ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ। মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ।। ৪২।।
অন্বয় ও অর্থ: ইন্দ্রিয়াণি (ইন্দ্রিয়গণকে, স্থূলশরীর থেকে) পরাণি (পর অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ, বলবান ও সূক্ষ্ম) আহুঃ (বলে থাকেন বা কথিত হয়), (এবং) ইন্দ্রিয়েভ্যঃ (ইন্দ্রিয়গণ থেকে) মনঃ পরম্ (মন শ্রেষ্ঠ), মনসঃ (মন থেকে) তু (আর) বুদ্ধিঃ পরা (বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ) তু (এবং) যঃ (যিনি) বুদ্ধেঃ (বুদ্ধি থেকেও) পরতঃ (উপরে বা অধিক উত্তম) সঃ (তিনিই আত্মা)।। (ইন্দ্রিয়াণি = senses পরাণি = superior আহুঃ = are said ইন্দ্রিয়েভ্যঃ = more than the senses পরং = superior মনঃ = the mind মনসঃ = more than the mind তু = also পরা = superior বুদ্ধিঃ = intelligence য়ঃ = who বুদ্ধেঃ = more than the intelligence পরতঃ = superior তু = but সঃ = he) ৪২।।
অনুবাদ: স্থূল শরীর থেকে ইন্দ্রিয়গণ শ্রেষ্ঠ। ইন্দ্রিয়ের চেয়ে মন এবং মনের তুলনায় বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ; এবং বুদ্ধির চেয়েও যিনি শ্রেষ্ঠ, তিনিই আত্মা।। ৪২।।
পদ্যরূপ: ১. ইন্দ্রিয়েরা হয় শ্রেষ্ঠ আছয়ে কথিত, তা হতে শ্রেষ্ঠ মন, বুদ্ধি—মন হতে, বুদ্ধি হতে শ্রেষ্ঠ যা, তা-ই তো সেই।।
(আছয়ে কথিত: কথিত আছে; সেই: আত্মা)
২. দেহাদি হতে শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের গণ, তা হতে হয় শ্রেষ্ঠ প্রবর্তক মন, মন হতে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধি, যে চালায় মন, বুদ্ধি হতে শ্রেষ্ঠ সেই আত্মা নিরঞ্জন।।
৩. দেহাদি বিষয় মাঝে ইন্দ্রিয় প্রবর, তেমনি ইন্দ্রিয় হতে মন মহত্তর, বুদ্ধি-অনুগত মন, বুদ্ধিই প্রধান, বুদ্ধি হতে, বুধ কহে, আত্মা গরীয়ান।। (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)
অন্বয়ের বিস্তৃতি: কোনো-না-কোনো উপায়ে বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করা সম্ভব হলেও মনের ভেতরের তৃষ্ণাকে ত্যাগ করা তো অতি দুষ্কর—পরমাত্মদর্শন হলে এই তৃষ্ণাও নিবৃত্ত হয়ে যায়। এখন কথা হচ্ছে, যাঁর দর্শনে তৃষ্ণার নিবৃত্তি হয়ে যায়, সেই ‘পর’ নামক পদার্থটা কী? ‘পর’ শব্দ দ্বারা শুদ্ধ আত্মাকে অর্থাৎ ‘পর’ শব্দের দ্বারা যা অভিহিত হয়, সেই শুদ্ধ আত্মা সূক্ষ্ম-স্থূল-কারণ শরীর হতে পৃথক। ‘ইন্দ্রিয়াণি’ অর্থাৎ চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বক, এই পাঁচটা জ্ঞানেন্দ্রিয়কে ‘পরাণি’ অর্থাৎ জড় পরিচ্ছিন্ন বাহ্যদেহ অপেক্ষা ‘পর’ অর্থাৎ (কে বা কারা বলেন) জ্ঞানীরা অথবা সকল শ্রুতিবাক্য সূক্ষ্ম, প্রকাশক, ব্যাপক এবং অন্তঃস্থ (আভ্যন্তরীণ) বলে ওঁদেরকে প্রকৃষ্ট অর্থাৎ উৎকৃষ্ট ‘আহুঃ’: বলেন, আবার ‘ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ’—সঙ্কল্প-বিকল্পাত্মক (দ্বিধায় দোদুল্যমান) মনকে ইন্দ্রিয়সমূহের চেয়ে উৎকৃষ্ট বলা হচ্ছে, কারণ মনই সেই ইন্দ্রিয়গুলির প্রবর্তক অর্থাৎ মনই অধিষ্ঠাতা হয়ে ইন্দ্রিয়গুলিকে নিজ নিজ বিষয় গ্রহণে প্রবৃত্ত করায়। মন সক্রিয় না হলে ইন্দ্রিয় কাজ করতে পারে না। আবার ‘মনসস্তু পরা বুদ্ধিঃ’—অধ্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি সেই মন হতে প্রকৃষ্ট, যেহেতু অধ্যবসায় হচ্ছে নিশ্চয়াত্মক, আর সঙ্কল্পের মূলে সেই অধ্যবসায়ই বিদ্যমান থাকে। ‘যঃ তু বুদ্ধেঃ পরতঃ’—আর যা বুদ্ধিরও পরে, অর্থাৎ বৃদ্ধি হতেও উৎকৃষ্ট, যা বুদ্ধির প্রকাশকরূপে অবস্থিত, কাম-ইন্দ্রিয় প্রভৃতি আশ্রয়ের সাথে মিলিত হয়ে জ্ঞানাবরণকে প্রশ্রয় দেয় এবং দেহীকে মোহগ্রস্ত করে, বুদ্ধির স্রষ্টা সেই পদার্থটাই ‘পর’ বা ‘আত্মা’। ইনি সে-ই, যিনি তাঁর নিজের মধ্যেই প্রবিষ্ট হয়েছেন।
