একমেবাদ্বিতীয়ম্

সব কথা, সব সত্য, সব শাস্ত্রের মূল ‘আমি’। আমিত্বের বিকাশ থেকেই যত কথা, সত্য ও শাস্ত্র। আমিত্বের প্রসার, বিকাশ ও বিস্তৃতি ছাড়া কোনো কিছুরই অস্তিত্ব বোঝা যায় না। ‘আমি’ না থাকলে ‘আমার’ ব্যাপারটাই তো আসছে না, আর তখন তো আমার চোখে-মনে-ভাবনায় কিছুই নেই—সব‌ই শূন্য। আমি আছি বলেই আমার কাছে সব কিছুর অস্তিত্ব আছে।




আমি কী? আমি কে? আমি কোথায় ছিলাম? আমি কোথায় যাব? অনেক দর্শন অনেক পথে এই প্রশ্নের মীমাংসা করার চেষ্টা করেছে—কিন্তু অকূলের কূল নির্ণয় করার জন্য একক কোনো সমাধানে আসা সম্ভব হয়নি। আমিত্বের উদয় এবং তিরোধান সম্পর্কে কেউ স্পষ্ট করে কিছু জানে না, বোঝে না—কেউ তা দেখেনি, কেউ তা স্পর্শ করেনি, কেউ তা অনুভব করেনি। সকল ইন্দ্রিয়‌ই যেন এখানে পরাজিত। পৃথিবীতে আসামাত্র মানবশিশুর যে-শ্বাসের যাত্রা আরম্ভ হলো, মৃত্যুর সময় সেই শ্বাস বন্ধ হলো—এর মাঝে কে এল, কে গেল—চিরকাল‌ই এসব মহারহস্যময়। মানুষ কোথা হতে এল, কোথায় গেল—কেই-বা বলতে পারে নির্দিষ্ট করে!




কত‌ই তো ব্যাখ্যা আর টীকা আছে…কিন্তু কোন ব্যাখ্যা সমীচীন? কোন টীকা প্রত্যক্ষ সত্যমূলক? অকূলের কূল নির্ণীত হয়নি, হবেও না, হবার‌ই নয়। আমিত্বের মহাবীজে অনন্তেরই মহাআভাস। কেউ বলে, সান্ত, সান্ত, সবই সান্ত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অণু-পরমাণু হতে আরম্ভ করে এই চৈতন্যময় মানববীজের মূলে সব জায়গাতেই কেবল অনন্তের আভাস। সবই অনন্ত, সান্ত বা পরিমিত কিছুই নেই।




জড়বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, জড় অবিনশ্বর; মনোবিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, চৈতন্যও অবিনশ্বর। মানুষ জড় ও চৈতন্যের সংমিশ্রণ, সুতরাং মানুষও অবিনশ্বর। পঞ্চভৌতিক দেহ মৃত্যুর পর পঞ্চভূতেই বিলীন, কিন্তু চৈতন্য কোথায় লুকোল? পাখি কোন অদৃশ্য জগৎ হতে এসেছিল, কোথায় গেল, কেউই জানে না। অবিনশ্বর চৈতন্য কোন রাজ্যে প্রস্থান করল, কল্পনার কথা বাদে দিলে, কেউই তা ঠিক করে বলতে পারে না। মহাসমস্যা! মহাপ্রহেলিকা! যদি বলতে পারত, তবে আমিত্বের সোপান অবলম্বন করে অনন্তের আভাস পাওয়া যেত না। সান্ত মানুষে বরাবরই অনন্তের মহামিলন।




সান্ত মানুষে যেমন অনন্তের মহামিলন, এই সান্ত মানুষেই তেমনি দ্বৈত-অদ্বৈতের মহাব্যাখ্যা। আমি মাটির পুতুল, আবার আমিই সোনার মানুষ—আমি যখন পাপের পথে ঘুরি, পাপচিন্তা, পাপাহার, পাপপান করি, তখন আমি মাটিতুল্য, কিংবা মাটির চেয়েও হীন এবং নীচ। মানুষ করে না কী অকাজ? পাপের সংসারে মানুষকে অন্বেষণ করলে দেখা যাবে, পশুর পশুত্বও অপেক্ষাকৃত ভালো বলে মনে হচ্ছে। পাপের সংসার মোহের মহান্ধকারে আচ্ছন্ন, সৎ-চিৎ-আনন্দ-রূপ সূর্যের প্রকাশ সেখানে নেই। সেখানে কেবল অসুর, পিশাচ, মানুষরূপী শয়তান বাস করে। আমি যখন মানুষরূপী শয়তান, তখন শ্রেয় বা বিবেক আমার কাছে প্রকাশিত হয় কি? ডুবতে ডুবতে এমন অন্ধকারময় প্রদেশে এসেছি, যখন আর দেবধামের কোনো কিছুর সাক্ষাৎ পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়—তখন আমি পৃথক, তখন আমি নরক, তখন আমি দ্বিত্বে বিহার করছি।




