এসো, ঈশ্বরকে জানি (চতুর্থ ভাগ)

তিনি নিজেই নিজেকে প্রকাশ করেন। তাঁর প্রকাশ জগতের অণুতে অণুতে। সেই প্রকাশ অনুভব করার জন্য আমাদের ইচ্ছে থাকা চাই, উপযুক্ত উপায় অবলম্বন করা চাই। দুপুরে যখন সূর্য মাথার উপরে ধকধক করে জ্বলতে থাকে, আমি যদি ঠিক ওই সময়ে আমার ঘরটিকে সম্পূর্ণ অন্ধকার করে ঘুমিয়ে কাটাই, আর পরে বলি যে, আমি সূর্য দেখিনি, তাই সূর্য ওঠেনি, সে কথা কি মেনে নেওয়া যায়? যে-ঈশ্বরের প্রকাশ সূর্যে, যে-ঈশ্বরের প্রকাশ সর্বত্রই; যে-ঈশ্বরের প্রকাশ জগতের প্রাণরাজ্যে, যে-ঈশ্বরের প্রকাশ মানুষের জ্ঞানরাজ্যে; যে-ঈশ্বরের প্রকাশ প্রতি অণুতে, প্রতি নিমেষে, সেই ঈশ্বরকে আমাদের যত্নের অভাবে হৃদয়ে অনুভব করতে না পারলেই তাঁর অস্তিত্বে সন্দেহ প্রকাশ করা কি ভুল নয়?




তোমরা ভালো করে নিজের নিজের হৃদয়ের দিকে চেয়ে দেখো; দেখবে, সেখানে পরমেশ্বর বিরাজমান আছেন। কিন্তু তাঁকে যতই দেখতে পাবে, ততই তাঁকে আরও দেখার ইচ্ছে হবে। যখন দেখতে দেখতে ক্রমে দেখবে, তাঁর অন্ত খুঁজে পাচ্ছ না, তখন তোমাদের হৃদয় স্তম্ভিত হয়ে যাবে এবং সেই স্তম্ভিত হৃদয়ে এক গভীর প্রশ্ন উঠবে…অন্ত কোথায় তাঁর, অন্ত কোথায় তাঁর! ঋষিরা এই প্রশ্নের যে-উত্তর দিয়েছেন, সেই উত্তরেই তখন শান্তি খোঁজার চেষ্টা কোরো। সেই উত্তর হচ্ছে: ওঁ সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম—তিনি সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ, অনন্তস্বরূপ পরমব্রহ্ম। তোমরা এই মন্ত্র হৃদয়ে অমূল্য মণির মতো ধারণ করে অপার শান্তি লাভ করো। নিজেকে জানলেই তাঁকে জানা হয়ে যায়। নিজেকে ভালোবাসলেই তাঁকে ভালোবাসা হয়ে যায়। নিজের সাথে আলাপ করে নিলেই তাঁর সাথে আলাপ করা হয়ে যায়। নিজের কাজে থাকলেই তাঁর কাছে থাকা হয়। নিজের অন্তরেই তাঁকে খুঁজতে হয়। এই নিবিড় যাত্রাটির নামই আত্মজ্ঞান তথা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করা। অনন্ত ব্রহ্মের নাম তাই সত্য বা জ্ঞান।




ঈশ্বর আনন্দরূপে প্রকাশ পাচ্ছেন। তাঁর বিষয়ে যিনিই একটু বিশেষভাবে আলোচনা করেছেন, যিনি ঈশ্বরে একটা বারও ডুবে, তাঁর সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করে ক্ষণকালের জন্যও তাঁকে স্পর্শ করতে পেরেছেন, তিনিই বলে গেছেন, ঈশ্বর সকল স্থানে ও সকল সময়ে আনন্দরূপে প্রকাশ পাচ্ছেন। যেখানেই নির্মল আনন্দ, সেখানেই ঈশ্বর। ঋষিরা তাঁকে কেবল আনন্দরূপ বলেই তৃপ্তিলাভ করেননি। তাঁরা স্বয়ং ঈশ্বরকে আনন্দরূপ জেনে যে অনুপম আনন্দ লাভ করেছিলেন, সেই আনন্দে ডুবে থেকে ঈশ্বরের আনন্দরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, তিনি রসস্বরূপ। এই 'রসস্বরূপ' কথাটিতে ঋষিদের সমস্ত আনন্দ, সমস্ত প্রেম, হৃদয়ের সমস্ত উত্তম ভাব যেন ঘন হয়ে, একত্রে মিলিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। তোমরাও যদি ঈশ্বরকে একমনে জানার চেষ্টা করো, তাহলে দেখবে, তিনি নিজেই আনন্দরূপে, রসস্বরূপে জগতের সব জায়গায় এবং তোমাদের হৃদয়ে বিরাজমান আছেন।




তিনি আনন্দরূপ বলেই তো জগতে এত আনন্দ ছড়িয়ে আছে। তোমরা যখন বন্ধুদের সাথে খেলা করো, তখন কত‌ই-না আনন্দ পাও! তোমাদের মা যখন তোমাদের স্নেহ করেন, গায়ে হাত বুলিয়ে দেন, আদরযত্ন করেন; তোমাদের বাবা যখন তোমাদেরকে ভালো ভালো বিষয়ে শিক্ষা দেন, পছন্দের জিনিস কিনে দেন, বেড়াতে নিয়ে যান, তখন তোমাদের কত‌ই-না আনন্দ হয়! তোমরা যখন খেলাধুলা করো, শরীরে রোগব্যাধি থাকে না, তখন তোমাদের শরীরে ও মনে কেমন একটা ফুর্তি ও আনন্দ আসে!




