এসো, ঈশ্বরকে জানি (দ্বিতীয় ভাগ)

ঈশ্বর আছেন, এই বিষয়টি নিয়ে এতক্ষণ আলাপ করলাম। এখন বোঝাবার চেষ্টা করব, ঈশ্বর সকলই জানছেন। ঈশ্বর সকলই জানেন বললে এটা বোঝায় যে, ঈশ্বরের জ্ঞান আছে।




ঈশ্বরের যে জ্ঞান আছে, তা বোঝার জন্য আমাদের বেশি দূরে যেতে হবে না। প্রতিদিন সকালে যখন সূর্য আকাশ ও পৃথিবীর মিলনস্থলে প্রভাতের কুয়াশা ভেদ করে চারিদিকে উজ্জ্বল কিরণ ছড়াতে ছড়াতে উঠতে থাকে, প্রতিদিন সন্ধ্যাকালে যখন অন্ধকার আকাশকে গ্রহ-নক্ষত্রে ঢেকে যেতে দেখি, পূর্ণিমারাতে যখন পূর্ণচন্দ্রকে সন্ধ্যাবেলায় পূর্বদিকে উঠে ভোরবেলায় পশ্চিমে ডুবতে দেখি, তখনই ঈশ্বরের জ্ঞানের কতই-না পরিচয় পাই। অন্তত এইটুকু বুঝতে পারি, যে-ঈশ্বর সকল স্থানে এবং সকল সময়ে সমানভাবে আছেন, এবং যাঁর আদেশে প্রকৃতির সমস্ত কাজ যথানিয়মে চলছে, সেই ঈশ্বর জ্ঞানশূন্য মূর্খ কোনো জীব নয় নিশ্চয়‌ই। ঈশ্বর সর্বজ্ঞানী।




জ্ঞানী লোকের কাজ‌ই জ্ঞানের প্রধান লক্ষণ, যা নিয়মের মধ্যেই প্রকাশ পাবে। মনে করো, একটা বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, চাকরদাসীরা সমস্ত কাজই ঠিক ঠিক নিয়মে করছে, প্রত্যেক জিনিস ঠিকঠাক জায়গায় রাখছে। তাহলে সহজেই বোঝা যায়, যে-মনিবের কথামতো চাকরদাসীরা এমন নিয়ম মেনে ভালোভাবে কাজ করছে, সেই মনিব নিশ্চয়ই একজন জ্ঞানবান মানুষ, সেই মনিব কখনোই পাগল বা মূর্খ হতে পারে না। কিন্তু যদি দেখা যেত, বাড়ির কোথাওবা কতগুলো ছেঁড়া বই পড়ে আছে; কোথাওবা কতগুলো ভাঙা জিনিস পড়ে আছে; থালা, বাটি প্রভৃতি উপযুক্ত পাত্রে খাবার জিনিস না থেকে একরাশ ধুলোর উপর পড়ে আছে; তাহলে নিশ্চয়ই মনে হতো, এ কেমন ধরনের কর্তা! হয় কর্তাটা একেবারে মূর্খ, আর নাহয় সে পাগল। কোনো কাজ নিয়মে হতে দেখলেই আমাদের স্বভাবতই মনে হয়, সেই কাজের কোনো নিয়ন্তা অথবা জ্ঞানবান কর্তা আছেন। এই কারণে নিয়মকে জ্ঞানের মূল লক্ষণ বলা হয়৷