স্বর্গের বাণী কখনো শুনলেও তা গ্রাহ্য করি না, আমি তখন অহংময়। আমি বলি, আমি চলি, আমি করি—তখন আমি সর্বেসর্বা। আমার প্রতি কথায় বিষ, প্রতি পদক্ষেপে নরক, প্রতি কাজে পাপ। এমন অবস্থায় আমি দ্বিত্বের রাজ্যে স্বামিত্বের বিজয়নিশান ওড়াচ্ছি। কিন্তু দৈব কোনো ঘটনায়, কোনো প্রক্রিয়ায়, কোনো লীলায় এই আমিত্বের কখনো কখনো আবার রূপান্তর হয়। যে নর-হত্যায় লিপ্ত ছিল, সে কখনো আবার নরসেবায় প্রবৃত্ত; যে ইন্দ্রিয়াসক্তিতে ডুবছিল, সে কখনো আবার সংযমের পথে ফিরছে; যে নরকের পথে মরছিল, সে কখনো আবার স্বর্গের অন্বেষণ করছে।




মৃত্যু সারাক্ষণই এই সংসারে বিচরণ করে মোহের জাল ছিঁড়ে চলেছে—মানুষকে যেন সারাক্ষণই সতর্ক করছে। মৃত্যুকে মানুষ এক দিন, দশ দিন, এক বছর বা দশ-বিশ বছর ভুলে থাকতে পারে, কিন্তু চিরকাল ভুলে থাকতে পারে না। ভুলতে চায় সে, তবুও পারে না। কে যেন সারাক্ষণই তাকে জাগাতে চেষ্টা করছে। পতনের পর উত্থান হবেই হবে, কেউ চিরপতিত থাকতে পারে না। দ্বৈতের ভেতরে অদ্বৈতের এমন‌ই মহাপ্রকাশ।




দ্বিজত্ব পায়নি, পুনর্জন্ম হয়নি, এই সংসারে এমন মানুষ কল্পনা করা যায় না। জগাই-মাধাই নবদ্বীপের জঙ্গলে দস্যুগিরি করত, হঠাৎ অদ্বৈতের প্রকাশে সাধুতে রূপান্তরিত; বাল্মীকি নরহত্যা করে অরণ্যে জীবন কাটাতেন, অদ্বৈতের আবির্ভাবে তিনি হঠাৎ মহাকবি। একসময়ের গর্বিত নিমাই পণ্ডিত, সময়ান্তরে প্রেমভক্তিতে নমিত শ্রীচৈতন্য; একসময়ে যিনি সূত্রধরের পুত্র যিশু, অন্যসময়ে তিনি মানবের উদ্ধারকর্তা খ্রিস্ট। শ্রীচৈতন্য কখনো কখনো বলতেন, “মুই সেই!”; যিশু বলতেন, “I and my father are one.”—এসব বলতেন কোন অবস্থায়? দ্বৈতের রাজ্যে চৈতন্য ও খ্রিস্ট শচীপুত্র ও মেরীনন্দন, কিন্তু অদ্বৈতের রাজ্যে উভয়েই আত্মহারা ‘আর-একটা কিছু’। আমি, আামি, আমি—মাটির পুতুল, পাপের কীট; সময়ান্তরে এই আমিই স্বর্গের দূত, সোনার চাঁদ। আমি কখনো শুধু আমিই, আবার কখনো যেন আর-এক রাজ্যের জীব। আমি দ্বৈত—পাপের পথে, আমি অদ্বৈত—পুণ্য বা স্বর্গের পথে।