এই যে এত আনন্দ জগতে ছড়ানো আছে, এত আনন্দ আসে কোথা থেকে? তোমরা ভালো করে ভেবে বুঝে দেখো, এত আনন্দরাশি আকাশ থেকে আপনাআপনি ঝুপ করে পড়তে পারে না। আগে দেখে এসেছি, যত কিছু জ্ঞান আমরা পাচ্ছি, তার সবই এক ঈশ্বরের জ্ঞানের ছায়ামাত্র। ঠিক সেরকম যত কিছু আনন্দ এই জগতে ছড়ানো দেখি, তার সবই নিশ্চয়ই এক মহান অখণ্ড আনন্দের ছায়া। নিশ্চয়ই একটা মূল প্রস্রবণ বা ঝরনা আছে, যেখান থেকে এই আনন্দরাশি নেমে এসে জগতসংসারকে একেবারে ছেয়ে ফেলেছে। তোমরা দেখতে পাও, নদীতে কত জল—এত জল যে, তাতে শতশত বড়ো বড়ো ট্রলার, জাহাজ, শতশত গাছ আর প্রাণী স্থান পায়। এত জল তো আর আপনাআপনি আসেনি। সেই কতশত ক্রোশ দূরে নানান পাহাড়ের ভেতরে কত কত ঝরনা আছে, সেইসব ঝরনা থেকে অবিরাম জল পড়তে পড়তে এত বড়ো বড়ো নদীর সৃষ্টি হয়েছে।




ঠিক একইভাবে, যে-আনন্দ জগতকে ঢেকে রেখেছে, সেই আনন্দরাশিরও নিশ্চয়ই একটা মূল ঝরনা আছে। একটা ভালো গান শুনে তোমরা মুগ্ধ হলে, আনন্দে ডুবে গেলে; ধার্মিক মানুষের কাছে ধর্মকথা শুনে সংসারের ছোটোখাটো কথা ও কষ্ট ছেড়ে দিয়ে এক আশ্চর্য আনন্দ অনুভব করলে। একটা মূল আনন্দ না থাকলে এই আনন্দ আমরা পাই কী করে? গ্রীষ্মকালে মুক্ত দখিনা বাতাসে বসে সন্ধ্যার মহিমা উপভোগ করতে করতে যে অনুপম আনন্দ পাও; বর্ষার পর শরতের পৌর্ণমাসীতে পূর্ণিমার জ্যোৎস্না উপভোগ করে যে অসীম আনন্দ পাও, এই সকল আনন্দ কি আপনাআপনি আসতে পারে? এই সমস্ত আনন্দের ভাব যে একটা মূল প্রস্রবণ থেকে নেমে এসেছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ আছে কি?




সকল আনন্দেরই মূলে যে একটি বৃহৎ আনন্দ আছে, তার বিশেষ একটি প্রমাণ এই যে, কোথায় মানুষ আর কোথায় পশু-পাখি, তবু সকলেরই আনন্দের মধ্যে একটা সাধারণ ভাব দেখতে পাওয়া যায়। খিদের সময় খাবার পেলে তোমারও যেমন আনন্দ হয়, আমারও তেমন আনন্দ হয়; পশু-পাখি, জীব-জন্তুরা'ও সেই একই আনন্দ লাভ করে। আবার দেখো, আমি আনন্দ প্রকাশ করলে তুমি বুঝতে পারো এবং তোমার আনন্দ‌ও আমি বুঝতে পারি। মানুষের আনন্দ পশু-পাখি বুঝতে পারে এবং পশু-পাখি'র আনন্দ‌ও মানুষ বুঝতে পারে। আরও দেখো, হাজার হাজার বছর আগে কেউ হয়তো কোনো বিষয়ে আনন্দ প্রকাশ করে গেছে, আজ তার বিবরণ পড়ে আমরাও সেই আনন্দ অনুভব করছি। এই আলাদা আলাদা আনন্দ-ভাবের মধ্যে মূলগত একটা সাধারণ ভাব আছে বলেই আমরা ঠিক একইভাবে পরস্পরের আনন্দ বুঝতে পারি। আনন্দ এ পৃথিবীর সর্বজনীন ভাষা। বিভিন্ন কালের, বিভিন্ন স্থানের মানুষের আনন্দের প্রকাশে ভিন্নতা থাকলেও তার উৎস অভিন্ন ধরনের।