এ সম্বন্ধে কঠোপনিষদ বলছেন—
ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরা হ্যর্থা অর্থেভ্যশ্চ পরং মনঃ। মনসস্তু পরা বুদ্ধির্বুদ্ধেরাত্মা মহান্ পরঃ।। ১/৩/১০।।
অন্বয়: ইন্দ্রিয়েভ্যঃ (পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় থেকে) হি (নিশ্চয়ই) অর্থাঃ (শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়-উৎপাদকসমূহ) পরাঃ (সূক্ষ্মতর, ব্যাপক ও আত্মভূত বলে শ্রেষ্ঠ)। অর্থেভ্যঃ চ (এবং ওই বিষয়সমূহ থেকে) মনঃ (বিষয় বা বৃত্তিসমূহের অববোধক বা আরম্ভক সংকল্প-বিকল্পাত্মক মন) পরম্ (শ্রেষ্ঠ)। মনসঃ তু (মনের থেকেও) বুদ্ধিঃ (অন্তঃকরণের নিশ্চয়াত্মিকা বা অধ্যবসায়াত্মক বৃত্তিসমূহের আরম্ভক বা অববোধক) পরা (শ্রেষ্ঠ)। বুদ্ধেঃ (ব্যষ্টিবুদ্ধি বা বুদ্ধ্যারম্ভক ভূতসূক্ষ্ম অপেক্ষা) মহান্ আত্মা (সমষ্টিবুদ্ধিরূপ হিরণ্যগর্ভ তত্ত্ব, যিনি অব্যক্তা প্রকৃতি থেকে প্রথম-জাত) পরঃ (সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বলে শ্রেষ্ঠ)।
‘সবচাইতে স্থূল’ ইন্দ্রিয়গুলি থেকে ক্রমশ সূক্ষ্মে নিয়ে যাবার জন্য শ্রুতি বলছেন: 'ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরা অর্থাঃ’—ইন্দ্রিয়গুলি (objects অর্থে) থেকে বিষয় (subject) হলো ‘পর’ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ, সূক্ষ্ম। 'পর' শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। উৎকৃষ্ট, সূক্ষ্ম ও কারণ অর্থে 'পর' শব্দের ব্যবহার আছে। এখানে বলা হলো—বিষয় ইন্দ্রিয়ের থেকে সূক্ষ্ম। এ কথাটি একটু বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে, কেননা আমরা তো ইন্দ্রিয়কেই সূক্ষ্ম জানি, বিষয়কে জানি স্থূল। এখানে বিষয় মানে স্থূলভূত নয়, সূক্ষ্মভূতের কথা বলা হচ্ছে, যা দিয়ে ইন্দ্রিয়গুলিও তৈরি। ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ, ব্যোম—এই পঞ্চভূতের স্থূলরূপকে এখানে বলা হচ্ছে না। কারণ, স্থূলভূত ইন্দ্রিয়ের চেয়ে সূক্ষ্ম নয়। এখানে যে-ভূতের কথা বলা হচ্ছে, তা ইন্দ্রিয়ের চেয়েও সূক্ষ্ম। সেগুলি ইন্দ্রিয়ের উপাদান, তাদের দিয়ে ইন্দ্রিয়ের সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং সেই ভূতকে ইন্দ্রিয় থেকেও পর, শ্রেষ্ঠ, সূক্ষ্ম বলা হচ্ছে। 'অর্থেভ্যশ্চ পরং মনঃ'—বিষয় অর্থাৎ এই সূক্ষ্মভূতগুলি থেকেও সূক্ষ্ম হলো মন। 'মনসস্তু পরা বুদ্ধিঃ'—আবার মন থেকেও সূক্ষ্ম হলো বুদ্ধি। 'বুদ্ধেঃ আত্মা মহান্ পরঃ'—বুদ্ধি থেকেও সূক্ষ্ম মহান আত্মা অর্থাৎ মহৎ তত্ত্ব। শ্রুতি এখানে ‘আত্মা’ শব্দটি বললেন এজন্য যে, কারণ কাজের মধ্যেই পরিব্যাপ্ত হয়ে থাকে বিধায়, আত্মার ব্যাপকত্ব সেখানে সার্থক হচ্ছে। আর এগুলি জীবের পরম্পরাক্রমে গৌণ আত্মাও বটে। সুতরাং বুদ্ধির থেকেও মহৎ-তত্ত্ব হচ্ছে সূক্ষ্ম, কারণ বুদ্ধিতত্ত্বেরও উপাদান সেই মহৎ-তত্ত্ব। এককথায়, অর্থ বা বিষয় সকল ইন্দ্রিয় হতে শ্রেষ্ঠ, মন সকল অর্থ হতে উৎকৃষ্ট, বুদ্ধি মনের অপেক্ষা উৎকৃষ্ট, মহান্ আত্মা বা মহত্ত্ব বুদ্ধি বা মহৎ-তত্ত্ব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ অব্যক্ত বা কারণ শরীর এবং অব্যক্ত হতে শ্রেষ্ঠ পুরুষ। পুরুষ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট আর কিছু নেই, তা-ই কাষ্ঠা বা সীমা এবং তা-ই পরম গতি। পুরুষই absolute subject বা পরম বিষয়, কারণ পুরুষকে আর কেউ object করতে পারে না। পুরুষ ব্যতীত বাকি সবাই পরের ধাপে object হিসেবে গণ্য। তাই এক পুরুষ বাদে বাকি সব সত্তাই apparent subject বা আপাত বিষয়। শ্রীভারতীতীর্থ উপনিষদ এবং গীতা থেকে এই ধারণাটি গ্রহণ করে ‘দৃগ্ দৃশ্য বিবেক’ নামে ৪৬ শ্লোকসমৃদ্ধ বেদান্ত-প্রকরণগ্রন্থ রচনা করেছেন।