আমি কে? আমার ভেতরে যখন পাপ কিলবিল করছে, ইন্দ্রিয় বা রিপুর তাড়নায় যখন আমি অস্থির, তখন আমি স্বর্গভ্রষ্ট, দেবত্বভ্রষ্ট অসুর, আমি তখন পৃথক। এই আমার ভেতরে যখন পুণ্যের আবির্ভাব, সংযমের কশাঘাতে যখন মোহাসক্তির বন্ধনরজ্জু ছিন্ন, আমি যখন ধীর এবং স্থির—যখন দয়া, প্রেম, পুণ্য, জ্ঞান ও সেবায় নিষ্কাম মহাযোগী, তখন আমি কে? তখন আমি চিত্-এর অংশ; অংশ‌ই কেবল নই, আমিত্ব তখন চিন্ময়ত্বে বিসর্জিত হয়েছে—তখন অদ্বৈতশক্তি-সিন্ধুতে তরঙ্গ উঠছে, তখন পৃথিবীর দ্বৈত অসুরের বিনাশ সাধন হয়েছে।




সময় অনবরত মানুষের মাথায় কত কিছুই তো চাপিয়ে যাচ্ছে। সময় কোথা হতে আসছে, কোথায় যাচ্ছে, কেউ জানে না, কিন্তু এটা সকলেই জানে, সময় মানুষকে কিছু-না-কিছু দিয়ে যাচ্ছে। সময় দিয়ে যাচ্ছে বলেই মানুষ অতীতের সমস্ত সঞ্চিত সত্যজ্ঞান ও পুণ্যরাশির উত্তরাধিকারী। বংশ-পরম্পরায় কত জ্ঞান, কত ভাব, কত শিক্ষা, কত অভিজ্ঞতা মানুষের মাথায় চাপছে। কালের সংগ্রাম ভীষণ কঠিন এক সংগ্রাম। মানুষ মায়ামোহের অধীন হয়ে মজে থাকতে চাইলেও, সময় তা করতে দিচ্ছে না। সময়—বাল্যের পর যৌবন, যৌবনের পর প্রৌঢ়ত্ব, প্রৌঢ়ত্বের পর বার্ধক্য আনছে। মানুষ ইচ্ছে বা চেষ্টা না করলেও, সময় তার মাথায় শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা চাপিয়ে দিচ্ছে। সময়ের পীড়নে মানুষের জ্ঞান, পুণ্য, ভাব, অভিজ্ঞতা বাড়ছে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে শরীর ও রিপু নিস্তেজ হচ্ছে, মস্তিষ্ক শিথিল হচ্ছে, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে শক্তি-বীর্য, ক্ষমতা-সৌন্দর্য, বুদ্ধি ও সংসারাসক্তি হারাচ্ছে—সে যেন দিন দিন কেমন অদ্ভুত হচ্ছে।




মানুষের সাধ ও ইচ্ছে অনেক, কিন্তু হায়, সেসব ইচ্ছে পূর্ণ হতে না হতেই, সেসব সাধ মিটতে না মিটতেই চিত্ত নিস্তেজ, ইন্দ্রিয় শ্লথ, অঙ্গ পরিম্লান হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে তার বাসনা, তার কামনা, তার আসক্তি, তার পাপানুরাগ, কী জানি কেন, কমে আসছে। অপূর্ণ পিপাসা, কী জানি কেন, আপনাআপনি হ্রাস হয়ে আসছে। সে আগে কত বাক্‌যুদ্ধ করত, এখন হাজার বার উত্তেজনা তৈরি হলেও একটা কথাও বলতে চায় না; পরনিন্দায় তার কত উল্লাস ছিল, এখন হাজার কারণ থাকলেও কারও নিন্দা করতে সে চায় না; সে আগে কোনো মানুষের ভালো দেখতে পারত না, হিংসা-বিদ্বেষে জর্জরিত ছিল, এখন সে সবার উন্নতি দেখলে কত উল্লসিত হয়; সে আগে, কাম-ক্রোধ-লোভের সৃষ্টি হয়, এমন কাজ‌ই বেশি করত—অথচ এখন সব ঝড় যেন থেমে আসছে, দিন দিন সে আসক্তিহীন, কামনাহীন, বাসনারহিত—অদৃশ্য এক কারণে, কীরকম জানি কী এক রাজ্যের লোক হয়েছে!