এখন কথা হচ্ছে, এই বিভিন্নতার মধ্যে একতা থাকে কেন? কোথা হতে এই একতা আসে? আগেই দেখে এসেছি, ঈশ্বর জ্ঞানস্বরূপ এবং জগতের সমস্ত জ্ঞান সেই মহান জ্ঞান থেকেই নেমে এসেছে বলেই তাদের মধ্যে একটা মূলগত একতা আছে; এবং সেই একতার কারণে আমরা দেশদেশান্তরের অধিবাসীদের জ্ঞানের মধ্যে প্রবেশ করতে পারি; এমনকী, গ্রহগ্রহান্তরেরও অধিবাসীদের প্রকৃতি বুঝতে পেরেছি বলে দাবি করি। ঠিক একইভাবে, একই আনন্দস্বরূপ পুরুষ থেকে জগতের এই আনন্দস্রোত নেমে এসেছে বলেই আমরা সমস্ত আনন্দরাশির মধ্যে একটা মূলগত একতা দেখতে পাই এবং এখানে বসেই সুদূরের ইংরেজ, ফরাসি, চৈনিক ও জাপানি, পৃথিবীর দুই প্রান্তের কুমেরু ও সুমেরুবাসী, সকলেরই আনন্দের উৎস ও প্রকৃতি হৃদয়ে অনুভব করতে পারি। এই আনন্দস্বরূপ পুরুষই আমাদের নিত্যপূজার পরমেশ্বর।




আনন্দস্বরূপ পরমেশ্বর যখন আছেন, তখন সংসারে নিরানন্দ আসে কেন? সীমার মধ্যে বাঁচা এবং সীমা নিয়ে জন্মগ্রহণই এই নিরানন্দের কারণ। ঈশ্বর অনন্ত এবং অখণ্ড নিত্যআনন্দ তাঁরই। আমরা সীমাবদ্ধ, সুতরাং আমাদের নিত্য অখণ্ড আনন্দ আসতেই পারে না—কোথাও-না-কোথাও তার সীমা থাকবেই এবং যেখানেই সীমা, সেখানেই আনন্দের অভাব হলো। আমরা সীমাবদ্ধ না হয়ে থাকতে পারি না এবং তাই আমাদের আনন্দেরও কোনো-না-কোনো সীমা না এসে থাকতে পারে না। ঈশ্বর অনন্ত বলেই আমরা সান্ত। আমাদের সীমা না থাকলে তো আমরা অনন্ত ঈশ্বরের সঙ্গে একেবারে এক ও অভিন্ন হয়ে যেতাম। তাহলে তো সৃষ্টিই থাকতে পারত না। জগতে যখন আমরা সীমা নিয়েই এসেছি, তখন আমাদের আনন্দেরও সীমা বা অভাব আছে জানতে ও মানতে হবে।




এই যে মুক্ত আকাশ, এই আকাশও সেই অনন্ত পুরুষের কাছে সীমাবদ্ধ। তাই এই আকাশেরও মুখ সময়ে সময়ে মেঘাচ্ছন্ন দেখা যায়। মেঘ এল, বর্ষা নেমে গেল—তখন আবার মুক্ত আকাশ মুক্ত আকাশই রয়ে গেল। এই যে মুক্তকাল, এই কালও সেই অনন্ত পুরুষের কাছে সীমাবদ্ধ। তাই এই কালের মুখ‌ও সময়ে সময়ে মেঘাচ্ছন্ন দেখতে পাই। যুদ্ধের মেঘ আসে, রক্তের বর্ষা নেমে যায়, তখন আবার মুক্তকাল মুক্তকালই থেকে যায়।




তাহলে দেখা যাচ্ছে, নিরানন্দ দূর করতে গেলে আমাদের আনন্দের সীমা ভাঙতে হবে এবং আনন্দস্বরূপ ঈশ্বরের পথে অগ্রসর হতে হবে। যখন সীমা নিয়ে জন্মগ্রহণ করাতেই আনন্দেরও সীমা এসেছে, তখন আনন্দের সীমা ভেঙে আনন্দের পথে এগোতে হলে আমাদের অন্যান্য বিষয়েরও সীমা ভাঙতে হবে। সীমা ভাঙতে জানাটা খুব দরকার। আমরা দুই রকম সীমা দেখতে পাই—এক, ঈশ্বরনির্দিষ্ট এবং দুই, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ও স্বরচিত। স্থান ও কালের সীমা ঈশ্বরনির্দিষ্ট। একই জিনিস একই সময়ে একের বেশি স্থান অধিকার করতে পারে না, এ-ই হলো স্থানের সীমা; একই কালে একের বেশি ভাবনা মনে স্থান দেওয়া যায় না, এ-ই হলো কালের সীমা; যে মুহূর্তটি চলে যায়, তা আর ফিরে আসে না, এ-ও হলো কালের সীমা।