবাদ:
যে-ভক্ত শ্রদ্ধা-সহ অন্য দেবতার পূজা করে
যথাবিধ না হলেও, বস্তুত সে আমারই পূজারি।
(মহাপয়ারামৃত গীতা, বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায় অনূদিত)




ব্যাখ্যা:
: যারা অনন্য তথা কেবলই তোমার উপাসক হতে পেরেছে, তাদের তো চিন্তাই নেই, তুমি তো তাদের সকল ভার নিজেই বহন করে থাকো, কিন্তু যারা অন্য দেবতার (সাকার) পূজা করে—বেশ শ্রদ্ধার সাথেই পূজা করে, তাদের অবস্থা কেমন হয়ে থাকে?




: ‘অন্য’ শব্দের অর্থই এখানে ‘আমি’ ব্যতীত—অর্থাৎ, আত্মা ব্যতীত বা পরমেশ্বর ব্যতীত অন্য সত্তা বা আধার। যাঁরা নিজেদেরকে বৈষ্ণব বলে মনে করেন, তাঁরা যতদিন বিষ্ণুকে আত্মারূপে জানতে না পারেন, ততদিন তাঁরা বিষ্ণুপূজা করেও অন্য দেবতারই পূজা করে থাকেন। অবিদ্যার বশবর্তী হয়ে অর্থাৎ পরব্রহ্ম বা পরমেশ্বরকে উপাস্য হিসেবে না জেনে সকল বিধি মেনে পূজা করলেও তা বিধির নয়, বরং অবিধির পূজাই হয়। যাঁরা নিজেদেরকে শাক্ত বলে অভিমান বা দাবি করেন, তাঁরাও যতদিন শক্তিকে আত্মারূপে পরিগ্রহণ বা অনুভব করতে পারেন না, ততদিন তাঁদেরও অন্য দেবতারই পূজা হয়ে থাকে। এভাবে সবখানে নিজের ইষ্টদেব যতদিন আত্মদেব তথা চৈতন্যরূপে প্রকাশিত না হন, ততদিন শ্রদ্ধাভক্তির সাথে ইষ্টদেবের পূজা করেও অন্য দেবতারই পূজা হয়ে থাকে। (অন্ধের মতন ধর্মপালন করলে তা অধর্মপালনের সমতুল্য।) ‘পূজা’ শব্দে কেবল পূজা নয়, জপ-স্তুতি-কীর্তন-ধ্যান-যোগ ইত্যাদি উপাসনা বা সাধনাপদ্ধতি যা-কিছু আছে, তার সব‌ই বোঝায়।




দেশময় বা পৃথিবীময় যে সাম্প্রদায়িক ভাব বা ধর্ম বিদ্বেষভাব বিদ্যমান রয়েছে—অন্য কারও ধর্ম অপেক্ষা নিজের ধর্ম উৎকৃষ্ট বা অন্য ধর্ম অপকৃষ্ট ইত্যাদি মনোভাব মানুষের মনের উপর আধিপত্য বিস্তার করছে, তার একমাত্র কারণ—এই অন্য দেবতার পূজা (উপাসনার চূড়ান্ত গন্তব্য সম্পর্কে ধারণার অভাব)। অন্য দেবতার ভক্ত হতে গিয়েই এই বিষ সব জায়গায় বিসর্পিত (ধীরে প্রসারিত) হয়ে পড়েছে। যাঁরা এই ভগবদ্‌বাক্যের অর্থ ঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন, তাঁদের কথা আলাদা, তাঁরা তো সকল বিরোধের উপরে উঠে গেছেন; কিন্তু তাঁদের সংখ্যা বড়ো কম। সাধারণ ধর্ম্মোন্মাদ জনগণ এই সত্য উপলব্ধির চেষ্টা হতেও দূরে থাকে। তাই পরস্পর ভেদভাব পোষণ করে ক্রমশ আত্মিক মৃত্যুর দিকেই অগ্রসর হয়। ওরা বলে বেড়ায়, আমার ঠাকুর বড়ো, তোমার ঠাকুর ছোটো—আর ওদিকে পরমঠাকুর ওদের অধর্মাচরণ ও নাস্তিকতা দেখে হাসেন।