তুমি তার হাজারো নিন্দা করো, সে ফিরেও চায় না; তুমি তার কত ক্ষতি করছ, সে এক বারও তাকায় না; সে দিন দিন যেন কেমন হচ্ছে। দেবদূত সময়—মানুষকে—ঘটনা, অবস্থা, শোকদুঃখের ভেতরে ফেলে নিষ্পেষিত করতে করতে এমন একটা অবস্থায় শেষে উপস্থিত করে যে, আগের মানুষ যেন আর থাকে না। আগের মানুষটাকে খুঁজে দেখো, এ সংসারে তাকে আর খুঁজে পাবে না। বাল্যে যে ছিল, যৌবনে সে নেই; যৌবনে যে ছিল, বার্ধক্যে তার মৃত্যু হয়েছে। এক অবস্থায় মৃত্যু, অন্য অবস্থায় পুনর্জন্ম—এ সংসারের নিত্য ঘটনা। নতুন জীবন লাভ করতে করতে, শেষে, বার্ধক্যে আমিত্বের স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত হচ্ছে—ইচ্ছের সাথে ইচ্ছের মিলন হচ্ছে—এক মহতী ইচ্ছে তাকে যেন পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলছে। স্বতন্ত্র মানুষ মরে গেছে, চিৎ-রাজ্যে অদ্বৈতের উদয় হয়েছে।




বয়স আসলে কী? বয়স এমন এক সত্তা, যা শীতল জলসিঞ্চনে শোক-দুঃখের আর আসক্তির গনগনে আগুন নির্বাণ করে। এই সংসার যেন এক বৃহৎ শিক্ষালয়। কাজের বন্ধনে ফেলে, খাটিয়ে নিয়ে, কোনো এক মহামায়া যেন মানুষকে নির্বাণের পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সারাক্ষণই কেবল কাজ আর কাজ। মানুষ অবিরত খাটছে, ছুটছে, একটুও বিরাম নেই। অর্থ উপার্জনের জন্য কত খাটুনি, ঘর-বাড়ি-পরিবারের জন্য কত শ্রম, সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কত আত্মত্যাগ। খাটতে খাটতে মানুষ পরিশ্রান্ত, তবুও খাটুনির বিরাম নেই। দ্বৈত অবস্থায় কর্মবন্ধন এক মহাবন্ধন—এই বন্ধনমু্ক্ত না হলে আসক্তির রজ্জু ছিন্ন হয় না। অমুক্ত অবস্থায়, এভাবে—একটু ভালোবাসলাম, তৃপ্তি নেই…আর‌ও বাসলাম, তবুও তৃপ্তি নেই। একটু জ্ঞানচর্চা করলাম, তৃপ্তি নেই; আরও একটু চর্চা করলাম, তৃপ্তি তবু কিছুতেই মিলল না।




ক্রমাগত হাঁটতে ছুটতে খাটতে লাগলাম—এ যেন এক অনন্তের পথে অনন্ত খাটুনি। যেতে যেতে, খাটতে খাটতে—শেষে, অবশেষে, হায়, এ কী তত্ত্বে এসে পৌঁছলাম? পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র, ভাই-বন্ধুর ভালোবাসার পথে হাঁটতে হাঁটতে, শেষে, এক অনন্ত প্রেমের রাজ্যে এসে উপস্থিত। জ্ঞানের চর্চা করতে গিয়ে, শেষে, এক অকূল জ্ঞানসাগরে এসে উপনীত। মনুষ্যত্বের পথে হাঁটতে হাঁটতে, শেষে, মানুষ দেবত্বে উপনীত। বয়সের পরিপক্বতার সাথে জ্ঞান, প্রেম আর পুণ্যের পরিপক্বতা উপস্থিত। অসম্পূর্ণতা—পাপ, মোহ, আবিলতা ঘুচতে ঘুচতে, শেষে, পূর্ণত্বের দিকে অভিযান। এই অবস্থায় মানুষ দ্বৈতের পদবি হারায়। বালক কি বৃদ্ধের স্বাতন্ত্র্য ঘুচে যায়—চিন্ময়ত্বেই আত্মার সকল স্বাতন্ত্র্য—সকল রিপু, সকল ইন্দ্রিয় নির্বাপিত, ওসব এখন অদ্বৈতের ভেতরে সুষুপ্ত।