বায়ু পুরাণে আছে—মনঃ, মহান্, মতি, ব্রহ্ম, পূঃ, বুদ্ধি, খ্যাতি ও ঈশ্বর—এরা একার্থক। ‘মহতঃ’ অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভের বৃদ্ধি হতে, ‘পরম্ অব্যক্তম্’ অর্থাৎ মায়া নামে প্রসিদ্ধ অখিল জগতের বীজস্বরূপ অব্যাকৃত (ব্রহ্ম বা পুরুষ বাদে জগদুৎপত্তি-বীজ (জগৎ অব্যাকৃত ছিল-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)) যা, তা পর বা শ্রেষ্ঠ। এ বিষয়ে “প্রকৃতিকে মায়া বলেই জানবে।” (শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্, ৪/১০) এবং “তখন (সৃষ্টির পূর্বে) এই জগৎ সেই অব্যাকৃতভাবে অর্থাৎ সূক্ষ্ম-অবস্থায় ছিল।” (বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ১/৪/৭) ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যই প্রমাণ। ‘অব্যক্তাৎ’ বা অব্যক্ত হতে ‘পুরুষঃ’ বা সকল জড়বর্গের (objects) প্রকাশক পুরুষ অর্থাৎ পূর্ণস্বরূপ আত্মা ‘পরঃ’ বা শ্রেষ্ঠ। ‘যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ—যা বুদ্ধির পরবর্তী অর্থাৎ বুদ্ধি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, সেই পুরুষই তা।
তাৎপর্য: ইন্দ্রিয়গণের চেষ্টা ছাড়া শরীর কোনো কাজই করতে পারে না। মনের উত্তেজনা ও প্রেরণার সাহায্য ছাড়া ইন্দ্রিয়গণের ভেতরে কাজ করার চেষ্টাই উৎপন্ন হয় না। আবার বুদ্ধির সংযোগ না থাকলে মনের মধ্যে সঙ্কল্পই তৈরি হতে পারে না। এর কারণ, সঙ্কল্প নিশ্চয়াত্মক (সন্দেহাতীতভাবে স্থিরীকৃত বা নির্ধারিত) এবং আত্মার সত্তা ও প্রকাশ না থাকলে বুদ্ধিরও বিকাশ হবার সম্ভাবনা নেই। এই কারণেই এই তিনের ক্রমানুসারে আত্মার শ্রেষ্ঠতা প্রতিপাদিত হয়েছে। শ্রুতিও বলছেন: মহতঃ পরমব্যক্তমব্যক্তাৎ পুরুষঃ পরঃ। পুরুষান্ন পরং কিঞ্চিৎ সা কাষ্ঠা সা পরা গতিঃ।। (কঠোপনিষদ, ১/৩/১১)
অন্বয়: মহতঃ (হিরণ্যগর্ভ থেকে) অব্যক্তম্ (সর্বজগদ্বীজভূতা অব্যাকৃতা পরমা প্রকৃতি বা মায়া) পরম্ (শ্রেষ্ঠ)। অব্যক্তাৎ (সেই অব্যক্ত বা সর্বকার্যকারণীভূতা শক্তিতত্ত্ব বা মায়াতত্ত্ব থেকে) পুরুষঃ (নামরূপাত্মক নিখিল জগতের প্রকাশক চৈতন্যস্বরূপ পরমাত্মা) পরঃ (সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম বলে শ্রেষ্ঠ)। পুরুষাৎ (সেই পুরুষ বা পরমাত্মা অপেক্ষা) কিঞ্চিৎ পরম্ (অপর কোনো শ্রেষ্ঠ বস্তু) ন (নেই)। সা (ওই পরমাত্মাই) কাষ্ঠা (সকল কার্যকারণের তথা স্থূলশরীরত্ব, সূক্ষ্মশরীরত্ব এবং কারণশরীরত্বের পরম বা শেষসীমা) সা (তিনিই বা সেই স্বরূপানুভূতিই) পরা গতিঃ (পরম পদ বা চরম লক্ষ্যস্থল)।
মহতঃ পরমব্যক্তম্—মহতের পেছনে রয়েছে অব্যক্ত, অনভিব্যক্তস্বরূপ অর্থাৎ যাতে এখনও অবধি কোনো ব্যক্তিত্ব উপস্থিত হয়নি, যাকে এখনও অভিব্যক্ত করা হয়নি। বলা বাহুল্য, এখানে চেতনের দ্বারা অধিষ্ঠিত রূপকে বলা হচ্ছে ‘কারণ’ বা ‘পরমদ্রষ্টা’। তার পরেই বলছেন, অব্যক্তাৎ পুরুষঃ পরঃ—অব্যক্ত থেকেও পর অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ হচ্ছেন পুরুষ। এখন, জগতের ক্রমাভিব্যক্তি যদি আমরা কল্পনা করি, তাহলে এভাবে দেখতে হবে: প্রথমে পুরুষ, পুরুষের থেকে অব্যক্ত (কারণশরীর), অব্যক্ত থেকে মহৎ-তত্ত্ব (সূক্ষ্মশরীর), মহৎ-তত্ত্ব থেকে বুদ্ধি, বুদ্ধি থেকে মন, মন থেকে বিষয় ও ইন্দ্রিয়গুলি। এ-ই হলো অবরোহণ-ক্রমে নেমে আসা।
