এসো, ঈশ্বরকে জানি (তৃতীয় ভাগ)

ঈশ্বর অনন্ত অসীম, আর বাকি সকলই সান্ত বা সীমাবদ্ধ। ঈশ্বরের অন্ত নেই, শেষ নেই—কোনো বিষয়েই তাঁর সীমা নেই। তুমি, আমি, সকল উদ্ভিদ, প্রাণী ও জড় পদার্থ প্রভৃতি যা-কিছু এই জগতচরাচরে আছে, তার কিছুই অনন্ত নয়; সকলই সান্ত, সকলেরই একটা শেষ আছে। আর সেই কারণেই আমাদের সহানুভূতি, সমানুভূতি, দয়ামায়া-সহ সমস্ত মনের ভাব, আমাদের জ্ঞান প্রভৃতি সকলই সান্ত, সীমাবদ্ধ।




জগতচরাচর এমনভাবেই গঠিত যে, এর সব কিছুই বিভিন্ন স্থানে সীমাবদ্ধ। জগতের সকলই—যা-কিছু আছে, তা একটা-না-একটা স্থানে সীমাবদ্ধ। বস্তু স্থান অধিকার করে থাকবেই—সুতরাং তা সেইটুকু স্থানের দ্বারা সীমাবদ্ধ। এমন প্রকাণ্ড যে সূর্য, পৃথিবী এবং সকল গ্রহ-নক্ষত্র, এরা সকলেই নিজ নিজ থাকার জায়গা দ্বারা সীমাবদ্ধ, অর্থাৎ এরা যতটুকু জায়গা নিয়ে আছে, তার বেশি এদের অবয়বের বিস্তৃতি নেই এবং থাকার ওইটুকু জায়গা ছেড়ে আরও বেশি জায়গা অনন্তে পড়ে আছে।




জগতচরাচরের সকলই যেমন স্থানে সীমাবদ্ধ, ঠিক তেমন সকলই কালে সীমাবদ্ধ। যে-সময়ে যে-ঘটনাটা ঘটে, সেই সময়েই সেই ঘটনাটা ঘটে গেল; যে-সময়ে যে-জিনিসটা যেখানে থাকল, সেই সময়েই সেই জিনিসটা সেইখানে থাকল; যে-সময়ে আমি যে-জ্ঞান পেলাম বা যে-ভাবকে মনে স্থান দিলাম, সেই সময়েই সেই জ্ঞান ও সেই ভাব আমার মনে ছিল, অন্য সময়ে ছিল না। আমরা ঠিক একই সময়ে বিভিন্ন বিষয় যে জানতে পারি না বা ভাবতে পারি না, সেইটাই আমাদের ভাব, জ্ঞান প্রভৃতির সীমাবদ্ধ হবার একটা প্রমাণ।




এখন তোমরা বোধ হয় বুঝতে পেরেছ, জগতে যা-কিছু আছে, ছিল ও থাকবে, সকলেরই একটা সীমা আছে, ছিল ও থাকবে। এককথায়, জগতের সকলই সান্ত, সীমাবদ্ধ। আমরা এরকম সীমাবদ্ধ বলেই তার বিপরীতে বুঝতে পারছি, সীমাবদ্ধের অতীত কোনো কিছু আছে, কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি এবং জানতে পারছি, আমাদের সীমা ছেড়ে, আমাদের দৃষ্টিবলয় ছেড়ে আরও ঢের স্থান আছে এবং আমাদের জ্ঞানের সীমা ছেড়ে আরও ঢের জ্ঞান আছে, আর আমাদের জীবনকাল ছেড়ে আরও ঢের সময় ছিল ও আছে।




আগে স্থানের বিষয় ধরো। এই লেখা এতটুকু জায়গা জুড়ে আছে; তার পরেও তো অনেক জায়গা পড়ে আছে। আবার সেই অতিরিক্ত স্থানের এক অংশে এই টেবিল আছে, তার পরেও তো অনেক জায়গা পড়ে আছে। আবার সেই অতিরিক্ত স্থানেরও এক অংশে এই বাড়িঘর আছে; আবার তারও অতিরিক্ত অনেক স্থান পড়ে আছে। এভাবে দেখতে দেখতে দেখা যাবে, এই পৃথিবীতে যত কিছু জিনিস যতটাই জায়গা জুড়ে থাক না কেন, সেই জায়গার অতিরিক্ত আরও ঢের জায়গা পড়ে থাকে।




পৃথিবীর প্রত্যেক বিন্দুস্থানও যদি কোনো-না-কোনো জিনিসে ঢেকে যায়, তাহলেও দেখবে, পৃথিবীতে থাকার স্থান ছাড়াও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ঢের অতিরিক্ত স্থান পড়ে আছে; সেই অতিরিক্ত স্থানে সূর্য-চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র বসে আছে। এরকম ভেবে দেখলে বুঝতে পারবে, যতই জিনিস জগতচরাচরে থাক, তারও অতিরিক্ত আরও অনেক অতিরিক্ত স্থান পড়ে আছে–-তা না হলে সেইসব জিনিস থাকতে পারে কী করে?