একেই কিনা মানুষ না বুঝে মৃত্যু নামে অভিহিত করে। হায়, না বুঝে কত কান্না, কত হাহাকার করে! অথচ দ্বৈত মানুষ এখন অদ্বৈত-সিন্ধুতে নিমগ্ন। এ এক মহাযোগ, মহাসমাধি, মহামিলন। পিতা পৃথক, পুত্রও পৃথক—পুত্র পিতার রাজ্য, সৎসংসর্গ পরিত্যাগ করে কত বিপথে ঘুরল—এখন সে আবার পিতার চরণতলে উপস্থিত, এখন পিতা-পুত্রের মিলন হয়েছে—এক ইচ্ছে, এক জ্ঞান, এক তত্ত্ব, এক সত্য, এক ধর্মে একাকার। এখন, এমন অবস্থায়ও, যে পার্থক্য দেখে, গভীর সৃষ্টিরহস্য সে মোটেই বোঝেনি।




দ্বিত্ব-বোধ, ভোজের বাজি, লীলার বুদ্‌বুদ, চোখের ভেলকি—এসব কিছুই নয়। পাপবোধের পরও আমি পাপের পথে চিরকাল ঘুরব, মরব, পচব—এ অধিকার আমার মোটেই নেই। দশ বছর, নয়-বিশ-ত্রিশ বছর…একজন আমার পেছনে লেগে আছেন, যিনি অনবরত আমার লাগাম টেনে ধরছেন। সাধ্য কী আমার যে আমি ক্রমাগত মরণের পথে চলব? আমার শোণিত অবিরত শিরায় শিরায় চলছে, আমার সাধ্য নেই, তা রোধ করি; আমার চোখের পলক নিমেষে নিমেষে পড়ছে, আমার সাধ্য নেই থামাই; পাকস্থলিতে ভুক্ত খাদ্যের হজম হচ্ছে, সাধ্য নেই, ওতে কর্তৃত্ব করি; আমার সমস্ত স্নায়ু অবিরত বিদ্যুতের মতো নানান বার্তা মস্তিষ্কে বহন করছে, সাধ্য নেই, আমি রোধ করি। কারও দুঃখকষ্ট দেখলে আমার কান্না পায়, বিপদ দেখলে ভয় আসে, সাধ্য নেই, আমি সেসব রোধ করি।




আমি কী পারি, আমি কীই-বা করি! দেখতে চাই একটা, দেখি আর-একটা; করতে চাই একটা, করে বসি আর-একটা। আমার বুকের ভেতরে কে যেন অনবরত কেমন একটা স্রোত প্রবাহিত করছে, আমি তো কিছুতেই তাঁকে অতিক্রম করতে পারলাম না। সংসার আমাকে কিনতে চাইল, আমি বিক্রীত হলাম না। পাপ চিরদাসত্বে আমাকে উৎসর্গ করতে চাইল, আমি অনুৎসর্গই র‌ইলাম। ভাই-বন্ধু, স্ত্রী-পুত্র, আমাকে এটা-সেটা ধরিয়ে দিয়ে দমিয়ে রাখতে চাইল, আমি ওতে মজতে পারলাম আর কই? কে যেন আমাকে সারাক্ষণই কেমন একরূপ করতে চাইছে। সবাই, সমস্ত সংসার, চায় এক রকম করতে, তিনি চান আরেক রকম করতে।




আমি কী করব বলো! আমার ক্ষমতা কোথায় যে ফিরি? আমার অসার আমিত্ব, অক্ষম স্বামিত্ব। যিনি আমাকে ধরেছেন, তিনি তোমাকে বা তাঁকে কি ভুলে রয়েছেন? না, তা-ও অসম্ভব। তিনি তোমাকে তুমিত্বে, আমাকে আমিত্বে, তাঁকে তিনিত্বেই নিয়ে যাচ্ছেন। মানুষ কত কোটি বছর চেষ্টা করল, দশ জনকেও মেলাতে পারল কি? এক রকমের করতে পারল কি? বিধানই যে তা নয়! প্রতিটি গাছের হাজার পাতা হাজার প্রকারের, মানুষের পরিবারের কোটি সন্তান কোটি প্রকারের। প্রতিটি বস্তু বা জীবই বিশেষত্বে পূর্ণ, কে কাকে উপেক্ষা করবে? এমন যদি না হতো, অনন্তের আভাস কেউ পেত না। অনন্তের আভাস দেবার জন্য কে যেন এমন বিধান করছেন। আমি অনন্তের ছেলে—তাই অনন্তের বিন্দু ধরেই, অনন্তের আদেশে অনন্তের পথে চললাম, কারও সাধ্য‌ই হলো না যে, আমাকে বেঁধে রাখে! তুমি বলো, এটা করো, সেটা করো—আমি তোমার প্রচারিত পথে যাবার চেষ্টা করেও যেতে পারলাম না, কেননা আমার শক্তি নেই, আমি এক শক্তিহারা জড়ভরত।