কঠোপনিষদ (২।১।১০) ঘোষণা করছেন:
যদেবেহ তদমুত্র যদমুত্র তদন্বিহ।
মৃত্যোঃ স মৃত্যুমাপ্নোতি য ইহ নানেব পশ্যতি।।




অন্বয়: যৎ এব ইহ (যা এখানে); তৎ অমুত্র (তা সেখানে); যৎ অমুত্র (যা সেখানে [অর্থাৎ যা ওই আত্মাতে স্থিত]); তৎ অনু ইহ (এখানেও তারই অনুরূপ); যঃ ইহ নানা ইব পশ্যতি (যে-ব্যক্তি 'যেন ভিন্ন' এরূপ দেখে [অর্থাৎ এই দুইয়ের মধ্যে যে পার্থক্য দেখে]); সঃ মৃত্যোঃ মৃত্যুম্ আপ্নোতি (সে মৃত্যু থেকে মৃত্যুকে প্রাপ্ত হয় [অর্থাৎ জন্মমৃত্যুর চক্রে বাঁধা পড়ে])।




সরলার্থ: এখানে যা আছে, ওখানেও তা আছে; ওখানে যা আছে, এখানেও তা আছে। এই দুই-এর মধ্যে (অর্থাৎ জগৎ ও ব্রহ্মের মধ্যে) যে পার্থক্য দেখে, সে মৃত্যু থেকে মৃত্যুতে গমন করে।




ব্যাখ্যা: এই জগৎ ব্রহ্ম থেকে যে বিচ্ছিন্ন নয়, এই শ্লোকে তা-ই বলা হয়েছে। জগৎ 'ঈশ্বরের (ব্রহ্মের) প্রকাশ' অর্থাৎ ঈশ্বরই জগৎ হয়েছেন, তাই জগৎ ঈশ্বরই রয়েছেন। ব্রহ্মই জগতের মূল কারণ বা উপাদান ও প্রকাশ।




জগৎকে ব্রহ্ম থেকে স্বতন্ত্রভাবে দেখা অর্থাৎ জগৎকে সত্য (অর্থাৎ নিত্য) বলে মনে করা মারাত্মক এক ভুল। সেক্ষেত্রে এই জগতের নানা প্রলোভনে মানুষ আসক্ত হয়ে পড়ে। এই আসক্তিই বন্ধন। এর ফলে স্থূল ইন্দ্রিয়সুখের বাইরে মানুষ আর কিছু দেখতে পায় না। জীবনের গতি তখন রুদ্ধ হয়ে যায়। আসলে আসক্তিও এক ধরনের মৃত্যু, একে বলা যায় আধ্যাত্মিক মৃত্যু, যা দৈহিক মৃত্যুরও অধম। আধ্যাত্মিকতার যে-আনন্দ, তা একদিকে যেমন চিরন্তন, অন্যদিকে আবার মানুষকে উৎসাহ ও প্রেরণা যোগায়। কিন্তু ইন্দ্রিয়সুখে আসক্ত হলে মানুষ সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। শুধু তা-ই নয়, মানুষ জন্মমৃত্যুর চক্রে বাঁধা পড়ে এইভাবে বিনাশপ্রাপ্ত হয়।




তাৎপর্য: ইহ (এখানে) যত্ এব (যা-কিছু আছে) অমুত্র (ওখানে) তত্ (তা-ই আছে)। অমুত্র (ওখানে) যত্ (যা আছে) তত্ ইহ অনু (তা-ই এখানে অনুবৃত্ত বা পূর্ব প্রসঙ্গের জের, সন্তত বা নিরন্তর হয়ে আছে)। লোকে ও লোকোত্তরে একই সুতোর টানা-পোড়েন। যঃ (যে) ইহ (এই অখণ্ডতার মধ্যে) নানা ইব (যেন সব কিছু আলাদা এভাবে) পশ্যতি (দেখে), সঃ মৃত্যোঃ মৃত্যুম্ আপ্নোতি (সে পায় মরণের পর মরণ; অথবা, মৃত্যু অর্থাৎ যমের কাছ থেকে সে প্রাকৃত বা স্বাভাবিক মৃত্যুকেই পায়, উজ্জ্বল বৈবস্বত (স্বর্ণখচিত জ্যোতির্ময়-লৌকিক) মৃত্যুকে নয়।