এই বাড়তি স্থান কোথায়?—আকাশে। আকাশ আর কিছুই নয়, কেবল একটা সুবিস্তীর্ণ স্থান---এত‌ই প্রকাণ্ড যে, আমরা কল্পনাতেও আনতে পারি না, এটা কত বড়ো। যত কিছু জিনিস এই জগতে ছিল, আছে বা থাকবে, সমস্তই এই আকাশের মধ্যে কোথাও-না-কোথাও ছিল, আছে বা থাকবে—আকাশ ছেড়ে কোনো জিনিসই থাকতে পারে না। আমরা স্থানে সীমাবদ্ধ বলেই এর বিপরীতে এই আকাশ থেকেই স্থান বিষয়ে অনন্তের আভাস পাই। আকাশ অনন্ত বলেই জগতের সকল জিনিসই তাতে ধরে। এই জন্য কোনো কোনো ঋষি ঈশ্বরের অনন্ত ভাব বোঝাবার জন্য তাঁর একটা নাম দিয়েছেন আকাশ।




কিন্তু এই আকাশই কি বিশুদ্ধ অনন্ত বা সীমাহীন? না, তা-ও নয়। আমরা তো আকাশকে ভাগ করে বলতে পারছি, এইটুকু স্থান, ওইটুকু স্থান। এরকম স্থানকে সীমাবদ্ধ করার ক্ষমতা থেকেই বুঝতে পারছি, আমরা সমস্ত আকাশকে ঠিক সীমার মধ্যে দেখতে না পেলেও, ধরতে না পারলেও, আকাশের কোনো-না-কোনো সীমা আছে। কিন্তু সেই সীমাকে তোমার-আমার ধরার সাধ্য নেই। সেই সীমা জানার জন্য অনন্ত আকাশের চেয়েও অনন্ত এক জ্ঞানবান পুরুষ চাই। সেই অনন্ত পুরুষই হলেন অনন্ত ঈশ্বর।




যেমন দেখলাম, ঈশ্বর স্থানে অনন্ত, ঠিক একইভাবে, তিনি কালেও অনন্ত। আগেই বলে এসেছি, জগৎ-চরাচরের সকলই যেমন স্থানে সীমাবদ্ধ, তেমনি কালেতেও সীমাবদ্ধ। যে-সময়ে যে-ঘটনাটি ঘটে, যে-জ্ঞান লাভ হয় বা যে-ভাব মনে উদিত হয়, ঠিক সেই সময়েই সেটা হয়ে গেল। ওই ঘটনা, জ্ঞান বা ভাবের জন্য ওইটুকু কাল বা সময়‌ই নির্ধারিত। কিন্তু এটা আমরা জানি যে, সেই সময়ের আগেও অনেক সময় চলে গেছে এবং তার পরেও অনেক সময় থাকবে। তোমরা বেশ ভালো করেই জানো, সেই অতীতকালে কতশত ঘটনা ঘটে গেছে, আর সেই কারণেই তোমরা এটাও সহজেই মনে করে নিতে পারো, ভবিষ্যতে আরও শতশত ঘটনা ঘটবে।




এ সকল ঘটনা কোথায় হয়েছে বা হবে? কালেতে। এই কাল এত বিস্তৃত যে, এর সমস্তটাকে আমরা কল্পনাতেও আনতে পারি না। যা-কিছু ঘটনা ঘটে গেছে, ঘটছে, বা ঘটবে—সময়কে বাদ দিয়ে ওসবের কিছুই ঘটতে পারে না। যতদূর অতীতকাল কল্পনাতে আনতে পারি, তারও পেছনে আরও কত অতীতকাল যে পড়ে আছে! যতদূর ভবিষ্যৎকাল কল্পনাতে আনতে পারি, তারও পরে আরও কত যে ভবিষ্যৎকাল পড়ে আছে! আমরা সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলেই এর বিপরীতে এই সময় থেকেই আর-এক দিক দিয়ে অনন্তের আভাস পাই। সময় অনন্ত বলেই সময়ের সকল ঘটনাই সময়ে ধরে।




কিন্তু এই সময়‌ও খাঁটি অনন্ত বা সীমাহীন নয়। সূর্যোদয় থেকেই হোক বা অন্য যে-কোনো উপায়েই হোক, আমরা তো সময়কে ভাগ করে বলতে পারছি যে, এইটুকু কাল, ওইটুকু কাল, এক ঘণ্টা, এক দিন ইত্যাদি। এরকম কালকে সীমাবদ্ধ করবার ক্ষমতা থেকেই বুঝতে পারছি, আমরা সমস্ত কালকে মনের মধ্যে ধরতে না পারলেও কালের একটা-না-একটা সীমা আছে। আকাশই বলো, আর কালই বলো, তারা খাঁটি সীমাহীন হলে আমাদের সীমাবদ্ধ ভাগের মধ্যে আসতে পারত না। কিন্তু কালের সেই সীমা ধরা তোমার-আমার সাধ্যের অতীত। সেই সীমা জানার জন্য অনন্তকাল হতেও অনন্ত এক জ্ঞানবান পুরুষ চাই। সেই অনন্ত পুরুষই অনন্ত ঈশ্বর। এই কাল থেকে সেই অনন্ত পুরুষের অনন্ত ভাবের কতকটা আভাস পাওয়া যায় বলে ধর্মপ্রাণ মহাত্মারা ঈশ্বরের আরেক নাম দিয়েছেন মহাকাল।