সেই পুরুষ একমেবাদ্বিতীয়ম্—এক ও অদ্বিতীয়। যখন সৃষ্টির ক্রম কল্পনা করি, তখন জগৎকারণ পরমেশ্বরের ভেতর প্রথম যা বীজাকারে সৃষ্টি হয়েছে, যে-বীজের তখনও অঙ্কুরোদ্গম হয়নি, সেই অবস্থাকে অব্যক্ত অবস্থা বলি। সেই অব্যক্ত অবস্থা থেকে উৎপন্ন হলো মহৎ-তত্ত্ব অর্থাৎ যে-উপাদান থেকে সমস্ত বিশ্ব সৃষ্টি হবে। অব্যক্ত আর মহৎ-তত্ত্বে পার্থক্য কেন করা হলো? না, মহৎ-তত্ত্ব হলো সেই অব্যক্তের ভেতর থেকে অঙ্কুরোদ্গম, যা সৃষ্টির প্রথম অবস্থা মাত্র। তারপর সূক্ষ্মতার তারতম্য অনুসারে ক্রমশ বুদ্ধি, মন, বিষয় ও ইন্দ্রিয়—সূক্ষ্ম থেকে স্থূল, আরও স্থূল—এরকম করে করে সমস্ত সৃষ্টিকে বোঝানো হচ্ছে। এগুলি বোঝাবার তাৎপর্য হলো: শেষ পর্যন্ত পুরুষে পৌঁছে দেওয়া। স্থূলশরীরের সঙ্গে আমরা পরিচিত। তাই এই পরিচিত বস্তু থেকে ক্রমশ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বস্তু-ক্রমে এক ধাপ করে নিয়ে গিয়ে আমাদের সেই পরমতত্ত্বে পৌঁছে দেবার উদ্দেশ্যে শ্রুতি এভাবে বর্ণনা করছেন।
তারপর বলছেন, পুরুষের থেকেও শ্রেষ্ঠ কী? তার উত্তরে আবার বলছেন, পুরুষান্ন পরং কিঞ্চিৎ—পুরুষের চেয়ে পর বা শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই। তিনিই হলেন অন্ত বা absolute subject। সা কাষ্ঠা সা পরা গতিঃ—তিনিই হলেন পরম লক্ষ্য, পরম গম্য। সেই পুরুষকেই প্রাপ্ত হতে হবে, তারপর আর কোনো গন্তব্য নেই। কেন নেই? তার উত্তর: যখন সমস্ত বিশেষের বা object-এর অবসান হয়, তখন কে আর কোথায় যাবে? কীসের সাহায্যেই-বা যাবে? পুরুষে পৌঁছে দ্বৈতের অবসান। তখন নুনের পুতুল যেমন সমুদ্রের জল মাপতে গিয়ে গলে যায়, সাগরের সমস্ত বুদ্বুদ সাগরে মিশে একাকার হয়ে যায়—তেমনি জীবের আর পৃথক সত্তা থাকে না।
আমাদের জীবনের উপাদানগুলিকে এখানে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। পরে সাংখ্যদর্শনের (এ দর্শনের মতে, জগৎ দুটি সত্যের দ্বারা গঠিত—পুরুষ (সাক্ষ্য-চৈতন্য) ও প্রকৃতি (আদি-পদার্থ)। এখানে পুরুষ হচ্ছে চৈতন্যময় সত্ত্বা, যা পরম, স্বাধীন, মুক্ত এবং ইন্দ্রিয়ের উপলব্ধির বাইরে (অপরোক্ষ)—যাকে কোনো অভিজ্ঞতা অথবা শব্দের দ্বারা বর্ণনা করা অসম্ভব। আর প্রকৃতির সত্তা হচ্ছে জড়-রূপা। এটি নিষ্ক্রিয় বা অচেতন এবং সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—এই ত্রিগুণের সাম্যাবস্থা।) ধারা ধরে আরও সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তবে এখানে উপাদানগুলিকে ঠিক সাংখ্যের মতন দেখানো হয়নি, একটু তফাৎ আছে। প্রথম-অর্থ Objective world, Material world, বিষয়ের জগৎ। তারপর ইন্দ্রিয় জগৎ, তারপর মনের জগৎ। অর্থ ইন্দ্রিয়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ, এর তাৎপর্য—অর্থের জগৎ objective world হলো আমাদের জীবনের ভিত্তি। তত্ত্ব হিসাবে এই objective world-কেই আগে রাখা উচিত ছিল, কিন্তু এখানে প্রথম ইন্দ্রিয় তারপরে অর্থ বলা হয়েছে। সাংখ্যে অনাত্ম জগতের সঙ্গে আত্মার একটা বিরোধ দেখা যায়। আত্মা ও অনাত্মার মাঝে অবিবেক (অজ্ঞান বা ব্রহ্ম সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব) আছে। অনাত্মা থেকে আত্মাকে বিবিক্ত বা পৃথক করাই সাধনা। অনাত্ম জড়। আত্মা চিৎস্বরূপ। জড় ও চৈতন্যে তফাৎ করতে শিখতে হয়, অথচ জড়ই জীবনের ভিত্তি। জড়ই মূল, তা থেকে ইন্দ্রিয়, প্রাণ, মন ইত্যাদি দেখা দিয়েছে। এই উপনিষদে objective world ও subjective world-এর একটা সমন্বয় দেখা যায়।