বৃথাই আমাকে তিরস্কার কেন করো, ভাই? কত চিকিৎসক এ জগতে আছে, কিন্তু প্রতিদিন কোটি কোটি লোকের মৃত্যু হচ্ছে, কে আটকে রাখতে পারে? ঘাতকের হাতে যিশুর মৃত্যু, শ্রীচৈতন্যের সমুদ্রে পতন—অপরিহার্য ঘটনা। রাজা মরছেন, প্রজা মরছেন, মহাধনী মরছেন; নিতান্ত নির্ধন যে, সে-ও মরছে। বিধান স্বতন্ত্র কি? এক সূর্য, এক চন্দ্র সকলকে আলো দেয়, এক বায়ু সকলকে সুশীতল করে, এক জল সকলের তৃষ্ণা মেটায়—বিধান স্বতন্ত্র কি? কেউ সোনার পাত্রে, কেউ-বা মাটির পাত্রে যে জল পান করে, তৃষ্ণা নিবারণ দুয়েরই হয়। বিধান কিন্তু এক ভিন্ন দুই নয়, গতি এক ভিন্ন বহু নয়, পাত্রানুসারে আলো ও জলকে পৃথকরূপ দেখালেও, তা একই আলো, একই জল। ভেলকি বা ভোজের বাজি দেখে যে ভোলে, বৃথা যে অহঙ্কারে ফোলে, প্রকৃতি-তত্ত্ব সে মোটেই বোঝেনি।




মূল কথা, আমি, তুমি, তিনি—সকলেই এক স্থানে পৃথক পৃথক, আবার আর-এক স্থানে একাকার। জীবনে ভিন্ন ভিন্ন, মরণে সবই এক‌; অথবা সীমায় রূপান্তর, অসীমে একাকার। কত নদী পর্বত হতে নেমে এসে কত নামে পরিচিত হলো, কিন্তু যখন সাগরে মিলল, তখন সব একাকার। ভেদ কোথায়, বলো তো? আমাদের জীবনের গল্পেও আমাদের কত রূপ, কত বিভিন্ন প্রকৃতি—কখনো আমরা অসুর, কখনোবা সুর; কখনো দস্যু, কখনোবা দেবতা। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন মৃত্যুর পথে সমস্ত পাপের নির্বাণ, ধীরে ধীরে সকল ইন্দ্রিয় আর রিপু নিস্তেজ—তখন ধীরে ধীরে স্বামিত্ব ও আমিত্বের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে কে যেন আমাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলছেন। একটা, একটা, একটা করে যখন পাপের বলিদান হতে লাগল, তখন শত দিক হতে শত প্রকারে পুণ্যের অভ্যুদয় হতে লাগল; শেষে একদিন জগৎ বিস্ময়ে দেখল, ‘আমিত্ব’ বলে যে একটা দিগ্বিজয়ী অসুর ছিল, সে কোনো এক নির্বাণ-পুরে বিলীন হয়ে গেছে, সেখানে এক পুণ্যময় দেবতার লীলা প্রকটিত হয়েছে; জগৎ দেখল, দেবাসুর সংগ্রামে এক মহাশক্তির জয় হয়েছে।




তখন বহু লোকে কেবল সেই শক্তিরই জয় ঘোষণা করতে লাগল। হায়, আত্মপ্রশংসা ভুলে আর কবে সব মানুষ সেই মহাশক্তির, সেই অদ্বৈতশক্তির জয় ঘোষণা করতে ব্রতী হবে! শক্তি কী আর আছে? এক শক্তি, পূর্ণ শক্তি—সকল‌ই, সর্বস্ব‌ই গ্রাস করে ফেলছে। ভক্তির সাথে, আকাশ কাঁপিয়ে আজ সবাই বলুক—একমেবাদ্বিতীয়ম্। দ্বৈতজ্ঞান কেবল ভোজের বাজি—অদ্বৈতের প্রকট লীলা মাত্র! ওসব ভুলে বরং এই দর্শনের হোক উদ্‌বোধন—এক শক্তি, এক ধর্ম, এক জ্ঞান—একমেবাদ্বিতীয়ম্—অদ্বিতীয় এক!