ঈশ্বর যখন স্থানেতে অনন্ত এবং কালেতে অনন্ত, তখন তিনি সকল ভাব, জ্ঞান প্রভৃতি বিষয়েও অনন্ত হবেন, সেটা বুঝতে বোধ হয় বিশেষ কষ্ট হয় না। ভাব, জ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্করহিত ঘটনাও আছে, আগেই বলে এসেছি, সে-সমস্ত‌ও কাল বা সময়কে অবলম্বন করে আছে। আমরা জানতে পারি, অমুক সময়ে আমাদের মনে এই ভাব এল, অমুক সময়ে অমুক বিষয়ে জ্ঞান পেলাম। এভাবে আমাদের জ্ঞানে আমরা সময়কে ছেড়ে কোনো ভাব, জ্ঞান বা ঘটনার বিষয় ভাবতেই পারি না। আর সত্যি সত্যিই দেখতে পাই, জগতের প্রত্যেক ঘটনাই কোনো-না-কোনো রকমে স্থান বা কালকে অবলম্বন করে থাকে। ঈশ্বর যখন সেই স্থান ও কাল সম্বন্ধে অনন্ত এবং যখন তিনি জ্ঞানময়, তখন তিনি নিশ্চয়ই ভাব, জ্ঞান প্রভৃতি বিষয়েও অনন্ত।




আমরা ঈশ্বরের অনন্তত্ব বিষয়ে অনেক বড়ো বড়ো কথা বললাম বটে, কিন্তু আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানে কি সেটা ধারণা করতে পারি? ঈশ্বরের অনন্তত্ব নিয়ে আমরা সম্পূর্ণরূপে ধারণা করতে না পারলেও এটা বলা যেতে পারে, আমরা সময়ে সময়ে আমাদের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের দ্বারা ঈশ্বরের অনন্তভাবের কিনারাটুকু ছুঁয়ে আসতে পারি। আমরা সীমাবদ্ধ বলেই জানতে পারি, এক অনন্ত মহান পুরুষ আছেন, যাঁকে অবলম্বন করে আমরা আছি, আকাশ আছে, কাল আছে। আবার জ্ঞানে এরকম জানতে পারলেও সকল সময়ে আমরা তাঁকে অনুভব করতে পারি না। যখন সংসারের ছোটোখাটো ঘটনা বা কথা থেকে আমরা আমাদের জ্ঞানকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাঁর জ্ঞানে যুক্ত করে দিতে সচেষ্ট হই, আমাদের ইচ্ছাকে তাঁর ইচ্ছার সঙ্গে যুক্ত করতে চাই, তখনই ক্ষণিক বিদ্যুৎপ্রকাশের মতো হৃদয়ে ক্ষণিকের জন্য তাঁকে অনুভব করতে পারি।




আমরা এ সংসারে যা-কিছু জ্ঞান বা ভাব পাচ্ছি, তার সবই সেই জ্ঞান ও ভাবের অনন্ত ভাণ্ডার থেকেই পাচ্ছি। কিন্তু তাই বলে তোমরা এটা মনে কোরো না, সেই অক্ষয় ভাণ্ডারের কোনো ক্ষয় হলো বা কম হয়ে গেল। ঈশ্বর এই আশ্চর্য নিয়মটি করে দিয়েছেন যে, জ্ঞান, ভাব প্রভৃতির ভাগ কাউকে দিলেও তার কিছুই কমে না। মনে করো, তুমি জানো, দুইয়ে দুইয়ে চার হয়। তোমার এই জ্ঞানটুকু আর কাউকে দিলে কি সে জ্ঞান একটুও কমে গেল? তোমার দয়ামায়া যদি জীবজন্তুর উপর ছড়িয়ে দাও, তাহলে কি সেই দয়ামায়া এতটুকুও কমে যেতে পারে? চর্চায় বরং ওসব মনোবৃত্তি বৃদ্ধি পায়। ঠিক ওরকম সেই অনন্ত পরমেশ্বর তাঁর জ্ঞানভাণ্ডার, তাঁর ভাবভাণ্ডার জগতে ছড়িয়ে রেখেছেন, কিন্তু তাতে তাঁর অনন্তত্বের কোনোরূপ অভাব ঘটে না। এককথায়, তাঁর কোনোরূপ ক্ষয় নেই।