আমাদের প্রাকৃত বা লৌকিক মনের আরম্ভ হয় ইন্দ্রিয় দিয়ে। এখানে প্রাণের কথা বলা হয়নি, সাংখ্যেও নেই; প্রাণের স্থান ইন্দ্রিয় নিয়েছে। সাংখ্যের ধারা বা scheme হচ্ছে পঞ্চমহাভূত-এটাই 'অর্থ'। এই পঞ্চমহাভূতগুলিকে দু-ভাগে ভাগ করা হয়েছে স্থূল ও সূক্ষ্ম। পঞ্চ স্থূল ভূত হচ্ছে, ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ বা বায়ু, আর ব্যোম বা আকাশ। আর পঞ্চ সূক্ষ্ম ভূত হচ্ছে গন্ধ, রস, রূপ, স্পর্শ, শব্দ। স্থূলভূতের সঙ্গে চেতনার যোগ হয় যখন, তখন গুণের প্রকাশ হয়—তারাই সূক্ষ্ম ভূত। এগুলিকে তন্মাত্র (হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্বের সূক্ষ্ম উপাদান বা কেবল একটি গুণের ভাবনা) বলা হয়েছে; তাদেরও ভূতের মধ্যে রাখা হয়েছে। এর অর্থ এভাবে বোঝা যেতে পারে—আমরা কোনো একটি বিষয়কে ইন্দ্রিয় দিয়ে গ্রহণ করি যখন, তখন বিষয় একদিকে যেমন বাইরে থাকে, তেমনি আবার আমার ভেতরেও ফুটে ওঠে। যেমন তেজ—বাইরের তেজোময় বস্তু আমাদের ভিতরে রূপ হয়ে ফোটে। এটা জড়েরই একটা রূপান্তর। বাইরে পঞ্চমহাভূতের objective world, ভিতরে ঠিক তেমনই subjective world। 'তন্মাত্র' শব্দ সাধনার দিক দিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। বাইরের সব বিচিত্রভাবে মিশ্রিত অবস্থায় রয়েছে। যেমন একটা ফল যদি দেখি, দেখব, সেখানে তার রূপ, রস, স্পর্শ ইত্যাদি মিশে রয়েছে। যখন তাকে ভেতরে গ্রহণ করি, তখন কখনো রূপকে, কখনো রসকে বা গন্ধকে, কিংবা দুটিই বা তিনটিই মিশিয়ে গ্রহণ করতে পারি। এখন আমি যদি চাই, শুধু রূপকে গ্রহণ করব, তাহলে এটা হবে রূপের ‘তন্মাত্র’। এইরকম অভ্যাসের ফলে আসে সবিচার সমাপত্তি। (যদি তন্মাত্র-বিশেষ বা অন্তঃকরণ ইত্যাদিরূপ কোনো একটি সূক্ষ্ম বিষয়ে, চিত্ত তন্নিষ্ঠ এবং তন্ময়-ভাবে সমর্পিত হয়ে শব্দ, অর্থ এবং জ্ঞান এই তিনের মধ্যে বিকল্পিত বা একগামী হয়, অথবা দেশ-কাল দ্বারা পরিচ্ছিন্ন হয়, তবে তখন চিত্তের যেরূপ পরিণাম হয়, তাকে সবিচার-সমাপত্তি বলে। যখন সেরূপ সূক্ষ্ম বিষয় শব্দার্থ-জ্ঞান-বিবর্জিত রূপে ও দেশ-কাল দ্বারা অনবচ্ছিন্ন রূপে প্রকাশ পায়, অর্থাৎ বস্তুমাত্র-রূপে প্রকাশ পায়, তখন সে বিষয়ক চিত্তের যে-পরিণাম, তাকে নির্বিচার-সমাপত্তি বলে।) আর তার পরে আসে universal রূপ বা রূপসামান্যকে গ্রহণ করার ক্ষমতা। রূপ শুধু রূপই, তার সঙ্গে অন্যকিছুর মিশ্রণ নেই। সাধারণত আমরা দুটিকে একসঙ্গে ভাবি, যেমন চিনির মিষ্টত্ব এবং রূপ। সাধনাতে তা না করে আমরা ভাবব শুধু তার মিষ্টত্বকে বা শুধু শুভ্রতাকে (সবিচার-সমাপত্তি)। তখন এই বোধ আসবে যে, একটা বিশ্বব্যাপী রস বা শুভ্রতা রয়েছে, তারই একটি রূপ এই চিনিতে। এইরকম প্রত্যেক বস্তুতে তার তন্মাত্রকে অনুশীলন করলে তার সামান্য জ্ঞান পর্যন্ত পৌঁছে যাব। আর তার ফলে কোনো একটি বিশেষ বস্তুর প্রতি আকর্ষণ কমবে।
জড় বিশ্ব রয়েছে, তারই মাঝে একটা গ্রাহ্যতা রয়েছে, একটা শক্তির potentiality রয়েছে, যার জন্য সে চৈতন্যের গ্রাহ্য হতে পারে। জড়ের সত্তা এবং তার গ্রাহ্যতা—এই দুই মিলে তার অর্থ। একসময় জগৎ শুধুই অর্থময়। যখন তার মধ্যে চিন্ময়ের প্রবেশ হয়, তখন তার মধ্যে গ্রাহ্যতা দেখা দেয়। যখন মানুষ ছিল না, চোখ ছিল না, দেখার কেউ ছিল না, তখন রঙের খেলা ছিল। কিন্তু যখন সে চৈতন্যের গ্রাহ্য হচ্ছে, তখন তার একটি বিশিষ্ট রূপ দেখা দিচ্ছে। এই যে রং দেখা দিচ্ছে, সে হচ্ছে একটা বিদ্যুৎস্পন্দন, তার শক্তির যে-স্পন্দ—সেটা নিত্য, জড়। সেই শক্তির স্পন্দ যখন চোখের সামনে দেখি, তখনই গোলাপী রং বা অন্য রঙের রূপ দেখা দেয়। একদিকে primary quality শক্তির স্পন্দ—সে যখন আমার চোখের সামনে ফুটল, তখনই তার বিশেষ রূপ দেখা দিল। বলতে গেলে এটাই 'অর্থ'। চেতনার সংস্পর্শে না এলে অর্থ ঠিক অর্থ হয় না; থাকলেও তা গ্রাহ্য হয় না। Primary quality স্থূলভূত (গোলাপী রঙের সৃষ্টি) আর secondary quality সূক্ষ্মভূত (রংহীন আলোর অস্তিত্ব)।