জ্ঞানের দ্বিতীয় লক্ষণ প্রকাশ। যার যতটুকু জ্ঞান আছে, তার ততটুকু জ্ঞানই প্রকাশ পাবে। কুকুরের দিকে তাকাও, ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। কুকুরের বোধ ও ভালোবাসার প্রকাশ‌ই তার জ্ঞানের প্রকাশ। জীবজন্তুদের যার যতটুকু জ্ঞান থাকে, সে সেইটুকু জ্ঞানই নানা উপায়ে প্রকাশ করতে চায়, করতে পারে এবং করতে থাকে। আমাদেরও যতটুকু জ্ঞান আছে, ততটুকুই আমরা প্রকাশ করতে চাই, করতে পারি এবং করতে থাকি। একজন যেই জানতে পারলেন, বাষ্পের কোনো জিনিসকে নাড়াবার শক্তি আছে, অমনি তিনি তাঁর সেই জ্ঞান প্রকাশ করলেন এবং তার ফলে আমরা আজ কলের গাড়ি, কলের জাহাজ, এমন অনেক কিছুই পেয়েছি। আবার একজন বুঝতে পারলেন, বিদ্যুৎকে আকাশ থেকে নিচে নামানো যায়, আর অমনি তিনি তা প্রকাশ করলেন এবং তার ফলে বজ্রাঘাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়িতে যে লোহার শিক দিতে হয়, সেই জ্ঞান আমরা পেয়েছি।




এই যে দেখো, আমি ঈশ্বর সম্বন্ধে যদিও খুবই অল্প জেনেছি, তবু সেইটুকুই তোমাদের কাছে প্রকাশ করতে উৎসুক হয়ে পড়েছি; বলতে কী, প্রকাশ না করে থাকতে পারছি না। জ্ঞানের একটি লক্ষণ প্রকাশ বলেই এই পৃথিবীতে আমরা আজ হাজারো রকমের জ্ঞানের কথা পাচ্ছি; কত রকমের বিজ্ঞানকথা, কত ধর্মকথা, কত গাছপালা আর জীবজন্তুর কথা আমরা জানতে পারছি। এক-একজন লোক এক-একটা বিষয় জানতে পারছে, বুঝতে পারছে, আর অমনিই সে তা প্রকাশ করে দিচ্ছে। এমনি করেই তোমরা কত জানার বিষয় পাচ্ছ, পড়ার বই পাচ্ছ। তবে সবার জানাটা যথার্থ নয়, প্রকাশ করার ক্ষমতাও সবার থাকে না। তাই খুব বুঝেশুনে এগোতে হবে।




এখন এই দুই লক্ষণ ধরে দেখা যাক, ঈশ্বরের জ্ঞান আছে কি না। প্রথম কথায় বলে এসেছি, পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র প্রভৃতির কর্তা যিনি, তিনিই ঈশ্বর। তোমাদেরকে এ-ও বলে এসেছি, এই পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র প্রভৃতি সকলেই নিজ নিজ কাজ ঠিক নিয়মে করে যাচ্ছে। তোমরা ভেবে দেখলে অবাক হবে, এরা এমন সুন্দর নিয়মে কাজ করছে যে, তার এলোমেলো হবার কোনো জো নেই। তোমরা জানো, জ্যোতিষীরা বলে দেন, অমুক দিন অমুক সময়ে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ হবে। এই গণনা একেবারে সেকেন্ডে সেকেন্ডে মিলে যাওয়া চাই। গণনা যদি একেবারে সেকেন্ডে সেকেন্ডে না মিলে গেল, তাহলেই জানা গেল যে, জ্যোতিষীর গণনায় কোথাও ভুল হয়েছে।




জ্যোতিষীরা এত সূক্ষ্ম গণনা কী করে করতে পারেন? তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন, সূর্য-চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র একটা স্থির নিয়মে ঘুরছে। সেই নিয়মটিও তাঁরা জানতে পেরেছেন, এবং তাঁরা এ-ও জেনেছেন যে, সেই নিয়মের অনিয়ম হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এ-কথা তাঁরা জেনেছেন বলেই তাঁরা এত সূক্ষ্ম গণনা করতে পারেন। যে-নিয়ম তাঁরা জানতে পেরেছেন, সেই নিয়মের সূত্রে তাঁরা ঠিক করতে পেরেছেন, অমুক সময়ে সূর্য অমুক স্থানে থাকবে, পৃথিবী অমুক স্থানে থাকবে, চন্দ্র অমুক স্থানে থাকবে এবং এরকম স্থানসংযোগ হলেই ঠিক অমুক মুহূর্তে সূর্যগ্রহণ হবে, অমুক মুহূর্তে চন্দ্রগ্রহণ হবে।