জ্ঞানীর কখনও ভেদজ্ঞান থাকে না। এমন অবস্থাই জ্ঞানীর বেলায় স্বাভাবিক। আমরা ইহ আর অমুত্রের মাঝে তফাৎ করি। প্রাকৃতদশায় যখন আমরা থাকি, তখন আমাদের যে-লক্ষ্য, সে থাকে দূরে। আমি এখানে, সে দূরে—এমন ভাব আসে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, অজ্ঞানীর ঈশ্বর হোথা, হোথা; কিন্তু জ্ঞানীর ঈশ্বর হেথা, হেথা। এই দূরত্বের সংস্কার দূর করতে হবে। তখন ভাবতে হয়, একটা ব্যাপক সত্য চারিপাশে রয়েছে, আর আমরা তার মাঝেই রয়েছি। রামকৃষ্ণদেব দেবেন্দ্র ঠাকুরের সাথে দেখা করতে গেলেন। তখন দেবেন্দ্র ঠাকুর তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার অনুভব কীরকম? রামকৃষ্ণদেব বললেন, “ব্রহ্ম যেন সচ্চিদানন্দ সমুদ্রের মতন—আর তার ভেতরে মীনের মতন বিচরণ করছি।” সেই তিনি এই হয়েছেন আর এই তিনি সেই হয়েছেন, যদি তা ভাবি, তাহলে এখানে যা দেখছি, তা-ই ওখানে আর যা ওখানে, তা-ই এখানে। মনে রাখতে হবে, আমাদের এখানকার দেখা খণ্ডদর্শন। খণ্ড দিয়ে অখণ্ডকে দেখতে গেলে খণ্ডের সংস্কার থেকে যায়। কিন্তু সেই অখণ্ড বোধ থেকে যদি এই খণ্ডের দর্শন করি, তাহলে দর্শনধারা সহজ হয়। ব্রহ্মে পৌঁছে গেলে জগৎকে দেখা সহজ।




সেই অসীম যেন আমায় আকর্ষণ করছেন বারে বারে, তাঁর মাঝে আমার চিত্ত লয় হচ্ছে। এখানকার সংস্কার যখন ভাঙবে, তখন পুরো জগৎটাকেই মায়াস্বপ্নের মতন মনে হবে। যখন সেই চেতনা স্বচ্ছ হয়, তখন রসের উল্লাস চিত্তে জাগে; আনন্দরূপে তার উপলব্ধি হয়। এটাই সচ্চিদানন্দের (সত্-চিত্-আনন্দ বা সত্য-চেতনা-আনন্দ) উপলব্ধি। তিনি আছেন—এখানেই, এই ভাবনাতেই সমস্ত প্রশান্তি। তা যখন গভীর হবে, তখন সৎ, চিৎ সব ছায়ারূপ মনে হয়। গীতাতে (৭/১২) বলা হয়েছে—”ন ত্বহং তেষু, তে ময়ি” আমি ভূতগ্রামে (জীবে ও জড়ে) নেই, কিন্তু তারা আমার মাঝে রয়েছে। আমি তাদের মাঝে নিঃশেষিত হইনি—অর্থাৎ, আমিই অস্তিত্ব, আরও স্পষ্ট করে বললে: অস্তিত্ব‌ই আমি।




আমাদের মাঝে একটা সংশয়বোধ থাকে। তার পরে আমরা যখন জাগ্রত হই, তখন মনে হয়, সব‌ই তো তিনি। ইহ এবং অমুত্রে তফাৎ করা—সেই ‘নানা’—নেই তো! ‘নানা’-র অর্থ হচ্ছে একটা থেকে আর-একটার তফাৎ করা। একটা শ্রেয়র goal, আর একটা প্রেয়র goal। সেই অর্থেও ‘নানা’ বা ‘বিবিধ’ শব্দের প্রয়োগ হতে পারে। (যা অল্প সময়ের মধ্যে প্রাপ্ত হওয়া যায়, কিন্তু ক্ষণস্থায়ী এবং অন্তিমে দুঃখজনক, তাকে বলা হয় প্রেয়। যা লাভ করা পরিশ্রমসাপেক্ষ, কিন্তু চিরস্থায়ী এবং সুখদায়ক, তাকে বলা হয় শ্রেয়।) যে এখানে ও ওখানে তফাৎ করে, সে মৃত্যু থেকে মৃত্যুকেই লাভ করে; তার উপাসনা অবিধিপূর্বক সাধিত।