জড় আগে, চৈতন্য পরে দেখা দিয়েছে—একথা মানলেও কোনো অসুবিধা নেই। অর্থের যে-জগৎ, তার মূলে জড়বস্তু আগে ছিল, তারপরে ইন্দ্রিয় দেখা দিয়েছে। যে পরে দেখা দেয়, সে ঈশ্বর (দ্রষ্টা বা seer অর্থে) হয়ে যায়। জড়ই মৌল উপাদান। সেই জড়ের মাঝে চৈতন্যের উদ্ভব হল।
‘ভূতেভ্যঃ ইন্দ্রিয়াণি'—matter থেকে life—এটা চার্বাকের মত, Materialist-দের মত। আধুনিক বৈজ্ঞানিকেরও এটাই মত। কিন্তু যখন ভূত থেকে ইন্দ্রিয় জাগল, তখন সেই ইন্দ্রিয় ভূতকে শাসন করতে লাগল। এটাই চৈতন্যের বৈশিষ্ট্য। আমাদের জীবন যদি সত্য, তাহলে তাতে চৈতন্যের উন্মেষ হওয়াটাই জীবনের সবচেয়ে বড়ো তাৎপর্য। চৈতন্য উন্মেষিত হয়েছে, তাকে বিদ্ধ করেছে, এটাই সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার। জড়ের উপর কর্তৃত্ব আনাই চৈতন্যের কাজ। জড় যদিও-বা চৈতন্য প্রকাশের আগেও ছিল, তা সত্ত্বেও চৈতন্য তাকে dominate নিয়ন্ত্রণ করে। জড় আগে ছিল, আর তাতেই চৈতন্যের উৎকর্ষ হয়েছে, Materialist-রা এটাকে খুব বড়ো করে দেখেন। এঁরা বলেন, জড়ই যদি না থাকত, চৈতন্য আসত কোথায়? মাটি যদি না থাকত, তাহলে ফুল কোথা থেকে আসত? তাই তাঁরা বলেন, চৈতন্যের সাধনা, ধর্মের সাধনা কাল্পনিক ও নিরর্থক। কিন্তু সেটা ভুল। আমরা সবসময় জীবনে values তথা মূল্য বা তাৎপর্যকে খুঁজি। আমরা সবাই একদিকে idealist বা ভাববাদী—যেখানে বিশুদ্ধ জড়, সেখানে ভালো-মন্দের কথা ওঠে না। সমস্ত idealism বা ভাববাদের মূল হচ্ছে এটাই যে, জীবনে আমরা একটা উৎকর্ষ খুঁজছি। আমরা জড়বাদীই হই, আর চৈতন্যবাদীই হই, আমরা সবসময় জীবনে নতুন values তথা মূল্য বা তাৎপর্য খুঁজি। জড় মূলবস্তু, কিন্তু তাকে অবলম্বন করে যে-ভাব জাগে, তা এই জড়েরই প্রশাস্তা হয়, আর এই ভাবের উন্মেষ ঘটানোই আমাদের কর্তব্য।
প্রথম বলা হয়েছে, ইন্দ্রিয় থেকে জড় বড়ো, ফুলের চেয়ে মাটি বড়ো। উপনিষদ এটা স্বীকার করে নিচ্ছেন, কিন্তু তারপর ধারাটা বদলে যাচ্ছে, আর বলছেন, ইন্দ্রিয় আর অর্থ থেকে মন বড়ো—এটাই চিদ্-উন্মেষের কথা। মন থেকে বুদ্ধি বড়ো, বুদ্ধি থেকে মহান্। মহান্ থেকে অব্যক্ত আর অব্যক্ত থেকে পুরুষ বড়ো। এখানে জড়বাদ আর চিদ্বাদে একটা আশ্চর্য সমন্বয় করা হয়েছে। জড়বাদীর দেহ জড় কিন্তু সে শুধু জড় দেহ নিয়ে ব্যস্ত থাকে না—সে-ও এগিয়ে যেতে চায়, ইন্দ্রিয়গুলিকে strong বা শক্ত করতে চায়, মনের শক্তি বাড়াতে চায়, বুদ্ধিমান হতে চায়। জড়বাদীরা কিন্তু এখানে আটকে যায়। জড়কে ভিত্তি করে চেতনার উৎকর্ষ, কিন্তু সে-পর্যন্ত তারা যেতে চায় না। যারা চিন্ময়বাদী, তারা আরও এগিয়ে যায়। তারা বলবে, আমি মহান, আমি অব্যক্ত, আমি পুরুষ।
প্রথম অর্থতত্ত্ব, তার মাঝে স্থূল আর সূক্ষ্ম; তার পরে ইন্দ্রিয় তত্ত্ব। সাংখ্যে একাদশ ইন্দ্রিয়ের কথা বলা হয়েছে—পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, তারপর মন। প্রথমে দেখা দেয় কর্মেন্দ্রিয়, এটা বাইরের জগতের সঙ্গে ঘাত-প্রতিঘাতের ব্যাপার (ইন্দ্রিয়-সঙ্ঘাত)। নিম্ন প্রাণীজগতে এটা ভালো করে দেখা যায়। এখানে বোধ খুব কম, কিন্তু কর্মেন্দ্রিয় বেশ প্রবল মাত্রায় আছে। প্রথমে প্রাণের একটা ক্ষোভ জগতের ওপর দেখা দেয়, তার থেকে ভেতরের ইন্দ্রিয়গুলি জাগে। প্রথম খাদ্যবস্তু ইত্যাদি শুধু ছিল, এর মাঝে যদি রূপ গন্ধ দেখা দেয়, তাহলে আর-একটা জগৎ দেখা দেবে, যেটা ভাবের জগতের প্রান্তভাগস্থিত—এটাই অন্তরিন্দ্রিয়ের জগৎ। এ সমস্তকেই ভাবের