তোমরা সবাই কিন্তু বলতে পারো না, এক সেকেন্ডে একটা আলোকরেখা কত মাইল চলে। জ্ঞানী লোকেরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, একটা আলোর রেখা এক সেকেন্ডে প্রায় দুই লক্ষ মাইল চলে থাকে। জ্ঞানীলোকেরা এই যে বিভিন্ন বিষয় গুনে বলতে পারেন, তার কারণ এই, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন, জগতের সকল কাজই একটা নিয়মে চলছে। যদি জগতের কাজগুলি অনিয়মে চলত, তাহলে তাঁরা কখনোই গুনে বলতে পারতেন না, অমুক সময়ে সূর্যগ্রহণ হবে কিংবা প্রত্যেক আলোকরেখা প্রতিমুহূর্তে এত মাইল চলবেই চলবে।




যে-নিয়মের বলে কোটি কোটি সূর্য-চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র ঘুরছে, যে-নিয়মের বলে আমাদের সঙ্গে অগণিত গ্রহ-নক্ষত্রের যোগসাধন হচ্ছে, যে-নিয়মের বলে আমাদের এই একটা পৃথিবীতেই অসংখ্য গাছপালা জন্মগ্রহণ করে আমাদের জীবনরক্ষার উপায় হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, যে-নিয়মের বলে শতসহস্র লক্ষকোটি ভবিষ্যৎ যুগের লোকেদের প্রাণধারণের জন্য প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বনজঙ্গল পরিবর্তিত হয়ে পাথুরে কয়লার খনিতে পরিণত হয়েছে, সেই সকল নিয়মের কর্তা কি তুমি-আমি হতে পারি? সেই সকল নিয়মের কর্তা যিনি, তিনিই আমাদের ঈশ্বর, তিনিই আমাদের জ্ঞানময় পরমেশ্বর।




তিনি কতশত নিয়ম করে দিয়েছেন, প্রজ্ঞাবান ঋষিরা তাঁকে জ্ঞানময় বলেছেন, অথচ নিয়মের টুকরোমাত্র সময়ে সময়ে আবিষ্কার করে আমরা জ্ঞানের বড়াই করি। যে-সকল নিয়মের টুকরোমাত্র আবিষ্কার করে আমরা মহাজ্ঞানী বলে খ্যাতিলাভ করি, সে-সকল নিয়মের কর্তা যদি জ্ঞানবান না হবেন, তবে আর কে জ্ঞানবান হবে? তিনি জ্ঞানবান বলেই তাঁর জ্ঞান তাঁর কাজে প্রকাশ পাচ্ছে। তাঁর জ্ঞানের কাছে আমাদের জ্ঞান খুব ছোটো, খুব অল্প। তাঁর জ্ঞানের সমস্ত আমরা মনে ধারণ‌ই করতেই পারি না। এই জন্য ঋষিরা তাঁকে যেমন 'সত্যং' বলেছেন, সেরকম তাঁকে 'জ্ঞানং' অর্থাৎ জ্ঞানস্বরূপও বলেছেন। তিনি যখন জ্ঞানস্বরূপ, তখন তিনি যে সর্বকালে প্রকাশিত হন, তা যে ঈশ্বরের নিজস্ব গুণের‌ই প্রকাশ, তা বলাই বাহুল্য।




আগেই বলেছি, জ্ঞানের একটা লক্ষণ হলো প্রকাশ। ঋষিরাও তাই এটিকে 'স্বপ্রকাশ'ও বলেছেন। প্রত্যেক খণ্ডজ্ঞানের লক্ষণই যদি প্রকাশ হওয়া হলো, তবে সকল জ্ঞানের আধার যে সকল বিষয়েই প্রকাশিত হবে এবং কাজেই সকল উপায়ে স্বপ্রকাশ অর্থাৎ আপনাআপনি প্রকাশিত হবে, এটা তোমরা সহজেই বোধ হয় বুঝতে পারবে।