সংহিতাতে পুনর্জন্মের কথা ছিল না, ছিল পুনর্মৃত্যুর কথা—একবার মরার পর আবার মরার কথা। পুনর্মৃত্যুকে যদি স্বীকার করি, তাহলে আবার মরতে হবে; আর যদি স্বীকার না করি, তাহলে পুনর্মৃত্যু বলে কিছুই থাকে না—এটাই হচ্ছে অস্তিত্বের ভাবে বা ভাবনায় নিজেকে সবসময় রাখা। পুনর্জন্মের ভীতি জাগে তখন‌ই, যখন এখানকার অস্তিত্বকে অস্বীকার করি—নেতিবাদ বা নৈরাশ্যবাদ থেকে। যখন বলি, আমি আর মরব না, বার বার মরব না, তখন অস্তিত্বকে স্বীকার করি—নিজের অস্তিত্ব নিয়ে তুষ্ট মানুষ বার বার জন্মাতে চায়, কিন্তু বার বার মরতে চায় না। এখন পুনর্জন্মের প্রতিষেধ (বারণ বা নিবৃত্তি) বড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু উপনিষদে ও বেদান্তে মানুষকে সুখী ও তুষ্ট রাখতে পুনর্মৃত্যুর প্রতিষেধের কথা বলা হয়েছে। তবে পুনর্জন্ম কোনো বিভীষিকা নয়। দেবতাদের জন্ম হয়, তেমনি আমাদের‌ও জন্ম হয়; কিন্তু আমাদের মৃত্যু হয়, তাঁদের মৃত্যু হয় না। দেবতারা অমর, কিন্তু তাঁরা জাত। (এখানে দেবতাদের সাথে মহাত্মাগণের তুলনা করলে বুঝতে সহজ হবে।) একইভাবে, পরমচেতনা জাত হয়, কিন্তু তার বিলোপ হয় না। এই জাগরণ বা জাত হ‌ওয়াই মূলকথা।




শঙ্করাচার্য এই বিষয়টিকে অন্যভাবে বলেছেন। “অবিদ্যার নাশে বিদ্যার জন্ম হয়, কিন্তু একবার বিদ্যার জন্ম হলে তার আর নাশ হয় না।” তাঁকে (ব্রহ্মজ্ঞানকে) নিয়েই অস্তিত্ব; তাঁকে নিয়ে ‘আছি’—এই ভাবনা। তিনি চিরন্তন হয়ে রয়েছেন—ভিত্তিরূপে তাঁকে আবিষ্কার করতে হবে; তাঁর মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দিতে হবে; সমস্ত অস্তিত্বের বোধে চেতনাকে ব্যাপ্ত করে দিতে হবে। এটা অত্যন্ত সহজে আসতে পারে, যদি শুধু এই ভাবনা করি—তিনি আছেন আকাশবৎ—সমস্ত কিছুকে অনুপ্রবেশ করে রয়েছেন। তাঁর এমন আকাশবৎ হওয়াতেই আমার অস্তিত্বসাধনার পূর্ণতা বা ঈশ্বরলাভ।




মৃত্যুর কাছ থেকে মৃত্যুকে গ্রহণ করতে হবে—সে মৃত্যু একদিকে অমৃতজ্যোতি, আর একদিকে দেহের পতন। মৃত্যুর কাছ থেকে প্রাকৃত মৃত্যুকে সে-ই গ্রহণ করে, যে তার অমৃতরূপকে দেখতে পায় না, যে 'ইহ' আর 'অমুত্রে' তফাৎ করে। যা ওখানে তা-ই এখানে, যা এখানে সে-ই ওখানে—এভাবে যে স্থির হতে পারে, সে মৃত্যুর অমৃত দিকটাকে গ্রহণ করে। বৈনাশিক বৌদ্ধদের একজন আচার্য নাগার্জুন বলেছেন, যদি তুমি নির্বাণে এবং ভবে তফাৎ করো, তাহলে প্রজ্ঞার উদয় হবে না। যার কাছে নির্বাণ ও ভব দুই-ই এক, যে ভবে থেকেই নির্বাণপ্রাপ্তির আস্বাদ গ্রহণ করে, সে-ই পূর্ণসত্যকে লাভ করেছে। নির্বাণ লোকোত্তর, অরূপাবচর ভূমির ওপারে তাকে স্থাপিত করা হয়েছে। রূপাবচর থেকে অরূপাবচর ভূমিতে উত্তীর্ণ হওয়া—সেটাই বৈদিক ‘নেতি নেতি’ বিশ্লেষণ। সকল ‘আমি’-র সেখানে প্রলয় হয়।