ব্যাপার করার জন্য দেখা দিল মন। মানুষের ভেতরে তার সবচেয়ে বেশি উৎকর্ষ ঘটেছে। বাইরে যা ঘটে, তার পুনরাবৃত্তি করে তার সম্ভোগ সে ভেতরে ভেতরে করতে পারে। মনের পরে আসে বুদ্ধি। মন অনেক পশুরও রয়েছে, কিন্তু মন একটা বস্তুকে গ্রহণ করলে তার বিশেষ রূপকেই ধরতে পারে। তার দেখা—বিচ্ছিন্ন করে টুকরো টুকরো করে দেখা। বস্তুকে সে সমগ্রভাবে দেখতে পারে না। কোনো judgement সে pass করতে পারে না, কোনো বিষয়ে রায় দিতে পারে না। বুদ্ধি সমগ্রভাবে গ্রহণ করতে পারে। আর একটা ব্যাপার হয়—রূপ-আদি বোধের তন্ময়তা। এটা বুদ্ধিরই, বোধেরই ব্যাপার। মন সামগ্রীগুলি এনে দেয়। এই মনের আহরণের বিষয় বুদ্ধির উপাদান হয়, সেটা থেকে বুদ্ধি একটা higher বা ঊর্ধ্বতর জগৎ আবিষ্কার করে। এটা ব্যক্তির নিজস্ব জগৎ। স্মৃতি থেকে যে-ভাব জাগে, তার থেকে একটা তন্ময়তা এসে গেলে তা থেকে আর-একটা উৎকর্ষ হবে। এই যে আমার সৌন্দর্যবোধ, সেটা একটা অসীম সৌন্দর্যেরই প্রতিবিম্ব মাত্র। এটা একটা universal বা সার্বভৌম জ্ঞান। এটা জাগলে ‘আমি’ দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক কিংবা কবি হতে পারি। এখান থেকে অধ্যাত্মচেতনার আরম্ভ।
সব দিকে বৃহৎকেই দেখছি। যা-কিছু আমার সামনে আসছে, তাকে বৃহৎ করেই দেখছি—এটা চিত্তের উৎকর্ষ, একটা উচ্চ অবস্থা। এটাকেই ‘মহান্’ বলা হয়েছে। সাংখ্যে এটাকে ‘মহত্ত্ব’ বলা হয়েছে। সাংখ্যে মনের পর অহং-তত্ত্বকে স্থান দেওয়া হয়েছে, তার পরে মহৎ; কিন্তু এখানে মনের পর বুদ্ধি, তার পরে মহান। ব্যষ্টি-মন উৎকৃষ্ট হচ্ছে বুদ্ধিতে, তার চেয়ে উৎকৃষ্ট মহান। ভাবের ভেতরে মহাভাব, তখন চেতনার প্রসার ঘটে। ফুলের মাঝে যদি অসীমের সৌন্দর্য দেখি, তাহলে মহান্ তত্ত্বকে পেলাম। রামকৃষ্ণ যখন একটি মেয়েকে দেখলেন, তার ভিতরে তিনি জগন্মাতাকে দেখলেন। সেটাই মহান্ ভাব। বুদ্ধি দিয়ে আমরা সব করতে পারি, কিন্তু বুদ্ধির ভেতরে অধ্যাত্ম ভাব আনতে পারে ওই মহৎই।
সাংখ্যের দৃষ্টি ঠিক এমন নয়। উপনিষদের দৃষ্টি synthetic বা সমন্বয়ী, সংশ্লেষণী, অন্যদিকে সাংখ্য হচ্ছে analytic বা বিশ্লেষণী। তাই জড় এবং চৈতন্যকে তাঁরা আলাদা রেখেছেন—কিন্তু উপনিষদে জড় এবং চৈতন্যকে মিশিয়ে দেখা হচ্ছে। চৈতন্যের উৎকর্ষের দিক থেকে তাই মহান্ হচ্ছে এই আত্মা। অপরদিকে, সাংখ্যরা মহৎকেও জড় বলেছেন। এখানে বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিকদের সঙ্গে অধ্যাত্মপুরুষের difference বা পার্থক্য আসে। সৌন্দর্য জগতে রয়েছে কিন্তু সেটা একটা সর্বব্যাপী সৌন্দর্য থেকে এসেছে, সেটা বলতে পারি—এই মহৎ-ই—উপনিষদ এ-ই বলছেন।
এই মহৎ যার একদেশ বা এক অংশ, সে হলো অব্যক্ত। সৌন্দর্যের রূপের যে-অভিব্যক্তি, সেটা পরিপূর্ণ অভিব্যক্তির একটা রূপ মাত্র। সে শুধু সৌন্দর্যেরই অভিব্যক্তি। তা মহানের অভিব্যক্তি হতে পারে, কিন্তু যে-কোনো বস্তুকে যদি আমরা একদিক দিয়ে দেখি, তাহলে তার পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় না। ভগবানকে যদি আমি একদিক দিয়ে দেখি, তাহলে তাঁর সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞান হয় না। মহত্ত্ব হচ্ছে ইতিভাবনার উৎকর্ষ। কিন্তু তাতে সব বলা হয়নি। তার পেছনে একটা-কিছু রয়েছে, যাকে আমরা আভাসে জানি, কিন্তু ব্যক্ত করতে পারি না। এই আভাস-তত্ত্ব অব্যক্ত।
সাংখ্য বলেছেন, এটা প্রকৃতি আর ওটা জড়। কিন্তু উপনিষদে সে জড় নয়, সে অব্যক্ত আত্মা, অব্যক্ত পুরুষ। যে manifest ব্যক্ত বা প্রকট বা সুস্পষ্ট, সে মহান; যে unmanifest অপ্রকট, সে অব্যক্ত। যদি প্রকাশ রূপে দেখি, তবে প্রকাশ হচ্ছে মহান, আর ছায়াতপ বা রেখান্যাস রূপে তার পেছনে রয়েছে অব্যক্ত। সাংখ্যরা বলেন, প্রকৃতি থেকে আসে মহৎ। এখানে বলা হয়েছে, অব্যক্ত থেকে আসে মহান। মহাকাশের যে-শূন্যতা, তাতে ফুটে উঠবে সূর্য, বরুণের বুকে মিত্র—’কিছুই নেই’, তা থেকে ফুটে উঠবে পূর্ণতা।