ঈশ্বরকে আমরা জানতে পারি। ঈশ্বর জ্ঞানস্বরূপ, অর্থাৎ সকল জ্ঞানের আধার, আর আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জ্ঞানের আধার। আশ্চর্য এই যে, সেই মহাজ্ঞানকে আমরা আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানের দ্বারা জানতে পারি। এর কারণ, জ্ঞান যেখানেই থাক, তা ঈশ্বরেরই নিয়মে সব জায়গায় সমধর্মী। কুকুরকে মারলে সে একপ্রকার সুরে কাতরতা প্রকাশ করে; আমাদের শরীরে আঘাত লাগলে আমরাও কাতরস্বরে ব্যথা প্রকাশ করি। সেই কারণেই কুকুরের কাতরভাব আমরা বুঝতে পারি এবং আমাদের কাতরভাব‌ও কুকুর বুঝতে পারে।




তোমাকে কোনো জন্তু তাড়া করলে তুমি যদি ভয়ে পালাও, তবে সেই জন্তু তৎক্ষণাৎ তা বুঝতে পারবে এবং তোমাকে আরও তাড়া করবে। সার্কাসের পশু-পাখি'কে যে নানা রকম খেলা শেখানো হয়, সেগুলি আর কিছুই নয়, কেবল খেলা শেখাবার যে-ওস্তাদ, তারই জ্ঞানের কিছু অংশ সেই পশু-পাখি'গুলোর মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সেই পশু-পাখি'রা তাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু সম্ভব, সেই পরিমাণেই বুঝেছে, ওস্তাদ তার নিজের জ্ঞানের যতটা দিয়েছে। আবার ওস্তাদও বুঝেছে যে, পশু-পাখি'রা তার ইচ্ছে ধরতে পেরেছে। এইখানে সেই ওস্তাদের জ্ঞান এবং পশু-পাখি'দের জ্ঞান সমধর্মী বা এক হয়ে গেল। সকল জ্ঞান যে সমধর্মী, এই নিয়মের বলে আজ মানুষ বানরের ভাষা, পিঁপড়ের ভাষা প্রভৃতি আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হয়েছে।




জ্ঞান সকল অবস্থায় সমধর্মী বলেই জ্ঞানের সূত্রে আমরা জ্ঞান সমধর্মী বলে ঈশ্বরের সঙ্গেও সমধর্মী হতে পারি। আমরা ঈশ্বরকে যেই এক-একটা জ্ঞানের টুকরো আবিষ্কার করে জানতে পারি অথবা কোনো উপায়ে লাভ করি, তখন সেইটুকু জ্ঞানের সূত্রে ঈশ্বরের সঙ্গে সমধর্মী হয়ে তাঁকে জানতে পারি। প্রতিমুহূর্তেই যখন আমরা কোনো-না-কোনো বিষয়ে জ্ঞানলাভ করছি, তখন প্রতিমুহূর্তেই সেইটুকু জ্ঞানের সূত্রে ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের সংযোগসাধন হচ্ছে এবং আমরা তাঁকে জানতে পারছি। ঈশ্বর সকল কালে সকল অবস্থায় আমাদেরকে জানলেও আমরা প্রতিমুহূর্তের জ্ঞানলাভের সময় তাঁর সঙ্গে যথাপরিমাণে মিলে যাই।




আমরা যতই ভালো বিষয় জানব, ভালো বিষয় ভাবব, ঈশ্বরকে ততই হৃদয়ে লাভ করব এবং শীঘ্রই ঈশ্বরকে মনের মধ্যে জানতে পারব—তাঁর ইচ্ছের সঙ্গে আমাদের ইচ্ছে এক হয়ে যাবে। তাই পুরাতন ঋষিরা আমাদেরকে সেই সুদূর অতীত থেকেই এই উপদেশ দিয়েছেন যে, আমরা একলা আছি, একথা যেন কখনোই মনে না করি। ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই আছেন এবং আমাদের সকলকেই জানছেন। কখনোই খারাপ চিন্তা, পরের অনিষ্টের ভাবনাকে মনে স্থান দিয়ো না। নিশ্চিতভাবে জেনো, ঈশ্বরের জ্ঞান তোমাদের মনের কথা সবসময়ই জানছেন। তাঁর চোখ এড়াতে পারবে না, তাই এড়াতে যেয়ো না। তিনি 'সত্যং জ্ঞানং'।