যখন এক অসীম বোধে সব কিছু ছেয়ে যায়, তখন বোধের সকল ভিন্নত্ব বিলুপ্ত হয়। যেমন ভোরের আকাশ—সেখানে শুধু একটা শুকতারা জ্বলছে—তাকে চেতনার স্ফুলিঙ্গের সাথে তুলনা করতে পারি। সূর্যের আভাস সে দেখতে পাচ্ছে, সেজন্য ঊষাতে সূর্যের উদয় হলে তার আলোতে সেই তারার আলো প্লাবিত হয়ে যায়—এটাই হলো নির্বাণপ্রাপ্তি বা পরমজ্যোতিকে পাওয়া। সকল ধরনের সত্তাই বৃহৎ সত্তায় প্লাবিত হয়ে যায়। প্রথম সম্প্রজ্ঞাত বা সবিকল্প পরে অসম্প্রজ্ঞাত বা নির্বিকল্প। পুরুষ প্রথমেই থাকে object বা গ্রাহ্যবস্তু হিসেবে; কিন্তু তিনি যখন সাধক বা উপাসককে possess বা ব্যাপ্ত করেন, তখন তাঁকে জানতে বাহ্যিক জোর বা চেষ্টা লাগে না, কেননা সাধকের সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে শুধু তিনিই থাকেন। এতে সকল আমিত্বের পরিপূর্ণ প্রলয় হয়। সাধক যখন এখান থেকে জাগেন, তখন তাঁর মনে হয়, এপারেও তিনি, ওপারেও তিনি। ‘অহম্’ বা ‘আমি’-র তরফ থেকে দেখতে গেলে সূক্ষ্ম তফাৎ থেকে যায়, তাই তাঁর ভেতরে ঝাঁপ দিতে হয়। তিনি আছেন, আমি নেই—সিন্ধু আছে, বিন্দু নেই। ওপার-এপার মিলিয়ে যাক, ওপারের জ্যোতিতে এপার প্লাবিত হয়ে যাক, সমস্ত ভেদ ঘুচে যাক। তাহলে শুকতারার মতন আমার আলোর যদি মরণ হয়, তখন সব অমৃত হয়ে যাবে। সিন্ধুতে সকল বিন্দু বিলীন হয়ে সিন্ধুর বিশালতা প্রাপ্ত হোক। এটা কঠিন নয়। তিনিই আছেন—এই ভাব রাখা, সমস্তকে তাঁর দ্বারা প্লাবিত করা—এটাই কাজ, এটাই ধর্মচর্চার লক্ষ্য।




বৃহদারণ্যকোপনিষদ (৪।৪।১৯) একই কণ্ঠে ঘোষণা করছেন:
মনসৈবানুদ্রষ্টব্যং নেহ নানাহস্তি কিঞ্চন।
মৃত্যোঃ স মৃত্যুমাপ্নোতি য ইহ নানেব পশ্যতি।।




[এখানে ব্রহ্মদর্শনের সাধন সম্পর্কে বলা হচ্ছে] মনসা এব (মনেরই দ্বারা) অনুদ্রষ্টব্যম্ (আচার্যের উপদেশ অনুযায়ী দ্রষ্টব্য) ইহ (এই ব্রহ্মে) নানা কিঞ্চন ([স্বগত, স্বজাতীয় বা বিজাতীয়] কোনো প্রকারের ভেদই) ন অস্তি (নেই)। যঃ (যিনি) ইহ নানা ইব (ভিন্নপ্রায় বস্তু) পশ্যতি (দেখেন) সঃ মৃত্যোঃ মৃত্যুস্ আপ্নোতি (মৃত্যুর পর মৃত্যুকে পান, পুনর্বার জন্মমৃত্যুর অধীন হন)।