তার উপরে আর-একটি তত্ত্ব রয়েছে, তিনি হচ্ছে পুরুষ, যিনি মহান্ এবং অব্যক্ত দুটোকেই একসঙ্গে ধারণ করে আছেন—তার উপরে কিছু নেই। ‘সা কাষ্ঠা সা পরা গতিঃ।’ সাংখ্যে এঁকেই বিবেকদৃষ্টি বলা হয়েছে। পুরুষই একমাত্র চিৎ। তার পাশে প্রকৃতি জড়। পুরুষের গ্রাহ্য বলে প্রকৃতি অচেতন। এই প্রকৃতি থেকে মহৎ ইত্যাদির সৃষ্টি।
অর্থ থেকে আরম্ভ করব, কিন্তু যে-পর্যন্ত অব্যক্তের রহস্য না জানব, সে পর্যন্ত শেষ নেই। (তুলনীয়: ‘নেতি নেতি’ বৈদান্তিক প্রক্রিয়া) ফুল বস্তু, তারপর তার রূপ, তাকে ইন্দ্রিয় করছে মনোগ্রাহ্য। তখন বস্তু-সত্তা বুদ্ধির কাছে ভাবরূপে দাঁড়ায়, মহত্ তাকে অসীম মহাভাব পর্যন্ত নিয়ে যায়; তার পরে অব্যক্ত; তারও পরে পুরুষ। অন্তের মাঝে অনন্ত রয়েছে। এটাই উপনিষদের দৃষ্টি।
যথোদকং শুদ্ধে শুদ্ধমাসিক্তং তাদৃগেব ভবতি। এবং মুনের্বিজানত আত্মা ভবতি গৌতম।। (কঠোপনিষদ, ২/১/১৫)
অন্বয়: গৌতম (হে নচিকেতা) যথা (যেমন) শুদ্ধম্ (নির্মল) উদকম্ (জল) শুদ্ধে (নির্মল জলে) আসিক্তম্ (নিক্ষিপ্ত হয়ে) তাদৃক্ এব (সেইরকম নির্মলই অর্থাৎ একরসই) ভবতি (হয়) [তেমনি] বিজানতঃ (একত্বদর্শী বা তত্ত্বদর্শী বা আত্মৈকদর্শী) মুনেঃ (উপলব্ধিবানের বা মননশীল ব্যক্তির) আত্মা (আত্মাও) এবম্ ভবতি (এইরূপ অভেদত্ব বা একত্ব-প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ তিনি ব্রহ্মস্বরূপই হয়ে যান)।
অর্থাৎ, যথা শুদ্ধং উদকং শুদ্ধে আসিক্তম্—নির্মল জলবিন্দু শুদ্ধ জলাশয়ে নিক্ষিপ্ত হলে যেমন 'তাদৃগেব ভবতি'—তাদৃশই অর্থাৎ শুদ্ধ জলাশয়ই হয়ে যায়, তেমনি 'এবং মুনেঃ বিজানত আত্মা ভবতি'—আত্মতত্ত্ব সাক্ষাৎকারী মননশীল তত্ত্বদর্শীর আত্মাও সেইরূপ অর্থাৎ ব্রহ্মই হয়। (তুলনীয়: সমুদ্রের ফেনা সমুদ্রের জলের সাথে মিশে গিয়ে সমুদ্রের অংশ তথা অভিন্ন সমুদ্রই হয়ে যায়, তাকে আর আলাদা করে ফেনা-রূপে চেনা যায় না।)
এই দৃষ্টান্তটি আমরা বহুক্ষেত্রে উল্লেখ করি যে, আত্মা উপাধি অর্থাৎ আবরণ-মুক্ত হলে পরমাত্মার স্বরূপতাই প্রাপ্ত হন; অর্থাৎ তিনি প্রকৃতই যা ছিলেন, সেই রূপেই প্রকাশ পান, তাঁর আর পৃথকতা থাকে না। ঠিক যেমন নির্মল শুদ্ধ জলরাশিতে একবিন্দু শুদ্ধ জল ফেললে জলবিন্দুটি বিশাল জলরাশির সঙ্গে মিলে গিয়ে একাকার হয়ে বিশালতা প্রাপ্ত হয়। শুদ্ধ জলে মলিন জলবিন্দু ফেললে কিন্তু এমনভাবে মেশে না। পরিষ্কার জলে এক ফোঁটা কালি ফেললে বেশ কিছু সময় কালিমা দেখা যায়। বিষাক্ত জলের ফোঁটা ফেললে সমগ্র জলটিই বিষাক্ত হয়ে যায়। এক বালতি দুধে এক ফোঁটাও গোমূত্র পড়লে সমস্ত দুধ নষ্ট হয়ে যায়, অথচ সমজাতীয় বস্তু তথা দুধ পড়লে তা মিশে গিয়ে একাকার বা অভিন্ন হয়ে যায়।
আমরা অবিবেকী (‘ব্রহ্ম সম্পর্কিত জ্ঞানহীন’ অর্থে) ব্যক্তিরা উপাধিযুক্ত হয়ে যেন মলিন জলবিন্দুর মতো হয়ে আছি। দেহ-ইন্দ্রিয়াদির আবরণের ভেতরে আত্মা যেন আবদ্ধ হয়ে গেছেন। ফলে আমার আত্মা, তোমার আত্মা ইত্যাদি এরকম পার্থক্য দেখা যায়। দেহেন্দ্রিয়াদিকে সেখান থেকে যদি সরিয়ে দেওয়া যায়, লোপ করে দেওয়া হয়, তাহলে যেমন ‘জলবিন্দুর ভেতরের সমস্ত মলিনতারূপ পরিচ্ছেদ দূর হয়ে’ তা ‘শুদ্ধ জলরাশির সঙ্গে এক হয়ে শুদ্ধ হয়ে’ যায়, সেইরকম সমস্ত উপাধিনির্মুক্ত জীব তখন সমষ্টির সঙ্গে অভিন্ন ও অখণ্ড যে-সত্তা, তার সঙ্গে এক হয়ে যাবে। কোনো পার্থক্যই আর থাকবে না।
(পরবর্তী তিন অংশে সমাপ্য)