অর্থ: মনেরই দ্বারা ব্রহ্ম অনুদ্রষ্টব্য বা চূড়ান্ত-জ্ঞাতব্য—মনের অস্তিত্ব বা অনুপস্থিতি থাকলে ব্রহ্মের জ্ঞান হয় না। শ্রুতিতে ব্রহ্মকে বাক্যমনের অতীত বলা হয়েছে সত্য; কিন্তু মন যখন ইন্দ্রিয়াদির দ্বারা সংস্কৃত বা প্রভাবিত হয়ে ব্রহ্মের আকারে আকৃতি পায়, অর্থাৎ শুদ্ধমনে যখন অখণ্ড ব্রহ্মাকারা বৃত্তির উদয় হয়, তখন ব্রহ্মকে বৃত্তিব্যাপ্য বলা হয়, অর্থাৎ ব্রহ্মকে সাপেক্ষ দ্বারা চেনা বা উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু তিনি ফলব্যাপ্য নন, অর্থাৎ চিদাভাস বা চৈতন্য বা জ্ঞানের ছায়া তথা বিকাশরূপে প্রকাশ্য নন—জ্ঞানের বিষয়রূপে অবগন্তব্য (অবগত হবার যোগ্য) নন; কেননা তিনি জ্ঞাতার আত্মস্বরূপ ভিন্ন আর কিছুই নন—ব্রহ্ম ও ব্রহ্মজ্ঞানী এক-অভিন্ন। সকল অহম্ চৈতন্যে মিশে একাকার অভিন্ন হয়ে যায়, ঠিক যেমনি সকল বুদবুদ ফেনারূপে সাগরে মিশে একাকার অভিন্ন হয়ে যায়।




এই ব্রহ্মে কোনো ভেদ নেই। যিনি এতে ভেদ বা অনুরূপ কিছু দেখেন, তিনি বার বার মৃত্যুর অধীন হন। অবিদ্যা থাকলে ভেদজ্ঞান দূর হয় না; কারণ তা অবিদ্যা দ্বারা আরোপিত। জ্ঞান, জ্ঞাতা, জ্ঞেয় প্রভৃতি বিভাগও অবিদ্যাসম্ভূত।




ধর্মের বা জীবনের যা উদ্দেশ্য, তা ভুলে কেবল পথ বা উপায়ের দিকেই সবসময় দৃষ্টি রাখার কারণেই এমন ভেদজ্ঞান বিকশিত হয়। একই আত্মা, একই সত্য, একই ব্রহ্ম বিভিন্ন উপাধিযোগে বিভিন্ন নামরূপে প্রকাশিত হয়। এ কথাটা হাজার বার বললে আর হাজার বার শুনলেও ভেদজ্ঞানটা ঠিক তিরোহিত হয় না; অন্যদেবতাজ্ঞান থাকেই। যতদিন নিজের ইষ্টদেবতাই অন্য দেবতারূপে পূজিত হয়ে থাকেন, ততদিন ইষ্টমূর্তি ছাড়া অন্য মূর্তি দর্শনে যে ভেদজ্ঞান আবির্ভূত হবে, তা খুবই স্বাভাবিক। যদি অবিচলিত শ্রদ্ধা-সহকারে অন্য দেবতার পূজা করে থাকে, তবে সেই শ্রদ্ধার প্রভাবেই একদিন সকল অবিধি-ভাব লুপ্ত হয়ে অন্যদেবে তন্ময়তা উপস্থিত হয়; আর জ্ঞানের উদয় হয়, তখনই বোঝা যায়, যিনি আত্মদেব, যিনি সত্যদেব, তিনিই তো বিভিন্ন মূর্তিরূপে বিরাজ করছেন। আমার, তোমার, তার সকলের‌ই মূল উপাস্য এক, যদিও এখানে উপাসনার সাকারত্ব বা নিরাকারত্ব তথা পদ্ধতিভেদ রয়েছে। সকল আচারবিধি মেনে পূজা করলেও সেই পূজা বা উপাসনা ‘অবিধিপূর্বক’ বলে অভিহিত হয়, যদি পূজার প্রকৃত প্রাপক তথা পুরুষ তথা পরব্রহ্ম তথা চৈতন্য তথা ক্ষেত্রজ্ঞ তথা পরমদ্রষ্টা তথা ঈশ্বর সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকে। হোক তা ‘অবিধিপূর্বক’, তবুও তা-ও এক ও অভিন্ন নিত্য-নির্গুণ পরব্রহ্মেই সমর্পিত।




ভগবান বলছেন, যারা অন্য দেবতার প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন, অন্য দেবতার পূজা উপাসনাদি যারা করে, তারাও কার্যত আমারই পূজা করে। কারণ আমি ছাড়া তো উপাস্য আর কোথাও কিছু নেই। যে যেখানে যে নামে যে আকারে যে গুণেরই পূজা করুক, বস্তুত আমারই পূজা হয়ে থাকে। আমিই তো সত্তারূপে সবখানে বিরাজিত থাকি, আমিই জ্ঞানরূপে নানান আকারে আকারিত হয়ে থাকি। আমাকে ছেড়ে যাবার তো উপায়‌ই নেই!




‘অবিধি পূর্বকং যজন্তি’—অবিধি শব্দের অর্থ বিধিহীন অর্থাৎ অজ্ঞান। যদিও অবিধিপূর্বক অনুষ্ঠিত পূজাও পরমার্থিক দৃষ্টিতে আমারই পূজা, তবুও তা উপাসকের নিকট অজ্ঞাত থাকার কারণে সেই পূজা, সকল বিধি মানা সত্ত্বেও, অবিধিপূর্বকই হয়ে থাকে। যে-ব্যক্তি পূজা করে, সে তো আর জানে না যে, আমিই সকল ঘটে-পটে সবসময় সকল ভাবে ও রূপে অবস্থিত। সে বরফ চেনে, জল চেনে না; পোশাক চেনে, তুলা চেনে না; বাতাসা চেনে, চিনি চেনে না; পুতুল চেনে, মাটি চেনে না। সে নাম-কীর্তন জানে, আমাকে জানে না; তাই তার পূজা অবিধিপূর্বকই হয়ে থাকে। অজ্ঞানীর সকল পূজাই সবসময় অবিধিপূর্বক অনুষ্ঠিত।




বৈষ্ণব বা শাক্ত বা শৈব বা অদ্বৈতবাদী যদি বলেন, “আমার পথ‌ই সঠিক, বাকিগুলো ভুল। তাই সবাই আমার পথে এসো।”, তাহলে তা কে মেনে নেবেন? কোনো ধর্মমতের পথিক যদি বাকি সবাইকেই তাঁর অনুসৃত পথেই চলতে বলেন, তাহলে নিজের পথ ছেড়ে কে চলবে তাঁর পথে? কেন‌ই-বা চলবে? (জোর করে বা লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করলে সেটা ভিন্ন কথা।) বাকিদের পথকে সত্য বললে কিন্তু নিজের পথ মিথ্যা হয়ে যায় না। সব পথ‌ই সত্য ও সুন্দর, মানসিকভাবে এটা গ্রহণ করতে না পারলে পৃথিবীতে মানুষ শান্তিতে বাঁচবে কীভাবে? পথ যা-ই হোক, উপাসনার পদ্ধতি যেমন‌ই হোক, সবার গন্তব্য তো একটাই—আত্মজ্ঞান লাভ বা ব্রহ্মত্বে পৌঁছা বা চৈতন্যের জাগরণ বা ভগবান তথা স্রষ্টাকে পাওয়া। “আমার পথটাই ঠিক, বাকিদেরটা ভুল।”—এরকম করে ভাবে যারা, তারা নিজেরাই জানে না যে, তাদের এই অবিধির উপাসনাও ঘুরেফিরে সেই গন্তব্যের‌ই অভিমুখী, যে-গন্তব্যে বাকি সকলের উপাসনাও অভিমুখী।




তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদেরকে আশ্বস্ত করছেন, আমরা যে পথে ও মতেই উপাসনা বা প্রার্থনা বা ইবাদত বা পূজা করি না কেন, আমাদের সকল সাধনা তাঁর কাছেই পৌঁছোয়, কেননা আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ‌ই জীবনের মূল লক্ষ্য—হয়তোবা আমরা নিজেরাই জানি না যে, আমাদের সকল প্রার্থনা, তা সবিকল্প‌ই হোক আর নির্বিকল্প‌ই হোক, এক ও অভিন্ন পরব্রহ্মের তথা চৈতন্যের তথা পুরুষের কাছে সমর্পিত। (এখানে ‘পুরুষ’ অর্থ পূরয়িতা বা পূরণকর্তা, অর্থাৎ যা দ্বারা সব কিছু পূর্ণ।)